হাসনাত আবদুল হাই। আগামীকাল তাঁর বয়স হবে ৮৯। বই, লেখালেখি, পাঠকপ্রিয়তা, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম- সবখানেই তিনি সমান প্রাণবন্ত। সম্প্রতি একান্ত সাক্ষাৎকারে এই কথাসাহিত্যিক আমাদের জানান, তাঁর লেখকসত্তার জন্ম, কর্মপন্থা, ঐতিহাসিক চরিত্রের প্রতি অনুরাগ এবং নিজেকে বারবার আবিষ্কারের এক আশ্চর্য যাত্রার কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহেরীন আরাফাত
lআগামীকাল আপনার ৮৯ বছর পূর্ণ হয়ে ৯০-এ পা দেবেন.

..
llএখন আর বছর গুনি না। লোকে যা বলে তাই মেনে নিই।
lএই বয়সেও আপনি লেখালেখি, পড়াশোনা, এমনকি ফেসবুকেও দারুণ সক্রিয়। এই অদম্য সক্রিয়তার প্রেরণা কোথা থেকে আসে?
llজীবন সম্পর্কে আমার কৌতূহল– এই কৌতূহল শুরু হয়েছে শৈশবে, তখন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এই কৌতূহলের জন্যই আমি সক্রিয়। যেমন আমি বই পড়ি, লিখি, লোকের সঙ্গে কথা বলি। জীবন সম্পর্কে আমার যদি কৌতূহল না থাকত, তাহলে এগুলো করতে পারতাম না।
lআপনার লেখালেখির শুরুটা কীভাবে হয়েছিল?
llলেখালেখির শুরুটা স্কুলজীবনে। আমি তখন ফরিদপুর জিলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। হাতে লেখা একটি পত্রিকা বের করা শুরু করলাম। সেখানে আমাকে কবিতা, গল্প অনেক কিছু লিখতে হতো। এভাবে আমার লেখালেখি শুরু। এক পর্যায়ে আমি শুধু ওই পত্রিকার সম্পাদক নই; সব লেখাই আমাকে লিখতে হলো। তারপর ১৯৫৩ সালে ফরিদপুর জিলা স্কুলের যে বার্ষিকী বের হলো, ওটা আমি সম্পাদনা করলাম। সেখানে প্রথম ছাপা অক্ষরে আমার লেখা প্রকাশিত হয়। সেটা ছিল একটি ভ্রমণকাহিনি– ভারতের রাজধানী দিল্লিতে একদিন। বয়েজ স্কাউট হিসেবে ট্রেনে করে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েছিলাম। সেই ট্রেন থেমেছিল দিল্লিতে। দিল্লিতে আমরা এক দিন ঘোরাঘুরির সুযোগ পেয়েছিলাম। পারিবারিক ক্ষেত্রে লেখার ব্যাপারে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। কারণ বাইরের পড়ার জন্য স্কুল-পাঠ্যবইয়ের পড়া অবহেলা করিনি। ক্লাসে আমি সবসময় প্রথম হতাম। তাই লেখালেখি নিয়ে আমার পরিবারের কোনো আপত্তি ছিল না। তারা বরং উৎসাহ দিয়েছে।
lআপনি কীভাবে লেখেন? মানে আপনার লেখার পদ্ধতিটা কেমন? একটি উপন্যাস বা লেখা মাথায় কীভাবে আসে?
llউপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে বাস্তবের ঘটনা, যেটা আমি দেখি বা শুনি সেটা থেকে আসে– এটি একটি সূত্র। আরেকটা সূত্র হলো, আমি হয়তো পরিকল্পনা করলাম যে, এ বিষয় নিয়ে লিখব। যেমন আমি হয়তো পরিকল্পনা করলাম, জেলেদের জীবন নিয়ে লিখব; কিন্তু জেলেদের জীবন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আমি যখন এ পরিকল্পনা নেব, তখন আমাকে জেলেজীবন দেখার জন্য জেলেপল্লির কাছে যেতে হবে। আমার একটি উপন্যাস ‘নবীর নৌকা’। নৌকা বানায় যারা তাদের জীবন নিয়ে লেখার ইচ্ছে হলো; কিন্তু এটা তো বাড়িতে বসে লেখা যায় না। এর পেছনে অনেক কারিগরি-টেকনিক্যাল ব্যাপার আছে, সেগুলো আমাকে জানতে হবে। এ জন্য কর্ণফুলী নদীর পারে যারা নৌকা বানাত, তাদের ওখানে গিয়ে আমি দিনের পর দিন থেকেছি। তাদের সমস্যার কথা শুনেছি; তারা কীভাবে নৌকা বানায়, তা প্রত্যক্ষ করেছি। বড় বড় নৌকা, সাম্পান সেগুলো কারা কিনে, এর বিনিময়ে তারা কী পায়– এসব সম্পর্কে জেনেছি।
এর মানে দু’ভাবে হয়। আমি একটা প্রত্যক্ষ ঘটনা দেখলাম। যেমন– জুলাইয়ের ঘটনা আমার নিজের চোখে দেখা, টেলিভিশনে দেখা, অন্যের কাছে শোনা; এরপর ইচ্ছে হলো আমি জুলাইয়ের ওপর লিখব। এটা লেখার জন্য শুধু আমার দেখার ওপর নির্ভর করলে হবে না, এ জন্য আমাকে গিয়ে পুরোনো কাগজগুলো পড়তে হলো। সংবাদপত্র পড়লাম, কী কী ঘটনা হলো, কোথায় কোথায় ঘটনা হয়েছে। কোথায় কোথায় গুলিবর্ষণ হয়েছে, কারা মারা গিয়েছে, কারা গুলি করেছে। এরপর নিউজ পেপার থেকে নোট নিয়ে আমি লিখতে বসলাম, তথ্যনির্ভর, ইতিহাসনির্ভর যে উপন্যাস আমি লিখতে চাই, সেটা আমি এখন লিখতে পারি। আমি যদি শুধু তথ্যের ওপর নির্ভর করি তাহলে সেটা ইতিহাস হয়ে যায়, উপন্যাস হয় না। সে জন্য আমি কিছু চরিত্র কল্পনা করেছি, ঘটনাগুলো আমার কল্পিত না, কিন্তু সে কল্পিত চরিত্রগুলো আমার বাস্তবের সঙ্গে জড়িত। তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। এভাবে ওই উপন্যাস লিখেছি। তারপরে আমি হয়তো পরিকল্পনা করলাম যে সুলতানকে নিয়ে উপন্যাস লিখব। এটা লিখতে গিয়ে তাঁর তো তেমন বই ছিল না, কিছু রিভিউ ছিল। সৌভাগ্যক্রমে তিনি তখন বেঁচেছিলেন। তিনি নড়াইলে থাকতেন, মাঝেমধ্যে ঢাকায় আসতেন। তিনি যখন ঢাকায় আসতেন তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ করেছি। তাঁর সঙ্গে গাড়িতে করে ঘুরেছি, তাঁর সঙ্গে নড়াইলে গিয়ে কথা বলেছি। তাঁকে যারা চেনে তাদের সঙ্গেও কথা বলেছি। এভাবে তাঁর তথ্য সংগ্রহ করে, এমনভাবে লিখি যেন এটা শুধু তথ্যনির্ভর না হয়, এর মধ্যে কিছুটা কল্পনাও থাকে। তা না হলে তো উপন্যাস হয় না। কিন্তু বাস্তবভিত্তিক উপন্যাস লিখতে গিয়ে ভাবতে হবে যে, কল্পনাটা যাতে বাস্তবের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। যেমন– সুলতান সম্পর্কে কল্পনা করে এমন কিছু বলতে পারব না যে, বাস্তব জীবনের সঙ্গে একেবারেই সম্পর্ক ছিল না। তার মানে আমার কল্পনা অপরিসীম না, সেটা সীমাবদ্ধ এবং সেটা কিছুটা বাধ্যবাধকতা মেনে চলে। 
lআপনার বইয়ে ইতিহাসকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর কারণ কী? 
llআমি জীবনীভিত্তিক উপন্যাস পাঁচ-ছয়টা লিখেছি। কিন্তু আমার উপন্যাসের সংখ্যা ৭০-৮০টির মতো হবে। আমি দেখেছি, জীবনীভিত্তিক উপন্যাসগুলো পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এগুলোর জন্যই আমার ঔপন্যাসিক হিসেবে পরিচিতিটা বেড়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সাংস্কৃতিক ব্যক্তি এদেরকে নিয়ে উপন্যাস লিখলে, ইতিহাসের একটা বিশেষ সময়ের, তাদের সমকালকে পাওয়া যায়। সেটা ২৫-৩০ বছর, তাদের জীবনভিত্তিক যেহেতু, সেটা ৫০ বছরও হতে পারে। ইতিহাসের বিষয় নিয়ে আরও এক ধরনের উপন্যাস আমি লিখেছি। যেমন মুক্তিযুদ্ধ। এটা ৯ মাসের ইতিহাস; কিন্তু আমি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে উপন্যাস-গল্প লিখেছি। জুলাই গণঅভ্যুত্থান তো ৩৬ দিনের। সুতরাং ইতিহাস তো বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের হয়। 
lআপনার ভ্রমণকাহিনিও গতানুগতিক ধারার নয়, সেখানেও ভিন্নতা রয়েছে। সেখানে ভূগোল, ইতিহাসের একটা বড় পরিক্রমা তুলে ধরেছেন...
llপ্রথমে ভিন্নতা আসেনি, আমি যখন ষাটের দশকে লিখেছি, সে সময় তো আমেরিকা থেকে ফিরলাম। তারপর আমি ‘দেশান্তরের দিন’ নামে দৈনিক পাকিস্তানে লিখেছি। তারপর ওটার নাম হলো দৈনিক বাংলা। সেখানে ধারাবাহিকভাবে আমার ভ্রমণকাহিনি প্রকাশ হওয়া শুরু হলো, সেটাই শুরু। ধারাবাহিকভাবে আমার ইংল্যান্ড ভ্রমণ, আমেরিকা ভ্রমণ নিয়ে লিখেছি; ঠিক ভ্রমণ নয়, প্রবাসজীবন। আমি তো প্রবাসে চার বছর ছিলাম– দুই বছর আমেরিকায় বিভিন্ন শহরে, তারপর ইংল্যান্ড-লন্ডনে। তারপর লন্ডন থেকে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে গিয়েছি, এই চার বছরকে বলা যায় আমার প্রবাসজীবন।  আমার ভ্রমণকাহিনির দুটো ভাগ বা পর্যায় রয়েছে। প্রথম দিকে ছাত্রজীবনে আমি যে ভ্রমণকাহিনি লিখেছি, ১৯৬৪ সালে সেখানে অভিজ্ঞতা, যে অভিজ্ঞতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অর্জন করেছি, চেষ্টা করতে হয়নি; সেই স্বতঃস্ফূর্ত অভিজ্ঞতা নিয়েই আমার প্রথম ভ্রমণকাহিনি। এরপর চাকরিজীবনে ও পরে বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে রচনাকে নতুন করে সাজানো। 
আমি যখন পরিণত বয়সে রাশিয়া গেলাম, তখন মনে হলো যে রাশিয়াকে তুলে ধরতে হবে। রাশিয়ায় যে বিপ্লব হলো, সে বিপ্লবে কী ফলাফল হয়েছে, ফলাফলের পর এখানকার মানুষের জীবনে কী পরিবর্তন এসেছে, এটা আমাকে দেখাতে হবে। আমি ওখানে গিয়ে যা দেখেছি বা দেখতে চেয়েছি; যা শুনতে চেয়েছি, যেখানে যেতে চেয়েছি; তার প্রধান কারণ– বিপ্লবোত্তর রাশিয়াকে তুলে ধরা।
ঠিক একইভাবে আমি যখন চীন দেশে গেলাম ১৯৭৯ সালে, তারপর আরও পাঁচবার গিয়েছি, তখনও আমার উদ্দেশ্য ছিল, মাও সে তুংয়ের বিপ্লবের পর চীন দেশ কীভাবে পরিবর্তন হলো; সে পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটা কী; সে প্রক্রিয়ার ফলে সেখানকার নর-নারীর জীবনে কী পরিবর্তন এসেছে; তারা কী আগের থেকে সুখে আছে; তাদের কী কল্যাণ বৃদ্ধি পেয়েছে– এসব জানার আগ্রহ নিয়ে আমি গিয়েছি। যখন কেনিয়া গেলাম, আমি জানতাম ওখানে সাফারি হয়, বন্যজন্তুদের পার্কে রাখা হয়েছে সেগুলো দেখব। পাশাপাশি কেনিয়াতে আমাদের আদিপুরুষের সবচেয়ে প্রাচীন কঙ্কাল রাখা আছে। এটি একটি মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে। আমি যাওয়ার আগেই পরিকল্পনা করেছি যে এই কঙ্কাল দেখব এবং আমাদের আদিপুরুষের ইতিহাস জানতে চেষ্টা করব। 
lসাহিত্য চর্চায় কোনো নির্দিষ্ট সময় বা রুটিন কি আপনি মেনে চলেন? 
llএটা খুবই নমনীয়, ফ্লেক্সিবল। আমি যখন সুস্থবোধ করি, সুস্থ-সতেজ এবং এনার্জেটিক থাকি, তখন লিখি। যেমন– আমার যদি রাতে ঘুম না হয়, তখন আমি সকালে ক্লান্ত, অবসন্নবোধ করি এবং আমি সতেজ থাকি না। তখন আমি লিখিও না, পড়িও না। নাশতা করে গিয়ে আবার ঘুমাই, তারপর দুপুর থেকে আমার আবার লেখাপড়া শুরু হয়। সুতরাং লেখার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই, এটা নির্ভর করছে আমি কখন সতেজ বোধ করি, কখন আমি সুস্থবোধ করি, কখন আমি অবসাদগ্রস্ত বলে মনে করি না।

lআপনার সাহিত্যে কি নিজেকে খুঁজে পান?
llসাহিত্যে আমার যা বক্তব্য সেটা বলতে চাই, আমি যা দেখছি-শুনছি তার ভিত্তিতে আমার যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, সেটা আমি কখনও গল্পের আকারে, প্রবন্ধের আকারে, উপন্যাসের আকারে আমি লিখছি। সেটাই উপস্থাপন করতে চাই। আমার যে বলবার তাগিদ, সেই তাগিদ থেকেই আমার সাহিত্য।
lলেখক হিসেবে আপনার দুর্বল ও শক্তিশালী দিক কোনটা?
আমার দুর্বলতা হলো, একবার লেখার পর সেটা আর কারেক্ট করি না। অনেক ভুলত্রুটি থাকে, সেটা আমি বাড়াইও না, কমাইও না। একবার লেখার পর সেটাকে আর সংস্কার, রিভাইজ করি না; এটা একটা দুর্বলতা। আমার মনে হয়, প্রত্যেক লেখকেরই উচিত একবার লেখার পর রিভাইজ করা; পরিবর্ধন, পরিমার্জন করা উচিত। আর আমার সবল দিক হলো– আমি যখন লিখি, তখন লেখার মধ্যে কোনো ছেদ আসে না। একই লেখা যে পর্যন্ত শেষ না হয় আমি লিখে যাই, কেননা আমার চিন্তা হয়, উদ্বেগ হয়; ছেদ দিই না, কারণ আমি আজকে যে চিন্তা করছি, যে গতি আছে, যেটা প্রকাশ করছি; ক’দিন পরে এই গতি পাব না, চিন্তার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটবে না। সে জন্য আমি একটানা লিখে যাই, খাওয়া-পড়া-ঘুমানো ছাড়া ওই লেখা নিয়েই থাকি।
lএখন কী লিখছেন?
llতিনটা বিষয় বেছে নিয়েছি। একটা হলো আমি কিয়তো শহরে ছয় মাস ছিলাম। এটা নিয়ে আমার লেখা হয়নি, সেখানে নোট নিয়েছি প্রচুর, এ নিয়ে একটা ভ্রমণকাহিনি লিখব। তাহলে অন্য ভ্রমণকাহিনির সঙ্গে সিরিজের হবে। এরপর স্থাপত্য, ভাস্কর্য এসব নিয়ে লিখতে চাই এক মলাটে। এটা হবে দ্বিতীয় বই; আর তৃতীয় বই– আমি অবসরে যাওয়ার পর তিন খণ্ডে জীবনস্মৃতি লিখেছি। আমার অবসর জীবন শুরু হয় ২০০০ সাল থেকে, সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত এই অবসরের জীবন কীভাবে কেটেছে, আমি কী করেছি; সেগুলো নিয়ে আমার চতুর্থ স্মৃতিকথা লিখব। এই তিনটা বই আমি একসঙ্গে লিখতে চাই, আমি এভাবে কোনো দিন লিখিনি। একটার পর একটা লিখেছি। যেহেতু আমার সময় কম, সেহেতু তিনটা বই একসঙ্গে লিখব। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: উপন য স ল খ ভ রমণক হ ন দ র জ বন আম র ক র কল প ক ত হল ই আম র ব ধ কর প রক শ lআপন র আম র য র জন য আম র স ন র ভর আপন র করল ম প রথম র একট ত রপর

এছাড়াও পড়ুন:

বেসরকারি চাকরিজীবীদের ঘুমের মধ্যেই কেন বেতন কমে যাচ্ছে

প্রতিবছর বাজেট আসে এবং মোটামুটি সবার আশায় গুড়ে বালি পড়ে। এটা মোটামুটি সব বছরেই সবাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। বিগত ফ্যাসিস্ট রেজিম চলে যাওয়ার পর সবাই আশা করেছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য একটা যুগোপযোগী বাজেট হবে। কিন্তু সেই গণ্ডি থেকে এবারও বের হতে পারল না সরকার। ফলাফল প্রতিবছরের ন্যায় এবারও আমাদের বেতন কমছে।

এই কমা হচ্ছে দুই ভাবে ১. ট্যাক্সের চাপ, ২. মুদ্রাস্ফীতি। আর এটা করতে হচ্ছে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় যা বেশির ভাগই সরকারি কর্মচারীদের বেতন–ভাতা, পেনশন এবং তাদের নিজেদের অক্ষমতার জন্য কর আদায় কম হওয়ার ঘাটতি মেটাতেই। এখন দেখি কীভাবে কমছে।

আয়কর স্ল্যাব পরিবর্তন

আমাদের সরকারের সবচেয়ে সহজ আদায়যোগ্য কর হচ্ছে ব্যাক্তিগত আয়কর। কারণ, সবার বেতন ব্যাংকে যায়, অফিস থেকেই ট্যাক্স কেটে রাখে, এমনকি কারও বেতন ১৫ হাজার টাকা হলেও টিন খোলার বাধ্যবাধকতা আছে এবং অফিসগুলোতে ট্যাক্স রিটার্নের কাগজও জমা দিতে হয়। ফলে এনবিআর মোটামুটি বিনা পরিশ্রমেই ট্যাক্স পেয়ে যায়। এখন টিন খোলা মানে আপনার ট্যাক্স হোক না হোক আপনাকে ৫ হাজার টাকা দিতে হবেই। নতুন খুললেও ১ হাজার।

এখন এই বাজেটে ২০২৬-২৭ এর জন্য নতুন আয়কর প্রস্তাব করা হয়েছে। এবং এখানেই আপত্তি। এখন দেখে নিই বর্তমান আয়করের সঙ্গে প্রস্তাবিত আয়করের কী পার্থক্য।

২০২৪-২৫ সালের বর্তমান কাঠামো অনুসারে প্রথম ৩,৫০,০০০ পর্যন্ত ০ শতাংশ, পরবর্তী ১,০০,০০০ পর্যন্ত ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৪,০০,০০০ পর্যন্ত ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৫,০০,০০০ পর্যন্ত ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫,০০,০০০ পর্যন্ত ২০ শতাংশ, পরবর্তী ২০,০০,০০০ পর্যন্ত ২৫ শতাংশ, ৩৮,৫০,০০০ টাকার ঊর্ধ্বে ৩০ শতাংশ।
প্রস্তাবিত ২০২৬-২৭ সালে আছে প্রথম ৩,৭৫,০০০ পর্যন্ত ০ শতাংশ ,পরবর্তী ৩,০০,০০০ পর্যন্ত ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৪,০০,০০০ পর্যন্ত ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫,০০,০০০ পর্যন্ত ২০ শতাংশ, পরবর্তী ২০,০০,০০০ পর্যন্ত ২৫ শতাংশ, ৩৮,৫০,০০০ টাকার ঊর্ধ্বে ৩০ শতাংশ।

আরও পড়ুনবেসরকারি চাকরিজীবীদের দেখার দায়িত্ব কার?০১ মার্চ ২০২৩

প্রথম অংশে ছাড় দিলেও (বাস্তবে ছাড় না, ৫০০০ টাকা তো দিতে হবেই) পরের সব ভাগেই তারা ১ লাখ টাকা করে কমিয়ে দিয়েছে। ফলাফল হবে সবার ওপরই বাড়তি চাপ বাড়বে। কেমন বাড়বে সেটা দেখি কারও বাৎসরিক করযোগ্য আয় (৫০ হাজার প্রতি মাসে) যদি হয়, তাঁর আয়কর বাড়বে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। এভাবে আসলে সবার ট্যাক্সই বাস্তবে বেড়ে গেল। মানে বেতন কমে গেল।

এ ছাড়া আর এক জায়গায় সরকার কমিয়েছে, সেটা হচ্ছে আগে বিনিয়োগ করে কর রেয়াত পাওয়া যেত। এখানেও সরকার মধ্যবিত্তদের ওপর হাত দিয়েছে। ২০১৯-২০ করবর্ষে রিবেটযোগ্য বিনিয়োগ সীমা ছিল করযোগ্য আয়ের ২০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা (যেটি কম), রিবেট হার (ছাড়ের হার) ছিল মোট রিবেটযোগ্য বিনিয়োগের ওপর ১৫ শতাংশ, যেখানে সর্বোচ্চ ছাড় পাওয়া যেত ৩ দশমিক ৭৫ লাখ টাকা।

২০২৪-২৫ করবর্ষে সেটা এখন রিবেটযোগ্য বিনিয়োগ সীমা করযোগ্য আয়ের ২০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৫ কোটি টাকা (যেটি কম) রিবেট হার (ছাড়ের হার) বাৎসরিক আয় ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫ শতাংশ এবং ১৫ লাখ টাকার ওপরে হলে ১০ শতাংশ।

২০২৬-২৭ করবর্ষে (প্রস্তাবিত) রিবেটযোগ্য বিনিয়োগ সীমা হবে করযোগ্য আয়ের ২০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৫ কোটি টাকা (যেটি কম), যা আগের মতোই; কিন্তু পরিবর্তন এসেছে রিবেট হার (ছাড়ের হার) আয় ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫ শতাংশ, ১০-২৬ লাখ টাকা পর্যন্ত ১২ শতাংশ এবং আয় ২৬ লাখ টাকার ওপরে গেলে ১০ শতাংশ।

সরকার বিনিয়োগও চাইবে আবার রিবেটে ছাড়ও কমিয়ে দেবে। এ রকম পরস্পরবিরোধী অবস্থান কেন? এই বুদ্ধি কার কাছ থেকে আসে?

মূল্যস্ফীতি

বহুদিন ধরেই আমাদের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি ঘুরঘুর করছে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ের পরিসংখ্যান মতে, গত বছরের গড় ইনক্রিমেন্ট ছিল ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এখন সরকার আশা করছে এই বছর মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারবে। তা যদি আরও নামানো না হয়, তাহলে আসলে বেতন কমতেই থাকবে তত দিন পর্যন্ত। করোনার পর থেকে সবার বেতন মূল্যস্ফীতির হিসাবে প্রতিবছর অন্তত ৪ শতাংশের কাছাকাছি করে কমছে। সেই হিসাবে এখন ২০ শতাংশের কাছাকাছি। যেহেতু তাদের কোথাও চাপ দেওয়ার নাই, তারা ব্যয় সংকোচন করে নিজেদের চালিয়ে নিচ্ছে।

সাধারণ মানুষের ওপর এই চাপ কেন

এই চাপ পুরোপুরি সরকারের অদক্ষতার জন্য। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার দায় সরকারি কর্মচারীদের। কিন্তু তাঁরা বিগত বছরগুলোতে এই কাজ করতে চরমভাবে ব্যর্থ। বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা (তাঁরা দুজনই আমলাতন্ত্রের বাইরের) কিছু যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে এখন কিছুটা কমছে, যদিও তা আরও কমে ৫ শতাংশের কাছাকাছি আসা উচিত। বাংলাদেশের আশপাশে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল সবার মূল্যস্ফীতি এখন ৪ এর নিচে। শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতিতে শূন্য থেকেও নিচে। কিন্তু সরকারের এসব অদক্ষতার জন্য কারও কখনো কোনো শাস্তি হয় না।

এরপর আসে এনবিআরের অদক্ষতা। এই অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে তারা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৫৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ আদায় করতে পেরেছে। এনবিআর কখনোই তার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে না, এবার যেহেতু প্রায় ১ মাসের কলমবিরতি ছিল, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব একেবারেই হবে না।

কিন্তু সরকার মুখে সবাইকে খরচ কমাতে বলেও প্রস্তাবিত বাজেটে খরচ বেতন–ভাতাতে গত বছরের থেকে ৩ হাজার কোটি এবং পেনশনেও খরচ বেড়েছে প্রায় ৩৬ শতাংশ। যেখানে অনেক দিন ধরেই প্রস্তাবনা ছিল এই খাতের খরচ ২০ শতাংশ কমানোর। যেহেতু এনবিআরের মানুষজন জানে কীভাবে নিজেদের (ব্যাপক অর্থে সরকারি কর্মচারীদের) ওপর চাপ না পড়ে, তাই সহজ সমাধান বেসরকারি খাতের মানুষের ওপর নতুন ট্যাক্সের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া। কেন বলছি, এই বোঝা কি শুধু বেসরকারি মানুষজনের ওপর? কারণ, সরকারি কর্মচারীদের ট্যাক্স শুধু বেসিকের ওপর হয়, বাকি সব ভাতা ট্যাক্স ফ্রি।

আয়কর দিয়ে বেসরকারি কর্মজীবীরা কিছুই পাচ্ছে না?

বহুদিন ধরে দাবি ছিল বেসরকারি কর্মজীবীদের জন্য আইন। সরকার সর্বজনীন পেনশন স্কিম করেছে; কিন্তু তা আসলে বেশির ভাগ মানুষকে আস্থা দিতে পারেনি। এই সরকার সেই পেনশন স্কিম ঠিক করার কোনো চেষ্টাও নেয়নি। দরকার ছিল যারা ট্যাক্স দিচ্ছে, তাদের ট্যাক্সের টাকার একটা অংশ দিয়ে এই স্কিম চালানো। তাহলে মানুষ ট্যাক্স দিয়ে কিছু অন্তত পাচ্ছে, বলে ভরসা পেত।

প্রস্তাব কী

ভারতে আয়করমুক্ত সীমা ৪ লাখ রুপি, পাকিস্তানে ৬ লাখ এবং শ্রীলঙ্কায় ১২ লাখ। ভারতের রিবেট সিস্টেমে একজন ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত রিবেট পেতে পারে। প্রথমে সরকার টাকা কেটে নিলেও পরে ফেরত দেয়। এদের সেন্ট্রাল কন্ট্রোল প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং কোম্পানিগুলো ইনস্যুরেন্স দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে। এদের সবারই প্রথম স্ল্যাব ৫ শতাংশ। যাহোক, এই অবস্থায় আমি ২০১৯-২০ সালের আয়কর স্ল্যাব তুলে ধরে, ২০২৪-২৫ এবং ২০২৬-২৭ সমন্বয়ে সবার উপযোগী একটা সীমা প্রস্তাব করছি।

২০১৯-২০ আয়কর বর্ষে ছিল আয়করমুক্ত সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার, পরবর্তী ৪ লাখ ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৬ লাখ ২০ শতাংশ, পরবর্তী ৩০ লাখ ২৫ শতাংশ, এরপর ৩০ শতাংশ।
সেই হিসাবে নতুন প্রস্তাব: আয়করমুক্ত সীমা ৩ লাখ ৭৫ হাজার, পরবর্তী ১,০০,০০০ পর্যন্ত ৫ শতাংশ,  পরবর্তী ৪ লাখ ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৬ লাখ ২০ শতাংশ, পরবর্তী ৩০ লাখ ২৫ শতাংশ, এরপর ৩০ শতাংশ। এ ছাড়া রিবেটের হার ২০১৯-২০ অর্থবছরের অনুরূপ করা উচিত। এবং ন্যূনতম কর ৫ হাজারের পরিবর্তে ৩ হাজার করা উচিত। এই হার যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে একজন বার্ষিক ৬ লাখ টাকা আয় করা মানুষের কর কমবে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। মানুষের সঞ্চয় এবং বিনিয়োগও বাড়বে। যার সুফল পাবে সরকার।  

এ ছাড়া দেশের টিন থাকা মানুষের মধ্যে মাত্র ৩৫ শতাংশ মানুষ ট্যাক্স দেয়। সহনীয় মাত্রায় ট্যাক্স ঠিক করলে তারাও দিতে উৎসাহী হবে। যদি তাদের অন্তত একটা সুবিধা দেওয়া যায়, দেশের শতভাগ মানুষই ট্যাক্স দেবে। এ ছাড়া যারা কর দেয় তাদের ওপর চাপ না বাড়িয়ে বরং এর আওতা বাড়ানো উচিত। যেহেতু এক দেশে দ্বৈত আইন থাকতে পারে না, সরকারি কর্মচারীদেরও একই আয়কর আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত।

সরকার যদি এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করে সরকারের আয় না কমে বরং বাড়বে এবং অনেক মানুষকেই আইন মানতে উদ্বুদ্ধ করবে। বাংলাদেশের মানুষ সরকারকে সাহায্য করতে চায়, তার বড় প্রমাণ রেমিট্যান্স–যোদ্ধারা। এখন আয়কর আইন সহজ করে বাকিদেরও দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দেওয়ার দায়িত্বও সরকারের।

সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট
ই–মেইল: [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ