ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে হযবরল অবস্থা
Published: 4th, May 2025 GMT
দেশের বেসরকারি খাতের অর্ধেকের বেশি ব্যাংকের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন আটকে গেছে। ফলে এসব ব্যাংক আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে পারছে না, আবার লভ্যাংশও ঘোষণা করতে পারছে না। আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মনীতি পরিপালন করতে গিয়ে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ কারণে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ২১টি কোম্পানি আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে সভা ডেকেও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ফলে আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন ছাড়া কিছু ব্যাংকের সভা শেষ হয়েছে। আর কিছু ব্যাংক পর্ষদ সভা বাতিল করেছে।
একই অবস্থা রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোরও। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোনো কোনো ব্যাংক আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি পায়নি। আবার কোনো কোনো ব্যাংককে অনাপত্তি দেওয়ার পর শেষ মুহূর্তে সেটি প্রত্যাহার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে শেষ মুহূর্তে এসে কিছু ব্যাংকের পর্ষদ সভা বাতিল হয়ে যায়। শেয়ারবাজারের নিয়ম অনুযায়ী, আর্থিক বছর শেষ হওয়ার সর্বোচ্চ চার মাসের মধ্যে আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে হয়। সেই হিসাবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর এপ্রিলের মধ্যে গত বছরের আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার কথা। গত ডিসেম্বরে এসব ব্যাংকের আর্থিক বছর শেষ হয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী, আর্থিক বছর শেষ হওয়ার চার মাসের মধ্যে আর্থিক হিসাব চূড়ান্ত করে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ ঘোষণা করতে হয়। কিন্তু তালিকাভুক্ত বেশির ভাগ ব্যাংকের ক্ষেত্রে এবার সেটি হয়নি। এ কারণে তালিকাভুক্ত ৩৬ ব্যাংকের মধ্যে ১৬টি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পেরেছে।
জানা যায়, গত মার্চে ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ ঘোষণাসংক্রান্ত নতুন নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে বলা হয়, নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে বা যথাযথ প্রভিশনিংয়ে ব্যর্থ যেসব ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিলম্ব সুবিধা নিয়েছে, তারা ২০২৪ সালের জন্য কোনো লভ্যাংশ দিতে পারবে না। এই শর্তের বেড়াজালে আটকে গেছে বেশির ভাগ ব্যাংকের লভ্যাংশ। এ ছাড়া গত ৫ আগস্টের পর মালিকানা-ব্যবস্থাপনা পরিবর্তিত হওয়া ব্যাংকগুলোর লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ, নিরাপত্তা সঞ্চিতিসহ আর্থিক বিভিন্ন সূচকের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বনিবনা হয়নি। এ কারণে এসব ব্যাংক আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে পারছে না। ফলে আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোতে হযবরল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সময়ে প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক নেতা তাঁর মালিকানায় থাকা ব্যাংকের ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে চাপ দিয়েও সমস্যার কোনো সুরাহা করতে পারেনি। ফলে ওই ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদনও ঝুলে গেছে। এর আগে সময়মতো আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে না পারায় অনেক ব্যাংক জরিমানার মুখেও পড়েছে। এবার বেশি সংখ্যক ব্যাংক নির্ধারিত সময়ে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে না পারায় এ জন্য সরকারের কাছে চিঠি দিয়ে বাড়তি সময় চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে ক্ষেত্রে সরকারের কাছ থেকে আইনি ছাড় দেওয়ার অনুমোদন পেলে এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকগুলোর বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদনের সময় শেষ হয়ে গেছে। এখন সরকারের অনুমতি পেলে এসব ব্যাংককে বাড়তি সময় দেওয়া হবে। এ জন্য সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আটকে গেছে কোন ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মে, প্রতিটি ব্যাংকের পুরো বছরের কার্যক্রম পরিদর্শন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে ব্যাংকগুলো নিজেরা ও বাইরের নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক কার্যক্রম নিরীক্ষা করে থাকে। এতে ব্যাংকটির প্রকৃত খেলাপি ঋণের পাশাপাশি সব ধরনের আর্থিক তথ্য পাওয়া যায়। এরপর ব্যাংক, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ ব্যাংক মিলে আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে। তার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলো কত লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারবে, তার সীমা নির্ধারণ করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, এবার দীর্ঘদিন পর পেশাদারত্বের সঙ্গে ব্যাংক পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর অনেক প্রকল্প পরিদর্শনে যান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়। এসব ব্যাংকের বেশির ভাগ লোকসানে চলে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংকের বেশির ভাগই লোকসান চলে গেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নিয়ন্ত্রণে থাকা আইএফআইসি ব্যাংক, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ইউসিবি ব্যাংক ও ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের এক্সিম ব্যাংক, এনআরবি ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকও সমস্যায় পড়েছে। এসব ব্যাংকঋণ অনিয়মের নানা ঘটনা রয়েছে।
এর বাইরে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ঢাকা ব্যাংক, এবি ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে পারেনি। এর মধ্যে প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘বুধবার পরিচালনা পর্ষদের সভায় ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন হওয়ার বিষয়টি এজেন্ডাভুক্ত ছিল। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনাপত্তি পেলেও সভা শুরুর পর জানতে পারে আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করা যাবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনাপত্তিপত্র ফেরত দিতে বলেছে। ফলে সভাটি আর হয়নি।’
এ ছাড়া রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, জনতা, রূপালী, অগ্রণী, বেসিক, বিডিবিএলসহ কোনো ব্যাংক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে পারেনি।
চূড়ান্ত করেছে যেসব ব্যাংক
এদিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৬ ব্যাংকের মধ্যে সিটি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ডাচ্–বাংলা, ব্যাংক এশিয়া, ইস্টার্ন ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী, ট্রাস্ট ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে। এর মধ্যে ১০ ব্যাংকের মুনাফা কমেছে ও ৫ ব্যাংকের বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অনেক দিন পর ব্যাংকগুলোর প্রকৃত অবস্থা বেরিয়ে আসছে। আগে ব্যাংকগুলো মুনাফা বেশি দেখাতে বা লোকসান কম দেখাতে নানা কৌশল নিত। এখন সেই সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর দেশের বাইরে থাকায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণও আটকে যায়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন চ ড় ন ত কর শ য় রব জ র আর থ ক ব এসব ব য সরক র র ল ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দলও কি স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে
১৫ বছর ধরে অনেক ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল আর সংগঠন মিলে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করে আসছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে শেখ হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসেন।
এর ফলে হাসিনা সরকারের পতন হয় ও তিনি এবং তাঁর দলের কর্মীরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এ পরিবর্তন শুধু একটা সরকারের পরিবর্তন নয়, বরং দীর্ঘ সময়ের ভয় ও দমনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের সাহস, আশা ও গণতান্ত্রিক চেতনার একটি বড় জয় ছিল।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়, কিছু গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দল এই আন্দোলনের সফলতাকে শুধু নিজের নামে দাবি করতে শুরু করে। কেউ কেউ বলতে থাকে, তাদের কারণেই সরকার পতন ঘটেছে। তাই তারাই ভবিষ্যতে ক্ষমতার একমাত্র ভাগীদার।
আবার কিছু ধর্মীয় বা আদর্শিক গোষ্ঠী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করছে, যারা আগে প্রকাশ্যে তেমন সক্রিয় ছিল না। এ ছাড়া কিছু নতুন দল, যারা আগে রাজনীতিতে খুব একটা পরিচিত ছিল না, তারাও হঠাৎ করে সামনে চলে এসেছে। তারা নিজেদের ‘নতুন শক্তি’, ‘ভিন্নধারার দল’ হিসেবে উপস্থাপন করে, কিন্তু তাদের আচরণে কখনো কখনো পুরোনো রাজনীতির কৌশলই দেখা যায়।
আরও পড়ুনশেখ হাসিনা স্বৈরশাসকদের টিকে থাকার দুটি মূলমন্ত্রেই ব্যর্থ২২ আগস্ট ২০২৪এই আন্দোলনের সময় বিভিন্ন গোষ্ঠী একসঙ্গে থাকলেও আন্দোলনের পর তারা নিজেদের অবস্থান ঠিক করতে গিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ আবার নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার হিসাব-নিকাশ করছে। এতে আন্দোলনের মূল চেতনা—জনগণের অধিকার, গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেন ধীরে ধীরে পেছনের দিকে চলে গেছে।
এ বাস্তবতায় প্রশ্ন ওঠে, যাঁরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁরাই কি আবার ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গিয়ে নতুন একধরনের স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দেবেন?
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। ৫ আগস্ট, ২০২৪