যেখানে দেশে গ্যাসের চাহিদা দিনে ৩৮০ কোটি ঘনফুট, সেখানে ২৫০ কোটি ঘনফুট দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তারপরও অন্তর্বর্তী সরকার জোড়াতালি দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা চালাচ্ছে, যদিও তার সফলতা নিয়ে সংশয় আছে।
মানুষ এখন দ্বিমুখী সংকটে আছে। একদিকে গ্যাসের সরবরাহ কম, অন্যদিকে নতুন শিল্পকারখানায় দাম দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে। এটি বৈষম্যমূলক প্রস্তাব। পুরোনো শিল্পের সঙ্গে নতুন শিল্প প্রতিযোগিতা করতে পারবে না। এতে বিনিয়োগে উৎসাহ কমে যাবে। ইতিমধ্যে সরকার যে ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর বাড়িয়ে দিয়েছে, তা জনজীবনে প্রভাব ফেলবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম আগে থেকেই চড়া ছিল, ভ্যাট বাড়ানোর পর আরও অনেক পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাবে।
মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, মিরপুর, কলাবাগান, উত্তরাসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিয়মিত গ্যাস সরবরাহ নেই। দিনে গ্যাস না থাকায় অনেক স্থানে রান্নার চুলা জ্বালাতে রাতের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের শিল্পাঞ্চলেও গ্যাসের চাপ কম। সাধারণত ১০ থেকে ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চি) চাপে গ্যাস সরবরাহ করা হয় শিল্পকারখানায়। এবার গ্যাসের সরবরাহ কম থাকায় কারখানা গ্যাস পাচ্ছে ১ থেকে ২ পিএসআই চাপে। গত রোববার গাজীপুরে ৬০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ৪০ কোটি ঘনফুট। নারায়ণগঞ্জেও চাহিদামতো গ্যাস পায়নি তিতাস। ফলে রপ্তানিশিল্প এলাকা হিসেবে পরিচিত নারায়গঞ্জ ও গাজীপুরের কারখানাগুলোর উৎপাদনও কমে গেছে। কোথাও কোথাও রেশনিং করে কারখানা চালু রাখতে হচ্ছে।
অদূর ভবিষ্যতে গ্যাস–সংকট কাটার সম্ভাবনা নেই বলে স্বীকার করেছেন জ্বালানি ও খনিজ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাইলেই চট করে গ্যাসের সংকট সমাধান করা যাবে না। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমার পাশাপাশি বাইরে থেকে আমদানির সক্ষমতাও সীমিত।’
অস্বীকার করার উপায় নেই যে আওয়ামী লীগ সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই গ্যাস–সংকট বেড়েছে। তারা গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের চেয়ে বিদেশ থেকে তরলীকৃত গ্যাস আমদানির ওপর জোর দিয়েছিল। এর পেছনে কমিশন বাণিজ্যও ছিল। কিন্তু উত্তরণের পথ তো বের করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্রের সময় বাড়িয়ে উন্মুক্ত করলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। এই প্রেক্ষাপটে সরকার দ্বিতীয়বার দরপত্র আহ্বানের উদ্যোগ নিয়েছে। এটি ইতিবাচক হলেও সময়সাপেক্ষ।
সে ক্ষেত্রে সরকারকে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানের পাশাপাশি তরল গ্যাস আমদানির পরিমাণও বাড়াতে হবে। চালু গ্যাসক্ষেত্র থেকে আরও বেশি গ্যাস উত্তোলন করা যায় কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। ভোলার গ্যাস দেশের অন্যান্য স্থানে এলএনজির মাধ্যমে সরবরাহের কাজটিও জোরদার করা প্রয়োজন।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জ্বালানি খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। বর্তমান সরকার লোপাটকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাকে স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে আমরা এ–ও আশা করি যে গ্যাস খাতের দুর্নীতির ছিদ্রগুলো বন্ধে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে এখনো বিভিন্ন স্থানে গ্যাসের অনেক অবৈধ সংযোগ আছে, যা থেকে রাষ্ট্র কোনো অর্থ না পেলেও ফায়দা নিয়ে যায় দুর্নীতিবাজেরা।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে, গ্যাস–বিদ্যুতের সংকট জিইয়ে রেখে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা যাবে না। রেশনিং পদ্ধতিতে কারখানা চালু রাখতে হলে মালিকের ব্যয় যেমন বাড়ে, তেমনি উৎপাদিত পণ্যের দামও বেশি পড়বে।
দেশবাসী অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে একটি বাস্তবমুখী নীতি–পরিকল্পনা এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন আশা করে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
পুতিনের ভারত সফর, কী থাকছে অর্থনীতিতে
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দুই দিনের সফরে আজ ভারতে এসেছেন। এই সফরের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের পাশাপাশি অর্থনৈতিক গুরুত্বও আছে।
বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক বিরোধ তুঙ্গে, সেই সময় ভারতের পরীক্ষিত মিত্র রাশিয়া তার পাশে কতটা দাঁড়াতে পারে, বিশ্লেষকেরা তা দেখার অপেক্ষায় আছেন। এই সফরে অর্থনীতির ক্ষেত্রে নতুন কিছু চুক্তি হতে পারে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে পার্থক্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি যেখানে বছরে প্রায় ৮০ বিলিয়ন বা ৮ হাজার কোটি ডলার, সেখানে রাশিয়ায় তার রপ্তানি মাত্র ৪ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন বা ৪৮৮ কোটি ডলার। গত পাঁচ বছরে ভারত-রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়লেও সেই বাণিজ্য মূলত রাশিয়ার দিকেই হেলে আছে। সেই সঙ্গে ভারত সম্প্রতি রাশিয়ার তেল কেনা কমিয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে আজ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভারতে আসছেন। খবর ইকোনমিক টাইমস ও দ্য হিন্দুর
গত অর্থবছরে, অর্থাৎ ২০২৪-২৫ সালে ভারত ও রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৬৮ দশমিক ৭২ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৮৭২ কোটি ডলার। সেখানে রাশিয়ার রপ্তানি ছিল ৬৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৩৮৪ কোটি ডলার।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই বাস্তবতায় ভারতের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হারানো একপ্রকার অসম্ভব। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে এত দিন অনড় থাকলেও সম্প্রতি ট্রাম্পের কথামতো রাশিয়ার তেল কেনা কমিয়েছে ভারত। তবে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে দেশটি। ২০৩০ সালের মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করতে চায় তারা।
যুক্তরাষ্ট্র যখন ভারতের পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, তখন রাশিয়া ভারতকে আশ্বস্ত করে, তারা ভারত থেকে আরও পণ্য কিনবে। ভ্লাদিমির পুতিন নিজেই সে কথা বলেছিলেন। ভারত চায় রাশিয়ায় যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক, খাদ্য ও ওষুধ সামগ্রীর রপ্তানি বাড়াতে। অন্যদিকে রাশিয়া চায়, পারমাণবিক বিদ্যুৎ খাতে তাদের রপ্তানি বাড়াতে।
এই বাস্তবতায় রুশ প্রেসিডেন্টের এই সফর গুরুত্বপূর্ণ। ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে গত সপ্তাহে বলা হয়, এই সফরে পুতিন ও মোদি রাশিয়া-ভারতের বিশেষ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করবেন। রাজনীতি, বাণিজ্য, অর্থনীতি—সব ক্ষেত্রেই দুই দেশের মধ্যে বিশেষ ও অগ্রাধিকারমূলক কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলা যায় কি না, সেটাই এই সফরের লক্ষ্য।
ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, এই সফরে বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় বিষয়ের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়েও বেশ কিছু চুক্তি হতে পারে।
ভারতের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অতিথি ফেলো আলেক্সিই জাকারভ বলেন, এই শীর্ষ বৈঠকের মূল লক্ষ্য হবে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির পথ খোঁজা। অর্থাৎ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য যেন একতরফা রাশিয়ার দিকে হেলে না থাকে, সেই ব্যবস্থা করা।
অর্থনৈতিক সহযোগিতার বহুমুখীকরণরাশিয়া ভারতের মূল অস্ত্র সরবরাহকারী, যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ভারত রাশিয়া থেকে সমরাস্ত্র আমদানি কমিয়েছে। মূলত রাশিয়া থেকে সমরাস্ত্র কেনার কারণেই দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য একতরফাভাবে রাশিয়ার দিকে হেলে আছে।
এই পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বহুমুখীকরণের কথা ভাবছে দুই দেশ। গবেষণা সংস্থা চ্যাটহ্যাম হাউসের তথ্যানুসারে, পুতিনের এই সফরে শ্রমিক সরবরাহের লক্ষ্য চুক্তি হতে পারে। অর্থাৎ ভারতের শ্রমিকেরা যেমন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য উন্নত দেশে যাচ্ছেন, এই চুক্তি হলে দক্ষ ভারতীয় শ্রমিকেরা রাশিয়াও যেতে পারবেন। এই চুক্তির তাৎপর্য বোঝা কঠিন নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। সেটা হলো, তারা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো।
গ্রাফিকস: প্রথম আলো