রায়পুর উপজেলার মেঘনার বুকে জেগে ওঠা চরটির নাম কানিবগা চর। চরের আয়তন প্রায় ৬ হাজার ৮০৯ একর। চলতি মৌসুমে চরের ৪ হাজার একর জমিতে সয়াবিন (তেল জাতীয় ফসল) চাষ করেছেন ২৫৪ জন কৃষক, যারা দখল সূত্রে ও অসিয়তমূলে মালিক। চরে প্রতি বছর প্রায় ২৫০ কোটি টাকার সয়াবিন উৎপাদিত হয়। কিন্তু গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চরের মালিকানা নিয়ে শুরু হয়েছে দ্বন্দ্ব। নতুন করে জমির মালিকানা দাবি করেছেন আরও ১৫০ জন; যাদের অধিকাংশই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী।
কৃষকরা জানান, ইতোমধ্যে চর দখলের লড়াইয়ে নেমেছে বিএনপির স্থানীয় দুটি গ্রুপ। তারা হামলা-পাল্টা হামলা, অগ্নিসংযোগ ও সয়াবিন লুটে জড়িত বলে তাদের অভিযোগ। চর দখল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ৭ এপ্রিল দুই পক্ষের সংঘর্ষে দু’জন নিহত হয়েছেন। বিএনপি কর্মী সাইজ উদ্দিন ঘটনাস্থলে ও আহত স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা জসিম উদ্দিন ব্যাপারী হাসপাতালে মারা যান।
অভিযোগ রয়েছে, জমির দখল নিতে মরিয়া চরবংশী ইউনিয়ন বিএনপি নেতা মেহেদী কবিরাজ ও জিএম শামীম গাজীর অনুসারীরা। ৭ এপ্রিলের খুনের ঘটনার পর চরে শুরু হয়েছে বাড়ি-ঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ। এতে আতঙ্কে আছেন স্থানীয় কৃষক ও সাধারণ মানুষ। তবে খুন-অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি দল থেকে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, নতুন জেগে ওঠা চরের ২ হাজার ৮০৯ একর জমির মালিক মূলত সরকার। জরিপ না হওয়ায় এখনও এসব জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়নি। এ সুযোগে প্রভাবশালীরা জমির দখল নিতে মরিয়া। 
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ জহির আহমেদ বলেন, ‘আবহাওয়াগত কারণে দেশের ৮০ শতাংশ সয়াবিন উৎপাদিত হয় লক্ষ্মীপুরে। এতে প্রায় ৭০ হাজার কৃষক জড়িত। এ বছর জেলায় সয়াবিন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে; চাষ হয়েছে তার চেয়েও ১ হাজার ৬৬০ হেক্টর বেশি জমিতে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে উৎপাদন হতে পারত প্রায় ৬৫ হাজার ৫০ মেট্রিক টন সয়াবিন, যার বাজার মূল্য আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকা। তার মধ্যে কেবল কানিবগা চরেই উৎপাদিত হবে ২৫০ কোটি টাকার সয়াবিন।’ 
সরেজিমন পরিদর্শনের সময় কৃষকরা জানান, পাকা সয়াবিন ফসল লুট করে নিয়ে যাচ্ছেন দখলদাররা। অনেক কৃষক মারধরের শিকার হয়েছেন। সাহাব উদ্দিন নামে এক বৃদ্ধ কৃষক কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘সারাবছর খেয়ে না খেয়ে সয়াবিন লাগাইছি। এখন ফসল ঘরে তুলতে পারছি না। প্রশাসন আমাদের একটু সাহায্য করলে আমাদের ফসল বাঁচত, আমরাও বাঁচতে পারতাম।’
চাষিরা জানান, নতুন করে যারা জমির মালিকানা দাবি করছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন রায়পুর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তফা গাজী, হারুন হাওলাদার, মোবারক আলী, বাদশা গাজী, ফারুক কবিরাজ, শামীম গাজী, মেহেদী কবিরাজ, হাসিম মাতাব্বর, গিয়াস উদ্দিন মাতাব্বর। এসব নাম পুলিশের তদন্তেও এসেছে বলে জানিয়েছেন রায়পুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মহিউদ্দিন।
অভিযোগের বিষয়ে উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তফা গাজী বলেন, ‘আমি কারও জমি দখল করিনি। কাউকে মারধরও করিনি। বিএনপির কেউ দখলের সঙ্গে জড়িত নেই।’ অপরিদেক আরেক যুগ্ম আহবায়ক বাদশা গাজী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের পতনের পর চরে যেন কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য নেতাকর্মীদের নির্দেশনা 


দিয়েছি। বহিষ্কৃত জামায়াত নেতাসহ কয়েকজন পরিকল্পিতভাবে চরের জমি দখলের সঙ্গে আমার নাম জড়িয়েছেন। তকে এসবে আমি জড়িত নই।’
চাষিরা অভিযোগ, জমি রক্ষায় প্রশাসনের কাছে বারবার আবেদন করেও কোন প্রতিকার পাননি তারা। ৭ এপ্রিলের সংঘর্ষের পর স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারা মিলে একটি ‘তথাকথিত সম্মিলিত শান্তি কমিটি’ গঠন করেছেন, কমিটিতে জমির প্রকৃত মালিকদের রাখা হয়নি। সেখানে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের রাখা হয়েছে, যারা নিজেরাই দখলের সঙ্গে জড়িত।
জমির প্রকৃত মালিক দাবিদার সফিক ভূঁইয়া, আফছার উদ্দিন, সিরাজুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী, কুদ্দুস পাটোয়ারী, শাহাজান পাটোয়ারী, বলেন, ‘সরকার জরিপ করে জমির প্রকৃত মালিকদের চিহ্নিত করতে পারে, এতে দ্রুত সমস্যার সমাধান সম্ভব।’
রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহবায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম মিঠু বলেন, ‘গত ৭ এপ্রিল উত্তর চরবংশী ইউনিয়নে হামলা, সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার ঘটনায় জড়িত দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি দল থেকে তাদের আজীবন বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। উপজেলা বিএনপি ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর যৌথ সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং তাৎক্ষণিকভাবে তা কার্যকর করা হয়েছে। বহিষ্কৃতরা হলেন, উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি কর্মী মেহেদী কবিরাজ, ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি এবাদ উল্যা গাজী, ইউনিয়ন বিএনপি নেতা ও হত্যা মামলার প্রধান আসামি ফারুক কবিরাজ, ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সফিক রাড়ী, ৮ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি আরিফ, ৭ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দল কর্মী ফারুক গাজী ও রায়হান, ৬ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দল কর্মী আল আমিন কবিরাজ, ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মানিক আহমেদ তারেক, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ওমর আলী হাওলাদার, কর্মী নজরুল ইসলাম, ইউনিয়ন যুবদল কর্মী শরিফ বাগ, শাহজাহান মাঝি এবং ইউনিয়ন কৃষকদলের সদস্য সচিব শাহ আলী।’
তিনি আরও বলেন, ‘বহিষ্কৃতদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা বা উঠাবসা করার ব্যাপারে নেতাকর্মীদের নিষেধ করা হয়েছে। নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ 
রায়পুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহেদ আরমান বলেন, ‘বরিশাল ও লক্ষ্মীপুর জেলার সীমানা জটিলতা, জরিপ না হওয়া এবং মামলা-মোকদ্দমার কারণে এসব জমি বন্দোবস্ত দেওয়া যাচ্ছে না।’
রায়পুর থানার ভারপাপ্ত কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন ভুঁইয়া জানান, এ পর্যন্ত সংঘর্ষের ঘটনায় ৪টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৯ জনকে। কেউ কেউ উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হয়েছেন। পুলিশের নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। 
সহকারী পুলিশ সুপার (রায়পুর-সার্কেল) জামিলুল হক বলেন, ‘পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আছে। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে পুলিশি টহল জোরদার করা হয়েছে।’
রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো.

ইমরান খান বলেন, ‘দুর্গম চরগুলোতে পেশি শক্তি দিয়ে কৃষকদের হয়রানি করার অভিযোগ পেয়েছি। আমি কৃষকদের কাছ থেকে দখলদার ব্যক্তিদের নাম শুনেছি। জমির মালিক ও চাষিদের নিয়ে বৈঠক হয়েছে। যাদের কাগজপত্র আছে আর যারা জমি চাষ করেছে তেবল তারাই ফসলের মালিক। কেউ অন্যায়ভাবে সয়াবিন লুটপাট করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নেবে।’


 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ন ত কর ম দ র ব এনপ র স ল ইসল ম স ঘর ষ র দখল উৎপ দ র ঘটন দখল র

এছাড়াও পড়ুন:

আফতাবনগরে পশুর হাট বসানো যাবে না: হাইকোর্ট

ঢাকার মেরাদিয়ার পর আফতাবনগর আবাসিক এলাকায় কোরবানির পশুর হাট বসানোর উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। 

আফতাবনগর আবাসিক এলাকায় কোরবানির পশুর হাট বসানোর ইজারা বিজ্ঞপ্তির কার্যক্রম স্থগিত করে হাইকোর্ট এই আদেশ দেন। এর ফলে চলতি বছরও আফতাবনগরে গরুর হাট বসানো যাবে না বলে জানিয়েছেন আইনজীবী।

রবিবার (৪ মে) বিচারপতি কাজী জিনাত হক ও বিচারপতি আইনুন নাহার সিদ্দিকার হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট ইউনুছ আলী আকন্দ।

এর আগে গত ২৫ এপ্রিল রাজধানীর আফতাবনগর আবাসিক এলাকায় কোরবানির পশুর হাট বসানোর ইজারা বিজ্ঞপ্তি চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইউনূস আলী আকন্দ। হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় তিনি এ রিট দায়ের করেন।

আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইউনূস আলী আকন্দ বলেন, “গত ২১ এপ্রিলের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আফতাবনগর আবাসিক এলাকায় পশুর হাট বসানের জন্য ইজারা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। অথচ হাইকোর্টে এ বিষয়ে রুল বিচারাধীন।”

এর আগে গত ২৯ এপ্রিল ঈদুল আজহা উপলক্ষে ঢাকার বনশ্রীসংলগ্ন মেরাদিয়া বাজারের পূর্ব পাশে খালপাড়ের খালি জায়গায় অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর ওপর তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট।

এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি কাজী জিনাত হক ও বিচারপতি আইনুন নাহার সিদ্দিকার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন।

ঢাকা/এম/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ