সঞ্চয়পত্রে সীমা, বন্ডে মুক্ত বিনিয়োগ
Published: 12th, July 2025 GMT
নিরাপদ বিনিয়োগ বলতে দীর্ঘদিন ধরে সঞ্চয়পত্রই ছিল সাধারণ মানুষের একমাত্র ভরসা। কিন্তু সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমেছে, রয়েছে বিনিয়োগ সীমা ও নানা জটিলতা। তবে সঞ্চয়পত্রে নানা বেড়াজাল থাকলেও সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে ট্রেজারি বিল ও বন্ড।
বিল ও বন্ডে সবার জন্য সীমাহীন এবং একক বিনিয়োগের সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। সঞ্চয়পত্রের চেয়েও রিটার্ন বেশি পাওয়া যাচ্ছে এ খাতে, সেই সঙ্গে রয়েছে নিরাপদ বিনিয়োগ। ফলে বিল ও বন্ড আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সঞ্চয়পত্রে সরকারকে তুলনামূলক বেশি সুদ দিতে হয়। যা বাজেটের ওপর চাপ বাড়ে। এর চেয়ে বাজারভিত্তিক হারে অর্থ সংগ্রহ করতে পারলে সরকারি দায় কমে।এছাড়া বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফও সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ ব্যবস্থাকে আরো বাজারমুখী করার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
আরো পড়ুন:
সিটি ব্যাংক ও আইবিএ মিলে আনছে ‘এক্সিকিউটিভ লিডারশিপ ট্রেনিং গ্রোগ্রাম’
প্রভিশন সংরক্ষণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নতুন নির্দেশনা
অন্যদিকে, সঞ্চয়পত্রের টাকা অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় বা অলস খাতে চলে যায়। ট্রেজারি বন্ড ও বিলের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি বেশি এবং তারল্যও থাকে। যা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্য রক্ষা করবে। এসব কারণে সরকার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে বিপরীত দিকে বন্ড ও বিলে বিনিয়োগ করতে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তবে বিল ও বন্ডে মুনাফার হার আরো বাড়ালে এগুলো দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠত বলে মনে করছেন তারা।
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ রাইজিংবিডিকে বলেন, “সঞ্চয়পত্র দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রিয় হলেও, সঞ্চয়পত্রে সরকারকে তুলনামূলক বেশি সুদ দিতে হয়। অন্যদিকে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের রিটার্ন বেশি হলে এগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।”
তার মতে, শেয়ারবাজারের মতো যারা দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করতে চায়, আয় করতে চায় তাদের জন্য সঞ্চয়পত্রের চেয়ে ট্রেজারি বিল ও বন্ড ভালো বিকল্প হতে পারে।
সঞ্চয়পত্রে সুদ কমেছে
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের পর থেকে ধাপে ধাপে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমিয়ে আনা হয়। বর্তমানে পাঁচ বছর মেয়াদি পারিবারিক সঞ্চয়পত্রে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৮১ থেকে ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ, তিন মাস পর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১০ দশমিক ৬৫ থেকে ১১ দশমিক ৮২ শতাংশ পর্যন্ত, পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ৯ দশমিক ৮৪ থেকে ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং ৫ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে ৯ দশমিক ৭৪ থেকে ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যায়। যা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে (সাড়ে ৭ লাখ টাকা) বিনিয়োগকারীদের জন্য। সাড়ে ৭ লাখ টাকার উপরে বিনিয়োগ করলে মুনাহার হার আর কম। গত জানুয়ারিতে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ছিল ১০ দশমিক ১১ থেকে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
এদিকে, সরকার বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। শেয়ারবাজার থেকেও ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে।
ট্রেজারি বিল ও বন্ড কী?
ট্রেজারি বিল ও ট্রেজারি বন্ড হচ্ছে সরকারের ইস্যু করা স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণপত্র। এগুলোর মাধ্যমে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ সংগ্রহ করে। ট্রেজারি বিল সাধারণত ৯১ দিন, ১৮২ দিন ও ৩৬৪ দিনের হয়। ট্রেজারি বন্ড হয় ২, ৫, ১০, ১৫, ২০ বছর মেয়াদি। এই বন্ড ও বিল আগে মূলত ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য ছিল।তবে বর্তমানে সাধারণ মানুষও অনলাইনে ট্রেজারি বন্ড ও বিল কিনতে পারেন।
সঞ্চয়পত্র বনাম ট্রেজারি বিল-বন্ডের মুনাফা:
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১ জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্রের সর্বনিম্ন সুদহার হবে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
গত ৭ জুলাই ৯১ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদহার দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৯৭ শতাংশ।১৮২ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদহার দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ৩৬৪ দিনের ট্রেজারি বিলে সুদহার দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৭৪ শতাংশের বেশি। এছাড়া ২-২০ বছরের ট্রেজারি বন্ডে সুদহার ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ।
এর আগে গত ১৬ জুন ৯১ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদহার দাঁড়ায় ১২ দশমিক ১০ শতাংশ। ১৮২ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদহার ছিল ১২ দশমিক ১১ শতাংশ। ৩৬৪ দিনের ট্রেজারি বিলে সুদহার ছিল ১২ দশমিক ২৪ শতাংশ।ওইদিন ট্রেজারি বন্ড ৫-২০ বছর সুদহার ছিল ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ থেকে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুবিধা
সঞ্চয়পত্রের মতো বিনিয়োগের নির্দিষ্ট সীমা নেই। চাইলে এককভাবে কয়েক কোটি টাকাও বিনিয়োগ করা যায়। সরকার নিজেই এগুলোর গ্যারান্টার। ফলে ডিফল্টের সুযোগ নেই। কর রেয়াতের সুবিধা, আবগারি শুল্ক থেকে অব্যাহতির সুযোগ রয়েছে।
ঢাকা/সাইফ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর বন ড ও ব ল ব ন য় গ কর ব ল ও বন ড ১২ দশম ক ১১ দশম ক ৯ দশম ক জনপ র য় র জন য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয়ের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে সঞ্চয়পত্রের অর্থ আত্মসাৎ
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের এনএসসি সিস্টেম জালিয়াতি করে অর্থ তুলে নিয়েছে একটি চক্র। অন্যের সঞ্চয়পত্র মেয়াদপূর্তির আগেই ভাঙিয়ে ওই চক্র নিজ ব্যাংক হিসাবে টাকা স্থানান্তর করেছে। সব মিলিয়ে ২৫ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। এভাবে আরও প্রায় ৫০ লাখ টাকা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করলে তা আটকে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয় থেকে কেনা সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে এই জালিয়াতি ধরা পড়েছে। মতিঝিল কার্যালয়ের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেই এই সঞ্চয়পত্র জালিয়াতি হয় বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এ ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকী আজ বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, যাঁদের হিসাবে অর্থ গেছে এবং যাঁরা জালিয়াতিতে জড়িত, তাঁদের চিহ্নিত করে মামলা করা হবে। সঞ্চয়পত্রের সিস্টেম যাঁরা পরিচালনা করেন, তাঁদের কারও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে এই জালিয়াতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ নিয়ে মতিঝিল থানায় মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কীভাবে এই জালিয়াতিজাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো গ্রাহক সঞ্চয়পত্র কেনার সময় যে ব্যাংক হিসাবের তথ্য দেবেন, সেই হিসাবেই সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ও আসল টাকা দেওয়া হয়। এ ছাড়া যে অফিস থেকে সঞ্চয়পত্র কেনা হয়, কোনো তথ্য পরিবর্তন, সুদ বা আসল নেওয়ার জন্য অবশ্যই সেই অফিসে আবেদন করতে হয়। আবেদন পাওয়ার পর গ্রাহকের দেওয়া মোবাইল নম্বরে একটি ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) যায়। উপস্থিত গ্রাহক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মীকে তৎক্ষণাৎ সেই ওটিপি দেখানোর পর তা ব্যবহার করে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনে তথ্য পরিবর্তন করা হয়। তবে সব ক্ষেত্রে সার্ভারে ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট বা প্রমাণ থাকে।
তবে দেড় বছর ধরে অনেক ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে ব্যর্থ হচ্ছেন গ্রাহকেরা। এসব ব্যাংকে প্রবাসী আয় বা সঞ্চয়পত্রের টাকা এলেও গ্রাহকেরা উত্তোলন করতে পারছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক পরিবর্তনের আবেদন করছেন অনেকে। গ্রাহকের সমস্যা বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানগুলোর দিক থেকে ব্যাংক পরিবর্তন করে দেওয়া হচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই কেউ জালিয়াতির ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারেন বলে ধারণা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয়ের কর্মকর্তারা।
যা ঘটেছেবাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয় থেকে গত বৃহস্পতিবার ২৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনেন এক ব্যক্তি। তাঁর ব্যাংক হিসাবটি আছে অগ্রণী ব্যাংকের জাতীয় প্রেসক্লাব শাখায়। চার দিনের মাথায় গত সোমবার এই সঞ্চয়পত্র ভাঙানো হয় এবং টাকা নেওয়া হয় এনআরবিসি ব্যাংকের দিনাজপুর উপশাখার অন্য এক ব্যক্তির হিসাবে। ওই টাকা জমা হওয়ার কিছু সময়ের মধ্যে ব্যাংকটির রাজধানীর শ্যামলী শাখা থেকে তুলে নেওয়া হয়।
একই প্রক্রিয়ায় একই দিনে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মাধ্যমে ৩০ লাখ ও এনআরবি ব্যাংকের মাধ্যমে ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে টাকা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে এলে তা আটকে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক তিনটি ঘটনায় সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলেছে। গ্রাহকেরা জানিয়েছেন, তাঁরা সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর জন্য আবেদন করেননি। ফলে তাঁদের মোবাইল ফোনে কোনো ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ডও (ওটিপি) যায়নি। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের যে তিন কর্মকর্তার কাছে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পাসওয়ার্ড ছিল, তাঁদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নতুন করে অন্য তিনজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেই এই জালিয়াতি করা হয়েছে। ফলে যাঁদের কাছে পাসওয়ার্ড ছিল, তাঁরা নজরদারিতে আছেন। এ ছাড়া বাইরের আরও কারও সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট পর্যন্ত ব্যাংকসহ অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকদের তিন লাখ ৪০ হাজার ৭১ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকারি-বেসরকারি সব বাণিজ্যিক ব্যাংক, সঞ্চয় অধিদপ্তর ও পোস্ট অফিস মিলে প্রায় ১২ হাজার শাখা থেকে এসব সঞ্চয়পত্র কেনা ও ভাঙানো হয়।
এনআরবিসি ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তৌহিদুল আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ঘটনার পর আমরা ডিএমডির নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি করে দিয়েছি। সেই কমিটি কাজ শুরু করেছে। এরপরই বিস্তারিত জানা যাবে।’