রায়পুরে ২৫০ কোটি টাকার সয়াবিন নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষ মুখোমুখি
Published: 3rd, May 2025 GMT
রায়পুর উপজেলার মেঘনার বুকে জেগে ওঠা চরটির নাম কানিবগা চর। চরের আয়তন প্রায় ৬ হাজার ৮০৯ একর। চলতি মৌসুমে চরের ৪ হাজার একর জমিতে সয়াবিন (তেল জাতীয় ফসল) চাষ করেছেন ২৫৪ জন কৃষক, যারা দখল সূত্রে ও অসিয়তমূলে মালিক। চরে প্রতি বছর প্রায় ২৫০ কোটি টাকার সয়াবিন উৎপাদিত হয়। কিন্তু গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চরের মালিকানা নিয়ে শুরু হয়েছে দ্বন্দ্ব। নতুন করে জমির মালিকানা দাবি করেছেন আরও ১৫০ জন; যাদের অধিকাংশই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী।
কৃষকরা জানান, ইতোমধ্যে চর দখলের লড়াইয়ে নেমেছে বিএনপির স্থানীয় দুটি গ্রুপ। তারা হামলা-পাল্টা হামলা, অগ্নিসংযোগ ও সয়াবিন লুটে জড়িত বলে তাদের অভিযোগ। চর দখল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ৭ এপ্রিল দুই পক্ষের সংঘর্ষে দু’জন নিহত হয়েছেন। বিএনপি কর্মী সাইজ উদ্দিন ঘটনাস্থলে ও আহত স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা জসিম উদ্দিন ব্যাপারী হাসপাতালে মারা যান।
অভিযোগ রয়েছে, জমির দখল নিতে মরিয়া চরবংশী ইউনিয়ন বিএনপি নেতা মেহেদী কবিরাজ ও জিএম শামীম গাজীর অনুসারীরা। ৭ এপ্রিলের খুনের ঘটনার পর চরে শুরু হয়েছে বাড়ি-ঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ। এতে আতঙ্কে আছেন স্থানীয় কৃষক ও সাধারণ মানুষ। তবে খুন-অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি দল থেকে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, নতুন জেগে ওঠা চরের ২ হাজার ৮০৯ একর জমির মালিক মূলত সরকার। জরিপ না হওয়ায় এখনও এসব জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়নি। এ সুযোগে প্রভাবশালীরা জমির দখল নিতে মরিয়া।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ জহির আহমেদ বলেন, ‘আবহাওয়াগত কারণে দেশের ৮০ শতাংশ সয়াবিন উৎপাদিত হয় লক্ষ্মীপুরে। এতে প্রায় ৭০ হাজার কৃষক জড়িত। এ বছর জেলায় সয়াবিন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে; চাষ হয়েছে তার চেয়েও ১ হাজার ৬৬০ হেক্টর বেশি জমিতে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে উৎপাদন হতে পারত প্রায় ৬৫ হাজার ৫০ মেট্রিক টন সয়াবিন, যার বাজার মূল্য আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকা। তার মধ্যে কেবল কানিবগা চরেই উৎপাদিত হবে ২৫০ কোটি টাকার সয়াবিন।’
সরেজিমন পরিদর্শনের সময় কৃষকরা জানান, পাকা সয়াবিন ফসল লুট করে নিয়ে যাচ্ছেন দখলদাররা। অনেক কৃষক মারধরের শিকার হয়েছেন। সাহাব উদ্দিন নামে এক বৃদ্ধ কৃষক কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘সারাবছর খেয়ে না খেয়ে সয়াবিন লাগাইছি। এখন ফসল ঘরে তুলতে পারছি না। প্রশাসন আমাদের একটু সাহায্য করলে আমাদের ফসল বাঁচত, আমরাও বাঁচতে পারতাম।’
চাষিরা জানান, নতুন করে যারা জমির মালিকানা দাবি করছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন রায়পুর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তফা গাজী, হারুন হাওলাদার, মোবারক আলী, বাদশা গাজী, ফারুক কবিরাজ, শামীম গাজী, মেহেদী কবিরাজ, হাসিম মাতাব্বর, গিয়াস উদ্দিন মাতাব্বর। এসব নাম পুলিশের তদন্তেও এসেছে বলে জানিয়েছেন রায়পুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মহিউদ্দিন।
অভিযোগের বিষয়ে উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তফা গাজী বলেন, ‘আমি কারও জমি দখল করিনি। কাউকে মারধরও করিনি। বিএনপির কেউ দখলের সঙ্গে জড়িত নেই।’ অপরিদেক আরেক যুগ্ম আহবায়ক বাদশা গাজী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের পতনের পর চরে যেন কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য নেতাকর্মীদের নির্দেশনা
দিয়েছি। বহিষ্কৃত জামায়াত নেতাসহ কয়েকজন পরিকল্পিতভাবে চরের জমি দখলের সঙ্গে আমার নাম জড়িয়েছেন। তকে এসবে আমি জড়িত নই।’
চাষিরা অভিযোগ, জমি রক্ষায় প্রশাসনের কাছে বারবার আবেদন করেও কোন প্রতিকার পাননি তারা। ৭ এপ্রিলের সংঘর্ষের পর স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারা মিলে একটি ‘তথাকথিত সম্মিলিত শান্তি কমিটি’ গঠন করেছেন, কমিটিতে জমির প্রকৃত মালিকদের রাখা হয়নি। সেখানে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের রাখা হয়েছে, যারা নিজেরাই দখলের সঙ্গে জড়িত।
জমির প্রকৃত মালিক দাবিদার সফিক ভূঁইয়া, আফছার উদ্দিন, সিরাজুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী, কুদ্দুস পাটোয়ারী, শাহাজান পাটোয়ারী, বলেন, ‘সরকার জরিপ করে জমির প্রকৃত মালিকদের চিহ্নিত করতে পারে, এতে দ্রুত সমস্যার সমাধান সম্ভব।’
রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহবায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম মিঠু বলেন, ‘গত ৭ এপ্রিল উত্তর চরবংশী ইউনিয়নে হামলা, সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার ঘটনায় জড়িত দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি দল থেকে তাদের আজীবন বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। উপজেলা বিএনপি ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর যৌথ সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং তাৎক্ষণিকভাবে তা কার্যকর করা হয়েছে। বহিষ্কৃতরা হলেন, উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি কর্মী মেহেদী কবিরাজ, ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি এবাদ উল্যা গাজী, ইউনিয়ন বিএনপি নেতা ও হত্যা মামলার প্রধান আসামি ফারুক কবিরাজ, ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সফিক রাড়ী, ৮ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি আরিফ, ৭ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দল কর্মী ফারুক গাজী ও রায়হান, ৬ নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দল কর্মী আল আমিন কবিরাজ, ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মানিক আহমেদ তারেক, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ওমর আলী হাওলাদার, কর্মী নজরুল ইসলাম, ইউনিয়ন যুবদল কর্মী শরিফ বাগ, শাহজাহান মাঝি এবং ইউনিয়ন কৃষকদলের সদস্য সচিব শাহ আলী।’
তিনি আরও বলেন, ‘বহিষ্কৃতদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা বা উঠাবসা করার ব্যাপারে নেতাকর্মীদের নিষেধ করা হয়েছে। নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
রায়পুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহেদ আরমান বলেন, ‘বরিশাল ও লক্ষ্মীপুর জেলার সীমানা জটিলতা, জরিপ না হওয়া এবং মামলা-মোকদ্দমার কারণে এসব জমি বন্দোবস্ত দেওয়া যাচ্ছে না।’
রায়পুর থানার ভারপাপ্ত কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন ভুঁইয়া জানান, এ পর্যন্ত সংঘর্ষের ঘটনায় ৪টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৯ জনকে। কেউ কেউ উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হয়েছেন। পুলিশের নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।
সহকারী পুলিশ সুপার (রায়পুর-সার্কেল) জামিলুল হক বলেন, ‘পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আছে। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে পুলিশি টহল জোরদার করা হয়েছে।’
রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন ত কর ম দ র ব এনপ র স ল ইসল ম স ঘর ষ র দখল উৎপ দ র ঘটন দখল র
এছাড়াও পড়ুন:
কলকাতায় ‘পার্টি অফিস’ খুলে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম, চলছে কীভাবে
কলকাতা লাগোয়া উপনগরীটাতে শয়ে শয়ে বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স, রাত-দিন লাখ লাখ মানুষের ভিড় সেখানে।
ব্যস্ত এই এলাকায় একটি বাণিজ্যিক কমপ্লেক্সে এমন কয়েকজন যাতায়াত করছেন, যাঁদের কয়েক মাস আগেও সেখানে দেখা যেত না।
ওই বাণিজ্যিক পরিসরে যাতায়াত করেন, এমন বেশির ভাগই চেনেন না এই নবাগতদের। চেনার কথাও নয়।
তবে এঁদের অনেকেই মাত্র এক বছর আগেও বাংলাদেশের সব থেকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তাঁরা আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ ও মধ্যম স্তরের নেতা।
তাঁরা যে বাণিজ্যিক কমপ্লেক্সটিতে যাতায়াত করছেন কয়েক মাস ধরে, সেখানেই ‘দলীয় দপ্তর’ খুলেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
এই ‘পার্টি অফিস’টি নতুন।
এর আগে, ২০২৪ সালের পাঁচই আগস্ট শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছাড়ার পরের কয়েক মাসে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যাঁরা ভারতে অবস্থান করছেন, তাঁরা নিজেদের মধ্যে ছোটখাটো বৈঠক বা দলীয় দপ্তরের কাজকর্ম চালাতেন নিজেদের বাসাবাড়িতেই।
বড় বৈঠকগুলি অবশ্য করতে হতো কোনো রেস্তরা বা ব্যাঙ্কয়েট হল ভাড়া করে।
সে কারণেই একটা নির্দিষ্ট ‘পার্টি অফিস’-এর দরকার ছিল বলে জানাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
কীরকম সেই ‘পার্টি অফিস’
বাণিজ্যিক পরিসরটির পেছনের দিকের ভবনটির আট তলায় লিফট দিয়ে উঠে বাঁ দিকে গেলেই সার দিয়ে বাণিজ্যিক সংস্থার দপ্তর। করিডরের দুদিকে হালকা বাদামি রঙের একের পর এক দরজা। তার মধ্যেই একটিতে আওয়ামী লীগের পার্টি অফিস।
শুধু বাইরে কেন, পাঁচ শ বা ছয় শ স্কয়ার ফুটের ঘরটিতে উঁকি মারলেও কেউ বুঝতে পারবেন না যে, এই ঘরটির সঙ্গে কোনোভাবে আওয়ামী লীগ জড়িত আছে।
কোনো সাইন বোর্ড, শেখ হাসিনা অথবা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ছবি কোথাও নেই ঘরটির বাইরে বা ভেতরে।
আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বা নেত্রীর কোনো ছবি, সাইনবোর্ড কোনো কিছুই আমরা রাখিনি খুবই সচেতনভাবে। আমরা চাইনি যে, এই ঘরটার পরিচিতি প্রকাশ করতে। এমনকি একটা দলীয় দপ্তরে যেসব ফাইল ইত্যাদি থাকে, সেসবও এখানে রাখা হয় না। নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ, বৈঠক ইত্যাদির জন্য একটা ঘর দরকার ছিল, এটা পাওয়া গেছে। এটাকে আমরা পার্টি অফিসই বলি, কিন্তু আদতে এটা একটা বাণিজ্যিক অফিস। আগে যে সংস্থা কাজ করত এখানে, তাদেরই ছেড়ে যাওয়া চেয়ার, টেবিল এসবই আমরা ব্যবহার করি।
আওয়ামী লীগের এই নেতাই জানালেন, ৩০-৩৫ জনের বৈঠক এই দপ্তরেই হয়ে যায়। কিন্তু একটু চাপাচাপি করে বসতে হয়। ছোটখাটো বৈঠক বিভিন্ন নেতাদের বাসাবাড়িতে এখনো হয়। তবে বড় বৈঠকগুলো, যেখানে শ দুয়েক নেতা-কর্মী হাজির হওয়ার কথা, সেরকম বৈঠকের জন্য কোনো ব্যাঙ্কয়েট হল বা কোনো রেস্তোরাঁর একটি অংশ ভাড়া নিয়ে নেওয়া হয়।
কারা যাতায়াত করেন ‘পার্টি অফিসে’
গত বছরের পাঁচই আগস্টের পর বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে আসা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলির অনেক শীর্ষ নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী কলকাতা বা তার আশপাশের অঞ্চলে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন।
এর বাইরে বিভিন্ন পেশাজীবী, সরকারি কর্মচারী, পুলিশ কর্মকর্তা ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারাও চলে এসেছেন ভারতে। মাস ছয়েক আগে আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানিয়েছিল যে, অন্তত ৭০ জন সাবেক সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন জেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, সাবেক মেয়রসহ শীর্ষ নেতৃত্বের প্রায় দুশোজন কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলে থাকছেন।
এঁদের কেউ সপরিবারে থাকেন। আবার কোথাও একসঙ্গে কয়েকজন মিলেও একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন। কারও পরিবার মাঝে মাঝে বাংলাদেশ থেকে এসেও কিছুদিন কাটিয়ে যায়।
আওয়ামী লীগের এক নেতা বলছিলেন, এখন যে সংখ্যাটা খুব বেশি বেড়েছে, তা নয়। দ্বাদশ সংসদের ৮০ জনের মতো সংসদ সদস্য এবং তারও আগে সংসদ সদস্য ছিলেন—এমন ১০-১২ জন নেতা আছেন এখানে। আবার এমনও কয়েকজন এসেছেন, যারা কলকাতায় এসে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা অন্যান্য দেশে চলে গেছেন।
সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারাও থাকেন কলকাতার আশপাশেই।
কলকাতা বা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আওয়ামী লীগের যে শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বাস করছেন, তাঁদের প্রায় সবাই ‘পার্টি অফিসে’ যাতায়াত করে থাকেন।
আওয়ামী লীগের ওই নেতা বলছিলেন, তবে অফিস খোলার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। যেরকম প্রয়োজন, সেরকমই আসেন নেতারা। আবার রোজই যে সবাই আসেন, তাও নয়। আসলে প্রয়োজনীয়তা ছিল একটা নির্দিষ্ট জায়গা গড়ে তোলা, সে জন্যই এই পার্টি অফিস।
আওয়ামী লীগের এই নতুন পার্টি দপ্তরের ব্যাপারে ওই বাণিজ্যিক পরিসরে যাতায়াত করা সাধারণ মানুষ যে কিছু জানবেন না, সেটাই স্বাভাবিক।
দলেরও কোন স্তরের নেতা-কর্মীরা এই দপ্তরের ব্যাপারে কতটা জানেন, সেটা জানা যায়নি।
কিন্তু এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, ভারতীয় গোয়েন্দারা এই দপ্তরের ব্যাপারে জানেন। এবং ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ স্তরের অনুমোদন ছাড়া এই দলীয় দপ্তর থেকে আওয়ামী লীগের কাজকর্ম চলতে পারত না।
যেভাবে দল চলছে এক বছর ধরে
গত এক বছরের কিছুটা কম সময় ধরে ভারত থেকেই আওয়ামী লীগ পরিচালিত হচ্ছে। দলটির নেত্রী শেখ হাসিনা দিল্লির কাছাকাছি কোথাও থাকেন, আর বড় অংশ থাকেন কলকাতা সংলগ্ন অঞ্চলে।
তবে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলছিলেন, ‘এই ধারণাটা ঠিক নয় যে, ভারত থেকে দল চলছে। মূল দল বা সহযোগী সংগঠনগুলোর কতজন নেতাইবা ভারত অথবা অন্যান্য দেশে রয়েছেন? বেশির ভাগ তো এখনো বাংলাদেশেই আছেন।’
কিন্তু দলের নেত্রী শেখ হাসিনা ও শীর্ষ নেতৃত্বের একটা বড় অংশ ভারতে আছেন বলে সেখান থেকেই যে রাজনৈতিক দিশা-নির্দেশ দেওয়া বা দলীয় অবস্থান চূড়ান্ত হবে, সেটাই স্বাভাবিক।
তবুও দুসপ্তাহ আগে পর্যন্তও শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সরাসরি দেখা হয়নি দল-নেত্রীর।
গত ৩১ জুলাই শীর্ষ নেতৃত্বের কয়েকজনকে দিল্লিতে এক বৈঠকে ডেকেছিলেন শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা ওই বৈঠকের বিষয়টি বিবিসি বাংলার কাছে নিশ্চিত করেছিলেন। তবে বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে, কোথায় বৈঠক হয়েছে, সে ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি ওই নেতারা।
দলের নেত্রীর সঙ্গে ওই বৈঠকটি ছাড়া এবং নিজেদের মধ্যে সশরীরে দেখা-সাক্ষাৎ ও বৈঠক ছাড়া দলটির বাকি সব কাজই চলে ভার্চুয়াল মাধ্যমে।
বিভিন্ন স্তরের নেতা কর্মীদের জন্য আলাদা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, টেলিগ্রাম গ্রুপ ইত্যাদি গড়া হয়েছে। এ ছাড়া নিয়মিতই লাইভ অনুষ্ঠান করে থাকে দলটি। এ রকম লাইভ অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝেই যোগ দেন শেখ হাসিনা নিজেও।
সেসব আলোচনায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা যেমন হয়, তেমনই আবার মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মী—যাঁরা বাংলাদেশেই থেকে গেছেন, তাঁদের নির্দেশনাও দেওয়া হয়ে থাকে।
সাবেক সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ বলছিলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের ফলে আমরা ভার্চুয়াল মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারছি। তাঁদের মতামত জানতে পারছি। কী করণীয় সে ব্যাপারে নির্দেশনা দিতে পারছি।’
পঙ্কজ দেবনাথ আরও বলছিলেন, ‘এই ভার্চুয়াল মাধ্যমে বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে তরুণ প্রজন্মের। কোনো একটা ব্যবস্থা বদলানোতে এই তরুণ প্রজন্মের বড় ভূমিকা থাকে। আমরা ভার্চুয়াল মাধ্যমে তাদের কাছেই পৌঁছানোর চেষ্টা করছি।’
কর্মীরা দেশে মার খাচ্ছেন, নেতারা কেন ভারতে
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে মাঝে মাঝেই এই প্রশ্ন ওঠে যে, আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা যখন দেশে মার খাচ্ছেন, গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যাচ্ছেন, তখন শীর্ষ নেতৃত্বের একটা বড় অংশ কেন ভারতে পালিয়ে আছেন।
সাবেক সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ বলছিলেন, ‘এই প্রশ্ন ওঠা যে খুব অযৌক্তিক, তা নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ১৯৭১-এ যদি তখনকার নেতৃত্ব ভারতে চলে এসে প্রবাসী সরকার গঠন না করতেন, তাহলে কি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব হতো? আমি ৭১-এর সঙ্গে তুলনা করছি না বর্তমান সময়ের, কিন্তু এ রকম উদাহরণ আমাদের দেশেও রয়েছে। অন্যান্য দেশেও আছে যে, বিদেশ থেকে দল পরিচালনা করে শক্তি সঞ্চয় করে দেশে ফিরে ক্ষমতা দখল করেছেন নেতারা। পাকিস্তানে নওয়াজ শরিফ বা বেনজির ভুট্টো বলুন বা আমাদের দেশের তারেক রহমান। সবাই তো বিদেশ থেকেই দল পরিচালনা করেছেন বা এখনো করছেন।’
পঙ্কজ দেবনাথের প্রশ্ন, ‘দেশে থাকলে হয় জেলে থাকতে হতো, মেরেও ফেলতে পারত। কিন্তু তাহলে আমাদের যে রাজনৈতিক কাজকর্ম—বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরা, দলকে আবারও সংগঠিত করা—সেগুলো কি আমরা করতে পারতাম?’
নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক আলোচনা
ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ নেতারা দলের নেত্রীর সঙ্গে আলোচনাক্রমেই দলের রাজনৈতিক অবস্থান ঠিক করেন।
যখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তার প্রথম বর্ষপূর্তি পালন করছে, সেই সময়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকারের ‘ব্যর্থতা’গুলোকেই তুলে ধরার অবস্থান নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন প্রচার করেছিল এই সরকার, তাতে তারা গত এক বছরে সব দিক থেকেই ব্যর্থ হয়েছে। অর্থনীতি ফেইল করেছে, বিচারব্যবস্থা প্রহসনে দাঁড়িয়েছে। আর সবক্ষেত্রেই তাদের ব্যর্থতার জন্য তারা শেখ হাসিনা আর ভারতের ওপরে দায় চাপাতে ব্যস্ত। একটা যেন ইন্ডিয়া ফোবিয়া, হাসিনা ফোবিয়া হয়ে গেছে তাদের।’
ওবায়দুল কাদের আরও বলছিলেন, ‘এক বছর পরে তাদের নিয়ে সেই উন্মাদনা কিন্তু আর নেই। তাদের মুখের কথায় মানুষ আর বিশ্বাস করতে পারছে না, বিভ্রান্ত হচ্ছে না। সবাই বাস্তবতার নিরিখে মূল্যায়ন করছে সরকারের। তাদের এই ব্যর্থতার জন্য বহু মানুষ বলছেন শেখ হাসিনার সময়েই ভালো ছিলাম।’
নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের সভাপতিও ভারতে
বাংলাদেশে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ভারতে অবস্থান করছেন গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে।
সাদ্দাম হোসেন বলছিলেন, ‘গত এক বছর ধরে ক্যাম্পাসটা খুব মিস করি। দেশে থাকলেও যে গত এক বছরে ক্যাম্পাসে যেতে পারতাম, তা নয়।’
ছাত্রলীগের সভাপতি বলছিলেন, ‘হাজার হাজার ছাত্রলীগের কর্মী-সমর্থক তারা তো দেশে থেকেও ক্যাম্পাসে যেতে পারছেন না এক বছর ধরে। তাদের ক্লাস করতে দেওয়া হয় না, তারা পরীক্ষা দিতে পারেন না, পাশ করলেও সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে না। এদের সবার শিক্ষাক্রমটাই শেষ করে দেওয়া হয়েছে।’
সাদ্দাম হোসেন আরও বলছিলেন, ‘এটা যে শুধু ছাত্রলীগের কর্মীদের সঙ্গে করা হচ্ছে, তা নয়। আওয়ামী লীগ করেন বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, এমন পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেও এই একই ঘটনা হচ্ছে। শুধু যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে হচ্ছে, তাও নয়। এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারেনি বহু ছাত্রছাত্রী—শুধুমাত্র তারা আওয়ামী লীগ ঘরানার পরিবারের সন্তান বলে।’
অর্থায়ন কীভাবে হচ্ছে
ভার্চুয়াল মাধ্যমে দলীয় প্রচার-প্রচারণার জন্য খুব বেশি অর্থের প্রয়োজন হয় না ঠিকই, কিন্তু খরচ তো আছে।
আবার যেসব নেতা-কর্মীরা ভারতে অবস্থান করছেন, তাঁদের ব্যক্তিগত খরচও চালাতে হয়। কীভাবে সেসবের জন্য অর্থের সংস্থান হচ্ছে?
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বিবিসিকে বলেছেন, দেশে-বিদেশে থাকা শুভাকাঙ্খীরাই তাঁদের খরচ চালাচ্ছেন।
দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কথায়, ‘সাংগঠনিকভাবে আগস্টের পরে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে, সেই অন্ধকার অতিক্রম করা কঠিন কাজ। যেসব নেতা-কর্মী দেশে বা বিদেশে আছেন, তাঁরাই এই দুঃসময়ে এগিয়ে আসছেন, অর্থ সাহায্য করছেন। কর্মীরা এখানে কষ্ট করেই আছেন, তবে মনোবলই আমাদের সম্বল।’
আরেক নেতা নাম উল্লেখ না করার শর্তে বলছিলেন, দেশ থেকে তাঁর পরিবার-পরিজন ও সহকর্মীরা প্রয়োজনমতো অর্থ পাঠিয়ে দেন।
পঙ্কজ দেবনাথ বলছিলেন, ‘তবে এই এক বছরে আমাদের জীবনযাত্রায় অনেক পরিবর্তন আনতে হয়েছে।
পঙ্কজ দেবনাথের কথায়, ‘আমরা যে এখানে মানবেতর জীবনযাপন করছি, বা ৭১-এর যুদ্ধের সময়ের মতো শরণার্থীশিবিরে থাকছি, তা নয়। কিন্তু আমাদের মধ্যে যাদের মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত জীবনযাত্রা ছিল, সে সবই পরিবর্তন করতে হয়েছে। যারা ঢাকায় হয়তো গাড়ি ছাড়া চলতেন না, তাদের এখন কলকাতার গণপরিবহন ব্যবহার করতে হচ্ছে।’
পঙ্কজ দেবনাথ বলছিলেন, ‘যেমন আমি একটি ফ্ল্যাটে আরও তিনজনের সঙ্গে থাকি। বাসে, ট্রেনে বা মেট্রোরেলে যাতায়াত করি। আবার সহকর্মীদের মোটরসাইকেল বা বাইকেও চেপে ঘোরাঘুরি করি। যদি কয়েকজন মিলে একসঙ্গে কোথাও যেতে হয়, তখন হয়তো ট্যাক্সিতে উঠলাম। ভাড়াটা ভাগাভাগি করে নিলে গায়ে লাগে না। আসলে সঞ্চিত অর্থে যতটা স্বল্প খরচে চলা যায়।’
কিন্তু কত দিন থাকবেন তাঁরা দেশ ছেড়ে?
ওবায়দুল কাদের বলছেন, ‘দিনক্ষণ ঠিক করে ওভাবে তো রাজনৈতিক লড়াই হয় না, আবার লড়াই ছাড়া উপায়ও নেই।’
অমিতাভ ভট্টশালী, বিবিসি নিউজ বাংলা, কলকাতা