কান– বিশ্ব চলচ্চিত্রের এক তীর্থস্থান। বছর ঘুরে আবারও ভূমধ্যসাগরের তীরে, দক্ষিণ ফ্রান্সের কান শহরের পালে দে ফেস্টিভ্যাল ভবনের গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে উঠছে ৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের পর্দা। মর্যাদাপূর্ণ এ আয়োজনকে ঘিরে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছে আয়োজক কর্তৃপক্ষ। শহরের বিভিন্ন স্থানে ঝুলছে উৎসবের অফিসিয়াল পোস্টার-ব্যানার।

চলতি আসর চলবে ২৪ মে পর্যন্ত। অর্থাৎ আজ থেকে শুরু করে আগামী ১২ দিন কান হয়ে উঠবে বিশ্ব চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কেন্দ্রস্থল। সুষ্ঠুভাবে উৎসব সম্পন্ন করতে নেওয়া হয়েছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আয়োজকদের প্রত্যাশা– প্রতিবারের মতো এবারও বিশ্বের প্রথিতযশা চলচ্চিত্র স্রষ্টাদের উপস্থিতিতে কান উৎসব হয়ে উঠবে বর্ণিল ও প্রাণময়।

এই উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক লালগালিচা পর্ব, যেখানে বিশ্বের খ্যাতিমান অভিনেত্রী, গায়িকা ও মডেলরা বাহারি পোশাকে হেঁটে বেড়াবেন। বলা যায়, বিলাসবহুল কান শহর যেন আবারও জেগে উঠেছে চলচ্চিত্রের রং, আলো ও নান্দনিকতায়। এবারের উৎসবে থাকছে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার দৃষ্টিনন্দন মিশ্রণ।

উপস্থাপনা ও সম্মাননা
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করবেন ফরাসি অভিনেতা লরাঁ লাফিত, যিনি ২০১৬ সালেও একই ভূমিকায় ছিলেন। তিনি মূল প্রতিযোগিতা বিভাগের বিচারকদের স্বাগত জানাবেন মঞ্চে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মার্কিন অভিনেতা রবার্ট ডি নিরোকে তাঁর দীর্ঘ চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারের স্বীকৃতি হিসেবে সম্মানসূচক ‘পাল্ম দ’অর’ প্রদান করা হবে। তিনি তাঁর অসংখ্য স্মরণীয় চরিত্র দিয়ে সিনেমার ইতিহাসে গড়ে তুলেছেন অনন্য অবস্থান। উৎসবের দ্বিতীয় দিনে তিনি একটি মাস্টার ক্লাস পরিচালনা করবেন, যেখানে তরুণ নির্মাতাদের সঙ্গে ভাগ করে নেবেন তাঁর অভিজ্ঞতা।

উদ্বোধনী চলচ্চিত্র
উৎসবের পর্দা উঠবে ফরাসি পরিচালক আমেলি বোনিন পরিচালিত কমেডি-ড্রামা ‘পার্তির উঁ জুর’ দিয়ে। সিনেমার ইংরেজি নাম ‘লিভ ওয়ান ডে’। বোনিন কানের ইতিহাসে অন্যতম কনিষ্ঠ নারী পরিচালক হিসেবে উদ্বোধনী ছবি নির্মাণের কৃতিত্ব অর্জন করলেন, যা এ অভিজাত প্ল্যাটফর্মে নারীর শিল্পীসত্তার দৃঢ় অবস্থানকেই প্রতিফলিত করে। সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র সেসিল, একজন প্যারিসের শেফ, নিজের একটি রেস্তোরাঁ খোলার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু হঠাৎ বাবার হৃদরোগের খবর পেয়ে ফিরে যান নিজ জন্মস্থানে। সেখানে তাঁর দেখা হয় কৈশোরের প্রেমিক রাফায়েলের সঙ্গে, যা তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করে। ৯৮ মিনিটের এ সিনেমায় অভিনয় করেছেন জুলিয়েট আরমানে, বাস্তিয়েন বুইয়োঁ এবং ফ্রাঁসোয়া রোলাঁ। আজই এটি মুক্তি পাচ্ছে ফ্রান্সের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে। উৎসবের প্রথম দিনই ‘কান ক্লাসিক’ বিভাগে দেখানো হবে চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত সিনেমা ‘দ্য গোল্ড রাশ’। 

মূল প্রতিযোগিতা বিভাগের জুরি
এ বছরের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগের জুরি প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন জুলিয়েট বিনোশ। তাঁর নেতৃত্বে বিচারক প্যানেলে রয়েছেন হলিউড অভিনেত্রী হ্যালি বেরি, ব্রডওয়ে তারকা জেরেমি স্ট্রং, ভারতীয় নির্মাতা পায়েল কাপাডিয়া, ফরাসি-মরক্কান লেখিকা লেইলা স্লিমানি, মেক্সিকান পরিচালক কার্লোস রেইগাদাস, কঙ্গোর ডকুমেন্টারিয়ান ডিয়ুডো হামাদি, ইতালিয়ান অভিনেত্রী আলবা রোরভাখার, কোরিয়ান নির্মাতা হং সাংসু।  

প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত ২১ সিনেমা
মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত ২১টি চলচ্চিত্র বিশ্ব চলচ্চিত্রের সৃজনশীলতা ও বৈচিত্র্যের প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি চলচ্চিত্র তাঁর নিজস্ব ভাষা, আঙ্গিক ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হাজির হয়েছে– যা তুলে ধরেছে সময়ের আলোকে বিশ্বচলচ্চিত্রের বহুমাত্রিক রূপ। এবারের প্রতিযোগিতায় অন্তর্ভুক্ত সিনেমাগুলোর ভাষার তালিকায় রয়েছে: ফরাসি, জার্মান, পার্সিয়ান, রাশিয়ান, ইউক্রেনীয়, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, হিন্দি ও রোমানিয়ান।

উৎসবের চমক
এই উৎসবের আরেক আকর্ষণ, প্রথমবারের মতো পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন দুই খ্যাতিমান অভিনেত্রী– স্কারলেট জোহানসন ও ক্রিস্টেন স্টুয়ার্ট। জোহানসনের পরিচালিত ‘এলেনর দ্য গ্রেট’ এবং স্টুয়ার্টের ‘দ্য ক্রনোলজি অব ওয়াটার’। দুটি ছবিই দেখানো হবে ‘আঁ সার্তেইন রিগার্ড’ বিভাগে।

নারী নির্মাতাদের অংশগ্রহণ
এবারের আসরে নারী নির্মাতাদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে রয়েছেন ৭ জন নারী পরিচালক– যা কানের ইতিহাসে এক নতুন রেকর্ড। এ প্রসঙ্গে উৎসবের প্রেসিডেন্ট আইরিস নোবলোচ বলেন, ‘চলচ্চিত্র কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি এক শক্তিশালী রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিও। নারী নির্মাতারা এখন পরিপূরক নন; বরং নেতৃত্বে আছেন।

তিনি আরও বলেন, এ আসরের থিমেই ছিল স্পষ্ট বার্তা– বৈচিত্র্য, অন্তর্ভুক্তি ও সাহসিকতা। এবারের কান যেন নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, অভিবাসন সংকট ও নারীর অধিকার নিয়ে নির্মিত সাহসী সব চলচ্চিত্রকে– যারা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছাতে চায় নিজেদের ভাষায় ও দৃঢ়তায়।

৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসব কেবল সিনেমার প্রদর্শনী নয়– এটি শিল্প, সংস্কৃতি, মতপ্রকাশ ও মানবিকতার এক মহোৎসব। বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মিলনমেলা প্রমাণ করে দেয়– সিনেমা শুধু পর্দার আলো নয়, এটি সমাজ, সময় ও মনকে প্রশ্ন করার এবং সামনে এগিয়ে নেওয়ার এক অনন্য হাতিয়ার।

.