ভারতে এবার প্রায় ৮ কোটিরও বেশি ভোটারের নথি পুনরায় যাচাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু করেছে দেশটির নির্বাচন কমিশন (ইসিআই)। দেশ থেকে ‘অবৈধ অভিবাসী’ বিতাড়নের উদ্যোগের অংশ হিসেবে এ কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। নথি দাখিলের মাধ্যমে তাদের পরিচয় নতুন করে প্রমাণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফলে এই ৮ কোটি মানুষকে ভোটবঞ্চিত করার এবং দেশ থেকে বের করে দেওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে বিশ্বের কথিত বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশটিতে। 

আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, এই উদ্যোগ দেশজুড়ে ব্যাপক বিতর্ক ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। গত ২৪ জুন ইসিআই ঘোষণা দেয়, বিহার রাজ্যে ৮ কোটির কাছাকাছি সব ভোটারকেই আগামী ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে নতুন করে ভোটার হিসেবে নাম নিবন্ধন করতে হবে। এতে ব্যর্থ হলে তারা ভোটাধিকার হারাবেন এবং ইসিআইয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের ‘সন্দেহভাজন বিদেশি নাগরিক’ হিসেবে গণ্য করা হবে। এমনকি তাদের জেল বা দেশ থেকে বহিষ্কারাদেশের মুখেও পড়তে হতে পারে। আগামী অক্টোবর বা নভেম্বরে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। 
এই পদক্ষেপকে অনেকেই কেন্দ্রীয় সরকারের বিতর্কিত জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনকে (এনআরসি) পেছনের দরজা দিয়ে বাস্তবায়নের কৌশল হিসেবে দেখছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার অতীতে ‘অবৈধ অভিবাসী’ শনাক্ত ও বহিষ্কারের অজুহাতে এনআরসি চালুর প্রস্তাব দিয়েছিল। 

বিতর্কটা কী নিয়ে? 

মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য বিহার। এখানকার জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। তবে তৃতীয় বৃহত্তম জনবহুল হওয়ায় রাজ্যটি রাজনৈতিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৫ সাল থেকে রাজ্যটিতে বিজেপি ও আঞ্চলিক জনতা দলের (ইউনাইটেড) জোট বেশির ভাগ সময় ক্ষমতায় রয়েছে। 

বিরোধী রাজনীতিবিদ ও নাগরিক গোষ্ঠীগুলো বলছে, এই অল্প সময়ে এত বিশালসংখ্যক মানুষের নাগরিকত্বের প্রমাণ দাখিল সম্ভব নয়। ফলে বহু বৈধ ভোটার ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস এবং তাদের বিহার মিত্র রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) রোববার বিহারে বন্‌ধের ডাক দিয়েছে। পাশাপাশি তারা সুপ্রিম কোর্টে এই উদ্যোগ বাতিলের আবেদন জানিয়েছেন। 
ক্ষমতাসীন দল বিজেপি দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে বিপুলসংখ্যক মুসলিম অভিবাসী ভারতে ঢুকছে বলে দাবি করে আসছে। দলটি চাচ্ছে, দেশজুড়ে একইভাবে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হোক। 

নির্বাচন কমিশনের এই পদক্ষেপের যৌক্তিকতা কী?

২৪ জুনের আদেশে ইসিআই বলেছে, ‘কোনো অযোগ্য ব্যক্তি যেন ভোটার তালিকায় না থাকে’ তা নিশ্চিত করতেই এই পদক্ষেপ। দ্রুত নগরায়ণ, অভিবাসন, নতুন ভোটার, মৃত ভোটার এবং বিদেশি অবৈধ অভিবাসীদের অন্তর্ভুক্তির মতো বিষয়গুলো এই পদক্ষেপের পেছনে কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। 

এর আগে ২০০৩ সালে সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ ভোটার তালিকা সংশোধন হয়েছিল। এর পর থেকে নিয়মিতই তালিকা হালনাগাদ হয়েছে, সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগেও তা করা হয়েছিল। ইসিআই জানিয়েছে, যারা ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় ছিলেন, তাদের শুধু পুনরায় ফরম জমা দিলেই চলবে। তবে ২০০৩ সালের পর যারা তালিকায় যুক্ত হয়েছেন, তাদের বয়স ও জন্মস্থান প্রমাণের জন্য নথিপত্র, এমনকি বাবা-মায়ের প্রমাণপত্রও জমা দিতে হবে। 

ইসিআইয়ের হিসাবে, প্রায় ৮ কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় ৩ কোটি নাগরিককে যাচাই করতে হবে। কিন্তু স্বাধীন বিশ্লেষকদের মতে, প্রকৃত সংখ্যা সাড়ে ৪ কোটিরও বেশি হতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় ইসিআইয়ের কর্মকর্তারা ঘরে ঘরে গিয়ে ভোটারদের একটি ফরম দেবেন। এরপর ভোটারদের সেই ফরমে প্রয়োজনীয় নথি সংযুক্ত করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জমা দিতে হবে। ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে এই কাজ শেষ করতে হবে। ১ আগস্ট খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে এবং বাদ পড়া ব্যক্তিদের আপত্তি জানানোর জন্য আরও এক মাস সময় দেওয়া হবে। 

ভারতীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মসের প্রতিষ্ঠাতা জগদীপ চোকার বলেন, ২০০৩ সালের পর যারা ভোটার হয়েছেন, তাদের সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখায় এই পদক্ষেপ। তাহলে কি ইসিআই বলছে, বিহারে ২০০৩ সালের পর যত নির্বাচন হয়েছে, সবই প্রশ্নবিদ্ধ? 
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, লাখ লাখ বৈধ ভোটার নথি দেখাতে না পারায় ভোটাধিকার হারাতে পারেন। এতে ভারতের গণতন্ত্র বড়সড় এক সংকটে পড়বে বলেই মনে করছেন তারা। এ নিয়ে জগদীপ চোকারের সংস্থাই প্রথম এই উদ্যোগ বন্ধ করতে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছে। তিনি বলেন, এর ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে। এভাবে চললে রাজ্যের অর্ধেক মানুষের ভোটাধিকারই বাতিল হয়ে যেতে পারে। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ২০০৩ স ল র

এছাড়াও পড়ুন:

‘জুলাই ঘোষণাপত্রকে’ সংবিধানের মূল নীতিতে স্বীকৃতি দেওয়ার পদক্ষেপের নিন্দা রিজভীর

সংবিধানের মূল নীতি হিসেবে জুলাই ঘোষণাপত্র অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বানকে ‘বিভ্রান্তিকর’ বলেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি ইতিমধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্রের অনেক বিষয় মেনে নিয়েছে। কিন্তু কেন এটিকে সংবিধানের মৌলিক নীতির অংশ করা হবে?’

আজ শুক্রবার রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জায়নামাজ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রুহুল কবির রিজভী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, সংস্কার সারা দেশে এবং সব সময় অব্যাহত থাকবে। সংস্কার কোনো পর্বতমালার মতো স্থির কিছু নয়। এটি একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। তিনি বলেন, গণতন্ত্র, রাষ্ট্র বা জনগণের স্বার্থে যখন প্রয়োজন হয়, তখন সংস্কার করা উচিত এবং উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা উচিত।

রিজভী বলেন, ‘এটাই একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সংস্কার আগে করতে হবে এবং এটি (জুলাই ঘোষণাপত্র) সংবিধানের মৌলিক নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, এই দাবি বিভ্রান্তিকর। এটি মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করছে। কেন আপনারা এভাবে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন?’

বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার পরিবর্তে জনগণের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার দিকে মনোনিবেশ করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান রুহুল কবির রিজভী।

রিজভী বলেন, ‘স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা ১৬ বছর ধরে গণতন্ত্রের দরজা বন্ধ করে জনগণের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন। আমাদের এখন সেই বন্ধ দরজা আবার খুলতে হবে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠন করে জনগণের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে।’

বিএনপি কখনো সংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলেনি এবং বাস্তবে সর্বদা এটিকে সমর্থন করেছে উল্লেখ করে রিজভী বলেন, ‘আপনি সংস্কারের নামে যে বিষয়গুলোর কথা বলছেন, তার অনেকগুলো ইতিমধ্যেই বিএনপির ৩১ দফা সংস্কার রূপরেখায় প্রতিফলিত হয়েছে।’

রিজভী বলেন, বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে একটি বৃহত্তর আদর্শের জন্য লড়াই করে আসছে—ন্যায়বিচার, সাম্য, আইনের শাসন এবং প্রকৃত গণতন্ত্র। ‘এই লড়াই রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানা পুনরুদ্ধারের জন্য। যখন সেই মালিকানা অস্বীকার করা হয়, তখন এটি ফ্যাসিবাদের পথ খুলে দেয়।’

রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘জনগণের সরকারকে প্রতিটি পদক্ষেপে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। সেই জবাবদিহি এখন নেই। আমরা বিশ্বাস করি যে অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের সমর্থন এবং সব রাজনৈতিক দলের সমর্থন নিয়ে গঠিত হয়েছে— আওয়ামী লীগ ও তার কয়েকটি মিত্র ছাড়া।’

রিজভী বলেন, ‘আমরা সবাই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন করে চলেছি। কিন্তু এটাও সত্য যে আমরা যদি দুর্ভিক্ষের লক্ষণ দেখতে এবং শুনতে শুরু করি, তাহলে জনগণ আমাদেরও ছাড় দেবে না।’

অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতির কথা উল্লেখ করে রিজভী বলেন, অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে মানুষ বেকার হয়ে পড়ছে। মানুষ যদি খাবার কিনে খেতে না পারে, তাহলে এটি দুর্ভিক্ষের স্পষ্ট লক্ষণ। যদি এ ধরনের লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না—তখন পতিত ফ্যাসিস্টরা আনন্দে হাততালি দেবে।

রিজভী বলেন, সরকার চাইলে আওয়ামী লীগের যেসব সহযোগী দেশ ছেড়ে বিপুল অর্থ পাচার করে পালিয়ে গেছেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য প্রশাসক নিয়োগ করতে পারে এবং কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া বন্ধ করতে পারে।

‘অর্থনীতির ভয়াবহ অবস্থার কারণে কারখানা বন্ধ করা উচিত নয়। এটি কেবল একটি বক্তব্যই নয়, মানুষ এখন গুরুত্বসহকারে ভাবছে যে সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের মধ্যে দেশ দুর্ভিক্ষে পতিত হয় কি না,’ সতর্ক করেন রিজভী।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • অবাধ ও সুন্দর নির্বাচন আয়োজনে ব্যর্থ হলে শহীদদের আত্মা কষ্ট পাবে: গয়েশ্বর
  • ‘জুলাই ঘোষণাপত্রকে’ সংবিধানের মূল নীতিতে স্বীকৃতি দেওয়ার পদক্ষেপের নিন্দা রিজভীর
  • গণতন্ত্র ব্যর্থ, আধুনিক সভ্যতা ভেঙে পড়েছে
  • ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ে গণতন্ত্র ধ্বংস করা হয়েছে: অ্যাটর্নি জেনারেল
  • ফিলিস্তিনিদের ওপর নিষ্ঠুর অমানবিকতার শেষ কোথায়? 
  • ইন্দিরার ‘জরুরি অবস্থা’: ৫০ বছরে ভারত কী শিক্ষা পেল
  • ঢাকায় এশিয়া কাপ বিষয়ক বৈঠকে আসতেও নারাজ ভারত 
  • শিশুর প্রস্রাবে সংক্রমণ প্রতিরোধ
  • যত দ্রুত দেশকে নির্বাচনের ট্র্যাকে ওঠানো যাবে ততই মঙ্গল: মির্জা ফখরুল