একদা বৃষ্টির দিনে অন্ধ তীরন্দাজ
আবিদ আনোয়ার
না, আর বৃষ্টিতে নয়—
চলো যাই গভীর, গভীরতর অন্য কোনো জলে
যেখানে ডুব-সাঁতারে তোমাকে একান্তে পেয়ে পাবো সমূদয়;
নিজেকে রাখবে না ঢেকে অহেতুক অসহ্য বল্কলে,
ব্যাকুল মৎস্যিনী হয়ে কাছে এসে বুদ্বুদের প্রতীকী ভাষায়
আমাকে জানিয়ে দেবে প্রতীক্ষায় সত্যি ফলে মেওয়া;
একদা বৃষ্টির দিনে ঠাঁই পেয়ে তোমাদের সান্দ্র বারান্দায়
কী এক শায়কে বিদ্ধ একাই রক্তাক্ত হয়ে শুরু হলো দেওয়া
অবিমৃশ্যকারিতায় যাকিছু সঞ্চিত ছিলো হৃদয়ের ধন,
কাটিয়েছি বহুদিন সানন্দে হারাম ক’রে নিদ্রা থেকে কাজ;
এবার প্রমাণ চাই: আমার সাধনাবলে ভিজিয়েছি মন,
অথবা বৃষ্টিতে ভেজা তোমাকেও গেঁথেছিলো অন্ধ তীরন্দাজ!
বৃষ্টি-কথন
শিহাব সরকার
সকলে জানি, নিশ্চয়ই জানি সকলে
সূর্য নিভে আসছে প্রতিদিন পলে পলে
গুল্মলতা অরণ্যানী জেনে গেছে সেই কবে
তাহলে আরো একবার বরফের যুগে .
ভুবন ভাসানো বৃষ্টির পরে নূহের প্লাবন?
পৃথিবী গ্রহ ডুবে যায় বারবার,
নয়া দুনিয়া জাগে দিগন্তের সীমানায়
শরতের আকাশে ফের ওড়ে কল্পনা-শিমুল
মেঘ ভাসে, রৌদ্রও ওঠে বাংলায়।
ঠাণ্ডা সূর্যের নীচে শীতার্ত মানুষেরা
তবু সাঁতরায়। অজানা কূলে এসে রাস্তা
গোপাট সব হারায়, নদীতে শত শব ভাসে
সেইসব বৃিষ্টর যুগও ফিরে ফিরে আসে।
মানুষের কোলাকুলি গোবি, সাহারায়
তারপর অঝোর বৃষ্টির শুরু গুহার তমসায়
মশালের আলোয় পড়ছি রাত্রির এলিজি।
সে না এসেও কেন মেঘ পাঠায়
আলফ্রেড খোকন
সে না এসেও কেন রোজ মেঘ পাঠায়!
যে মেঘ কাঁধে নিয়ে ঘুরেছি মনে মনে
তখন আমি ছিলাম দূরের ফুল্লশ্রী বনে
একবার দাশেরহাটের মামুলি বর্ষা এসেছিল
আমাদের টিনের চালে
সেই বর্ষা ঝম্ঝম্ করে গড়িয়ে পড়েছিল
উঠোনের নয়নতারার কপালে;
এইভাবে বর্ষা যদিও আসে, ঝাঁপায়ে আসে না
যেমন আমি তোমাকে করেছি রচনা
তুমি প্রতিদিন এসেও কেনও কোনোদিন আসো না?
আরেকবার বর্ষাকে দেখেছি টানবাজারের গলিতে
ঝরে পড়া নৈঃশব্দ্যের মতন মাসিক রক্ত ত্যানায়
তার আসার কথাই ছিলো না যখন;
সে হঠাৎ এসেছিলো গত শীতে!
এইভাবে এলে কি আর ভিজে যাওয়া যায়!
পাখির ডানায় আজও আমি এ বারতা লিখি
সে না এসেও কেনো রোজ মেঘ পাঠায়!
মৌসুমি বেদনা
মুজিব ইরম
কেনো যে মৌসুম আসে বিবিধ ফলের!
পেয়ারার বনে
আনারস বনে
কে যেন ডাকিছে
আম জাম কাঁঠালের বনে
নাম ধরে
কাতর ব্যাকুল…
কেনো যে মৌসুম আসে
কেনো যে মৌসুম যায় ফলফলাদি বিনে…
কোনো এক
ফলের মৌসুমে
তোমাদের গ্রামে
যাবো আমি ফল পাড়া লোক হয়ে বৃষ্টি নামা দিনে।
বৃষ্টিগুলো বুক পকেটে
মুজতবা আহমেদ মুরশেদ
বৃষ্টিগুলো অনেক রকম কথার মত আবেগ দেয়া!
ছবি আঁকার ঈজেল ছুঁয়ে বৃষ্টিগুলো ঘোর সংসারি।
কখনোও বা বেখেয়ালি, বোহেমিয়ান খুব বিবাগী!
বৃষ্টিগুলো প্রেমের মত আহ্লাদী ভীষণ রকম!
কখনোওবা তোমার বুকের রোমান্টিকতায় দেয়াল দেয়া
উষ্ণবুকের দুঠোঁট চুমে বৃষ্টিগুলো টুপ টুপাটুপ ।
বৃষ্টি আছে কত রকম, হরেক রকম ভীষণ ক্ষেপা!
আবার ভোলা মতন বৃষ্টিগুলো কেউ চলে যায়
ঐ ফিরে ঐ দূরেরি ঐ মেঘের ওপর কথা বলে
ফিসফিসিয়ে, আবার আমি নামবো জোড়ে
ঐ যে নীচে মাটির ওপর বৃষ্টি হবো ঝমঝমাঝম!
বৃষ্টি গুলো মায়ের পুরোন শাড়ির আঁচল খাঁমচে ধরে
মিষ্টি মতন গন্ধ জুড়ে বৃষ্টি নামে হৃদয় কাড়া ব্যাকুল স্বরে।
বৃষ্টিগুলো বুক পকেটে, প্রিয় বাবার পাঞ্জাবিটার
পকেট ভরে, দুদিক ধরে ভীষণ ধারায় বৃষ্টি নামে
অঝোর ঝরে কান্না মতন অনেক জোরে।
বৃষ্টি নামে নীল মর্গের বারান্দাতে লাশের বুকে
ভয়ার্ত এক শূন্যতার আকুল ঘন বিষন্নতায়।
মৃতের ভাষায় বৃষ্টি নামে আতর-লোবান
কফিন খুলে প্রশ্ন করে, — কোনো এলে !
বৃষ্টি নামে পাহাড়ি মেয়ের নোলক ছুঁয়ে শপথ হাতে
নিঝুম করে গহীন সুরে তোমায় দেবো শক্তি প্রবল।
বৃষ্টি হলো তেপান্তরে সোনার কাঠি-রূপোর কাঠি
রূপকথারই হাউ মাউ খাঁউ জাদুর মত।
বৃষ্টি নামুক গুলির মত এই পৃথিবীর আর্তনাদে।
বৃষ্টি নামুক গোলাপ ফুলের বাগান সেজে —
তোমার আলিঙ্গণে মুগ্ধ চোখে ভিজবে দ্যাখো।
জানছো এখন তোমার চুমুর ঘনঘটায় অঝোর ধারায়
বৃষ্টি পেতে ইচ্ছে করে হুডতোলা সেই রিকসাটাতে।
এমন আষাঢ়ে
রিমঝিম আহমেদ
রুগ্ণ এক বীজক্ষেতে খোঁড়া পায়ে দাঁড়ায় আষাঢ়
সারাদিন কী যেন তরঙ্গ, মেঘভাঙা ভেজা রোদ
অঘোর বিরহ বয়, শাঁখাভাঙা শোকে হাহাকার
সারাদিন বৃষ্টিভাব, মেঘে মেঘে জলের মোচড়
সর্বনাশা আত্মকথা একা একা চুল আঁচড়ায়
সারাদিন মায়াবী খঞ্জন বনপথে ঘুরে ঘুরে বাজে
জট খোলে হাওয়া, হতভম্ব মাঠে– ঝড় উপদ্রুত
নিজের ছায়ায় বসে কাঁপে কেউ, আগুন পোহায়
বৃষ্টির কার্তুজ খোলে সন্ধ্যা আসে, রাত-অভিপ্রায়
চাই না কিছুই জানি, তবু আশা– যদি পাই কিছু!
জীবনের কুহু এসে কত আলো ভাসায় নদীতে
মানুষেরা ঢুকে পড়ে উন্মাদ এক যৌনখাঁচায়
নিজেকে লুকিয়ে দেখি, আমিও আমার মাঝে নাই
মেঘের দুঃখের সাথে মিশে গিয়ে বৃষ্টি হয়ে যাই
বৃষ্টিগুণ
তাসনুভা অরিন
পৃথিবীকে পারমাণবিক শাসনে রেখে,
আর ক্লাউড সিডিং করে
কদম ফোটানো যায় না।
“কেন জ্বালাও?”
রোদে পোড়া মানুষেরা বৃষ্টিগুণ নিয়ে জন্মায়
ভেজা ঘড়ির কাঁটার পাশে নীল হয়ে খোঁজে
গুম হয়ে যাওয়া সময়।
প্রতিচ্ছবিতে মন মজে আছে এ শহরের।
মানুষেরা যখন নিজেকে মাটি ভাবত
প্রেমের নামে কদম ফুটতো।
আমি কিছু দেখি নাই
চাঁদনী মাহরুবা
জুলাইটা এমন—এই গা-জ্বালা রোদ, এই বৃষ্টি
প্যাচপেচে কাদায় গড়াগড়ি খায় অফিস-ফেরত সন্ধ্যা
আমের মৌসুম—কারওয়ানবাজারে কীটের হুলুস্থুল!
নর্দমায় ঠাসা এ বাজার, যেন মানুষের মগজ।
ধরে নাও,আমি কিছু দেখি নাই। ঘাম কিংবা রক্ত!
সবকিছু এবসার্ড।
পথের রুগ্ন ঘা-ওঠা কুকুর থেকে চোখ ফিরিয়ে বাড়ি ফিরি বিবমিষায়।
কবিদের বিনমিত মুখ
অসময়ের খিস্তিখেউড়_
ভালো থাকার প্রশ্নে যে ব্যক্তি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ায়ে গেলো, মন চায় তারে এক বাক্স টুথপিক কিনে দেই।
লিখে কোন লাভ নাই, তবু কবিতা লেখার ভীষণ তাড়া নিয়ে আমি লিখি.….
ভাতের যোগান দিতে গিয়াই যে শালারা খরচ হয়ে যাচ্ছে রাস্তায়,তারে তুমি রাজনীতি বোঝাতে এসো না।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: এস ও ক ন
এছাড়াও পড়ুন:
আম রপ্তানিতে নতুন সম্ভাবনা
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের অলিগলিতে এখন সুমিষ্ট পাকা আমের মধুর ঘ্রাণ মিশ্রিত বাতাসের আনাগোনা। বাজারে ঢুকে দেখা গেল একপাশে বসে রয়েছেন রাজশাহী থেকে আসা আম ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, দাম একটু কম, কিন্তু বিক্রি বেশ ভালো। রপ্তানি বেড়েছে বলে বাজারে স্থিরতা এসেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের হিমসাগর তো এখন ইউরোপেও যাচ্ছে!
শুধু রাজধানী নয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, যশোর আর নওগাঁর কৃষকদের চোখেও এখন নতুন স্বপ্ন। কারণ, আম আর শুধুই মৌসুমি ফল নয়। এটি হয়ে উঠছে রপ্তানিযোগ্য এক সম্ভাবনার নাম। চলতি মৌসুমে সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগে নিরাপদ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত শিল্প এবং বহির্বিশ্বে আম রপ্তানিতে তৈরি হয়েছে এক অনন্য গতি।
রপ্তানির পালে হাওয়া
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বাংলাদেশ চার হাজার টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। জুন মাসেই ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার ২৫টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হয়েছে ৬০০ টনের বেশি আম।
শ্যামবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী নূরুল হক বলেন, “চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী আর সাতক্ষীরার গোপালভোগ, ল্যাংড়া ও হিমসাগরের বিদেশে ভালো চাহিদা আছে। প্যাকেজিং আর কোল্ড চেইনের উন্নয়ন হলে আরও বাড়বে এই বাজার।”
ফ্রুট বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপক ইমরান শিকদার জানান, সৌদি আরব, কাতার, জার্মানি আর ইতালিতে এবার বাংলাদেশের আমের চাহিদা আগের চেয়ে অনেক বেশি। নিরাপদ উৎপাদনের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় আমাদের অবস্থান শক্ত হচ্ছে।
নিরাপদ উৎপাদনে প্রযুক্তির ছোঁয়া
রাজশাহী ও নওগাঁর প্রায় ১২০০ বাগানে এই মৌসুমে ট্রেসেবলিটি সিস্টেম ও বায়োসেফটি ব্যাগিং প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে। এতে কেমিকেলমুক্ত, গাছে পাকানো নিরাপদ আম উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চাষি ওসমান গনি বলেন, “আগে কেমিকেল ছাড়া আম পাকানো যেত না। এখন গাছেই পাকছে, বিদেশেও যাচ্ছে। এটা গর্বের ব্যাপার।”
কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেন, “আম এখন আর মৌসুমি ফল নয়। এটি রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্যে পরিণত হয়েছে। সরকার নিরাপদ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। ভবিষ্যতে আম হবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস।”
শত কোটি টাকার সম্ভাবনা প্রক্রিয়াজাতে
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ টন আম অপচয় হয়, যা দিয়ে তৈরি করা যেতো জুস, আচার, আম পিউরি বা শুকনো আমের মতো পণ্যে বিপুল আয়ের উৎস।
কারওয়ান বাজারে বসে থাকা নারী উদ্যোক্তা মিতা বেগম বলেন, “মাত্র তিন মাসেই আমি ১৫ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছি। যদি সারাবছর কাজ করতে পারি, আরও অনেক নারী উদ্যোক্তা এই শিল্পে আসতে পারবে।”
নগরজুড়ে ছাদবাগানে বারোমাসি আম
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ নানা শহরে ছাদে গড়ে উঠছে আমবাগান। বারোমাসি জাতের আম ফলাতে ছাদে টবে বা ড্রামে গাছ লাগিয়ে বাণিজ্যিক উৎপাদনের দিকে এগোচ্ছেন অনেকেই।
আগারগাঁওয়ের সরকারি কর্মকর্তা খালিকুজ্জামান বলেন, “আমার তিনটি কাটিমন গাছে এবার ৩০ কেজি আম পেয়েছি। অসাধারণ ফলন।”
কৃষিবিদরা বলছেন, টবে নিয়মিত পরিচর্যা ও আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে নগরেও আমের বাণিজ্যিক চাষ সম্ভব।
আম অর্থনীতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে দেশে আম উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ২৪.৮ লাখ টন। যার বাজারমূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। উৎপাদন, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাত ও বিপণনসহ সরাসরি যুক্ত রয়েছেন অন্তত ৩০ লাখ মানুষ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমের বাজার রাতারাতি বদলাবে না। তবে আমরা এখন যে কাজগুলো করছি নিরাপদ উৎপাদন, রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাতকরণএই তিনটি ধারা যদি একসঙ্গে এগোয়, আম হবে বাংলাদেশের গর্বের পণ্য।”
কৃষি মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, “নিরাপদ উৎপাদন, বৈচিত্র্যময় বাজার আর নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ এই তিনে মিলেই গড়ে উঠছে ‘আম অর্থনীতি’র এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।”
তিনি বলেন, “এক সময় শুধু গ্রীষ্মের স্বাদ হিসেবে পরিচিত আম এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্ভাবনার নাম। উন্নত পদ্ধতিতে উৎপাদন, রপ্তানি বাজারে প্রবেশ ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ আমাদের নিয়ে যাচ্ছে এক নতুন উচ্চতায়। যেখানে ‘আম’ মানেই কেবল রসালো ফল নয়, বরং দেশের অর্থনীতির মিষ্টি সফলতার প্রতীক।”
ঢাকা/এস