দুপক্ষের দ্বন্দ্বে বিএনপির কার্যালয় ভাঙচুর
Published: 28th, January 2025 GMT
রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার মাছপাড়া ইউনিয়নে বিএনপির দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের জেরে নিজ দলের একটি কার্যালয় ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সোমবার রাত ৮টার দিকে মাছপাড়া ইউনিয়নের কালীনগর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, পাংশা উপজেলায় বিএনপির নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে সাবেক সাংসদ নাসিরুল হক সাবু ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশীদ পক্ষে বিভক্ত। দুই পক্ষের বিরোধ ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত। মাছপাড়ায় হারুণ পক্ষের নেতৃত্ব দেন ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি জমির উদ্দিন। সাবু পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম টিপু। মাছপাড়া বাজারে অবস্থিত কার্যালয়ে জমির উদ্দিন পক্ষের নেতাকর্মীরা বসেন। সোমবার রাত ৮টার দিকে ওই কার্যালয়টি প্রতিপক্ষ ভাঙচুর করে।
মাছপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি জমির উদ্দিন অভিযোগ করেন, মাছপাড়া ইউনিয়নের কালীনগর গ্রামে দলীয় কার্যালয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা বসতেন। সোমবার রাতে টিপু তাঁর লোকজন নিয়ে অফিসটি ভাঙচুর করেছেন। তারা অফিসে থাকা চেয়ার টেবিল আসবাব– সবকিছু ভেঙে ফেলেছে। শহীদ জিয়া ও খালেদা জিয়ার ছবি সংবলিত ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে। এ ঘটনায় থানায় কোনো অভিযোগ করা হয়নি বলে জানান তিনি।
অভিযোগ প্রসঙ্গে মাছপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম টিপু বলেন, এটা বিএনপির কার্যালয় নয়। সেখান থেকে চাঁদাবাজি করা হচ্ছিল। তিনি গত ৯ দিন ঢাকা ছিলেন। এই ৯ দিনের আট দিন ওই কার্যালয়ে বসা লোকজন সকাল-বিকেল মানুষকে ধরে মেরেছে আর চাঁদাবাজি করেছে। চাঁদার দাবিতে এ পর্যন্ত তারা চারটি দোকানে তালা মেরে রেখেছে। গত পাঁচ মাস ধরে এভাবে চাঁদাবাজি করছে।
টিপু দাবি করেন, গত সোমবার সন্ধ্যায় তিনি জানতে পারেন চাঁদা না দেওয়ায় ওই কার্যালয়ে একজনকে পেটানো হচ্ছে। তখন সেখানে যান তিনি। চাঁদাবাজি করলে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে– এ জন্য তিনি এই পদক্ষেপ নিয়েছেন। বিষয়টি দলীয় হাইকমান্ডকে জানানো হয়েছিল কিনা– এ প্রশ্নের জবাবে টিপু বলেন, সম্প্রতি জেলা কৃষক দলের সদস্য সচিব তাঁর ইউনিয়নে এসেছিলেন। তাঁকে সবকিছু জানানো হয়েছে।
পাংশা মডেল থানার ওসি (তদন্ত) রাসেদুল ইসলাম জানান, মাছপাড়ায় বিএনপির দুটি পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে– এমন খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করে। দলীয় কার্যালয় ভাঙচুরের বিষয়ে কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব এনপ ব এনপ র ন ত কর
এছাড়াও পড়ুন:
শিল্পীরা সমকালকে কীভাবে ধরেন
জুলাই অভ্যুত্থানের মতো বড় ঘটনা ঘটে গেল দেশে। অথচ গত দেড় বছরে এর তীব্র অভিঘাত শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে খুবই কম। সমকালের বড় একটা ঢেউ লেখক, কবি-সাহিত্যিকদের কি আসলেই স্পর্শ করেনি? এমন জিজ্ঞাসা নিয়ে গিয়েছিলাম পাঁচ শিল্পীর প্রদর্শনী ‘রেজোনেন্স অব টাইম’ দেখতে। মনে আশা জাগল নামটা দেখে, ‘সময়ের অনুরণনের’ কথা আছে, নিশ্চয় সমকালকেও খুঁজে পাওয়া যাবে।
চট্টগ্রামের আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তনে ২৪টি ছবি নিয়ে পাঁচ দিনের এই প্রদর্শনী শুরু হয় ১৫ নভেম্বর, শনিবার। শেষ হয় ২০ নভেম্বর। পাঁচ শিল্পীর কেউ অ্যাক্রিলিক, কেউ কালি-কলম, কেউ চারকোল-কাগজ আর কেউবা ধাতুর পাতকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
প্রদর্শনীতে বিশেষভাবে নজর কেড়েছে শিল্পী সঞ্জীব বড়ুয়ার শিল্পকর্ম ‘টাইম অ্যান্ড রিয়েলাইজেশন’ সিরিজের ছবিগুলো। ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে আঁকা একটি ছবির বিবরণ দেওয়া যাক। নানা তলে সন্নিবেশিত ছবিটি প্রথম দেখায় মনে হবে জলরঙের ওয়াশে আঁকা। জলের ওপর লাল রক্তের ফোঁটা যেন মিশে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে স্থির হয়ে গেছে। যেন অন্ধকার বনভূমির পটভূমিতে কেউ একটি ফুল ফুটিয়েছে। ছড়িয়ে থাকা গাছগুলোর ঠিক কেন্দ্রেই এই রক্তচিহ্ন। আবার তার ভেতরে একটা আবছা ধারালো দা। সব মিলিয়ে ক্ষত, জন্ম, মৃত্যু, অন্ধকারের বিস্তার সব এসে গ্রাস করে দর্শককে। অর্গানিক অ্যাবস্ট্র্যাকশনের ভেতরে বর্তমান সময়ের নৈরাজ্য যেন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছে।
সবাই চুপ করে থাকলেও ঘটনা নিজেই তার বিবরণ হয়ে দাঁড়ায়। সমকালের এই বার্তা কে এড়াতে পারে? শিল্পী সঞ্জয় কুমার দাশের ‘সাউন্ড অব সাইলেন্স’ দেখতে দেখতে এমন ভাবনা দর্শকের মনে দোলা দিয়ে যায়। তাঁর ছবি দেখে ভীষণভাবে ফরাসি চিত্রশিল্পী মার্ক শাগালের কথা মনে পড়ে। শাগাল যেভাবে বহুতলকে একসঙ্গে একটা বাস্তবতায় হাজির করেন সঞ্জয়ও তা করেছেন। তাঁর চিত্রকর্ম বিশৃঙ্খল, সহিংস ও মানবিক ট্র্যাজেডিতে ভরা নগর বাস্তবতার রূপকে ধারণ করে। মৃত্যু, হাসপাতাল, উর্দি পরা নিরাপত্তা বাহিনী, তর্কপ্রবণ মানুষ—সব মিলিয়ে একই জমিনে বিশৃঙ্খল বিচ্ছিন্ন দৃশ্য একসঙ্গে মিলিত হয়ে একটি সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা তৈরি করেছে। রঙের ব্যবহার তীব্র ও উজ্জ্বল—নীল, সবুজ, কমলা, বেগুনি ইত্যাদি রং মিলেমিশে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক উত্তেজনা তৈরি হয়। এই ডিস্টোপিয়ান আরবান ল্যান্ডস্কেপের ভেতরে দর্শক সমকালীন বাংলাদেশকেই খুঁজে পাবেন।
শিল্পীরা কি এই সময়ে কেবলই অন্ধকার দেখছেন। কোথাও প্রেম, আশা আর স্বপ্নের রেশ দেখতে পাননি কেউ? উত্তর খুঁজতে গিয়ে উত্তম কুমার তালুকদারের অ্যাক্রিলিকে আঁকা একটি চিত্রকর্মে চোখ আটকে যায়। ‘দ্য লাইফ অব টাইম অ্যান্ড মাই পেইন্টিং’ শিরোনামে তিনটি ছবি আছে তাঁর। প্রায় ৭ ফুট দৈর্ঘ্যের ও ৪ ফুট প্রস্থের একটি ছবির কথা বলি। ক্যানভাসে এক কোণে লাল আপেলের প্রতিকৃতি মনে করিয়ে দেয় আদি পাপের বেদনা। ক্যানভাসের ছড়িয়ে থাকা নানা ফিগারে প্রকৃতি, ফুল আর জীবনের নানা অনুষঙ্গ জড়াজড়ি করে আছে। মানব-মানবীর যুগল অবয়বে নবজন্মের ইশারা। স্বর্গ থেকে মানবের বিতাড়নের কারণ প্রেম। আর প্রেম আছে বলেই জীবন আছে, মৃত্যুও আছে। যুদ্ধ আর হিংসার ভেতরে সেটাই তো আশার আলো।
উত্তমের চিত্রকর্মে মানবদেহ, প্রাণী, ফুল ও জৈবিক মোটিফগুলো একত্রে একটি ঘন প্রতীকী জগৎ তৈরি করে। রং ব্যবহারে তীব্র কনট্রাস্ট—বিশেষত নীল, লাল ও বাদামির উপস্থিতি—দৃশ্যকে নাটকীয় করে তোলে, আর সাদা ফাঁকা অঞ্চলগুলো যেন অসম্পূর্ণতার ভেতর লুকোনো সম্ভাবনার ইঙ্গিত। চরিত্রগুলোর মুখে স্পষ্ট পরিচয় নেই; এই অবয়বহীনতা ব্যক্তিগত বেদনা, দেহ-রাজনীতি কিংবা অস্তিত্বগত অনিশ্চয়তার দিকে দর্শকের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়। ছবিতে লতানো সবুজ শিরা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভেতরে-বাইরে প্রবহমান রেখা—এসব যেন মানবজীবনের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের জড়িত থাকার অনিবার্যতাকে তুলে ধরে।
জাবের আহমেদ চৌধুরীর কাজ নানা দিক থেকেই আলাদা। প্রদর্শনীতে তিনি ‘সরোস অ্যান্ড হ্যাপিনেস’ শিরোনামে দুই ফুট বাই দুই ফুট মাপের চারটি রিলিফ ভাস্কর্য উপস্থাপন করেছেন। এসএস মেটাল শিটের ওপর করা ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্যগুলো দ্বিমাত্রিক তলের বিভ্রম তৈরি করে। আনন্দ–বেদনার এই কাব্য পুরোটাই সাদাকালো। কালো এসএস শিট কেটে যে স্থান বা স্পেস তৈরি করেছেন শিল্পী, সাদা দেয়ালের পটভূমিতে তাকে সাদাকালোয় পরিণত করেছেন। সেখানে নিবিড় প্রকৃতি ও বনের কেন্দ্রে রয়েছে নিঃসঙ্গ মানুষ। এই বিভক্তিতা বা অ্যালিয়েনেশন আধুনিক মানুষের নিয়তি। ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ থেকে দূরের এই দুনিয়া খুব চেনা লাগে।
অরুণ কুমার শীল পেন-পেপারে কাজ করেছেন। ঘন ডিটেলে ভরা বহুতলের সিরিজগুলোর নাম ‘সারকমস্টেনসেস’। জীবন ছুঁয়ে চলে যাওয়া পরিপার্শ্ব তাঁকে ভাবিয়েছে। প্রদর্শনীতে তাঁর ৬টি ছবিতে অসংখ্য ঘটনা একসঙ্গে ভিড় করেছে। তবে ঘটনা একান্ত দৈনন্দিন। সেখানে বাজারের থলে হাতে মানুষ যেমন দেখা যাবে, তেমনি দেখা যাবে সবজির গাড়ি, মুদিরদোকান, ছাদের কোণে কাস্তের মতো চাঁদ। সব মিলিয়ে জীবনের প্রবহমানতা দর্শককে ভীষণভাবে আলোড়িত করে।