খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ৭৪ দিন পর আজ রোববার একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শিক্ষকেরা ক্লাসে ফেরেননি। শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় জড়িত শিক্ষার্থীদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা ক্লাসে ফিরবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে কবে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরোদমে ক্লাস শুরু করা সম্ভব হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

এর আগে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে পরিস্থিতির অবনতি হলে ২৫ ফেব্রুয়ারি সিন্ডিকেটের আরেকটি সভায় অনির্দিষ্টকালের জন্য একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়। গত ৪ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় পুনরায় আজ থেকে সব শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর সিদ্ধান্ত হয়।

১৮ এপ্রিল কুয়েট শিক্ষক সমিতি সাধারণ সভায় শিক্ষকদের লাঞ্ছিতকারী ব্যক্তিদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষকেরা ক্লাসে ফিরে যাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই সাধারণ সভায় অধ্যাপক আবদুল্লা আল ফারুককে সভাপতি করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিকে শিক্ষকদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা ও তাঁদের নিয়ে সাইবার বুলিংয়ের প্রতিটি ঘটনার তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

কুয়েটের শিক্ষকেরা জানান, ১৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সংঘর্ষে কুয়েটের অনেক শিক্ষার্থী আহত হন। ওই দিন বিকেল থেকে পরদিন বিকেল পর্যন্ত কুয়েটের মেডিকেল সেন্টারে বিদায়ী উপাচার্য মুহাম্মদ মাছুদকে অবরুদ্ধ করে রাখেন কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী। তাঁরা বিদায়ী উপাচার্যসহ কয়েকজন শিক্ষককে মারধর, লাঞ্ছিত ও গালাগাল করেন। পরবর্তী দুই মাস আন্দোলন চলাকালে কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী শিক্ষকদের নিয়ে কটূক্তি করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি সংঘর্ষের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত শেষে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষকদের ক্লাস বর্জনের সিদ্ধান্ত বহাল আছে।

আরও পড়ুনঅনশন ভাঙলেন কুয়েটের শিক্ষার্থীরা, ক্যাম্পাসে উল্লাস২৩ এপ্রিল ২০২৫

কুয়েট শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ফারুক হোসেন বলেন, ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী এবং ভিসিসহ শিক্ষকদের লাঞ্ছনাকারী ব্যক্তিদের সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা একাডেমিক কার্যক্রমে ফিরবেন না।

কুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক আবদুল্লাহ ইলিয়াছ আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সবার সঙ্গে বসছেন। গতকাল ডিনসহ বিভিন্ন দায়িত্বশীলদের সঙ্গে বসেছেন, আজ কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সঙ্গে বসছেন, এ রকম বিভিন্ন ফোরামের সঙ্গে বসছেন। এভাবে একটা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। মোট কথা, নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত ভিসি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

আরও পড়ুনঅভিভাবকশূন্য কুয়েট, নতুন প্রশাসনের কাছে প্রত্যাশা নিয়ে আলোচনায় শিক্ষার্থীরা২৬ এপ্রিল ২০২৫

১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। পরদিন শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনসহ সব একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন। ওই দিন দুপুরে সিন্ডিকেট সভায় কুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি সব আবাসিক হল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

এরপর আবাসিক হল খুলে দেওয়ার দাবিতে ১৩ এপ্রিল বিকেল থেকে শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেন। একপর্যায়ে তাঁরা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করেন। ওই আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও সহ–উপাচার্যকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ১ মে অন্তর্বর্তী উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক হজরত আলী।

আরও পড়ুনকুণ্ডেরচরের বাস্তুহীন মানুষের প্রতিনিধি হযরত আলী ২৮ জুলাই ২০২৪.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ক ষকদ র ১৮ ফ ব র উপ চ র য

এছাড়াও পড়ুন:

ঝলমলে পর্দার নেপথ্যে রক্ত-ঘাম: মনিরের মৃত্যু ও স্টান্টম্যানদের ব

রুপালি পর্দার ঝলমলে আলোয় যখন দর্শকরা ‘ডিসুম ডিসুম’ ফাইট আর বহুতল ভবন বা বিশাল সেতু থেকে লাফানোর দৃশ্য দেখে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন, তখন খুব কম মানুষই প্রশ্ন করেন, এই সাহসিকতার আসল নায়ক কে। পর্দায় যেসব ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্যে তারকাদের দেখা যায়, আসলে তা ঝুঁকি নিয়ে বাস্তবায়ন করেন একজন স্টান্টম্যান। এসব দৃশ্যের প্রকৃত নায়ক নেপথ্যের এই মানুষগুলো।

রাজশাহীতে বহুল প্রতীক্ষিত ‘তাণ্ডব’ সিনেমার শুটিং সেটে ঘটে গেল এক বেদনাবিদূর ঘটনা। অভিজ্ঞ স্টান্টম্যান মনির হোসেন শুটিং চলাকালে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এই নীরব যোদ্ধার মৃত্যু যেন বাংলা সিনেমার স্টান্টম্যানদের দুঃখ-বেদনার চিত্রকে আরো একবার জনসমক্ষে টেনে আনল।

মনির হোসেন ছিলেন সেই মানুষ, যে দর্শকদের রোমাঞ্চকর অনুভূতি দিতে গিয়ে পর্দার পেছনে নিজের জীবন বাজি রাখতেন। নায়করা বাঁচতেন, দর্শকরা উল্লাস করতেন, কিন্তু মনির হোসেনের মতো মানুষেরা থেকে যান নীরবে! তার মৃত্যু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, নায়কদের সুরক্ষা দিতে গিয়ে প্রকৃত নায়কেরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।

আরো পড়ুন:

উর্দু ভাষায় পাকিস্তানে মুক্তি পাচ্ছে বাংলাদেশের ‘জংলি’

মেট গালার লাল গালিচায় হাঁটবেন শাহরুখ, উড়ে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে

এই ঘটনা মনে করিয়ে দেয়, আরেক স্টান্টম্যান আমিনুলের জীবনযুদ্ধের গল্প। নব্বইয়ের দশকে ঢাকায় এসে তিনি ফাইট গ্রুপে কাজ শুরু করেন। সুঠাম দেহ আর সাহসিকতার কারণে দ্রুত হয়ে ওঠেন ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্যের অপরিহার্য নাম। প্রায় ৪০-৫০টি সিনেমায় স্টান্টম্যান এবং আরো ৭০টি সিনেমায় ফাইট দৃশ্যে অভিনয় করেন। কিন্তু ২০১৪ সালে শাকিব খান প্রযোজিত ‘হিরো দ্য সুপার স্টার’ সিনেমার শুটিংয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হন। জাম্প দিতে গিয়ে ঘাড়ে আঘাত পান এবং সেখানেই তার জীবন থমকে যায়। হাসপাতালের বিল সেই সময় শাকিব খান দিলেও, এরপরের প্রতিদিনের ব্যয় আর জীবনযুদ্ধে আমিনুল একাই লড়েছেন। এফডিসির প্রতিশ্রুতি অপূর্ণ রয়ে যায়, আর বাচ্চার দুধ কেনার টাকাও জোগাড় করতে পারতেন না তিনি।

বাংলাদেশের সিনেমা শিল্পে স্টান্টম্যানদের জন্য নিরাপত্তা বলতে গেলে নেই বললেই চলে! উন্নত বিশ্বে যেখানে তাদের ইনস্যুরেন্স, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক, আমাদের দেশে এখনো এসবের ঘাটতি প্রকট। মনির হোসেন অসুস্থ হলেও কাউকে কিছু না বলে শুটিং চালিয়ে গেছেন। আর এটাই হয়তো তার জীবনের জন্য মারাত্মক হয়ে দাঁড়াল।

এই সাহসী মানুষদের কাজের স্বীকৃতি বাংলা সিনেমায় নেই বললেই চলে। দর্শক যখন নায়কের অ্যাকশন দৃশ্যে উল্লসিত, তখন খুব কমজনই ভাবেন এই দৃশ্যের নেপথ্যে কারা ছিলেন। আজও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে স্টান্টম্যানদের জন্য কোনো আলাদা বিভাগ নেই। তাদের প্রতি এই অবজ্ঞা শুধু সামাজিক নয়, প্রাতিষ্ঠানিকও।

অভাব-অনটন যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। কোটি টাকা বাজেটের সিনেমায় যেখানে নায়ক-নায়িকারা ৩ লাখ থেকে কোটি টাকা পারিশ্রমিক পান, সেখানে একজন স্টান্টম্যান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পান খুবই সামান্য পারিশ্রমিক। কাজও প্রতিদিন থাকে না, দুর্ঘটনা হলে সহায়তা তো দূরের কথা, অনেকে পঙ্গু হয়ে ঘরে বসে আছেন অর্থাভাবে। ঝলমলে আলোর পেছনে এই মানুষদের জীবন সত্যিই অন্ধকারে ঢাকা।

বাংলাদেশে এখনো কোনো পেশাদার স্টান্ট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই। ফলে যারা এই পেশায় আসেন, তারা নিজেদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে হাতে-কলমে শেখেন। এই ঘাটতি তাদের ঝুঁকিকে আরো বাড়িয়ে দেয়। মনিরের ঘটনা শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, এটা পুরো ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটি সতর্কবার্তা। সময় এসেছে স্টান্টম্যানদের জন্য বাধ্যতামূলক ইনস্যুরেন্স, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়ার। পাশাপাশি, তাদের কাজের স্বীকৃতি দিতে জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার চালু করা জরুরি।

এই নেপথ্যের নায়কেরা যদি নিরাপদ থাকেন, তবে রুপালি পর্দার ঝলক আরো দীপ্তিমান হবে। তাদের জন্য চাই নিরাপত্তা, সম্মান, চাই জীবনের নিশ্চয়তা। না হলে মনির হোসেনের রক্ত-ঘামে ভেজা মাটিতে আরো জীবন অনাদরে হারিয়ে যাবে। এখনই সময় নেপথ্যের নায়কদের সামনে আনার।

ঢাকা/শান্ত

সম্পর্কিত নিবন্ধ