ঘুষ দিলে এনআইডির জটিল সংশোধনও হয় সহজে
Published: 1st, July 2025 GMT
চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার জেরিন আক্তারের জন্ম ১৯৯৬ সালে। জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) ভুলবশত তাঁর নাম ছাপা হয়ে আসে জেরীনা বেগম, জন্ম সাল ১৯৯৯। এনআইডিতে নাম ও জন্ম সাল ভুল থাকায় পাসপোর্ট করতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়েন তিনি। ভুল সংশোধনীর জন্য অনলাইনে আবেদন করেন। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নির্দেশনা অনুযায়ীজমা দেন জন্ম সনদ, বিয়ের সনদ, মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। আট মাসে নির্বাচন অফিসে অন্তত ১৫ বার ছোটাছুটিও করেছেন। তবু সংশোধন হয়নি তাঁর এনআইডি।
নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তাদের কাছে গেলে তাঁকে নয়ছয় বুঝ দেওয়া হয়। এর মধ্যে নির্বাচন অফিস থেকে বের হতেই দালালের চক্করে পড়েন জেরিন। দালালরা জেরিনকে বলেন, ‘৭০ হাজার টাকার মতো খরচ করলে কয়েক দিনের মধ্যেই কার্ড হাতে পেয়ে যাবেন।’ তিন ধাপে প্রায় ৭০ হাজার টাকা দেওয়ার চার দিনের মাথায় জেরিনের হাতে সংশোধিত পরিচয়পত্র তুলে দেয় তারা।
এনআইডি সংশোধনে এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা শুধু জেরিনের নয়; তাঁর মতো আরও অনেক সেবাপ্রত্যাশী মাসের পর মাস ঘুরেও পাচ্ছেন না সংশোধিত পরিচয়পত্র। এসব কারণে এখন ভোগান্তির আরেক নাম চট্টগ্রামের নির্বাচন অফিস। তবে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা ঘুষ দিলে এনআইডির জটিল সংশোধনও হয়ে যায় সহজে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার প্রায় প্রতিটি নির্বাচন অফিসে চার থেকে পাঁচজন দালাল সক্রিয়। দালালের সঙ্গে সখ্য আছে চট্টগ্রাম ও ঢাকা কার্যালয়ের সব পর্যায়ের কর্মকর্তার। স্থানীয়ভাবে ও নির্বাচন অফিসের আশপাশের কম্পিউটার দোকানের লোকজনও এ কাজে জড়িত। অনেক সময় দালালের সঙ্গে সেবাপ্রত্যাশীর পরিচয় করিয়ে দেন কম্পিউটারের দোকানি। এনআইডি সংশোধন করাতে মোটা অংকের ঘুষের টাকা চার থেকে পাঁচ ভাগে দিতে হয়। ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমেও ‘ঘুষ’ লেনদেন হয়। এর সঙ্গে নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তারাও জড়িত। এর বেশ কিছু প্রমাণও পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
প্রায় এক বছর ঘুরেও বাবার নামের ছোট একটি সংশোধনী করতে পারেননি কর্নেলহাটের বাসিন্দা শিমুল কুমার। এনআইডিতে ‘ম’-এর স্থলে ‘শ’ বসাতেই গলদ্ঘর্ম হতে হচ্ছে তাঁকে। যৌক্তিক কারণ ছাড়া নির্বাচন কর্মকর্তা আবেদন নাকচ করার পাশাপাশি অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের প্রস্তাব দেন। এ ব্যাপারে নির্বাচন অফিসে একটি লিখিত অভিযোগও করেছেন শিমুল কুমার। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন অফিসে গিয়ে কয়েকবার দালালের খপ্পরে পড়েছি। ৫০ হাজার টাকা দিলে তিন দিনের মধ্যে এনআইডি সংশোধন করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দালালরা।’ শিমুলের মতো এনআইডি সংশোধন করতে গিয়ে দালালের খপ্পরে পড়ার কথা আরও বেশ কয়েক সেবাপ্রত্যাশী সমকালের কাছে স্বীকার করেছেন।
এ ব্যাপারে দুদক-চট্টগ্রাম মেট্রো কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক এমরান হোসেন বলেন, ‘এনআইডি সংশোধনে ঘুষ আদায়, হয়রানি, দালালদের দৌরাত্ম্য বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। একটা এনআইডি সংশোধনে কর্মকর্তারা দালালের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকার ওপরে নিয়ে থাকেন। দুই প্রধান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে দালালদের একটা সংযোগ আছে। এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
দুদকের আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতা ছাড়া ঘুষ দিয়ে এনআইডি সংশোধন করা অসম্ভব। এই কাজে প্রধান অফিসের লোকজনও জড়িত।’
দালাল সক্রিয় থাকার কথা স্বীকার করে সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বশির আহমেদ বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই এখানে দালালের উৎপাত ছিল। এটাকে ভাঙার চেষ্টা করায় অনেকে আমার পেছনে লেগেছিল। জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার সময় ৩২ হাজার সংশোধনীর আবেদন অনিষ্পন্ন ছিল। এখন সেটি অনেক কমেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভেতরের কয়েকজনের সংশ্লিষ্টতা তো আছে। প্রতিটা উপজেলায়ও দালাল চক্র আছে।’
আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ডিসেম্বর থেকে চার ক্যাটেগরিতে প্রায় ৫৩ হাজার সংশোধনীর আবেদন অনিষ্পন্ন ছিল। নির্বাচন কমিশন ৩০ জুনের মধ্যে সব সংশোধনী নিষ্পত্তির নির্দেশনা দেওয়ায় এখন পুরোদমে কাজ শুরু করেছেন কর্মকর্তারা। সরকারি বন্ধের দিনেও নিষ্পত্তির কাজ চলায় মাত্র দুই সপ্তাহে অনিষ্পন্ন আবেদনের সংখ্যা ১০ হাজারের নিচে নেমে এসেছে।
এদিকে, ইসি নির্দেশনা দেওয়ায় জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের ক্রাশ প্রোগ্রামের আওতায় গত ৬ মাসে সাড়ে ৪৫ হাজার আবেদন সংশোধন করা হয়েছে বলে দাবি করেছে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়। গতকাল সোমবার দুপুরে নগরের আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত সভায় এ তথ্য জানান সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বশির আহমেদ।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: এনআইড কর মকর ত র ন কর মকর ত ন অফ স র কর ছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
টিউলিপের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব রয়েছে
যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্য (এমপি) টিউলিপ সিদ্দিকের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব আছে। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে এ তথ্য জানিয়েছেন। যদিও টিউলিপ বলে আসছেন, তাঁর বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নেই। যুক্তরাজ্যের সাবেক ‘সিটি মিনিস্টার’ টিউলিপ এখন বাংলাদেশে বিচারের মুখোমুখি।
বিধিবহির্ভূতভাবে সরকারি প্লট নেওয়ার অভিযোগে চলতি সপ্তাহে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে করা মামলার শুনানির ফাঁকে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মোহাম্মদ সুলতান মাহমুদ ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির এই এমপি একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ও পরিচয়পত্র গ্রহণ করেছেন এবং ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন।
সুলতান মাহমুদ বলেন, ‘তাঁর (টিউলিপ সিদ্দিকের) ঠিকানা, একাধিক পাসপোর্ট এবং ভোটার তালিকায় তাঁর নাম—সব পাওয়া গেছে। আমরা যথাসময়ে এগুলো দাখিল করব।’
এ ধরনের নথিপত্র থাকে বাংলাদেশের এমন কয়েকটি দপ্তর বা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। তাদের কাছে এসব কাগজপত্রের অনুলিপি আছে বলে তারা নিশ্চিত করেছে।
টিউলিপ এই বিচারকে ‘হয়রানি ও প্রহসন’ আখ্যায়িত করছেন। টিউলিপ অনেক আগে থেকে দাবি করে আসছেন, তিনি বাংলাদেশি নাগরিক নন। ২০১৭ সালে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আপনি কি আমাকে বাংলাদেশি বলছেন? আমি ব্রিটিশ...আমি বাংলাদেশি নই।’
টিউলিপ সিদ্দিকের আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্টিফেনসন হারউডের একজন মুখপাত্র এসব নথির অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন এবং সেগুলোকে জাল বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘টিউলিপের কখনো বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র বা ভোটার আইডি ছিল না এবং তিনি শিশু বয়স থেকে কোনো পাসপোর্ট নেননি।’
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, টিউলিপের নাগরিকত্বের প্রশ্নটি বাংলাদেশের আইনে তাঁর বিচার হতে পারে কি না, সেটাকে প্রভাবিত করে না। তবে আদালতে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরুর কয়েক দিন আগে তাঁর সততা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হওয়াটা অস্বস্তিকর হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
টিউলিপ সিদ্দিকের খালা শেখ হাসিনা গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হন।
খালা, মা ও দুই ভাই-বোনসহ টিউলিপের বিরুদ্ধে ঢাকার পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে বেআইনিভাবে সরকারি প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগ আনে দুর্নীতি দমন কমিশন। সংস্থাটির আইনজীবীরা দাবি করেন, প্লট পাওয়ার যোগ্যতার নিয়ম এড়াতে রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করেছেন টিউলিপ সিদ্দিক।
শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে কর্তৃত্ববাদ, নির্বাচনে কারসাজি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে। ছাত্রদের নেতৃত্বে দেশব্যাপী বিক্ষোভের মুখে আকস্মিক তাঁর সরকারের পতন হয়। তিনি ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। শেখ হাসিনার বিদায়ের ফলে তাঁর সরকার ও পরিবারের দুর্নীতির ব্যাপকতর তদন্তের সুযোগ আসে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে।
ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের অনুপস্থিতিতে তাঁর বিচারকাজ চলছে। টিউলিপ বলেছেন, মামলার বিষয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে গত সোমবার তিনি লিখেন, ‘কোনো যোগাযোগ নেই। কোনো প্রমাণও দেওয়া হয়নি। এমনকি আমার আইনজীবীদের পক্ষ থেকে আইনসিদ্ধভাবে এ বিষয়ে জানতে চাইলেও কোনো সাড়া দেওয়া হয়নি। এটি যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া নয়। এটা হয়রানি ও প্রহসন।’
দুর্নীতি দমন কমিশনের কৌঁসুলি সুলতান মাহমুদ বলেন, টিউলিপের পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকায় থাকা ঠিকানায় একটি সমন পাঠানো হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘ভোটার আইডি কার্ডে থাকা ঠিকানাগুলো পরিদর্শন করা হয়েছিল। তাঁর একটি জাতীয় পরিচয়পত্র ও একটি পাসপোর্ট আছে। আমাদের দুদক টিমগুলো, একাধিক টিম তদন্তের জন্য সেসব ঠিকানায় গিয়েছিল এবং যথাসময়ে নোটিশ দেওয়া হয়েছে।’
দুদকের ঠিকানায় গত জুনে টিউলিপের আইনজীবীদের পাঠানো একটি চিঠি ফিন্যান্সিয়াল টাইমস দেখতে পেয়েছে। এতে দুদককে তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা চালানোর এবং তাঁর আইনি পরামর্শক দলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে অস্বীকৃতি জানানোর অভিযোগ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন নিশ্চিত করেছে, টিউলিপ সিদ্দিকের একটি জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে, যদিও এটি সরাসরি নাগরিকত্ব নির্দেশ করে না।
টিউলিপ সিদ্দিক গত জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যের সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন সিটি মিনিস্টারের (ইকোনমিক সেক্রেটারি) পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ পদে দেশটির আর্থিক খাতে দুর্নীতি রোধের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
খালা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দল আওয়ামী লীগ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পদ থেকে তিনি সুবিধা নিয়েছেন, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এ প্রথমবারের মতো এমন প্রতিবেদন প্রকাশের পর রাজনৈতিক চাপের মুখে টিউলিপ পদত্যাগ করেন।
টিউলিপ কোনো ধরনের অনিয়ম করার কথা অস্বীকার করে আসছেন। শেখ হাসিনার ভাগনি বলছেন, অধ্যাপক ইউনূস সরকার ‘বিরোধীদের দমন’ করছে, তার শিকার তিনি।