আজ রোদের ঝাঁজ নেই। বৃষ্টির সম্ভাবনাও কম। তবু সাফওয়ান সারাদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে বেড়ায় একটা রঙিন ছাতা মাথায় দিয়ে। রোদ হোক, মেঘ হোক ছাতা হাতে থাকেই। আজ মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই আকাশে; তবুও ছাতা। তার ব্যাগে বইপত্র, কাঁধে ঝোলানো পানির বোতল আর হাতে সেই বিশাল রঙিন ছাতা। সবাই ঠাট্টা করে, পেছন পেছন আওয়াজ করে– ‘ছাতা মিয়া আসছে! ছাতা মিয়া!’ সাফওয়ানের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে নীরবে হাঁটে নিজের মতো। যেন এই পৃথিবীতে তার কোনো তাড়া নেই, কোনো লজ্জা নেই, কোনো ব্যথা নেই।’
আজ ক্লাস শেষে ক্যান্টিনে বসে সাফওয়ান ছাতা খুলে সামনে রেখে ভেজা স্যান্ডউইচ কামড় দিচ্ছিল, তখনই এলো মিরাজ। মিরাজের হাতে দুই কাপ চা। একটা বাড়িয়ে দিল সাফওয়ানের দিকে। বলল– ভাইরে, সত্যি করে বল, ছাতাটা কিসের জন্য?
সাফওয়ান মুখ তুলে তাকাল, চোখেমুখে এক অদ্ভুত শান্তি। আস্তে বলল, স্মৃতি রক্ষা করি।
মিরাজ হাসল, কার স্মৃতি ছাতায়?
সাফওয়ান কিছু বলল না। এক চুমুকে চা শেষ করে উঠে পড়ল। সেই রঙিন ছাতা খুলে মাথার ওপর ধরল আর হাওয়ায় ভেসে ভেসে চলে গেল কলেজের গেটের দিকে।
মিরাজ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল। ছেলেটা এমন কেন?
পরের দিন সকালে আবার দেখা হলো। আজ ক্যান্টিনে ছিল রিমি। নতুন ছাত্রী। তার হাতে মোটা মোটা বই আর অগোছালো চুল। রিমি সাফওয়ানের পাশের টেবিলে বসে পড়ল। হঠাৎ তার কলম মেঝেতে পড়ে গেল। সাফওয়ান ছাতা হাতে রেখে নরম গলায় বলল, তোমার কলম।
রিমি মৃদু হাসল। বলল, থ্যাঙ্ক ইউ ছাতা ভাই।
সাফওয়ান লজ্জা পেল। এতদিন পরে কেউ তাকে এই নামে ডাকল না বিদ্রূপ করে। বরং এমনভাবে বলল যেন নামটা আদরের।
রিমি বলল, আপনার ছাতাটা খুব সুন্দর।
সাফওয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, এটা আমার দাদির ছাতা। দাদি মারা যাওয়ার সময় বলেছিলেন– ‘যখন খুব কষ্ট পাবে, এই ছাতা মাথায় দিও, ছায়া পাবে।’
রিমি চুপ করে গেল। ছেলেটার কথায় যেন বাতাসের ভেতর একটা নরম কষ্ট ছড়িয়ে পড়ল। তারপর থেকে রিমি প্রায়ই সাফওয়ানের পাশে বসত। কখনও ছাতা নিয়ে গল্প করত, কখনও নিজেদের বই বদলে নিত। মাঝেমধ্যে রিমি বলত, ছাতা নিয়ে চল আজ ইউনিভার্সিটির পেছনে বটগাছের নিচে বসি।
এভাবেই কেটে গেল মাস তিনেক। একদিন রিমি এলো না। পরদিনও না। তৃতীয় দিনও না। চতুর্থ দিনে খবর এলো– রিমির বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তাকে গ্রামের বাড়ি যেতে হয়েছে।
সাফওয়ান সারাদিন ছাতাটা বন্ধ করে হাতে রাখল। তার মাথার ওপর তখন রোদ্দুর পুড়ছিল, গরমে মাথা ঝিমঝিম করছিল, কিন্তু সে ছাতা খোলেনি। রিমির অনুপস্থিতি যেন তার মাথার ওপর কোনো ছায়া রাখতে পারছিল না।
আরও এক সপ্তাহ কেটে গেল।
হঠাৎ এক বিকেলে মেঘ করে বৃষ্টি এলো। পুরো ইউনিভার্সিটিতে সবাই ছুটছে কোনো ছাদের নিচে আশ্রয় নিতে। ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে সাফওয়ান ছাতা খুলে ধরেছে মাথার ওপর। ঠিক তখনই পেছন থেকে একটা কণ্ঠ– ছাতাটা আমার দিকে দেবে?
পেছন ফিরতেই দেখে, রিমি দাঁড়িয়ে, ভেজা চুল, ভেজা চোখ। সাফওয়ান ছাতাটা তার দিকে এগিয়ে দিল। দু’জন এক ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। বৃষ্টি ঝরছিল অবিরাম। রিমি বলল, আমাকে একটা ছায়া দেবে সারাজীবন?
সাফওয়ান মাথা নিচু করে বলল, আমার ছাতা আছে। ছাতা ভাগ করে নিলে দু’জনেই ছায়ায় থাকব। কান্নাভেজা চোখে হেসে উঠল রিমি।
কলেজের মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে দুটো মানুষ– এক রঙিন ছাতার নিচে নতুন এক গল্প বুনছিল।
সুহৃদ ঢাকা
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স হ দ সম ব শ স ফওয় ন ছ ত ম থ র ওপর স ফওয় ন র রঙ ন ছ ত
এছাড়াও পড়ুন:
অভিনয় থেকে দূরে প্রিয়দর্শিনী
একটা সময় ছিল, যখন তাঁর একটুখানি হাসি, চোখের দৃষ্টি কিংবা নিঃশব্দে ঘুরে যাওয়া চুলের ভঙ্গিমাও মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিত। নাম তাঁর মৌসুমী। ‘প্রিয়দর্শিনী’– এ নামটা যেন তাঁর জন্যই সৃষ্টি। শুধু অভিনয় দিয়ে নয়; নিজের ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্য এবং কোমল আচরণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন কোটি ভক্তের হৃদয়ের রানী।
মৌসুমী এখন আছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে। দুই বছর ধরে সেখানেই। মায়ের অসুস্থতা আর মেয়ের পড়াশোনার কারণে পরিবারকে সময় দিচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে পর্দায় দেখা মিলছে না তাঁর। ফলে ক্যামেরার ঝলক, শুটিং সেটের কোলাহল কিংবা মেকআপ রুমের আয়নায় প্রতিফলিত হয় না প্রিয়দর্শিনীর মুখ। তিনি আছেন শুধুই আপনজনের সঙ্গে– নীরবে, নিশ্চুপে। ওমর সানী– যিনি একসময় ছিলেন পর্দার নায়ক, বাস্তবে আছেন তাঁর জীবনসঙ্গী হয়ে। সম্প্রতি তিনি বললেন এক গভীর বিষাদের কথা, ‘মৌসুমী ভুলে যেতে চাইছে, সে কখনও মৌসুমী ছিল।’
ওমর সানীর এই কথায় আছে তীব্র এক নীরবতা। যে অভিনেত্রী একসময় সিনেমা হলের অন্ধকার ভেঙে আলো হয়ে উঠতেন, তিনিই আজ নিজেকে পেছনে সরিয়ে রাখছেন সময়ের গহ্বরে। সিনেমাকে ভালোবেসে এক জীবন কাটিয়ে দেওয়া সেই মৌসুমী কি তবে বিদায় নিতে চাইছেন? কারণ? একটা সময় আসে, যখন মানুষ নিজেকেই প্রশ্ন করে– আর কতদূর? কী পেলাম? আর কী চাই? মেয়ের পড়াশোনা, অসুস্থ মা, পরিবার– এসব হয়তো ‘উত্তর’ নয়, তবে ব্যাখ্যা।
তবু প্রশ্ন থাকে, এত সহজে কি বিদায় বলা যায়? একজন মৌসুমী কি হারিয়ে যেতে পারেন? তিনি তো শুধু একজন অভিনেত্রী নন; একসময়ের আবেগ, এক প্রজন্মের ভালোবাসা। নতুন প্রজন্ম হয়তো তাঁর নাম জানে, ছবিগুলো চেনে, কিন্তু অনুভব করে না তাঁর পর্দার উপস্থিতি। সেই সৌজন্যবোধ, সেই মায়া– সব যেন ধীরে ধীরে আটকে যাচ্ছে সময়ের ফ্রেমে। একজন বলেছিলেন, ‘যদি কোনো অভিনেতা তাঁর চরিত্রের চেয়েও বড় হয়ে ওঠেন, তবে সে-ই সত্যিকারের কিংবদন্তি।’ মৌসুমী ঠিক তেমনই একজন। ১৯৯৩ সালে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার মাধ্যমে যাঁর যাত্রা শুরু, তা থেমে থেমে নয়; বরং গানে, গল্পে, কান্নায় আর ভালোবাসায় ছিল পূর্ণ। সেই সিনেমায় সালমান শাহর পাশে দাঁড়িয়ে তিনি এক নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন।
এখন প্রশ্ন মৌসুমী কি কখনও চলে যেতে পারেন? তিনি তো আমাদের স্বপ্নের মতো সুন্দর। যারা মৌসুমীর সিনেমা দেখে বড় হয়েছেন, যারা আজও তাঁর পুরোনো ছবির গান শুনে একা রাতে জানালার বাইরে মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তাদের জন্য খবরটা যেন হারিয়ে যাওয়ার গল্প– একটা সময়ের, একটা আবেগের, একটা ভালোবাসার।
হয়তো এ বিরতিটা তাঁর প্রয়োজন ছিল। হয়তো তিনি আর ফিরবেন না। অথবা একদিন, হঠাৎ করেই আবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে বলে উঠবেন– ‘আমি ফিরেছি।’ যদি না-ই ফেরেন, তাহলেও মৌসুমী ঠিক যেখানে আছেন, সেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। স্মৃতির মণিকোঠায়, আলো-ছায়ার কল্পনায় আর কোটি ভক্তের ভালোবাসায়।