ভূখণ্ড বেদখল, ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় অবকাঠামো ধ্বংস ও সীমাহীন মানবিক ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও ইউক্রেনের অর্থনীতি দারুণভাবে টিকে থাকার সক্ষমতা দেখিয়ে চলেছে। অনেক গুণ শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের সামরিক প্রতিরোধের পেছনে দেশটির সফল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে ধসে পড়ার কথা, তার বদলে এই যুদ্ধ বরং সেগুলোকে আরও শক্তিশালী করেছে।

রাজস্ব সংগ্রহ ও স্বেচ্ছাসেবামূলক তহবিল সংগ্রহ—এই দুয়ের সমন্বয়ে ইউক্রেন নাটকীয়ভাবে সামরিক বাহিনীর আকার বাড়িয়েছে, প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের ধারাও একটা মাত্রায় বজায় রেখেছে। ইউক্রেনকে এই সাফল্যের জন্য কৃতিত্ব দিতে হবে। কিন্তু যুদ্ধের বিপুল খরচ মেটানোর ক্ষেত্রে দেশটির নিজস্ব সম্পদের অভাব রয়েছে। ফলে বাইরের আর্থিক সহায়তা অত্যাবশ্যক। ইউক্রেনের যুদ্ধকালীন স্থিতিশীলতা একটা বৈপরীত্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সেটা হলো, রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা উল্লেখ করার মতো বাড়ার পরও বিদেশি সহায়তার ওপর মৌলিকভাবে নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে।

রাশিয়ার অর্থনীতিকে প্রায়ই একটা সর্বাত্মক যুদ্ধের সফলতার গল্প বলে দেখা হয়। সাধারণ একটা ধারণা যে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে রাশিয়ার অর্থনীতি সংকটে পড়েনি। কিন্তু এই আপাত শক্তিমত্তার কারণ হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর রাশিয়ার নির্ভরশীলতা। গত এক দশকে তেল ও গ্যাস থেকে রাশিয়ার রাজস্ব আয় ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ। এই রাজস্বই রাশিয়ার বাকি অর্থনীতিকে টেকসই রাখছে।

২০২২ সালে বিশ্বে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সেটা রাশিয়ার অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু বর্তমানে জ্বালানি তেলের চাহিদা কমে যাওয়ায় রাশিয়ার সামনে সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের যে ভবিষ্যৎ প্রবণতা, সেটাও রাশিয়ার জন্য বড় সমস্যা তৈরি করবে। দ্য ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির অনুমান হলো, আগামী পাঁচ বছরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের সরবরাহ অভূতপূর্বভাবে বেড়ে যাবে। এটা নিশ্চিতভাবেই রাশিয়ার অর্থনীতিকে দুর্বল করবে।

ইউক্রেন ২০২৭ সাল পর্যন্ত সাহায্য ও ঋণ হিসেবে বিদেশি সহায়তা নিশ্চিত করে ফেলেছে। কিন্তু রাশিয়াকে সামরিক খাতের ব্যয়ের জন্য অভ্যন্তরীণ উৎসের ওপরই নির্ভর করতে হবে। কাগজে–কলমে ইউক্রেন অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করা সাম্প্রতিক খনিজ চুক্তি এই মূল্যায়নকে জটিল করে তুলছে।

চুক্তিতে ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ উত্তোলন ও ব্যবহারের জন্য একটি যৌথ বিনিয়োগ তহবিল গঠনের কথা থাকলেও শর্ত থেকে স্পষ্ট যে এতে যুক্তরাষ্ট্রই লাভবান হবে। চুক্তি অনুযায়ী, তহবিল পুষ্ট করার জন্য ইউক্রেনকে এ খাত থেকে রাজস্ব আয়ের অর্ধেকটা দিয়ে দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এমন কোনো বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি। এই বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারবে।

এই চুক্তিকে ব্যাপকভাবে ইউক্রেনের বিজয় বলে প্রচার করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে আগের চুক্তির খসড়ায় অনেক কঠিন শর্ত ছিল এবং ইউক্রেনকে বিজয়ী করার জন্য শর্তগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত চুক্তিটিতেও এমন শর্ত রয়েছে, যেটা ঔপনিবেশিক চিহ্ন বহন করছে। বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও এই চুক্তি কার্যকর না–ও হতে পারে।

খনিজ সম্পদ উত্তোলনের কাজটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এবং এ ক্ষেত্রে প্রচুর পুঁজি বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। আবার বিনিয়োগকারীদের রাজনৈতিক ঝুঁকির কথাও বিবেচনা করতে হয়। ভবিষ্যতে ইউক্রেনে যে সরকার আসবে, তারা চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি আরও ভালো কোনো প্রস্তাব দেয়।

এখানে ভাষ্যটা কী তৈরি হচ্ছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্প প্রশাসনের করা এই খনিজ চুক্তিকে আন্তর্জাতিকভাবে জবরদস্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। একটা দেশ যখন গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য লড়াই করছে, তখন সেই দেশের সঙ্গে এভাবে ব্যবসা করাটা ঠিক নয়।

ইউক্রেনকে আত্মরক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ওপর কিছু মাত্রায় নির্ভর করে যেতে হবে। ইউক্রেন এখন চুক্তিটাকে সেই বিবেচনা থেকেই দেখছে। তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় রাশিয়ায় যুদ্ধযন্ত্রের জন্য রসদ যখন ফুরিয়ে আসবে, তখন ইউক্রেনের দিকে ঘুরে যাবে।

লুক কুপার থিঙ্কট্যাংক এলএসই আইডিয়াসের রিসার্চ ফেলো দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউক র ন র র র জন য র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

নিহত জঙ্গিদের রাষ্ট্রীয় সম্মান দিয়েছে পাকিস্তান: বিক্রম মিশ্রি

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেছেন, অপারেশন সিঁদুরে নিহত জঙ্গিদের রাষ্ট্রীয় সম্মান দিয়েছে পাকিস্তান, নিহত জঙ্গিদের দেহ মোড়ানো হয়েছে দেশটির জাতীয় পতাকায়।

আজ বৃহস্পতিবার ভারতের নয়া দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করেন পররাষ্ট্র সচিব। 

সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের অপপ্রচার ও সীমান্ত উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট করেন তিনি। বিক্রম মিশ্রি পাকিস্তানের জঙ্গিদের প্রতি কঠোর বার্তা দিয়ে বলেছেন, ভারত তার নিরাপত্তার বিষয়ে কোনো আপস করবে না।

আরো পড়ুন:

ভারতের জম্মু শহরে বিস্ফোরণ, ব্ল্যাকআউট

ভারতে পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, দাবি ভারতীয় মিডিয়ার

তিনি বলেন, “আমরা যতটা জানি, এই ঘটনায় (অপারেশন সিঁদুর) মৃত জঙ্গিদের শেষকৃত‍্যে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়েছে পাকিস্তান, এটাই হয়তো ওদের প্রথা।” 

অপারেশন সিঁদুরের পর ভারত স্পষ্ট বার্তা দেয়, হামলা চালানো হয়েছে কেবল জঙ্গি ঘাঁটিতেই। যদিও পাকিস্তান অভিযোগ তোলে ধর্মীয় স্থানে হামলা চালিয়েছে ভারত।

বৃহস্পতিবার সকালে ভারত পাকিস্তানের লাহোরের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমে হারপি ড্রোন ব্যবহার করে পাল্টা হামলা চালায়। মিশ্রি জানান, এই হামলা পাকিস্তানের আক্রমণের সমান তীব্রতায় এবং একই ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল। 

এদিন পররাষ্ট্র সচিব জানান, ‘‘ভারত পরিষ্কার করে জানাচ্ছে জঙ্গি ঘাঁটিতেই হামলা চালানো হয়েছে। কোনো ধর্মীয় স্থানে করা হয়নি। পুঞ্চে গুরুদ্বোয়ারে আক্রমণ করেছে পাকিস্তান। তাতে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। আজ সকাল পর্যন্ত ১৬ জন মারা গেছেন, ৫৯ জন আহত। পাকিস্তান সাম্প্রদায়িক কথার মাধ্যমে রাজনীতি করছে। পহেলগাঁও’তে আপনারা অবশ্যই দেখেছেন বেছে বেছে মারা হয়েছে।’’

পররাষ্ট্র সচিব আরো জানান, ‘‘২২ এপ্রিল আক্রমণ শুরু করেছিল ওরা। পহেলগাঁওয়ের সেই আক্রমণের জবাব আমরা দিচ্ছি। ওরা এটা শুরু করেছিল। ভারত জাতিসংঘকে রিপোর্ট দিয়েছে। আমরা আবার দেব নানা তথ্য তাদের। টিআরএফ নিয়ে পাকিস্তান তাদের জবাব এড়িয়েছিল। ভারতের জবাব সংযত। আমরা শুরু করিনি। আমরা ওদের যথাযথ জবাব দিচ্ছি।”

মিশ্রি জানান, হামলার জন্য দায়ী ছয় জঙ্গিকে নির্মূল করতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

পহেলগাঁওয়ের ঘটনায় তদন্তের দাবি জানিয়েছিল পাকিস্তান। এ প্রসঙ্গে বিক্রম মিশ্রী বলেন, ‘‘পাকিস্তান হাত ধুয়ে ফেলতে চাইছে। ওদের তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রী বলছেন, সেখানে জঙ্গি নেই। আমরা প্রকৃত পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করেছি। সবাই জানে লাদেন কোথায় ছিল, আর তাকে কে শহীদ বলেছিল। পাকিস্তান আন্তর্জাতিক স্তরে নানা মিথ্যা কথা বলে চলেছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কী বলছে আপনারা নিশ্চয়ই জানেন। পাকিস্তান চায় যৌথ তদন্ত কমিটি। কিন্তু ওদের ট্র‍্যাক রেকর্ড আপনারা জানেন। মুম্বাই, পাঠানকোটে ওরা কি করেছিল সেটা সকলে জানে। কাসভ গ্রেপ্তার হওয়ার পরে, নানা তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। তা জানানোর পরে ওরা কী বলেছিল নিশ্চয়ই জানেন।’’

পাকিস্তানের মন্ত্রীদের সঙ্গে জঙ্গিদের যোগাযোগ আছে বলেই এদিন দাবি করলেন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব। তুলে ধরলেন প্রমাণও। তিনি বলেন, ‘‘পাকিস্তান জাতিসংঘে ‘টিআরএফ’ (পহেলগাঁওতে হামলাকারী জঙ্গি সংগঠন) এর নাম নিতে বিরোধ করেছিল। পাকিস্তানের মন্ত্রীদের সঙ্গে আতঙ্কবাদীদের যোগ রয়েছে।”

সাংবাদিকদেরকে ছবি দেখিয়ে মিশ্রি বলেন, “কফিনের সামনে কারা দাঁড়িয়ে আছে। কফিনে পাকিস্তানের পতাকা দেওয়া। এর থেকে বুঝতেই পারছেন ওদের যোগাযোগ।’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা বেছে বেছে জঙ্গি ঘাঁটিতেই আক্রমণ করেছি। ভারত একাধিকবার নেগোশিয়নের প্রস্তাব দিয়েছিল পানি চুক্তির। পাকিস্তান বারবার নিয়ম ভেঙেছে। ভারতের সহনশীলতা হলো গত ৬৫ বছর ধরে ভারত সহ্য করেছে। পাকিস্তান শুধু প্রোপাগাণ্ডা তৈরি করছে। পাকিস্তানের সমস্ত হামলার জবাব দেবে ভারত।’’

মিশ্রি জানান, অপারেশন সিঁদুর সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাকা হয়েছিল। তিনি বলেন, “ভারত তার সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার বিষয়ে কঠোর। পাকিস্তান যদি আরো হামলা চালায়, তবে ভারত যথাযথ জবাব দেবে।”

মিশ্রি জানান, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং চীন, বাংলাদেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশ শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। তিনি বলেন, “ভারত শান্তি চায়, কিন্তু সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে।”

মিশ্রি ইন্ডাস ওয়াটার ট্রিটি প্রসঙ্গে বলেন, “ভারতের ধৈর্যের কারণেই আমরা ৬৫ বছর ধরে ইন্ডাস ওয়াটার ট্রিটি মেনে চলেছি, কিন্তু পাকিস্তানের উসকানির জবাব দেওয়া হবে। ভারত এই চুক্তি মেনে চলেছে, কিন্তু পাকিস্তানের ক্রমাগত উসকানি এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ প্রশ্নবিদ্ধ করছে।” তিনি পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের সমর্থন বন্ধ করার আহ্বান জানান।

মিশ্রি ভারতের অভ্যন্তরে স্লিপার সেল সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “পাকিস্তান সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে স্লিপার সেল ব্যবহার করতে পারে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই হুমকি মোকাবিলায় প্রস্তুত।”

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ