চ্যাটজিপিটির ব্যবহার কি ‘মগজ পচিয়ে’ দিতে পারে, কী বলছেন গবেষকেরা
Published: 8th, July 2025 GMT
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চ্যাটজিপিটি চালু হওয়ার প্রায় তিন বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এরই মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে বিস্তর বিতর্ক উঠেছে। প্রশ্ন উঠছে, এআই কি ব্যক্তিগত শিক্ষায় কাজে লাগে, নাকি শিক্ষা ক্ষেত্রে অসততার পথ খুলে দেয়?
সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কথা হলো, এআই ব্যবহারে মানুষের ‘বুদ্ধির বিকাশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত’ হতে পারে। অনেকে বলছেন, শিক্ষার্থীরা কম বয়সে এআই–নির্ভর হয়ে পড়লে তাদের মৌলিক চিন্তা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতাই তৈরি হবে না।
সত্যিই কি তা–ই? যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্রে এমনটা ঘটতে পারে।
গবেষকদের দাবি, চ্যাটজিপিটির সহায়তায় প্রবন্ধ লেখার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বলতা তৈরি হয়। কারণ, এতে যে কেউ তাৎক্ষণিক সুবিধার জন্য চিন্তা করার পরিশ্রম এড়িয়ে যান। এতে করে শেখার বা সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা কমে যেতে পারে।
এআই এবং শুধু মস্তিষ্ক ব্যবহারের মধ্যে পার্থক্য
চার মাস ধরে চালানো গবেষণায় এমআইটির গবেষকেরা ৫৪ জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে ৩ ধাপে প্রবন্ধ লেখার কাজ দেন। এতে কেউ শুধুই নিজের মস্তিষ্ক ব্যবহার করে (‘ব্রেন অনলি’ গ্রুপ) প্রবন্ধ লেখেন, কেউ লেখেন সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে, আর কেউ লেখেন এআই টুল (চ্যাটজিপিটি) ব্যবহার করে।
গবেষকেরা প্রবন্ধ লেখার সময় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মস্তিষ্কে ঘটে যাওয়া মস্তিষ্কের তড়িৎ সংকেত পরীক্ষা করেছেন। সেই সঙ্গে প্রবন্ধের ভাষা এবং গুণগত মান বিশ্লেষণ করে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা বা সক্রিয়তা পরিমাপ করেছেন। অর্থাৎ এসব পদ্ধতির মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা কতটা মনোযোগ দিয়ে ও সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন, তা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে।
ফলাফলে দেখা গেছে, যাঁরা এআই ব্যবহার করে লিখেছেন, তাঁদের মস্তিষ্কের সক্রিয়তা অন্যদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। শুধু তা-ই নয়, তাঁরা নিজেদের লেখায় ব্যবহৃত উদ্ধৃতিও মনে রাখতে পারেননি। এমনকি, সেই লেখার ওপর তাঁদের সম্পৃক্ততার অনুভূতিও ছিল কম।
চতুর্থ ও সর্বশেষ ধাপে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের ভূমিকা বদলে দেওয়া হয়। যাঁরা প্রথম তিন ধাপে শুধু নিজের মস্তিষ্ক ব্যবহার করেছিলেন, তাঁরা এবার চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেন। আর যাঁরা প্রথম তিন ধাপে শুধু এআই ব্যবহার করেছিলেন, তাঁরা এবার মস্তিষ্ক ব্যবহার করে প্রবন্ধ লেখেন।
এবারের ফলাফল ছিল রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। দেখা যায়, এআই থেকে মস্তিষ্ক গ্রুপে আসা (এআই-টু-ব্রেন) ব্যক্তিদের ফল খারাপ হয়েছে। তাঁদের মানসিক সম্পৃক্ততা প্রথম ধাপের অন্য গ্রুপের চেয়ে সামান্য ভালো হলেও ‘ব্রেন-অনলি’ গ্রুপের তৃতীয় ধাপের তুলনায় তা ছিল অনেক কম।
এই ফলাফলের ভিত্তিতে এমআইটির গবেষকেরা দাবি করেন, দীর্ঘদিন এআই ব্যবহারের ফলে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে মানসিক দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। এতে শেখার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। অর্থাৎ যখন তাঁরা নিজেদের মস্তিষ্ক ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছেন, তখন তাঁরা আগের মতো মনোযোগ দিতে বা অন্য দুই গ্রুপের মতো ভালো করতে পারেননি।
নিজেদের গবেষণার বিষয়ে সতর্ক করে গবেষকেরা বলেন, চতুর্থ ও শেষ ধাপে মাত্র ১৮ জন (প্রতি গ্রুপের ৬ জন) অংশ নিয়েছেন। তাই এই ফলাফলকে প্রাথমিক হিসেবে গণ্য করা উচিত। এই ফলাফলের বিষয়ে নিশ্চিত হতে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
সত্যিই কি এআই আমাদের বোকা বানাচ্ছে
গবেষণায় যে ফল পাওয়া গেছে, তা থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না, যেসব শিক্ষার্থী এআই ব্যবহার করেছেন, তাঁদের মধ্যে ‘মানসিক দুর্বলতা’ তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সম্ভবত গবেষণার পদ্ধতির কারণেই, মানে গবেষণাটি যেভাবে পরিচালিত হয়েছে, সেই কারণে ফলাফল এমন হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রথম তিন ধাপের মধ্যে যাঁরা শুধু মস্তিষ্ক ব্যবহার করেছিলেন, তাঁদের মস্তিষ্কের কাজ করার ধরনে (নিউরাল সংযোগে) কিছুটা পরিবর্তন আসে। এটা সম্ভবত এই কারণে হয়েছে, তাঁরা এক কাজ বারবার করতে করতে সেটায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন।
এ ধরনের পরিবর্তনকে ‘ফ্যামিলিয়ারাইজেশন ইফেক্ট’ বলে। মানে কোনো কাজের সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে ওঠা। যত বেশি তাঁরা কাজটা করছেন, ততই তাঁরা সেটা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন, আরও দক্ষ হয়েছেন এবং তাঁদের চিন্তা করার ধরনও ধীরে ধীরে বদলে গেছে।
যখন চতুর্থ ধাপে এআই গ্রুপ শেষ পর্যন্ত মস্তিষ্ক ব্যবহার করে লেখার সুযোগ পেল, তখন সেটি ছিল তাদের জন্য প্রথম ও শেষবার প্রবন্ধ লেখার সুযোগ। এর ফলে যাঁরা শুরু থেকেই মস্তিষ্ক (ব্রেইন অনলি গ্রুপ) ব্যবহার করছিলেন, তাঁদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে শেষ ধাপে এআই গ্রুপ তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি। এসব কিছুর কারণে, চতুর্থ ধাপে এআই গ্রুপের অর্জন মস্তিষ্ক গ্রুপের প্রথম ধাপের চেয়ে সামান্য ভালো ছিল।
গবেষকদের দাবি পুরোপুরি ঠিক কি না, সেটা বুঝতে যাঁরা শুরুতে শুধু এআই ব্যবহার করেছিলেন (এআই-টু-ব্রেন গ্রুপ), তাঁদেরও এআই ছাড়া তিনবার লেখার কাজ করতে হতো। তাহলেই সঠিক তুলনা করা যেত।
অন্যদিকে শেষ ধাপে ব্রেন-টু-এআই গ্রুপ চ্যাটজিপিটিকে বেশি ভালোভাবে ও ঠিকভাবে ব্যবহার করেছিল। কারণ, তাদের চতুর্থ ধাপের লেখার বিষয় আগের তিনটি বিষয়ের যেকোনো একটার সঙ্গে মিল ছিল।
যেহেতু এআই ছাড়া লেখার সময় বেশি মনোযোগ দিতে হয়েছে, তাই ব্রেন-টু-এআই গ্রুপ আগে যা লিখেছিল, সেটা তাদের ভালো মনে ছিল। তাই তারা চূড়ান্ত ধাপে এআইকে মূলত নতুন তথ্য খুঁজে বের করতে এবং আগের লেখাগুলো আরও ভালোভাবে সাজিয়ে লিখতে ব্যবহার করেছে।
শিক্ষার মূল্যায়নে এআইয়ের কী প্রভাব পড়তে পারে
এআই নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে আমরা ক্যালকুলেটরের সূচনা যুগে ফিরে যেতে পারি।
১৯৭০-এর দশকে ক্যালকুলেটরের ব্যবহার শুরুর পর এসব যন্ত্রের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করতে স্কুল-কলেজের পরীক্ষা আগের তুলনায় অনেক বেশি কঠিন করে দেওয়া হয়েছিল। তবে হাত দিয়ে হিসাব করার বদলে শিক্ষার্থীদের ক্যালকুলেটর ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। আর তুলনামূলক জটিল কাজগুলোতে বেশি মনোযোগ দিতে বলা হয়েছিল।
পরীক্ষায় ক্যালকুলেটর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার পর মানদণ্ড অনেক বেশি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই শিক্ষার্থীদের আগের সমান বা তার চেয়েও বেশি কঠোর পরিশ্রম করতে হতো।
কিন্তু এআই নিয়ে সমস্যা হলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে এখনো অনেক শিক্ষক (পরীক্ষার বা মূল্যায়নের) মানদণ্ড তেমনটি বৃদ্ধি করেননি, যা এআই ব্যবহারকে জরুরি করে তোলে। তাঁরা এখনো শিক্ষার্থীদের পাঁচ বছর আগের মতো একই ধরনের কাজ করতে বলছেন। আর তাদের থেকে আগের মতোই মান আশা করছেন।
এ পরিস্থিতিতে এআই অধিকতর সাহায্য করার বদলে ক্ষতি করতে পারে। শিক্ষার্থীরা অনেক সময় এআইয়ের ওপর বেশি ভরসা করে। তারা নিজেরা ভালো করে চিন্তা করে শেখার চেষ্টা করে না। এই প্রবণতাকে ‘মেটাকগনিটিভ লেজিনেস’ বা মনের অলসতা বলা হয়।
ক্যালকুলেটরের মতো এআইও আমাদের এমন সব কাজ করতে সাহায্য করতে পারে এবং করা উচিত, যা আগে করা প্রায় অসম্ভব ছিল এবং যেসব কাজ করতে গেলে এখনো উল্লেখযোগ্য মনোযোগ ও সম্পৃক্ততা দরকার হয়। যেমন আমরা শিক্ষার্থীদের এআই দিয়ে একটা বিস্তারিত পাঠ পরিকল্পনা বানাতে বলতে পারি। তৈরির পর মৌখিক প্রশ্নের মাধ্যমে সেটার মান ও কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে পারি।
এমআইটির গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা এআই ব্যবহার করেছিলেন, তাঁরা আগের মতোই ‘সাধারণ ধাঁচের’ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তাঁরা ঠিক ততটুকুই মনোযোগ দিয়েছিলেন, যতটা দিয়ে সাধারণ মানের কাজ শেষ করা যায়।
শিক্ষার্থীদের যদি ক্যালকুলেটর দিয়ে বা না দিয়ে কঠিন হিসাব করতে বলা হতো, তাহলে একই জিনিসই ঘটত। যারা হাতে হাতে হিসাব করত, তাদের ঘাম ঝরত। আর যাদের ক্যালকুলেটর থাকত, তারা চোখের পলকে কঠিন হিসাব করে ফেলত।
এআইয়ের ব্যবহার শিখতে হবে
এআই এখন শেখার ধরন বদলে দিচ্ছে। আগে যেমন নিজেকে চিন্তা করে সমস্যা বুঝতে হতো, এখন অনেক কিছুই এআই করে দিতে পারছে। তাই আজকের ও আগামী দিনের শিক্ষার্থীদের এআই ব্যবহার করে আরও ভালোভাবে কীভাবে চিন্তা করতে হবে, সৃজনশীলতা বাড়াতে হবে এবং সমস্যার সমাধান করতে হবে, তা শিখতে হবে।
এখন কাগজে-কলমে প্রবন্ধ লিখে জটিল চিন্তাভাবনার প্রমাণ দেওয়ার যুগ শেষ হয়ে গেছে। ক্যালকুলেটর আবিষ্কারের ফলে ঠিক একইভাবে হাতে হাতে বড় সংখ্যা ভাগ করে দেখানোর দক্ষতার যুগ শেষ হয়ে গিয়েছিল।
সফল হতে হলে কখন ও কীভাবে এআই ব্যবহার করতে হবে, তা জানতে হবে। কোন কাজগুলো এআই দিয়ে করলে সময় ও চিন্তার চাপ কমবে, আর কোন কাজগুলো চিন্তা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে করতে হবে—তা বুঝে নেওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর ছ ল ন প রবন ধ ল খ র এআই গ র প র ব যবহ র ব যবহ র র মন য গ দ হ স ব কর ক জ করত পর ক ষ ক জ কর হয় ছ ল প রথম সমস য ফল ফল
এছাড়াও পড়ুন:
চ্যাটজিপিটির ব্যবহার কি ‘মগজ পচিয়ে’ দিতে পারে, কী বলছেন গবেষকেরা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চ্যাটজিপিটি চালু হওয়ার প্রায় তিন বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এরই মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে বিস্তর বিতর্ক উঠেছে। প্রশ্ন উঠছে, এআই কি ব্যক্তিগত শিক্ষায় কাজে লাগে, নাকি শিক্ষা ক্ষেত্রে অসততার পথ খুলে দেয়?
সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কথা হলো, এআই ব্যবহারে মানুষের ‘বুদ্ধির বিকাশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত’ হতে পারে। অনেকে বলছেন, শিক্ষার্থীরা কম বয়সে এআই–নির্ভর হয়ে পড়লে তাদের মৌলিক চিন্তা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতাই তৈরি হবে না।
সত্যিই কি তা–ই? যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্রে এমনটা ঘটতে পারে।
গবেষকদের দাবি, চ্যাটজিপিটির সহায়তায় প্রবন্ধ লেখার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বলতা তৈরি হয়। কারণ, এতে যে কেউ তাৎক্ষণিক সুবিধার জন্য চিন্তা করার পরিশ্রম এড়িয়ে যান। এতে করে শেখার বা সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা কমে যেতে পারে।
এআই এবং শুধু মস্তিষ্ক ব্যবহারের মধ্যে পার্থক্য
চার মাস ধরে চালানো গবেষণায় এমআইটির গবেষকেরা ৫৪ জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে ৩ ধাপে প্রবন্ধ লেখার কাজ দেন। এতে কেউ শুধুই নিজের মস্তিষ্ক ব্যবহার করে (‘ব্রেন অনলি’ গ্রুপ) প্রবন্ধ লেখেন, কেউ লেখেন সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে, আর কেউ লেখেন এআই টুল (চ্যাটজিপিটি) ব্যবহার করে।
গবেষকেরা প্রবন্ধ লেখার সময় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মস্তিষ্কে ঘটে যাওয়া মস্তিষ্কের তড়িৎ সংকেত পরীক্ষা করেছেন। সেই সঙ্গে প্রবন্ধের ভাষা এবং গুণগত মান বিশ্লেষণ করে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা বা সক্রিয়তা পরিমাপ করেছেন। অর্থাৎ এসব পদ্ধতির মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা কতটা মনোযোগ দিয়ে ও সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন, তা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে।
ফলাফলে দেখা গেছে, যাঁরা এআই ব্যবহার করে লিখেছেন, তাঁদের মস্তিষ্কের সক্রিয়তা অন্যদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। শুধু তা-ই নয়, তাঁরা নিজেদের লেখায় ব্যবহৃত উদ্ধৃতিও মনে রাখতে পারেননি। এমনকি, সেই লেখার ওপর তাঁদের সম্পৃক্ততার অনুভূতিও ছিল কম।
চতুর্থ ও সর্বশেষ ধাপে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের ভূমিকা বদলে দেওয়া হয়। যাঁরা প্রথম তিন ধাপে শুধু নিজের মস্তিষ্ক ব্যবহার করেছিলেন, তাঁরা এবার চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেন। আর যাঁরা প্রথম তিন ধাপে শুধু এআই ব্যবহার করেছিলেন, তাঁরা এবার মস্তিষ্ক ব্যবহার করে প্রবন্ধ লেখেন।
এবারের ফলাফল ছিল রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। দেখা যায়, এআই থেকে মস্তিষ্ক গ্রুপে আসা (এআই-টু-ব্রেন) ব্যক্তিদের ফল খারাপ হয়েছে। তাঁদের মানসিক সম্পৃক্ততা প্রথম ধাপের অন্য গ্রুপের চেয়ে সামান্য ভালো হলেও ‘ব্রেন-অনলি’ গ্রুপের তৃতীয় ধাপের তুলনায় তা ছিল অনেক কম।
এই ফলাফলের ভিত্তিতে এমআইটির গবেষকেরা দাবি করেন, দীর্ঘদিন এআই ব্যবহারের ফলে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে মানসিক দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। এতে শেখার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। অর্থাৎ যখন তাঁরা নিজেদের মস্তিষ্ক ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছেন, তখন তাঁরা আগের মতো মনোযোগ দিতে বা অন্য দুই গ্রুপের মতো ভালো করতে পারেননি।
নিজেদের গবেষণার বিষয়ে সতর্ক করে গবেষকেরা বলেন, চতুর্থ ও শেষ ধাপে মাত্র ১৮ জন (প্রতি গ্রুপের ৬ জন) অংশ নিয়েছেন। তাই এই ফলাফলকে প্রাথমিক হিসেবে গণ্য করা উচিত। এই ফলাফলের বিষয়ে নিশ্চিত হতে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
সত্যিই কি এআই আমাদের বোকা বানাচ্ছে
গবেষণায় যে ফল পাওয়া গেছে, তা থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না, যেসব শিক্ষার্থী এআই ব্যবহার করেছেন, তাঁদের মধ্যে ‘মানসিক দুর্বলতা’ তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সম্ভবত গবেষণার পদ্ধতির কারণেই, মানে গবেষণাটি যেভাবে পরিচালিত হয়েছে, সেই কারণে ফলাফল এমন হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রথম তিন ধাপের মধ্যে যাঁরা শুধু মস্তিষ্ক ব্যবহার করেছিলেন, তাঁদের মস্তিষ্কের কাজ করার ধরনে (নিউরাল সংযোগে) কিছুটা পরিবর্তন আসে। এটা সম্ভবত এই কারণে হয়েছে, তাঁরা এক কাজ বারবার করতে করতে সেটায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন।
এ ধরনের পরিবর্তনকে ‘ফ্যামিলিয়ারাইজেশন ইফেক্ট’ বলে। মানে কোনো কাজের সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে ওঠা। যত বেশি তাঁরা কাজটা করছেন, ততই তাঁরা সেটা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন, আরও দক্ষ হয়েছেন এবং তাঁদের চিন্তা করার ধরনও ধীরে ধীরে বদলে গেছে।
যখন চতুর্থ ধাপে এআই গ্রুপ শেষ পর্যন্ত মস্তিষ্ক ব্যবহার করে লেখার সুযোগ পেল, তখন সেটি ছিল তাদের জন্য প্রথম ও শেষবার প্রবন্ধ লেখার সুযোগ। এর ফলে যাঁরা শুরু থেকেই মস্তিষ্ক (ব্রেইন অনলি গ্রুপ) ব্যবহার করছিলেন, তাঁদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে শেষ ধাপে এআই গ্রুপ তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি। এসব কিছুর কারণে, চতুর্থ ধাপে এআই গ্রুপের অর্জন মস্তিষ্ক গ্রুপের প্রথম ধাপের চেয়ে সামান্য ভালো ছিল।
গবেষকদের দাবি পুরোপুরি ঠিক কি না, সেটা বুঝতে যাঁরা শুরুতে শুধু এআই ব্যবহার করেছিলেন (এআই-টু-ব্রেন গ্রুপ), তাঁদেরও এআই ছাড়া তিনবার লেখার কাজ করতে হতো। তাহলেই সঠিক তুলনা করা যেত।
অন্যদিকে শেষ ধাপে ব্রেন-টু-এআই গ্রুপ চ্যাটজিপিটিকে বেশি ভালোভাবে ও ঠিকভাবে ব্যবহার করেছিল। কারণ, তাদের চতুর্থ ধাপের লেখার বিষয় আগের তিনটি বিষয়ের যেকোনো একটার সঙ্গে মিল ছিল।
যেহেতু এআই ছাড়া লেখার সময় বেশি মনোযোগ দিতে হয়েছে, তাই ব্রেন-টু-এআই গ্রুপ আগে যা লিখেছিল, সেটা তাদের ভালো মনে ছিল। তাই তারা চূড়ান্ত ধাপে এআইকে মূলত নতুন তথ্য খুঁজে বের করতে এবং আগের লেখাগুলো আরও ভালোভাবে সাজিয়ে লিখতে ব্যবহার করেছে।
শিক্ষার মূল্যায়নে এআইয়ের কী প্রভাব পড়তে পারে
এআই নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে আমরা ক্যালকুলেটরের সূচনা যুগে ফিরে যেতে পারি।
১৯৭০-এর দশকে ক্যালকুলেটরের ব্যবহার শুরুর পর এসব যন্ত্রের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করতে স্কুল-কলেজের পরীক্ষা আগের তুলনায় অনেক বেশি কঠিন করে দেওয়া হয়েছিল। তবে হাত দিয়ে হিসাব করার বদলে শিক্ষার্থীদের ক্যালকুলেটর ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। আর তুলনামূলক জটিল কাজগুলোতে বেশি মনোযোগ দিতে বলা হয়েছিল।
পরীক্ষায় ক্যালকুলেটর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার পর মানদণ্ড অনেক বেশি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই শিক্ষার্থীদের আগের সমান বা তার চেয়েও বেশি কঠোর পরিশ্রম করতে হতো।
কিন্তু এআই নিয়ে সমস্যা হলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে এখনো অনেক শিক্ষক (পরীক্ষার বা মূল্যায়নের) মানদণ্ড তেমনটি বৃদ্ধি করেননি, যা এআই ব্যবহারকে জরুরি করে তোলে। তাঁরা এখনো শিক্ষার্থীদের পাঁচ বছর আগের মতো একই ধরনের কাজ করতে বলছেন। আর তাদের থেকে আগের মতোই মান আশা করছেন।
এ পরিস্থিতিতে এআই অধিকতর সাহায্য করার বদলে ক্ষতি করতে পারে। শিক্ষার্থীরা অনেক সময় এআইয়ের ওপর বেশি ভরসা করে। তারা নিজেরা ভালো করে চিন্তা করে শেখার চেষ্টা করে না। এই প্রবণতাকে ‘মেটাকগনিটিভ লেজিনেস’ বা মনের অলসতা বলা হয়।
ক্যালকুলেটরের মতো এআইও আমাদের এমন সব কাজ করতে সাহায্য করতে পারে এবং করা উচিত, যা আগে করা প্রায় অসম্ভব ছিল এবং যেসব কাজ করতে গেলে এখনো উল্লেখযোগ্য মনোযোগ ও সম্পৃক্ততা দরকার হয়। যেমন আমরা শিক্ষার্থীদের এআই দিয়ে একটা বিস্তারিত পাঠ পরিকল্পনা বানাতে বলতে পারি। তৈরির পর মৌখিক প্রশ্নের মাধ্যমে সেটার মান ও কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে পারি।
এমআইটির গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা এআই ব্যবহার করেছিলেন, তাঁরা আগের মতোই ‘সাধারণ ধাঁচের’ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তাঁরা ঠিক ততটুকুই মনোযোগ দিয়েছিলেন, যতটা দিয়ে সাধারণ মানের কাজ শেষ করা যায়।
শিক্ষার্থীদের যদি ক্যালকুলেটর দিয়ে বা না দিয়ে কঠিন হিসাব করতে বলা হতো, তাহলে একই জিনিসই ঘটত। যারা হাতে হাতে হিসাব করত, তাদের ঘাম ঝরত। আর যাদের ক্যালকুলেটর থাকত, তারা চোখের পলকে কঠিন হিসাব করে ফেলত।
এআইয়ের ব্যবহার শিখতে হবে
এআই এখন শেখার ধরন বদলে দিচ্ছে। আগে যেমন নিজেকে চিন্তা করে সমস্যা বুঝতে হতো, এখন অনেক কিছুই এআই করে দিতে পারছে। তাই আজকের ও আগামী দিনের শিক্ষার্থীদের এআই ব্যবহার করে আরও ভালোভাবে কীভাবে চিন্তা করতে হবে, সৃজনশীলতা বাড়াতে হবে এবং সমস্যার সমাধান করতে হবে, তা শিখতে হবে।
এখন কাগজে-কলমে প্রবন্ধ লিখে জটিল চিন্তাভাবনার প্রমাণ দেওয়ার যুগ শেষ হয়ে গেছে। ক্যালকুলেটর আবিষ্কারের ফলে ঠিক একইভাবে হাতে হাতে বড় সংখ্যা ভাগ করে দেখানোর দক্ষতার যুগ শেষ হয়ে গিয়েছিল।
সফল হতে হলে কখন ও কীভাবে এআই ব্যবহার করতে হবে, তা জানতে হবে। কোন কাজগুলো এআই দিয়ে করলে সময় ও চিন্তার চাপ কমবে, আর কোন কাজগুলো চিন্তা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে করতে হবে—তা বুঝে নেওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।