দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধির যেই চিত্র বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে উঠিয়া আসিয়াছে, উহা উদ্বেগজনক। সোমবার সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলমান অর্থবৎসরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাইয়া ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশে উপনীত, যাহা গত বৎসর একই সময়ে ছিল ৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। সংখ্যার হিসাবে উক্ত সময়ে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৪ লক্ষ হইতে বৃদ্ধি পাইয়া ২৭ লক্ষ ৩০ সহস্রে থিতু হইয়াছে। বিষয়টা উদ্বেগজনক এই কারণে, বেকারত্বের রাজনৈতিক ও সামাজিক অভিঘাত কাহারও জন্য সুখকর নহে। বৈধ আয়ের পন্থা না পাইলে অনেকে জীবিকা নির্বাহে ক্ষেত্রবিশেষে নীতি-নৈতিকতাও বিসর্জন দিতে দ্বিধা করে না। সমাজবিজ্ঞানীরা উহাকেই চৌর্যবৃত্তি, ডাকাতি, রাহাজানির ন্যায় নানাবিধ অপরাধ বিস্তারের মোক্ষম কারণ বলিয়া মনে করেন। এহেন পরিস্থিতি দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতারও জ্বালানিরূপে সাব্যস্ত হইয়া থাকে।
দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধির এই চিত্র এমন সময়ে জনসমক্ষে উপস্থিত, যখন জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পরিণতিতে সৃষ্ট রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা থামিয়া যায় নাই। বরং মব সন্ত্রাস নামক নূতন নূতন অস্থিতিশীলতা অপরাধের অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিয়া চলিয়াছে। প্রসঙ্গক্রমে বলিয়া রাখা প্রয়োজন, বিবিএসের সংজ্ঞা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বেকার জনগোষ্ঠী মূলত তাহারাই, যাহারা জরিপ শুরুর পূর্বের সাত দিনে কমপক্ষে এক ঘণ্টাও কোনো কার্যে ব্যাপৃত হন নাই, কিন্তু কার্যের অভিপ্রায়ে ঐ সাত দিন এবং আগামী দুই সপ্তাহের জন্য প্রস্তুত ছিলেন এবং জরিপ শুরুর পূর্বের ৩০ দিনে বেতন বা মজুরি বা মুনাফার বিনিময়ে কোনো না কোনো কার্যের সন্ধান করিয়াছেন। বেকারের উল্লিখিত সংজ্ঞা অধুনা অচল। অর্থাৎ প্রকৃত বেকারত্ব বিবিএসের জরিপের তথ্য অপেক্ষা অধিকতর হইবার আশঙ্কাই প্রবল। এই প্রেক্ষাপটে বেকারত্ব লইয়া রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকগণ, তৎসহিত নাগরিকদেরও মনোজগতে ভাবনার উদয় হইবার প্রয়োজন রহিয়াছে।
বেকারত্ব বৃদ্ধির কারণ অন্বেষণে অর্থনীতিবিদগণ সঠিকভাবেই দীর্ঘদিন ধরিয়া চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রবণতা এবং ব্যাংক ঋণের সুদহার অতিরিক্ত হইবার ঘটনাকে দায়ী করিয়াছেন। বেসরকারি খাতে বটেই, সরকারি খাতেও নূতন কর্মসংস্থান বর্তমানে নাই বলিলেই চলে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস-বিসিএস পরীক্ষা প্রায় এক বৎসর ধরিয়া বন্ধ। এমনকি ‘বিসিএসজট’ চলিবার সংবাদও আসিয়াছে। অন্যান্য সরকারি চাকুরিতেও নিয়োগ প্রায় বন্ধ। অন্যদিকে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের ভ্রান্ত নীতির কারণে বিগত কয়েক বৎসর যাবৎ কর্মসংস্থানের বৃহত্তম খাত বলিয়া পরিচিত বেসরকারি খাতে নিয়োগের যে খরা চলিতেছিল; যাহার কারণে তৎকালে সৃষ্ট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ব্যঙ্গ করিয়া চাকুরিবিহীন প্রবৃদ্ধিরূপে বর্ণনা করা হইত, সেই খরা অদ্যাবধি কাটে নাই। তদুপরি, বিশেষত গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বিশৃঙ্খলার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতার সুযোগ লইয়া বিবিধ প্রকার দুর্বৃত্ত বহু শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে হামলা চালাইয়া সেইগুলি বন্ধ করিয়া দিয়াছে। অন্য কিছু কারণেও বহু কলকারখানার দরজা তালাবদ্ধ। ফলস্বরূপ, গত ৯ মাসে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নাগরিক বেকারের খাতায় নাম লিপিবদ্ধ করিয়াছেন।
আমর জানি, তারুণ্যের আধিক্যের কারণে বাংলাদেশ বর্তমানে জনমিতির লভ্যাংশের যুগে রহিয়াছে, যাহা যথাযথ প্রক্রিয়ায় ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বের অনেক দেশ ইতোপূর্বে বিশেষত অর্থনৈতিক উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করিয়াছে। স্বভাবতই, এই তরুণ কর্মশক্তিকে উপযুক্ত কার্যে প্রযুক্ত করিতে না পারিলে রাষ্ট্রের জন্য তাহা বিশাল অপচয়রূপে প্রতিভাত হইবে। সরকারের শীর্ষ মহল দাবি করিতেছে, অর্থনীতি ইতোমধ্যে স্থিতিশীল হইয়া উঠিয়াছে। যাহার সুফল অচিরেই জনগণ পাইতে শুরু করিবে। কিন্তু বেকারত্ব বৃদ্ধির হার অব্যাহত থাকিলে তো সকলই গরল ভেল!
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সুস্থধারার তর্কবিতর্ক হোক
চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মূল চেতনা ছিল সমাজ-রাষ্ট্রের সর্বস্তর থেকে বৈষম্যের অবসান। জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ধাপে ধাপে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ পায় এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটায়। আন্দোলনকে চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছে দিতে নারীদের অবদান ছিল অসামান্য, অনেক ক্ষেত্রে মোড় বদলকারী। অভ্যুত্থান পরিবর্তনের যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, তা পূরণে অন্তর্বর্তী সরকার অন্যান্য কমিশনের পাশাপাশি নারী সংস্কার কমিশন করে। সম্প্রতি কমিশন তাদের প্রতিবেদন ও সুপারিশ সরকারপ্রধানের কাছে জমা দেয়।
উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, নারী সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন আসার আগেই বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক গোষ্ঠীর কাছ থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে। কেউ কেউ কমিশন বাতিলেরও দাবি জানান। সংবিধান, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আমলাতন্ত্র, নির্বাচনী ব্যবস্থাসহ ১১টি ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য কমিশন করা হয়েছে। সব কটি কমিশনের প্রতিবেদন ও সুপারিশ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা অবস্থান দেখা গেছে। কিন্তু কেবল নারী কমিশনের ক্ষেত্রেই বাতিলের দাবি উঠেছে।
সংবিধান ও আইনে নারীদের প্রতি যেসব বৈষম্য আছে, তা বিলোপের দাবি দীর্ঘদিন ধরেই দেশের মানবাধিকারকর্মী ও আন্দোলনকর্মীরা জানিয়ে আসছেন। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন সম্পদ-সম্পত্তি, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদে নারীকে সমান অধিকার দেওয়া, বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বিশেষ বিধানের মাধ্যমে অপ্রাপ্তবয়স্ক (১৮ বছরের নিচে) মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার সুযোগ বন্ধ, নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করাসহ নানা সুপারিশ করেছে।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন নারীবান্ধব প্রস্তাব পেশ করবে, সেটাই স্বাভাবিক। একটি কমিশনের সব প্রস্তাব সমাজের সবার কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হবে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। কমিশনের কোনো প্রস্তাবে আপত্তি কিংবা বিরোধিতা থাকলে সেটা নিয়মতান্ত্রিকভাবে জানানোর সুযোগ রয়েছে। একটা সমাজ স্বাস্থ্যকর তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়েই গণতান্ত্রিকভাবে সামনে এগোয়। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, গণতান্ত্রিক এই রীতিনীতিকে বিবেচনার মধ্যে না নিয়েই নারী সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবি উঠেছে। এমনকি সমাবেশ করে নারীবিদ্বেষী ও অবমাননাকর বক্তব্যও দেওয়া হয়েছে। যদিও এর জন্য বিবৃতি দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে, কিন্তু এ ধরনের কর্মকাণ্ড নারীর অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা। উপরন্তু এ ধরনের কর্মকাণ্ডে বাইরের বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা যায়।
পুরুষতন্ত্র ও ধর্মীয় উগ্রবাদ নারীর অগ্রযাত্রায় প্রধান অন্তরায়। অভ্যুত্থানের পর নারীরা তাঁদের পোশাক ও চলাফেরার জন্যও বাস্তব ও সাইবারজগতে নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন। ধর্ষণসহ নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। কার্যত একটা গোষ্ঠীর দিক থেকে নারীদের পেছনে টেনে ধরার চেষ্টা দৃশ্যমান রয়েছে। এটা অপ্রত্যাশিত, এটা উদ্বেগজনক।
একসময়কার তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম অর্থনীতি। এই অগ্রযাত্রায় অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও অনবদ্য অবদান অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, খেলাধুলায় নারীদের অবদান কোনো অংশে কম নয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা এর বিশাল তরুণ জনশক্তি। নারী বা দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে পেছনে রেখে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বলি আর মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্নই বলি, সেখানে পৌঁছানো বাস্তবে অসম্ভব।
বৈষম্য বিলোপের মূল কথা হলো, নাগরিক হিসেবে নারী-পুরুষের সমমর্যাদা, সমান অধিকার। এর জন্য সবার আগে দরকার আইন, সংবিধানে যেসব বৈষম্যমূলক ধারা আছে, তার বিলোপ। এটা সত্যি যে সমাজ ও সংস্কৃতির শিকড়ে প্রোথিত নারীবিদ্বেষী মতাদর্শ ও আচরণ রাতারাতি পরিবর্তন হবে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ, দেশ-কাল বিবেচনায় সংস্কার কমিশনের কিছু প্রস্তাব হয়তো এখনকার বাস্তবতায় প্রাসঙ্গিকও নয়। কিন্তু এর জন্য নারী সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত অতি জরুরি সংস্কারগুলো আড়ালে চলে যেতে পারে না। নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে সবখানেই সুস্থধারার তর্কবিতর্ক হোক।