থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা নিতে গিয়ে যেভাবে প্রতিষ্ঠানটির কর্মী হয়ে উঠলেন রনি ইসলাম
Published: 7th, May 2025 GMT
কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান রনি ইসলামকে সেই সময় প্রথমে কবিরাজি চিকিৎসা করানো হয়েছিল। পরে স্থানীয় ক্লিনিকে নেওয়া হয়। ধরা পড়ে রক্তশূন্যতা। সেবারই প্রথম রক্ত নিতে হলো। বছর দুই পরে আবারও অসুস্থতা। রাজশাহীতে চিকিৎসা হয় সেবার। রক্ত নিতে হয় আবারও। এরপর প্রায়ই রক্ত নেওয়ার প্রয়োজন হতে থাকে।
পড়ালেখা করে কী হবে!ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখায় দারুণ আগ্রহ রনির। অসুস্থতার জন্য পড়ালেখা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। অনেকে নেতিবাচক মন্তব্যও করতেন। রনি ইসলাম বলেন, ‘কেউ বলতেন ক্যানসার হয়েছে। কেউ উপহাস করতেন, এই শরীরে এত পড়ালেখা করে কী হবে! কেবল আমাদের প্রতিবেশী হাজী রফিকুল ইসলাম চাচা সাহস দিয়েছিলেন। পরবর্তী জীবনেও যথাসাধ্য করেছেন চাচা।’ তবে সেই সময় অষ্টম শ্রেণির পর আর পড়ালেখা করা হয়নি রনির। এদিকে পেটখানা বড় হয়ে যাচ্ছিল। বয়স যখন ১৭, তখন সুস্থতার আশায় জমিজমা বিক্রি করে রনির প্লীহা নামের অঙ্গটি অস্ত্রোপচার করে ফেলে দেওয়া হলো।
নতুন যুদ্ধের সূচনাপরিবারের চাপে ১৭ বছর বয়সেই বিয়ে করেন রনি। এর পর থেকে প্রতি মাসে রক্ত নিতে হতো তখন, শরীর একেবারেই ভালো নয়। কিন্তু স্ত্রীর দায়িত্বও তো অস্বীকার করা যায় না। ২০১৪ সালে প্রতিবেশী সেই চাচা রফিকুল ইসলামের সহায়তায় রনি বিক্রয়কর্মীর চাকরি শুরু করেন গাজীপুরে। পরের বছর পদোন্নতিও হয়। সেবারই কোয়ান্টামের ভ্রাম্যমাণ ব্লাড ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন সম্পর্কে জানতে পারেন।
আরও পড়ুনথ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা২৯ এপ্রিল ২০২৪সত্যের মুখোমুখি২০১৫ সালে ঢাকায় এসে বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনে পৌঁছে অবাক হয়েছিলেন রনি। দেয়ালে কার্টুনের ছবি, শিশুরা রক্ত নিচ্ছে, কেউ কেউ খেলছে, আর নার্সরা গান গাইছেন। চিকিৎসাকেন্দ্র কি এমন হতে পারে! ডা.
বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনে বিভিন্ন ফান্ডের মাধ্যমে রনির চিকিৎসা চলছিল। সেখানের কর্মীরা কেবল চিকিৎসাই নয়, সাহসও দিতেন। ফাউন্ডেশনের মহাসচিব ডা. আবদুর রহিমের সঙ্গে পরিচয় সেখানেই। চিকিৎসার পাশাপাশি জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। ২০১৬ সালে অসুস্থতার কারণে রনি গাজীপুরের চাকরিটা ছেড়ে দেন, পরের বছর নারায়ণগঞ্জ চলে আসেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেন। রনির থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ার পর থেকেই তাঁর দাম্পত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুই পরিবারে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। তবে স্ত্রী তাঁর পাশে ছিলেন সব সময়। এদিকে পোশাক কারখানার অপারেটর হিসেবে প্রায়ই বেশ রাত অবধি কাজ করতে হতো রনিকে। কখনো কাজ থাকত সারাটা রাত। শরীরে কুলাচ্ছিল না। সে বছরই আবার চাকরি ছাড়লেন বাধ্য হয়েই। এরপর কী করলেন? রনি বললেন, ‘স্ত্রীকে নিয়ে কুষ্টিয়া চলে গেলাম। রোজগারের চেষ্টায় অন্য এলাকায় গিয়ে পাট কাটা ও পেঁয়াজ তোলার মতো কাজও করেছি দিনমজুর হিসেবে। তবে অসুস্থ শরীরে সেই ধকলও সইল না। তাই ২০১৮ সালে ডা. আবদুর রহিমের সঙ্গে আবার দেখা হলে নিজের সমস্যার কথা জানালাম।’
আরও পড়ুনকেউ থ্যালাসেমিয়া বাহক কিনা, তা বুঝবেন কীভাবে এবং থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা কী০৮ মে ২০২৩বদলে যাওয়ার গল্পসে বছরই ল্যাব সহকারী হিসেবে বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনে যোগদান করেন মো. রনি ইসলাম। বদলে যায় জীবন। ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় তাঁর ও তাঁর বোনের চিকিৎসা চলছিল। বেতনের টাকায় সাচ্ছল্যের মুখ দেখলেন। তবে বোন মারা যান ২০১৯ সালে। ওদিকে পরিবার ও শ্বশুরবাড়ির চাপে রনির বিয়েটাও ভেঙে যায় পরের বছর। মানসিক আঘাত সামলে ২০২১ সালে আবার বিয়ে করেন মো. রনি ইসলাম। এবার আর বিয়ের আগে স্ত্রীর রক্ত পরীক্ষা করাতে ভুল করেননি। জীবনটা একটু স্থিতি পেলে রনির পড়ালেখার তীব্র ইচ্ছাটা আবার জেগে ওঠে। ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায়ই বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পড়ালেখা শুরু করেন। ২০২৩ সালে তাঁর প্রথম কন্যা পৃথিবীর আলো দেখে। এ বছর দ্বিতীয় কন্যা জন্ম নিয়েছে। রনির সংসার এখন পরিপূর্ণ। গত বছর চাকরি ছেড়ে কুষ্টিয়া গিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসার চেষ্টা করেছিলেন। তবে সুবিধা হয়নি। ৩ মাস ১১ দিন পর আবার ফাউন্ডেশনে যোগ দেন সেখানকার ফার্মেসির বিক্রয়কর্মী হিসেবে। এবার মাধ্যমিক পরীক্ষায়ও অংশ নিচ্ছেন। নিজ উদ্যোগে একটি ব্যবসাও দাঁড় করিয়েছেন। মালিবাগে গড়ে তুলেছেন আল হেরা সুগন্ধি স্টোর। সুগন্ধি ছাড়াও সেখানে পাওয়া যায় টুপি। জীবনের ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের সামনে হার না মানা মো. রনি ইসলাম স্বপ্ন দেখেন, বাংলাদেশ একদিন থ্যালাসেমিয়ামুক্ত হবে। প্রতিটি সুস্থ মানুষ বিয়ের আগে যদি জানতে পারেন, তিনি থ্যালাসেমিয়া বাহক কি না, কেবল তাহলেই রনির স্বপ্ন পূরণ হবে। নতুন করে এমন ভয়াবহতায় পড়বে না আর একটি প্রাণও। আর থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত মানুষের মধ্যে কারও হয়তো তাঁর এই উদ্যোগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান হবে—এমনটাও আশা করেন তিনি।
আরও পড়ুনথ্যালাসেমিয়া রোগী আর বাহক কিন্তু এক নয়৩১ অক্টোবর ২০২৩উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ব র র চ কর পর ক ষ ব হক ক প রথম ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দলও কি স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে
১৫ বছর ধরে অনেক ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল আর সংগঠন মিলে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করে আসছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে শেখ হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসেন।
এর ফলে হাসিনা সরকারের পতন হয় ও তিনি এবং তাঁর দলের কর্মীরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এ পরিবর্তন শুধু একটা সরকারের পরিবর্তন নয়, বরং দীর্ঘ সময়ের ভয় ও দমনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের সাহস, আশা ও গণতান্ত্রিক চেতনার একটি বড় জয় ছিল।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়, কিছু গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দল এই আন্দোলনের সফলতাকে শুধু নিজের নামে দাবি করতে শুরু করে। কেউ কেউ বলতে থাকে, তাদের কারণেই সরকার পতন ঘটেছে। তাই তারাই ভবিষ্যতে ক্ষমতার একমাত্র ভাগীদার।
আবার কিছু ধর্মীয় বা আদর্শিক গোষ্ঠী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করছে, যারা আগে প্রকাশ্যে তেমন সক্রিয় ছিল না। এ ছাড়া কিছু নতুন দল, যারা আগে রাজনীতিতে খুব একটা পরিচিত ছিল না, তারাও হঠাৎ করে সামনে চলে এসেছে। তারা নিজেদের ‘নতুন শক্তি’, ‘ভিন্নধারার দল’ হিসেবে উপস্থাপন করে, কিন্তু তাদের আচরণে কখনো কখনো পুরোনো রাজনীতির কৌশলই দেখা যায়।
আরও পড়ুনশেখ হাসিনা স্বৈরশাসকদের টিকে থাকার দুটি মূলমন্ত্রেই ব্যর্থ২২ আগস্ট ২০২৪এই আন্দোলনের সময় বিভিন্ন গোষ্ঠী একসঙ্গে থাকলেও আন্দোলনের পর তারা নিজেদের অবস্থান ঠিক করতে গিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ আবার নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার হিসাব-নিকাশ করছে। এতে আন্দোলনের মূল চেতনা—জনগণের অধিকার, গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেন ধীরে ধীরে পেছনের দিকে চলে গেছে।
এ বাস্তবতায় প্রশ্ন ওঠে, যাঁরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁরাই কি আবার ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গিয়ে নতুন একধরনের স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দেবেন?
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। ৫ আগস্ট, ২০২৪