সন্ধ্যা নামার আগে
খুঁজে বের করার কথা বলে, লুকোচুরি খেলতে খেলতে যে হারিয়ে গেছে, সে আমাদের বন্ধু। পশ্চিমের আকাশে তখন ঢলে পড়েছে সূর্য। শত্রু-মিত্র চেনা যায় এমন আলোর রং ডানায় মেখে নীড়ে ফিরছে পাখি। গ্রামের এক প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে কীর্তনের সুর, আরেক প্রান্তে নেওয়া হচ্ছে আজানের প্রস্তুতি। হতবিহ্বল আমরা কজন তখন বনের উপান্তে এসে দাঁড়ালাম। বাড়ি ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগেই মাথায় চেপে বসল তিন গোয়েন্দা হওয়ার ভূত। যদিও আমরা সংখ্যায় ছয়জন। ফলে ছয়টি দলে ভাগ হয়ে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।
বনটি পরিত্যক্ত, নিষিদ্ধও বলে কেউ কেউ। বনের একপ্রান্তে রয়েছে শ্মশান, আরেক প্রান্তে স্মৃতির মধ্যে বেঁচে থাকা মরা নদীর ঢেউ। কাঠঠোকরা খুব বেশি নেই এখানে, তবে আছে কাঠচোরদের আস্তানা। খুব সচেতন হলে টের পাওয়া যায় মাদকাসক্ত যুবকদেরও আনাগোনা। ঝোপের আড়ালে আরও কত অপরাধ লুকিয়ে আছে কে জানে, ভাবতে ভাবতে মনে হলো, আমাদের বন্ধুটি হয়তো জানে! নাহলে এই ভরসন্ধ্যায় কেন তাকে হারিয়ে যেতে হলো!
রাগ, অভিমান, ভয় কিংবা দুশ্চিন্তার মতো অনেক মানবিক অনুভূতি আমাদের দেখিয়ে চলেছে পথ। অন্ধকারের মুখাপেক্ষী হয়ে নক্ষত্রগুলোও যেন ডুব দিয়েছে অন্ধ কোনো কূপে। নিজেদের গলার আওয়াজ যখন নিজেদের কাছেই অপরিচিত মনে হচ্ছে, ঠিক তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়ি ফিরে যাওয়ার। হারিকেন কিংবা আট ব্যাটারির টর্চলাইট ছাড়া এই বনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। ফলে পরাস্ত মনে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুটির নাম ভুলে আমরা একে অপরের নাম ধরে ডাকতে শুরু করলাম। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বাতাসের গায়ে ধাক্কা লেগে যে শব্দ আমাদের কানে ফিরে আসছিল, তা শুধু আমাদের নিজেদেরই নাম! ফলে সমস্ত অনুভূতিকে পরাজিত করে আমাদের মনের দখল নিল ভয়।
ভয় যখন ডালপালা বিস্তার করে তখন লাঠি হয়ে যায় সাপ, পাতা হয়ে যায় অশরীরী কোনো আত্মা। ফলে আমরা সকলেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে চিৎকার দিতে শুরু করলাম। এই চিৎকার শুনছিল শুধু আমাদের ঐ বন্ধুটি, যে সন্ধ্যা নামার আগেই ফিরে গেছে ঘরে।
স্থানচ্যুত এক নাবিকের গল্প
ট্রেনলাইনে আত্মাহুতি দেওয়ার মনোবাঞ্ছা নিয়ে মধ্যরাতে লোকটি যখন বাড়ি থেকে বের হলো তখন শেষ ট্রেনটিও ছেড়ে গেছে স্টেশন। একদিকে রক্তের ভেতর মৃত্যুকে পাওয়ার প্রবল বাসনা, অন্যদিকে বিরক্তিকর অপেক্ষার মাঝে পেন্ডুলামের মতো ঝুলতে ঝুলতে লোকটি ট্রেনলাইন ধরে হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে একটি বস্তির সামনে এসে দাঁড়িয়ে, তার নিজেকে স্থানচ্যুত এক নাবিকের মতো মনে হয় এবং ঠিক তখনই মাথায় আসে এক নতুন পরিকল্পনা।
বস্তিতে তখন চলছে নিত্যদিনের হট্টগোল। বিভিন্ন মারণাস্ত্র নিয়ে বস্তিবাসী বিভক্ত হয়ে গেছে দলে দলে। লোকটি সিদ্ধান্ত নিল এই হট্টগোলের মধ্যে ঢুকে কোনো এক ধারালো অস্ত্রের নিচে গলিয়ে দেবে তার মাথা। কিন্তু যখনই সে মঞ্চে প্রবেশ করল তখন দর্শকমহলে নেমে এলো থমথমে নীরবতা। কেননা, ঠিক যেন তাকে অনুসরণ করেই নায়কের মতো ঘটনাস্থলে হাজির হলো পুলিশের জিপ। নিমেষেই ময়দান ফাঁকা এবং এসবের মধ্য থেকে পুলিশ তাকে পাকড়াও করে নিয়ে গেল থানায়।
চাইলেই দুই-একটা ফোনকলের সাহায্যে কারার ঐ লোহকপাট ভাঙার ক্ষমতা লোকটির আছে। যেহেতু তার কোথাও যাওয়ার বিশেষ তাড়া নাই, সেহেতু সে গোটা রাত জেলেই কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। বিভিন্ন জিজ্ঞাসাবাদের শেষে পুলিশ যখন মোটামুটি নিশ্চিত হলো, লোকটি পাগল কিসিমের এবং তার কাছ থেকে অর্থযোগের বিশেষ কোনো সম্ভাবনা নেই তখন পুলিশের মধ্যে কেউ কেউ তাকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। কারও কারও মনে অবশ্য ছিল ভিন্ন পরিকল্পনা। পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই হয়তো বহুদিন পর লোকটির সন্ধান পাওয়া যায় কেন্দ্রীয় কারাগারে। জোড়া খুনের আসামি হিসেবে আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। লোকটির সাথে আমার দেখা হয়েছিল ঐ কারাগারেই, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝে পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা গল্পটাও তার কাছ থেকেই শোনা। নির্বাণপ্রাপ্ত কোনো মানুষের মতো সে ইতোমধ্যে ভুলে গেছে তার বিগত জীবনের সমস্ত স্মৃতি, ভুলে গেছে নাম-ঠিকানা। এ জীবন তার এখনও ভালো লাগে না, তার রক্তের মধ্যে এখনও রয়ে গেছে মৃত্যুকে পাওয়ার প্রবল বাসনা। কিন্তু অন্য কোনো উপায়ে নয়, লোকটি শুধু ট্রেনলাইনেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন হতে চায়! v
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
লাকুটিয়া জমিদারবাড়ি এখন যেমন
২ / ১২সংস্কারকাজ চলমান থাকায় নোটিশ দিয়ে রাখা হয়েছে