গত বছরের নভেম্বরে বন্ধ হওয়া একটি কারখানার কয়েকশ শ্রমিক গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বকেয়া বেতনের জন্য মহাসড়কে নেমেছিলেন। তাদের সরিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়ে লাঠিপেটা করেছে শিল্পপুলিশ। এ সময় পাল্টা ইট-পাটকেল ছোড়েন বিক্ষোভকারীরা। পরে সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। শুক্রবার সকালে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এদিন অন্তত ১০ শ্রমিক পুলিশের লাঠিপেটা ও সাউন্ড গ্রেনেডে আহত হয়েছেন। 

শ্রমিকরা জানান, দুই মাসের বকেয়া বেতন রেখেই ওই এলাকার মাহমুদ জিনসের কারখানাটি গত বছরের ৯ নভেম্বর বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। বারবার নোটিশ দিয়ে বেতন পরিশোধের তারিখ দিলেও তাদের পাওনা পরিশোধ করা হয়নি। অনেকেই অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কাজ নিয়েছেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিন ধরে প্রতি মাসেই দু-তিনবার মহাসড়ক অবরোধ করে বকেয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন।

শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে তিন শতাধিক শ্রমিক চন্দ্রা ত্রিমোড় এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করেন। এতে সড়কের ঢাকামুখী লেনে দীর্ঘ যানজট দেখা দেয়। চরম দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। সংবাদ পেয়ে সেখানে যান শিল্পপুলিশের সদস্যরা। তারা শ্রমিকদের বুঝিয়ে মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। দুপুরের দিকে তাদের সরিয়ে দিতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া শুরু হয়। ক্ষিপ্ত শ্রমিকরাও পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকেন। এ সময় কয়েক রাউন্ড সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। সেখানে অন্তত ১০ শ্রমিক আহত হন। অন্য শ্রমিকরা তাদের উদ্ধার করে স্থানীয় কয়েকটি ক্লিনিকে চিকিৎসা দেন।

মামলায় আসামি হওয়ার ভয়ে বিক্ষোভকারী শ্রমিকরা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তাদের ভাষ্য, অতীতে যে শ্রমিকরা গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধেই মামলা দিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। তারা প্রতি মাসেই বকেয়ার জন্য বিক্ষোভ করে আসছেন। পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর সদস্যরা প্রতিবারই তাদের বুঝিয়ে মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দেন। পাওনা পরিশোধের জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মালিকপক্ষ তাদের কাছে একের পর এক তারিখ দিলেও সেই প্রতিশ্রুতি রাখেনি। সর্বশেষ ১৫ মে বকেয়া বেতন পরিশোধের কথা দিয়েছিল তারা। সেদিনও টাকা পাননি। 

এলাকাবাসী জানায়, ২২ মে রাতে কারখানার সামনে শ্রমিকদের উপস্থিত থাকতে উপজেলার কয়েকটি এলাকায় মাইকিং করা হয়। এ ঘোষণার পর শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে তিন শতাধিক সাবেক শ্রমিক ওই কারখানার সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। পরে ১০টার দিকে মহাসড়ক অবরোধ করেন। 

এ ঘটনায় কারখানা কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। কালিয়াকৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিয়াদ মাহমুদ বলেন, সকালে শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। তারা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করলে সেখান থেকে সরে যেতে বারবার অনুরোধ করেন। কিন্তু শ্রমিকরা পুলিশের ওপর চড়াও হলে তাদের লাঠিচার্জ ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়।

.

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

ধান চাষে আশা জাগাচ্ছে এডব্লিউডি সেচ পদ্ধতি

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের কৃষক কমলেশ শর্মা পাঁচ বছর ধরে তিন একর জমিতে ধান চাষ করছেন। পানিনির্ভর এ ফসলে সেচ দিতে প্রতিবছর তিনি বিদ্যুৎ বিল গুনতেন ১৩ হাজার টাকার মতো। প্রচলিত সেচ পদ্ধতির চেয়ে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত সাশ্রয়ী অলটারনেট ওয়েটিং অ্যান্ড ড্রায়িং (এডব্লিউডি) পদ্ধতি ব্যবহারে সেই খরচ এখন নেমেছে ১০ হাজার টাকায়। আগে যেখানে এক মৌসুমে ৭০-৮০ বার সেচ দিতে হতো, এখন দিতে হচ্ছে ৬০ বার। এ ছাড়া প্রতি বিঘায় ধানও মিলছে ৫ থেকে ৭ মণ বেশি। পরিমিত সেচ দেওয়ায় জমিতে হয় না জলাবদ্ধতাও। এতে একদিকে যেমন ভূগর্ভস্থ পানির অপচয় রোধ হয়েছে, কমেছে রোগবালাইও।

শুধু কমলেশ শর্মা নন; কালীগঞ্জ উপজেলার ৬০০ কৃষক এডব্লিউডি পদ্ধতি ব্যবহার করে সুফল পেয়েছেন। শেয়ার দ্য প্ল্যানেটের সহযোগিতায় স্থানীয় এনজিও সোনার বাংলা ফাউন্ডেশন কৃষককে এডব্লিউডি কৌশলের আওতায় নিয়ে এসেছে। 

সম্প্রতি কালীগঞ্জের মহাদেবপুর, কুরুলিয়া, সুন্দরপুর, মহেশ্বরচন্দ, ইছাপুরসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত। চারদিক পাকা ধানের ঘ্রাণে ম-ম। কৃষক সোনালি ফসল মাড়াই করছেন। নিজের ক্ষেতের পাশে বসে কৃষক আমিনুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে জানান, এ পদ্ধতিতে ১২ ইঞ্চি একটি প্লাস্টিক পাইপের ৯ ইঞ্চি পর্যন্ত চারদিকে ছিদ্র করা হয়। এর পর ছিদ্রযুক্ত অংশ ধানের জমির নির্দিষ্ট স্থানে বসানো হয়। ভেতরের মাটি বের করার পর ছিদ্র দিয়ে পানি ঢোকে, যা দেখে জমিতে পানির পরিমাণ বোঝা যায়। ওই পানি দেখে প্রয়োজনমতো জমিতে সেচ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, এই পদ্ধতিতে জমিতে ধানের চারা বেশি গজাচ্ছে। রোগবালাইয়ের পরিমাণও কম। সেচ মালিকদেরও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খরচ কমে এসেছে।
উপজেলার সুন্দরপুর গ্রামের কৃষক আব্দুর রশিদ বলেন, আগে প্রতিদিন জমিতে সেচ দিতে হতো। এখন তিন-চার দিন অন্তর দিতে হয়। আগে না বুঝে পুরো জমিতে সেচ দেওয়া লাগত। অনেক বেশি বিদ্যুৎ বিল আসত। এখন তা লাগছে না। 

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) গবেষকরা বলছেন, বর্তমানে এক কেজি ধান উৎপাদনে দেড় হাজার লিটারের মতো পানি লাগে, যার বেশির ভাগই পাম্পের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ থেকে উত্তোলন করা হয়। এডব্লিউডি সেচ পদ্ধতিতে পানি সাশ্রয় হয় ২০০ লিটারের বেশি। সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পানি সাশ্রয় হয়। এতে উৎপাদন খরচ কমে ২০ শতাংশের মতো। এ ছাড়া ৩-১০ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন বাড়বে। 

ব্রির সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মাহবুবুল আলম বলেন, দেশের কিছু অংশে ইতোমধ্যে এই পদ্ধতি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এখন এডব্লিউডি পদ্ধতির প্রসারে সরকারি বিনিয়োগ দরকার। তিনি আরও বলেন, এডব্লিউডি পদ্ধতি বাস্তবায়নে প্রতিটি পাইপের খরচ ১০০-১৩০ টাকা। এক একর জমিতে তিনটি পাইপ যথেষ্ট।
স্থানীয় এনজিও সোনার বাংলা ফাউন্ডেশন কালীগঞ্জে এডব্লিউডি পদ্ধতির প্রসার ও প্রচারণায় কাজ করছে। ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শিবু পদ বিশ্বাস বলেন, আগে কৃষককে বিনামূল্যে পাইপ সরবরাহ করা হতো। কিন্তু এখন অনেকে নিজেরাই পাইপ কিনে নিচ্ছেন। 

ব্রির মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, দেশে ধানক্ষেত থেকে প্রতিবছর ক্ষতিকর মিথেন গ্যাস নির্গমন হয় প্রায় ১.৩৯ থেকে ১.৫৬ মিলিয়ন টন। সেচে এডব্লিউডি ব্যবহারের মাধ্যমে এটি ২৫-৩০ শতাংশ কমানো সম্ভব। এ ছাড়া ১০ লাখ হেক্টর জমিকে এডব্লিউডির আওতায় আনা গেলে বেঁচে যাওয়া পানি দিয়ে আরও প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমি বোরো চাষের আওতায় আনা যাবে। 

তবে বৃহত্তর পরিসরে এডব্লিউডি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। ধান বিজ্ঞানী এবং ব্রির সাবেক মহাপরিচালক ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, সবচেয়ে বড় বাধা, সেচ মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থা। 
পানি ব্যবহার করলে নলকূপ মালিককে পুরো মৌসুমের অর্থই পরিশোধ করতে হয় কৃষককে। সরকারকে এমন একটি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে কৃষকরা ব্যবহৃত পানির পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে অর্থ দেবেন। এ ছাড়া কৃষকরা প্রায়ই নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত হন। এই ক্ষেত্রে সরকারি নীতি সংস্কার দরকার। 
আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ) রিডুসিং এগ্রিকালচারাল মিথেন প্রোগ্রামের অধীনে দেশে এডব্লিউডি কৌশল প্রচারের জন্য কাজ করছে। বাংলাদেশে ইফাদের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. ভ্যালানটাইন আচানচো বলেন, মিথেন গ্যাস নির্গমনের অন্যতম প্রধান উৎস দেশের সেচনির্ভর ধান চাষ। ধানক্ষেতে তৈরি হওয়া অক্সিজেনহীন পরিবেশ মিথেন উৎপাদনকারী অণুজীবের জন্য আদর্শ অবস্থা তৈরি করে। এই অবস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের গতি বাড়িয়ে দেয় এবং বাংলাদেশের স্বল্পমেয়াদি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি করে। তিনি আরও বলেন, রিডিউসিং এগ্রিকালচারাল মিথেন প্রোগ্রাম কর্মসূচির মাধ্যমে ইফাদ অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছে, যাতে সচেতনতা বৃদ্ধি, সক্ষমতা উন্নয়ন এবং সরকারের ও সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের তথ্যপ্রমাণভিত্তিক সহায়তা দেয়। এতে জলবায়ু-স্মার্ট কৃষি চর্চার গ্রহণযোগ্যতা ত্বরান্বিত করা যায়। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ