আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থার কাজ হলো, কোনটি দেহের জন্য উপকারী আর কোনটি ক্ষতিকর, তা ঠিকভাবে বুঝে নেওয়া। এ জন্য শরীরকে ভালো ও খারাপ বস্তু চেনাতে হয়; আর পরিচয়টা হয় যখন শিশুরা মাটিতে খেলাধুলা করে। কারণ, তখন দেহ ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস চিনতে পারে এবং চিনে নিতে পারে উপকারী জীবাণুকেও।

এখানে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো ‘গাট মাইক্রোবায়োম’। আমাদের পেটের ভেতরে বাস করে কোটি কোটি ক্ষুদ্র জীবাণু। এগুলোর বেশির ভাগই আমাদের জন্য উপকারী। এগুলো যেমন খাবার হজম করতে সাহায্য করে, দেহে ভিটামিন তৈরি করে এবং রোগ ঠেকাতে সাহায্য করে। আর এসব ভালো জীবাণু থেকেই রোগ প্রতিরোধব্যবস্থার সঠিক নির্দেশনা পাওয়া যায়।

আরও পড়ুনশিশুর হোমওয়ার্ক নিয়ে বিপত্তি?২২ এপ্রিল ২০২৫

শিশুর জীবনের প্রথম বছরটা এই গাট মাইক্রোবায়োম গঠনের জন্য সবচেয়ে জরুরি। শিশুরা নরমাল ডেলিভারি বা স্বাভাবিক উপায়ে জন্মালে মায়ের দেহ থেকে কিছু উপকারী জীবাণু পায়। আর মায়ের দুধ খেলে তো পায়ই। এরপর শিশুটি বড় হতে হতে আরও বেশি জীবাণুর সংস্পর্শে আসে। যেমন মাটি, গাছপালা, পোষা প্রাণী বা খেলার মাঠ থেকে আসে জীবাণুর সংস্পর্শে।

এ ক্ষেত্রে ওল্ড ফ্রেন্ডস হাইপোথিসিস বা তত্ত্বের কথা বলতে হয়। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, ছোটবেলায় যত বেশি উপকারী জীবাণুর সংস্পর্শে আসা যাবে, ততই শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার জন্য ভালো। এখানে শৈশবের ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলোকে বলা হচ্ছে পুরোনো বন্ধু। এরা মানবদেহের কোনো ক্ষতি করে না।

হাইজিন হাইপোথিসিস নামের আরেক তত্ত্বের কথাও বলে রাখা ভালো। এই তত্ত্ব অনুসারে, শৈশবে যে যত বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকে, বড় হতে হতে তার অ্যালার্জির ঝুঁকি তত বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু কৃষিনির্ভর পরিবেশ বা খামারে বড় হয় বা যাদের বাড়িতে পোষা প্রাণী থাকে, তাদের অ্যালার্জি কম হয়। এ ছাড়া শৈশবে কোনো শিশুকে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ালে বা সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে শিশু জন্মালে অ্যালার্জির ঝুঁকি বেশি থাকে।

আরও পড়ুনশিশুর আকস্মিক দুর্ঘটনায় কী করবেন০৪ মে ২০২৫

ফিনল্যান্ডে এক গবেষণায় শহরটির কিছু শিশুকে বন থেকে আনা মাটি ও ঘাসে খেলতে দেওয়া হয়েছিল। মাত্র এক মাসেই তাদের ত্বকে নিরীহ উপকারী জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল উল্লেখযোগ্য হারে। তাদের রক্তে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা সম্পন্ন বিশেষ কোষও বেড়ে গিয়েছিল। এর থেকেই বোঝা যায়, মাটির জীবাণু শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়।

আর সুইডেনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা খামারে বড় হয় বা যাদের পোষা প্রাণী আছে, তাদের অ্যালার্জিজনিত সমস্যা ভোগার হার কম এবং গাট মাইক্রোবায়োমে উপকারী জীবাণুর পরিমাণ বেশি। তবে মনে রাখতে হবে, অ্যালার্জি হওয়ার পেছনে জিনগত ব্যাপারও আছে। আর সবার শরীর একরকম নয়। তাই এটা হলফ করে বলা যাবে না যে বাড়িতে পোষা কুকুর বা বিড়াল থাকলেই শিশুর অ্যালার্জি হবে না।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শহরের রাস্তার পাশে বা দূষিত জায়গার মাটি কিন্তু বিপজ্জনক হতে পারে। এতে ক্ষতিকর রাসায়নিক, যেমন সিসা থাকতে পারে। তাই শিশুরা যেন মাটি খেয়ে বা শুঁকে না ফেলে, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।

সব মিলিয়ে এটা নিশ্চিত, শিশুদের মাটিতে খেলতে দেওয়া উচিত নিয়মিত। প্রকৃতির মধ্যে থাকলে শিশুর শরীর ভালো থাকবে, বাড়বে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা।

সূত্র: লাইভ সায়েন্স

আরও পড়ুনকোষ্ঠকাঠিন্য থেকে শিশু যেসব রোগে ভুগতে পারে১১ মে ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য তত ত ব উপক র

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ