প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমাতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন (এনসিসি), প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ দুইবার করাসহ মৌলিক সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলো এখনও একমত হতে পারেনি। কীভাবে সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হবে, তা নিয়েও তাদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে।

সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারে ১৬৬ সুপারিশের অধিকাংশে রাজনৈতিক দলগুলো একমত বা আংশিক একমত হয়েছে। আনুপাতিক উচ্চকক্ষ ও এনসিসি গঠন এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাসের যেসব সুপারিশকে মৌলিক সংস্কার বলা হচ্ছে, সেগুলোতে প্রধান প্রধান দল পুরোপুরি বিপরীত অবস্থানে রয়েছে।

ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সমকালকে বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শুরু হবে। প্রথম ধাপের সংলাপে ৩৩টি দল ও জোট আন্তরিকতার সঙ্গে অংশ নিয়েছে; নিজেদের মতামত জানিয়েছে। যেসব মৌলিক জায়গায় ভিন্নমত রয়েছে, সেগুলোতে ঐকমত্যে পৌঁছাতে দলগুলোকে ছাড় দিতে হবে। 

উচ্চকক্ষে রাজি, আসন বণ্টনে গোলমাল 
প্রায় সব রাজনৈতিক দল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনে একমত। বিএনপি চায়, বিদ্যমান নিয়মে যেভাবে সংসদে সংরক্ষিত আসন বণ্টন হয়, একই পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হবে। অর্থাৎ নিম্নকক্ষে যে দল যত শতাংশ আসন পাবে, ১০০ সদস্যের উচ্চকক্ষেও তত শতাংশ পাবে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে পরবর্তী সংসদে আলোচনার মাধ্যমে।

তবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্মতি তৈরি করতে প্রধান উপদেষ্টা ড.

মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন মনে করে, নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন হলে আলাদা করে আর উচ্চকক্ষ গঠনের প্রয়োজনীয়তা থাকে না।

কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, সংসদের নিম্নকক্ষই আইন ও বাজেট প্রণয়ন করবে। উচ্চকক্ষ তা আটকাতে পারবে না। সংসদের ক্ষমতা অক্ষুণ্ন থাকবে। তবে সংবিধান সংশোধন বিল সংসদের উভয় কক্ষে দু্ই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস হতে হবে।

অতীতের নির্বাচনগুলোর নজির বিবেচনায় আনুপাতিক পদ্ধতির উচ্চকক্ষে কোনো দলের পক্ষেই এককভাবে সংবিধান পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। যেমন– ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৩০ আসন তথা সংসদের ৭৭ শতাংশ আসন পেয়েছিল। দলটির নেতৃত্বাধীন জোট ৫৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ৮৮ শতাংশ আসন পেয়েছিল। ওই নির্বাচনে বিএনপির জোট ৩৯ শতাংশ ভোট পেয়ে মাত্র ৩৩ আসন পেয়েছিল। 

আনুপাতিক উচ্চকক্ষ থাকলে আওয়ামী লীগ জোট 
উচ্চকক্ষে ৫৭টি আসন পেত। বিএনপি জোট পেত ৩৯ আসন। সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ তথা ৬৭ জন এমপির সমর্থন প্রয়োজন হতো। বিএনপির জোটে ৩৯ এমপি থাকায় আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা বা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করার মতো যেসব কাজ করেছে, তা করতে পারত না। রাষ্ট্রে এমন ভারসাম্যহীন অবস্থাও তৈরি হতো না। 

এ নজির তুলে ধরে জামায়াতে ইসলামী চায় আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন। দলটির প্রস্তাব, যে দল জাতীয় নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদের উচ্চ ও নিম্নকক্ষে তত শতাংশ আসন পাবে। কারণ, বর্তমান ব্যবস্থায় ভোটের তুলনায় জামায়াতের আসন খুব বেশি থাকে না। একই অবস্থান চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনেরও। 

শেখ হাসিনার পতন ঘটানো ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের নেতাদের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) চায় নিম্নকক্ষের নির্বাচন বিদ্যমান সংসদীয় আসনে ‘ফাস্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতিতেই হবে। যে প্রার্থী বেশি ভোট পাবেন, তিনি জয়ী হবেন। উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হবে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে। 

ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে অংশ নেওয়া ৩৩ দল ও জোটের অন্তত ২১টি একই পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ চায়। এ দলগুলোর মধ্যে রয়েছে এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, গণসংহতি আন্দোলন, জেএসডি ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি। 

দলগুলোর সঙ্গে প্রথম ধাপের সংলাপ শেষ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বিএনপির সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির উচ্চকক্ষ মেনে নেওয়ার সুযোগ তাদের নেই। এনসিপি বলছে, আনুপাতিক পদ্ধতির উচ্চকক্ষের দাবিতে কোনো ছাড় তারা দেবে না। 

জামায়াত এবং ইসলামী আন্দোলনের একই মনোভাব। 

বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়েও মতবিরোধ
সংস্কারের সুপারিশগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, এ নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলো বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে। বিএনপি চায়, কমিশনের সঙ্গে সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, তা নিয়ে সই হবে জুলাই সনদ। এর ভিত্তিতে পরবর্তী সংসদে সাংবিধানিক সংস্কার হবে।

জামায়াত এতে রাজি নয়। দলটির ভাষ্য, অতীতে সংবিধানের ১৭টি সংশোধনীর ছয়টি আদালতে আংশিক বা পুরোপুরি বাতিল হয়েছে। ঐকমত্যের মাধ্যমে সাংবিধানিক সংশোধনী হলে আবারও একই পরিণতি হতে পারে। তাই দ্বাদশ সংশোধনীর মতো এবারের সাংবিধানিক সংস্কার হতে পারে গণভোটের মাধ্যমে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে।

এনসিপির দাবি, গণপরিষদে সংবিধান সংশোধন হোক। জাতীয় সংসদ ও গণপরিষদ নির্বাচন একই সঙ্গে হবে। পরবর্তী আইনসভাই গণপরিষদের ভূমিকায় থাকবে। সংবিধান সংস্কারের পর তা সংসদে আইনে রূপান্তরিত হবে। 

গণসংহতি আন্দোলনসহ কয়েকটি দল গণপরিষদের ধারণাকে সমর্থন দিলেও বিএনপি-জামায়াত এর ঘোর বিরোধী। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আগামীতে একটিই নির্বাচন হবে, তা হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সংসদ সাংবিধানিক সংস্কার করবে। এ ছাড়া সংবিধান সংশোধনের আর কোনো পথ নেই। গণপরিষদ সেই সব দেশে হয়, যেখানে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হয়। বাংলাদেশের সংবিধান আছে।

জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের সমকালকে বলেছেন, অতীত অভিজ্ঞতা হলো সংসদে পাস হওয়া সংবিধানে সংশোধনী, প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদল হয়ে যায়। এ অভিজ্ঞতার কারণে গণভোট টেকসই পদ্ধতি।

বাহাত্তরের গণপরিষদের উদাহরণ দিয়ে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেছেন, পাকিস্তানের সত্তরের নির্বাচনে গঠিত গণপরিষদে বাহাত্তর সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন ও অনুমোদন করা হয়েছিল। সেখানে আওয়ামী লীগের আদর্শ স্থান পেয়েছে। এখন হতে হবে চব্বিশের অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের প্রত্যাশা, জনগণের অভিব্যক্তি ধারণ করে এমন সংবিধান। 

এনসিসি নিয়ে দলগুলো ভিন্ন মেরুতে
সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ বাদে বাকি কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করতে হয় রাষ্ট্রপতিকে। এর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারপতি, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসহ স্বতন্ত্র আইনের দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ীই নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। 

এই একচ্ছত্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, উচ্চ ও নিম্নকক্ষের স্পিকার, বিরোধী দল থেকে উচ্চ ও নিম্নকক্ষে নির্বাচিত ডেপুটি স্পিকার, প্রধান বিচারপতি এবং প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার বাইরে দল থেকে একজন করে সংসদ সদস্য নিয়ে ৯ সদস্যের এনসিসি গঠনের সুপারিশ করেছে কমিশন। একই সুপারিশ করেছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও।

সুপারিশ অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেলের মতো দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, স্থানীয় সরকার কমিশনও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হবে। এনসিসির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে এসব প্রতিষ্ঠান এবং তিন বাহিনীর প্রধান পদে নিয়োগ করা হবে। নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও নিয়োগ হবে এনসিসির মাধ্যমে।

এতে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা কমে যাবে– এমন যুক্তিতে এনসিসি গঠনে রাজি নয় বিএনপি। দলটির ভাষ্য, সুপারিশ অনুযায়ী সংসদ বিলুপ্তির সময়ে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে এনসিসি কার্যকর থাকলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ঝুঁকি রয়েছে। এটি রাষ্ট্রকে অনিশ্চয়তায় ফেলবে। সংস্কার প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত বিএনপি নেতারা সমকালকে বলেছেন, এনসিসি গঠনের বিষয়ে তারা কিছুতেই সম্মতি দেবেন না। 

জামায়াত এনসিসি গঠনের পক্ষে। তবে দলটি চায়, এনসিসিতে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান বিচারপতি থাকতে পারবেন না। সংসদ বিলুপ্তির সঙ্গে এনসিসিও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। 

জাতীয় নাগরিক পার্টিও এনসিসি চায়। তবে এ দলটির প্রস্তাব, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ এনসিসির মাধ্যমে হলেও প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান, অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ সরকারই দেবে। 

প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ও ক্ষমতা নিয়ে মতভিন্নতা
কমিশন প্রস্তাব করেছে, কেউ দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। বিএনপি এতে রাজি নয়। দলটি ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ঘোষিত ৩১ দফা অনুযায়ী, কেউ টানা দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। একবার বিরতির পর আবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। বিএনপির এ অবস্থানের কারণে কমিশন সংলাপে বলেছে, টানা দুইবার এবং জীবনে তিনবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হওয়া যাবে না। বিএনপি এতেও রাজি নয়। 

কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, এক দিন দায়িত্ব পালন করলেও একবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন বলে গণ্য করা হবে। এতে জামায়াত রাজি নয়। দলটি চায়, কেউ ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না।

এনসিপি প্রধানমন্ত্রী পদ দুইবারে সীমাবদ্ধ করার সুপারিশে একমত। প্রধানমন্ত্রী দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না– এ প্রস্তাবেও একমত এনসিপি।

এতে রাজি নয় বিএনপি। দলটির অবস্থান হলো, দল ঠিক করবে প্রধানমন্ত্রী দলীয় প্রধান এবং সংসদ নেতা পদে থাকবেন কিনা। জামায়াতের অবস্থান হলো, প্রধানমন্ত্রী সংসদ নেতা কিংবা দলীয় প্রধান যে কোনো একটি পদে থাকতে পারবেন।

সব দলই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমাতে রাজি। জামায়াত চায়, এনসিসির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো হবে। এনসিপির প্রস্তাব– প্রধানমন্ত্রী নন, নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করবে মন্ত্রিসভা। বিএনপির প্রস্তাব, প্রধানমন্ত্রীর কিছু ক্ষমতা আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হবে। 

অন্য দলগুলো মনে করে, এতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আবার দলীয় মনোনীত রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে আদতে প্রধানমন্ত্রীর কাছেই থেকে যাবে ক্ষমতার চাবিকাঠি। 

বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় একমত, তবে...
বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ সব দল বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতের সুপারিশে একমত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠন, নিম্ন আদালতকে সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণে স্থানান্তর, উচ্চ আদালতে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত বিচারপতি নিয়োগে দলগুলো একমত। কিন্তু প্রধান বিচারপতি কে হবেন– এ নিয়ে মতভিন্ন রয়েছে।

অতীতে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে এ বি এম খায়রুল হককে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের নজির থাকলেও বিএনপি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম তিন বিচারপতির মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগসহ বিভিন্ন প্রস্তাব করেছে।

জামায়াত প্রস্তাব করেছে, আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিই হবেন প্রধান বিচারপতি। একই প্রস্তাব করেছে এনসিপি। 

আরও যেসব মতভেদ
জেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ‘ইলেকট্রোরাল কলেজ’-এ রূপান্তরের সুপারিশে বিএনপি ও জামায়াত একমত নয়। এনসিপি এতে সমর্থন জানিয়েছে। জেলা সমন্বয় পরিষদে বিএনপির আপত্তি থাকলেও দলটি জিয়াউর রহমানের শাসনামলের জেলা উন্নয়ন পরিষদ চায়। শক্তিশালী স্থানীয় সরকারের প্রতিশ্রুতি দিলেও উন্নয়ন পরিষদে এমপিদের চায় বিএনপি।

কমিশন সুপারিশ করেছিল, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) কোনো আসামির বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগপত্র গ্রহণ করলে সেই ব্যক্তি রাজনীতি এবং নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বিরুদ্ধে জুলাই অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা হয়েছে।

সুপারিশ অনুযায়ী, তাদের বিরুদ্ধে আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করলে তারা দণ্ডিত হওয়ার আগেই নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। তবে এ সুপারিশে একমত নয় বিএনপি। এনসিপি তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। জামায়াত কমিশনের সুপারিশে একমত হয়েছে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স প র শ অন য য় র প রস ত ব ন ম নকক ষ র ষ ট রপত প রব ন ন অবস থ ন য় ব এনপ এনস স র ব এনপ র ষ র আসন শ আসন প ব যবস থ পরবর ত বল ছ ন সরক র এনস প সদস য দলট র একই প আওয় ম গঠন র

এছাড়াও পড়ুন:

সংসদীয় গণতন্ত্রই চায় ইসলামপন্থি ছয় দল

ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো সংসদীয় গণতন্ত্রই চায়। সংস্কার কার্যক্রমে অংশ নেওয়া এমন ছয়টি দলের কেউই শরিয়াহভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা, খেলাফত রাষ্ট্র চায়নি। ঐচ্ছিক শরিয়াহ আদালত স্থাপনের প্রস্তাব করেছে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন। বাকি দলগুলো বিদ্যমান ব্যবস্থা অব্যাহত রেখে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতের প্রস্তাব করেছে।
এর বাইরে ঐচ্ছিক শরিয়াহ আদালত চেয়েছে আন্দালিব রহমান পার্থর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)।

সংবিধানের মূলনীতিতে বহুত্ববাদ যুক্তের সুপারিশে একমত হয়নি ইসলামপন্থি দলগুলো। ধর্মভিত্তিক সব দল সংবিধানের মূলনীতিতে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা’ পুনর্বহালের প্রস্তাব করেছে। কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী আইন প্রণয়ন না করার প্রস্তাব করেছে দলগুলো। কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছে।

সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশনে লিখিত মতামত জানায় জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিস। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে এই তিন দল ছাড়াও মতামত জানিয়ে সংলাপে অংশ নেয় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টি।

ঐকমত্য কমিশনের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও সমকালকে বলেছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমর্থন করেছে সব ধর্মভিত্তিক দল।
হেফাজতে ইসলাম-সংশ্লিষ্ট এবং কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলোর নেতারা সমকালকে বলেছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে বাংলাদেশে উগ্রবাদের উত্থান হিসেবে দেখাতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। ৫ আগস্টের পর পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকরা বারবার জানতে চেয়েছেন, ইসলামী দলগুলোর শরিয়াহভিত্তিক শাসন, খেলাফতভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য রয়েছে কিনা।

সংবিধান সংস্কার কমিশনে জামায়াত প্রস্তাব করেছিল, জরুরি অবস্থা জারি হলেও মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার স্থগিত করা যাবে না। ঐকমত্য কমিশনের মতামতে এবং সংলাপে তারাও উন্নত গণতন্ত্রের দেশগুলোর আদলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো, জবাবদিহির প্রস্তাব করেছে।

দলের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের সমকালকে বলেছেন, জামায়াত কখনও জোরজবরদস্তির মাধ্যমে ইসলাম কায়েম করার কথা বলেনি। জামায়াত সম্পর্কে যেসব নেতিবাচক প্রচারণা রয়েছে, সেগুলো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ছড়ানো। গণতান্ত্রিক দল হিসেবে জামায়াতের লক্ষ্য নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া; সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থনে ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
সংবিধান সংস্কার কমিশনে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন ১২ পৃষ্ঠার প্রস্তাবে ধর্মবিষয়ক একটি লাইন লিখেছে। এতে বলা হয়েছে, শরিয়াহবিরোধী আইন করা যাবে না। ঐকমত্য কমিশনের ১৬৬ সুপারিশেও দলটি ধর্ম-সংক্রান্ত কোনো প্রস্তাব দেয়নি। দলের মহাসচিব ইউনূস আহমদ বলেছেন, বাংলাদেশের কোনো গণতান্ত্রিক দলই শরিয়াহবিরোধী আইনের পক্ষে নয়।
৭ মে দ্বিতীয় দিনের সংলাপে শরিয়াহ আদালত স্থাপনের প্রস্তাব করে ইসলামী আন্দোলন। এর ব্যাখ্যায় দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য গাজী আতাউর রহমান বলেছেন, বিদ্যমান পদ্ধতিতে বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকারের মতো বিষয়ে শরিয়াহ আইনে বিচার হয়। ইসলামী আন্দোলন প্রস্তাব করেছে, নিম্ন থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত পৃথক শরিয়াহ বেঞ্চ থাকবে। বাদী ও বিবাদী একমত হলে বিচারের জন্য শরিয়াহ আদালতে যেতে পারবেন। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যেমন সাধারণ ও শরিয়াহ পদ্ধতি রয়েছে। গ্রাহক যে পদ্ধতি পছন্দ করেন, তা গ্রহণ করেন। শরিয়াহ আদালতও তেমন ঐচ্ছিক হবে।
নেজামে ইসলাম পার্টি সংলাপে গুরুত্ব দিয়েছে স্থানীয় সরকারের স্বায়ত্তশাসনে। খেলাফত মজলিস সংবিধানের প্রতিটি অনুচ্ছেদ সংস্কারে প্রস্তাব দেয় কমিশনে। জমিয়ত ১৬৬ সুপারিশের ১০৯টিতে একমত পোষণ করেছে। দলটি দেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে। দেশের নাম ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ’ করার প্রস্তাব করেছে।
মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস ১৬৬ সুপারিশের ১৪৭টিতে একমত। এই দলটিও আনুপাতিক পদ্ধতির উচ্চকক্ষ, সাংবিধানিক কাউন্সিলসহ সরকার, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের পক্ষে। 

দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমিনী সমকালকে বলেছেন, ইসলামপন্থি দল হিসেবে খেলাফত মজলিসের চূড়ান্ত লক্ষ্য খেলাফতের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তবে তা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অর্জন করা হবে। নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পারলে জনগণের মতামত এবং সমর্থনে খেলাফত কায়েম করবে খেলাফত মজলিস।

 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সংসদীয় গণতন্ত্রই চায় ইসলামপন্থি ছয় দল
  • চার মূলনীতি বহাল রাখার পক্ষে বাম দলগুলো
  • মিত্র দলগুলো বিএনপির বিপরীতে
  • জুলাইয়ে হবে সংস্কারের ‘জুলাই সনদ’
  • বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্কার প্রশ্নে এখনো ঐকমত্য হয়নি: আলী রীয়াজ