ছবি: কবির হোসেন

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

প্রতিবাদের অবিস্মরণীয় কণ্ঠস্বর

ইতিহাসে বারবার দেখা যায়, সমাজের প্রতিটি বড় বাঁকে নারীরা সপ্রতিভ উপস্থিতি দিয়ে বদলে দিয়েছেন সময়ের গতি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধে কেউ হাতে জাতীয় পতাকা, কেউবা অস্ত্র তুলে নিয়েছেন, কেউ আবার কলম দিয়ে কুসংস্কারের দেয়াল ভেঙেছেন। ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও এই ধারাবাহিকতা থেমে থাকেনি। সন্ত্রাসী হামলাও নারী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে সরিয়ে রাখতে পারেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ভালনারেবল স্টাডিজ বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান ইমু জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া এবং ছাত্রলীগের নৃশংস হামলার শিকার হওয়া একজন। তাঁর আন্দোলনের শুরুটা হয় ফেসবুকে ৫৬ শতাংশ কোটার একটা পোস্ট দেখা থেকে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে পড়াশোনা করতে করতে একদিন বড় ভাইয়েরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের জন্য ডাকেন। সেই ডাক শুনে সেখানে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন ইসরাত। পরে ১ জুলাই টিএসসিতে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় আসে ১৪ জুলাই। সারাদিন হলের বাইরের কর্মব্যস্ততা শেষ করে রাতে হলে এসে দেখেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষণে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলে ব্যঙ্গ করেছেন। সেখান থেকে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। রাতে স্লোগানে মুখরিত হয় গোটা বিশ্ববিদ্যালয়। কর্মসূচি পালন শেষে হলে ফিরে এসে খবর পান ইডেন কলেজের আন্দোলনরত মেয়েদের ওপর আক্রমণ করেছে ছাত্রলীগের কর্মীরা। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের ছেলেরা একত্র হয়ে তাদের উদ্ধার করেন। 

১৫ জুলাই। সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে ইমু বলেন, ‘আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে আমরা সবাই সমবেত হতে থাকি। ছাত্রলীগের কর্মীরা আমাদের ওপর যেভাবে হামলা চালায়, তা ছিল কল্পনার বাইরে। আমরা যখন আন্দোলন করতে আন্তর্জাতিক হলের সামনে যাই, ঠিক সেই সময় মধুর ক্যান্টিনের দিক থেকে তারা আমাদের দিকে তেড়ে আসে। শুরুর দিকেই আমি ও আমার বোন ছিলাম। সন্ত্রাসীরা এসে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সজোরে ধাক্কা দেয় এবং তার পরপরই ইট দিয়ে আঘাত করে আমাকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি অন্যদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করি। বেশ কিছু সময় পর পালিয়ে এসে যখন একটু বিশ্রাম করি, তখন বুঝতে পারি যে হাতে ও শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। পরে চিকিৎসা করে সেই হাত নিয়েই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ উন্নয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী সুলতানা। বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া সুলতানার কাছে কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল অনেক বেশি বাস্তব ও যৌক্তিক, যা তৎকালীন সরকার চাইলেই সমাধান করতে পারত। তিনি আন্দোলনে প্রথম অংশগ্রহণ করেন ৮ জুলাই। প্রচণ্ড বৈরী আবহাওয়া সত্ত্বেও ফিরে যেতে মন টানেনি সুলতানার। ১৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন তিনি। সুলতানা বলেন, ‘১৫ জুলাই আমি এবং আমার হলের এক ছোট বোন একসঙ্গে আন্দোলনে যুক্ত হই। সেখানে মেয়েদের সারির একদম সামনের কাতারে আমরা অবস্থান করি। বিজয় একাত্তর হলে যখন বিকেলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয় তখন আন্তর্জাতিক হলের কাছে ছিলাম আমরা। এক পর্যায়ে ওর হাতে ইট ছুড়ে মারে। ব্যথা সহ্য করতে না পেরে সে সেখানেই বসে পড়ে। আমি তার দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে পড়ি। সেই মুহূর্তে আয়ান আহমেদ জর্জ নামে একজন হুট করে দৌড়ে আমার কাছে চলে আসেন। এসেই আমাকে ধমকাতে থাকেন এবং জোর করতে থাকেন হলে চলে যাওয়ার জন্য। আমি প্রতিবাদ করি এবং যেতে অস্বীকৃতি জানাই। এক পর্যায়ে তিনি আমার হাতটা ধরে মুচড়ে প্রায় ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেন। আন্দোলনে যাওয়ার সময় বাবা ছিলেন আমার অন্যতম অনুপ্রেরণা। তিনি আমাকে শত্রুর চোখের দিকে তাকিয়ে মোকাবিলা করতে শিখিয়েছিলেন। আমিও আয়ান আহমেদ জর্জের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম কোনো রকম ভয় ছাড়া।’

সুলতানা আরও বলেন, ‘হামলার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমার হলের ছোট বোনকে নিয়ে চিকিৎসা নিতে গেলে আক্রমণের বীভৎসতা দেখে আমি নিজের কথা ভুলে যাই। হাসপাতালের সামনের গেটের দিকে যখন আসি অন্যান্য রোগীর খোঁজখবর নিতে, তখন ছাত্রলীগ সেদিন তৃতীয় দফা হামলা করে হাসপাতালের ভেতরে। কিছু বোঝার আগেই কয়েকজন মিলে আমাকে এলোপাতাড়ি লাঠি দিয়ে আঘাত করতে থাকে। আমি সামলাতে না পেরে পড়ে যাই সেখানে। পড়ে যাওয়ার পরও আমাকে পেটাতে থাকে যতক্ষণ না আমি অজ্ঞান হই। এরপরও তারা আমার মোবাইল ট্র‍্যাকিং থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নিশিতা জামান নিহা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যুক্ত হয়েছিলেন তাঁর দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রামের পথ ধরে। ক্যাম্পাসে আসার পরই ‘নিরাপদ ক্যাম্পাস চাই’ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন নিহা। সেখান থেকে বিভিন্ন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সব যৌক্তিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। 

আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের কথা স্মরণ করে নিহা বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে এত নারী একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনের ইতিহাস বিরল। এই নারীরা আন্দোলনজুড়ে সাহসিকতা দেখিয়েছেন। ১৭ জুলাই আমাদের নির্দেশ আসে হল ছেড়ে দেওয়ার। তখন মেয়েরা দীপ্তকণ্ঠে প্রতিবাদ করে হল না ছাড়ার জন্য, যদিও প্রশাসনের প্রচণ্ড চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত আমরা হল ছাড়তে বাধ্য হই। কিন্তু আমরা বেশির ভাগই নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় গ্রহণ করে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের আন্দোলন জোরদার করতে পদক্ষেপ নিয়েছি।’ 

সম্পর্কিত নিবন্ধ