দেশে জাতীয় নির্বাচনের পালে হাওয়া লেগেছে। আগামী ফেব্রুয়ারি কিংবা এপ্রিলে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশে ভোটারদের কাছে বিএনপির বিকল্প হতে চাইছে ইসলামি দলগুলো। তারা এক ছাতার নিচে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আগামী নির্বাচনে লড়তে চায়। তবে ইসলামি দলগুলোর অতীত ঐক্যের ইতিহাস মোটেও সুখকর নয়, তাই তারা এ নির্বাচনকে ঘিরে ঐক্য গড়তে চাইলে আদতে তা কতটা সফল হবে, নাকি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে, তা নিয়ে চলছে জল্পনাকল্পনা। 

বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত ইসলামি রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ১০, সঙ্গে আরও কিছু অনিবন্ধিত ছোট দলও রয়েছে। এ দলগুলো মূলত তিনটি আদর্শিক ঘরানায় বিভক্ত। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী হলো ‘সংস্কারপন্থী’ ধারার সর্ববৃহৎ দল। 

কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দেওবন্দ আদর্শের দলগুলো হচ্ছে দ্বিতীয় ধারার; এর মধ্যে রয়েছে ইসলাম আন্দোলনের মতো দলগুলো। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক একটি ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠন হলো হেফাজতে ইসলাম। ‘অরাজনৈতিক’ হলেও এ সংগঠনে বিভিন্ন ইসলামী দলের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে।

এ দুটি ধারার বাইরেও আরও কয়েকটি গোষ্ঠী আছে, যারা রেজভি বা বেরলভি আদর্শের। এ দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ও বিভক্তির ইতিহাস একরকম মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো। একদিকে যখন ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন অপর দিকে বিভাজন অনিবার্য হয়ে ওঠে। 

ক্রিয়াশীল ইসলামি দলগুলোর মধে৵ কোনো না কোনোভাবে ঐক্য হলেও একমাত্র জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ১৯৭৯ সালের পর অন্য কোনো ইসলামি দলই ঐক্য করতে আগ্রহী হয়নি।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল পূর্বাভাস করা বেশ জটিল। আগের নির্বাচনগুলোর ফলাফলের চেয়ে এবারের ফলাফল ভিন্ন হতে পারে।

নির্বাচনী ঐক্য ও বিভক্তির ইতিহাস

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে ইসলামি রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ছিল ১০। ’৭১–পরবর্তী সময়ে এসব দল ও ধর্মীয় রাজনীতি দুটিই নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭৬ সালে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলে সেই বছর ডেমোক্রেটিক পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফতে রাব্বানী পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামী মিলে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লিগ (আইডিএল) নামে একটি জোটবদ্ধ রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠন করে। 

এই প্ল্যাটফর্ম ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং ৬টি আসন লাভ করে। এটি ছিল বাংলাদেশের ইসলামি ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম ঐক্য প্রচেষ্টা। ১৯৭৯ সালে জোটটির ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ও নেতৃত্ব নিয়ে দলগুলোর মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে জোটটি আর এগোতে পারেনি এবং সেখানেই ভাঙন ধরে। 

১৯৮১ সালে ইসলামপন্থী দলগুলো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য একটি ঐক্য প্রচেষ্টা শুরু করে। হাফেজ্জি হুজুর যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের ডাক দেন, তখন ইসলামি দলের নেতারা এবং কিছু অরাজনৈতিক আলেম তাঁর ডাকে সাড়া দেন। জামায়াতে ইসলামী ঐক্যে অংশগ্রহণ করতে চাইলে হাফেজ্জি হুজুর তাদের মওদুদির কিছু মতবাদ সংশোধন করার আহ্বান জানান এবং পত্রিকায় এ সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশের শর্ত জুড়ে দেন। 

জামায়াত ওই শর্ত মেনে না নেওয়ায় জামায়াতকে ছাড়াই ঐক্য হয়। চারটি দলের সমন্বয়ে গঠিত ঐক্যটি ‘উলামা ফ্রন্ট’ নামে পরিচিত ছিল। তবে তারা সে নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য কোনো সফলতা অর্জন করতে পারেনি।

১৯৮৭ সালে হাফেজ্জি হুজুরের মৃত্যুর পর কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। হাফেজ্জি হুজুরের মৃত্যুর পর তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী ফজলুল হক আমিনী, আজিজুল হক ও সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে তিনটি আলাদা দল প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে ফজলুল করীমের দলই বর্তমানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নামে পরিচিত।

১৯৯১ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৯০ সালের ২২ ডিসেম্বর ছয়টি দলের সমন্বয়ে ‘ইসলামী ঐক্যজোট’ গঠন করা হয়। জোটটি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে একটি আসন এবং মোট ভোটের ০.

৮ শতাংশ পায়। তবে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও নেতৃত্বের ভাগাভাগি নিয়ে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জোটটি আবার ভাঙনের মুখে পড়ে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী অন্যান্য ইসলামি দলের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলেও তারা এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ১৮টি আসন ও মোট ভোটের ১২.২ শতাংশ অর্জন করে। 

জোট কি আদৌ হবে? 

এবার ‘ইসলামী দলগুলোর ঐক্য’ বলতে মোটাদাগে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের জোটবদ্ধ হওয়াকে বোঝানো হচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে এ দল দুটি কখনো এক ছাতার নিচে আসেনি; বরং একধরনের দূরত্ব বজায় রেখেছে। 

গত প্রায় সাড়ে চার দশকের ইসলামি দলগুলোর ঐক্য প্রচেষ্টায় একটি বিষয় লক্ষণীয়, সব ক্রিয়াশীল ইসলামি দলগুলোর মধে৵ কোনো না কোনোভাবে ঐক্য হলেও একমাত্র জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ১৯৭৯ সালের পর অন্য কোনো ইসলামি দলই ঐক্য করতে আগ্রহী হয়নি। এর মূল কারণ ছিল জামায়েতের সঙ্গে অন্য ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর ধর্মীয় কিছু বিষয়ে মতানৈক্য। ফলে এবার যে ঐক্য প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে, সেখানে এসব বিষয়ের সমাধান না হলে আশু ঐক্য সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।

 লক্ষণীয়—মুখে জোটের কথা বললেও নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াত এককভাবে প্রায় সব আসনে নিজেদের প্রার্থী প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন দিয়ে রেখেছে। সে ক্ষেত্রে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জোট হলে দলটি তার শরিকদের কতটা ছাড় দেবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অপর দিকে মতভেদের কারণে এত দিন জামায়াতকে দূরে রাখা বাকি ইসলামি দলগুলো জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্ব কতটা মানবে সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ফলে এসব বিষয় সামনে রেখে ঐক্য প্রচেষ্টা থমকে যাওয়ার আশঙ্কাও কম নয়। 

ঐক্য হলে কী হবে? 

সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্ন, ইসলামি দলগুলো যদি এক ছাতার নিচে আসতে পারে, তবে তাদের জয়ের সম্ভাবনা কতটুকু বা তারা কেমন ভোট টানতে পারবে? ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সব ইসলামি দল মিলে মোট ভোটের ১৪.৪ শতাংশ অর্জন করতে সক্ষম হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোটের ভোট ছিল ১ শতাংশ। অর্থাৎ ঐতিহাসিকভাবে অন্যান্য ইসলামি দলসহ এদের সর্বোচ্চ ভোটব্যাংক ১৬ শতাংশ হতে পারে। সরকার গঠনের ক্ষেত্রে এ ভোটব্যাংক পর্যাপ্ত নয়। ফলে ভালো ফলের জন্য তাদের এবার হয়তো তরুণ ও নিরপেক্ষ ভোটারদের দিকে ঝুঁকতে হবে। 

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল পূর্বাভাস করা বেশ জটিল। আগের নির্বাচনগুলোর ফলাফলের চেয়ে এবারের ফলাফল ভিন্ন হতে পারে। কারণ, এবারের নির্বাচনের চারটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। 

এক. বিগত ১৬ বছর দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার কারণে কোন দলের সমর্থন বেড়েছে বা কমেছে এবং কোথায় আছে তা নির্ধারণ করা জটিল। 

দুই. এবারের নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ না থাকে, তবে তাদের সমর্থকেরা কোথায় যাবেন, সেটি এখনো অনিশ্চিত। 

তিন. এবারের নির্বাচনে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৪ জন তরুণ ভোটার; এই তরুণ ভোটাররা কাদের ওপর আস্থা রাখবেন, সেটি এখনো অনিশ্চিত। 

চার. গণ–অভ্যুত্থানের ফলে মানুষের চিন্তা ও চেতনায় পরিবর্তন এসেছে এবং এসব পরিবর্তন নির্বাচনের ফলাফলের ওপর যে প্রভাব ফেলবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে এসব দিক বিবেচনা করে যদি ইসলামি দলগুলো সঠিক কর্মপন্থা অবলম্বন করে, তবে তারা ভালো ফলের আশা রাখতে পারে। 

ভোটের মাঠের পরিস্থিতি

আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটারদের মনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতি নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, যার মধ্যে দুর্নীতি একটি প্রধান বিষয়। এ প্রেক্ষাপটে অন্যান্য দলের তুলনায় ইসলামি দলগুলোর প্রতি জনগণের আস্থা কিছুটা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইসলামি দলগুলো যদিও কখনো সরাসরি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়নি, তবু চারদলীয় জোটের শাসনামলে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা দখল–বাণিজ্যের অভিযোগ তুলনামূলকভাবে কম ছিল।

অন্যদিকে বিগত সময়ে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে ভারতের একধরনের দূরত্ব স্পষ্টভাবে লক্ষ করা গেছে। বিশেষ করে গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে ভারত ইসলামি দলগুলোর ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করেছে—এমন অভিযোগ উঠেছে। ফলে তাদের ‘ভারতপ্রেমী’ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের ভোটারদের কাছে এখন ‘ভারত ইস্যু’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয় এবং এ বিষয়ে ইসলামি দলগুলো সন্তোষজনক অবস্থানে থাকবে বলে ধারণা করা যায়। 

উল্লেখিত বিষয়গুলোতে ইসলামি দলগুলোর প্রতি জনমনে একরকম ধারণা থাকলেও নারীদের বিষয়ে তাদের ভাবনা বা পরিকল্পনা নিয়ে ভোটারদের জানার আগ্রহ রয়েছে। ভোটাররা জানতে চান, ইসলামি দলগুলো ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেলে তারা কি ধর্মীয় স্বাধীনতার পাশাপাশি নারীশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করবে? নারীদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অংশগ্রহণে তাদের ভূমিকা কী হবে? 

আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়, ইসলামি দলগুলোর সাংগঠনিক কাঠামোয় ভিন্নধর্মাবলম্বী এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। এ বিষয়ে ইসলামি দলগুলোর ভাবনা কী? কীভাবে তারা দেশের সব নাগরিকের জন্য সমানভাবে কল্যাণ ও উন্নয়নে কাজ করবে? 

শেষ কথা

ইসলামি দলগুলোর মধ্যে এর আগে একাধিকবার ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও ৫ আগস্ট–পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বাস্তবতায় পুনরায় দলগুলোর মধে৵ নতুন করে ঐক্যের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এই ঐক্য প্রচেষ্টা আদৌ সফল হবে কি না, কিংবা ঐক্য হলে আগামী নির্বাচনে তাদের ফলাফল কেমন হবে, তার উত্তর পেতে আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

এস কে তৌফিক হক, অধ্যাপক ও পরিচালক, সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সৈয়দা লাসনা কবীর, অধ্যাপক লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মোহাম্মাদ ঈসা ইবন বেলাল, গবেষণা সহযোগী, সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় 

*মতামত লেখকদের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ১৯৭৯ স ল র ফল ফল ন র ফল দল র স হওয় র ইসল ম র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

তিনদিন ধরে বাড়িঘরে হামলা লুটপাট চলছে

আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল নেতা সোহরাব মিয়া হত্যাকাণ্ডের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের কাঁঠালকান্দি গ্রাম ভুতুড়ে জনপদে পরিণত হয়েছে। পাল্টা হামলার মুখে গ্রাম ছেড়েছে শতাধিক পরিবার। ঘটনার তিনদিন পর আজ মঙ্গলবারও প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে হামলা–লুটপাট হয়েছে। 

চাতলপাড় ইউনিয়নের কাঁঠালকান্দি গ্রামে গত শনিবার মোল্লা গোষ্ঠী ও উল্টা গোষ্ঠীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে নিহত হন ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক সোহরাব মিয়া (২৬)। তিনি ছিলেন মোল্লা গোষ্ঠীর। এরপর উল্টা গোষ্ঠীর লোকজন গ্রাম ছাড়লেও প্রতিদিনই তাদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হচ্ছে।

সংঘর্ষের চারদিন পেরোলেও গ্রামটিতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়নি। চাতলপাড়ে একটি পুলিশ ফাঁড়ি থাকলেও এর সদস্য মাত্র ১০ জন। তারা বলছেন, কাঁঠালকান্দিতে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। তারা সেখানে যেতে নিরাপদবোধ করছেন না। তাছাড়া হাওড়বেষ্টিত গ্রামটিতে যাতায়াতের মতো বাহনও তাদের নেই।

চাতলপাড় পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের জনবল কম। হাওর এলাকা হওয়ায় যাতায়াতেও অসুবিধা। তাছাড়া নিহতের স্বজনরা টেঁটা-বল্লম নিয়ে পাহারা দেওয়ায় আমাদেরও নিরাপত্তা নেই।’ 

নাসিরনগর থানার ওসি আজহারুল ইসলাম জানান, সোহরাব মিয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

গ্রামের ইউপি সদস্য বাবুল মিয়ার দোতলা বাড়ি সংঘর্ষের পর গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিবার নিয়ে তিনি গ্রাম ছেড়েছেন। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক। ফলে তাদের কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সোমবার কাঁঠালকান্দি গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের পথে পথে ছড়িয়ে আছে ভাঙা কাচ, পোড়া টিন আর লণ্ডভণ্ড আসবাবপত্র। পোড়া, বিধবস্ত বাড়ি গ্রামজুড়ে। ২/৩টি পোড়া বাড়ি থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। ৩৭টির বেশি বাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে। ওইদিন সন্ধ্যার পর আগুন দেওয়া হয় উল্টা গোষ্ঠীর লিলু মিয়ার বাড়িতে। গতকাল জয়নাল মিয়া ও মো. হাসানের বাড়িতে ভাংচুর করা হয়। নাজমুল মিয়ার বাড়ি থেকে ৬০ মণ ধান লুট হয়।

গ্রামের ষাটোর্ধ্ব মমতাজ বেগম বলেন, ‘আমরা কোনো পক্ষকেই সমর্থন করিনি। তারপরও আমার বাড়িতে মোল্লা গোষ্ঠীর লোকজন হামলা করে সব ভেঙে নিয়ে গেছে। তিন দিন ধরে খাবারও নেই। হামলাকারীরা রান্নাঘরের চুলা, এমনকি টিউবওয়েলটিও তুলে নিয়ে গেছে।’ 

সাফিয়া বেগম নামের আরেক নারী বলেন, ‘আমার এক ছেলে সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে ঘর তুলেছিল। কিন্তু মোল্লা গোষ্ঠীর লোকজন ঘরটা পুড়িয়ে দিল। আজ আমার সব শেষ।’

অন্তঃসত্ত্বা কোহিনুর বেগম বলেন, ‘আমি অসুস্থ। আমাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে গলা থেকে স্বর্ণের চেইন পর্যন্ত নিয়ে গেছে। এমনকি আমার ওষুধগুলোও নিয়ে গেছে। বারবার অনুরোধ করার পরও আমার হাত-পা বেঁধে রেখে চলে যায়।’

কাঁঠালকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় সোমবার অন্তত ২১ শিক্ষার্থী অংশ নেয়নি। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এ বিদ্যালয়ের ৫০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩০০ জনের বেশিই অনুপস্থিত ছিল। আতঙ্কে একজন শিক্ষকও ছুটি নিয়ে আত্মগোপনে আছেন। 

প্রধান শিক্ষক তুহিনা বেগম বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা তো বটেই, শিক্ষকরাও আতঙ্কে আছেন। অভিভাবকদের ফোন করেও সাড়া পাচ্ছি না।’ 

চাতলপাড় বাজারের ছয়টি দোকানেও ভাংচুর লুটপাট হয়েছে। এর মধ্যে চালের আড়ত, মোবাইল ফোন এবং রড-সিমেন্টের দোকান রয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ