জাতীয় পার্টি যে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে পারে
Published: 12th, July 2025 GMT
সামনেই নির্বাচন। যাদের মাঠে যাওয়ার অনুমতি মিলেছে, তারা সংসদে যাওয়ার তোড়জোড় করছেন। যাঁদের অনুমতি মেলেনি, তাঁরা এই আশায় ‘ভাঙা নৌকা’ পাহারা দিচ্ছেন, হয়তো নৌকা ‘মেরামত’ করা হতে পারে।
শেখ হাসিনার রাজত্বকালে যে দলটা এত বছর সংসদে ‘বিরোধী দল’ ছিল, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জনগণ তাদের মাথায় নিয়ে নাচার কথা। ১৫ বছর শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে সংসদে বিরোধী দলে বসা কম সাহসের ব্যাপার নয়! সংসদীয়ই গণতন্ত্রের নিয়মকানুনের বই খুললে দেখা যাবে, সরকার পতনের পর নতুন সরকার গঠনের প্রথম দাবিদার হলো বিরোধী দল।
কিন্তু বিধি বাম। এত বছর বিরোধী দলে থেকেও জাতীয় পার্টি সেই সম্মানটা পেল না। এখন তারা মাঠে নামতেই ভয় পাচ্ছে—সবাই বলে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’। দেশে সংস্কার নিয়ে এত এত কথা হচ্ছে, যেসব দলের সদস্যসংখ্যা দুই থেকে দশ জনে সীমিত, তারাও ঐকমত্য কমিশনে গিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চা-নাশতা খাচ্ছেন। আর জাতীয় পার্টির কত কত ব্যারিস্টার আর ১৫ বছরের সরকারবিরোধী সংসদীয় অভিজ্ঞতা—এই সবকিছুই কাজে আসছে না। কেউ তাদের কোনো ইনপুট দিতেও বলছে না। কীভাবে ভালো বিরোধী দল হওয়া যায়, এ ব্যাপারে তারা সংস্কার কমিশনে কত-না সুচিন্তিত মত দিতে পারত!
জাতীয় পার্টির এই দুরবস্থা দেখে তাদের সিনিয়র তিন নেতা সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং দুই কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও সাবেক মহাসচিব মুজিবুর রহমান চুন্নু এগিয়ে এলেন। তাঁরা চাইছেন দলের গঠনতন্ত্রটা বদলিয়ে গণতন্ত্রের ছাপ মারতে। এখনই সময় জাতীয় সংস্কারে তাল মেলানোর। নিজেদের দলে সংস্কার করতে পারলে হয়তোবা ঐকমত্য কমিশনেও ডাক পড়বে।
সিনিয়র নেতারা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নিয়ে দারুণ নাখোশ। সবকিছু একজনের হাতে, এটা কীভাবে হয়? এত দিন দল থেকে মন্ত্রী-সংসদ সদস্য থাকাতে কিছু বলা যায়নি, কিন্তু আর কতকাল চুপ থাকা যায়?
এই তিন নেতা জাতীয় পার্টির ২০-এর ১ (ক) ধারা বাতিল করতে বলেছেন। এই ধারাটা যোগ করেছেন জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। জাতীয় পার্টির বর্তমান যত নেতা, সবাই এই ধারাবলেই মনোনীত হয়ে আঁটসাঁটভাবে এত বছর নেতৃত্ব দিয়েছেন। জি এম কাদেরকে মনোনীত করেছেন এরশাদ, চুন্নুকে সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনীত করেছেন জি এম কাদের। কিন্তু এখন দেশে গণতন্ত্রের জোয়ার—মনোনয়নের দিন শেষ। জাতীয় পার্টিকে জাতীয় সংস্কারে না ডাকলেও তারা নিজেরাই তো নিজেদের সংস্কারটা করে ফেলতে পারে! দেশের অনেকেই নিশ্চয় তাদের তিনজনকে বাহবা দেবেন, অন্তত একটা দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রকে কিছুটা এগিয়ে নিতে চেষ্টা করা হচ্ছে। জাতীয় সংস্কার কমিশনও সাহস করে এই প্রয়োজনটা তুলে ধরতে পারেনি।
সুতরাং জাতীয় পার্টির সব শেষ হয়ে যায়নি। তারা অন্তর্দ্বন্দ্ব করে দল ভাঙচুর করলে সবদিক হারাবেন। এর চেয়ে যে যে পদে আছেন, চুপচাপ থেকে ভালো দিনের অপেক্ষা করতে পারেন। হয়তো একসময় ডাক পড়বে। আর এর মধ্যে নৌকাও মেরামত হয়ে যেতে পারে!আমাদের দেশে যত রাজনৈতিক দল আছে, জামায়াতে ইসলামী ছাড়া সব দলেই ২০-এর ১ (ক) ধারা নামে-বেনামে বা অন্য নামে তাদের গঠনতন্ত্রে লেখা আছে। দলের প্রধান ‘তাঁকে দেওয়া ক্ষমতাবলে’ যে কাউকে দলের যে কোনো পদ দিতে পারেন। কার কি বলার আছে? সবই বিধিবদ্ধভাবে দলের কোনো না কোনো ধারামতে করা হয়েছে।
জি এম কাদের কেন গঠনতন্ত্র বদলাতে যাবেন? তাঁর বড় ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ হলেও তাঁর অধিকার আছে এই ধারা আঁকড়ে ধরে রাখার। আর তিনি চাইলেই কি পারবেন ধারা বদলাতে? তাঁর স্ত্রী শরীফা কাদের এখন দলে বেশ ক্ষমতাশালী। তিনি কি দেবেন জি এম কাদেরকে এই ধারা বদলাতে? তাঁকেও দোষ দেওয়া যায় না, সরকার ব্যাংকের সব টাকাকড়ি ফ্রিজ করে রেখেছে, স্বামীর চেয়ারম্যানশিপটাও যদি চলে যায়, তাহলে আর রইল কী!
এর মধ্যে ঐক্যের বাণী নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন দলটির রওশন এরশাদপন্থী অংশের মহাসচিব কাজী মো.
এত কিছুর পরেও কি বিদিশা চুপ থাকবেন? তিনিও যদি এরিক এরশাদের স্বাক্ষরের কাগজ হাতে নিয়ে বের হয়ে আসেন জাতীয় পার্টিতে তাঁদের অংশীদারত্বের দাবি জানাতে, তা হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
জাতীয় পার্টির এই দুর্দশা দেখলে অনেকেই বলবেন, জাতীয় পার্টিও হাসিনার ফ্যাসিবাদের ভিকটিম। হাসিনা যদি এত বাড়াবাড়ি না করতেন, তাহলে এখনো ক্ষমতায় থাকতেন। জাতীয় পার্টিকেও এত টানাপোড়েনে পড়তে হতো না।
সব দেশে নির্বাচনের আগে আলোচনা হয়, কোন দল ক্ষমতায় আসবে? শেখ হাসিনার সময়, বাংলাদেশে আলোচনা হতো কে বিরোধী দলের নেতা হবেন? কারণ, যেকোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে, সেটা ছিল অবধারিত আর রংপুরের কয়টা সিট পেয়ে জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হবে—সেটাও ছিল নির্ধারিত।
২০১৪ সালে শেখ হাসিনা ডিবির লোক পাঠিয়ে এরশাদকে ধরে সিএমএইচে নিয়ে রোগী বানিয়ে রাখলেন। তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ নিজেই জাতীয় পার্টির নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। এরশাদকে মেনে নিতে হলো।
কিন্তু এরশাদ মারা যাওয়ার পর দ্বন্দ্বটা শুরু হলো, জাতীয় পার্টি থেকে কে হবেন বিরোধী দলের নেতা? রওশন এরশাদ যত দিন সুস্থ ছিলেন, বিরোধী দলের নেতার চেয়ার শেখ হাসিনা তাঁকেই দিয়েছিলেন। জাতীয় পার্টিতে এ নিয়ে টানাপোড়েন লেগেই ছিল। জি এম কাদের রাজনীতিতে ছিলেন কিছুটা আনাড়ি, সুতরাং রওশন এরশাদের মতো পাকা রাজনীতিবিদের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। আনিসুল ইসলাম ও রুহুল আমিন হাওলাদার পাল্লার ওপর চোখ রাখতেন—কোন দিক ভারী। আনিসুল ইসলাম দুবার বিরোধী দল থেকে শেখ হাসিনার মন্ত্রী হয়ে যথেষ্ট কৌতুকের জন্ম দিয়েছিলেন।
২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে রওশন এরশাদ খুব অসুস্থ ছিলেন। তার চারপাশে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের ওপর হাসিনা ভরসা করতে পারেননি। তিনি বিরোধী দলের নেতা বানালেন জি এম কাদেরকে।
এরশাদ মারা যাওয়ার পর যখন জি এম কাদেরকে দলের দায়িত্ব দেওয়া হলো, তাঁকে মনে করা হতো একজন ‘অনিচ্ছুক রাজনীতিবিদ’। বলা হতো, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দলের নেতাদের সঙ্গে তাঁর তেমন যোগাযোগ ছিল না। রাজনীতির কুটিলতা বা চাতুর্যও তিনি খুব রপ্ত করতে পারেননি। একসময় তাঁর রংপুরের আসনটিও ভাতিজা সাদের দখলে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়। রংপুরের তৎকালীন মেয়র মোস্তফা ও স্থানীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে তাঁর মানসম্মান রক্ষা পায়।
এখন তিনি সম্ভবত রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ কিছুটা রপ্ত করেছেন। দলের বিদ্রোহীদের এই পর্যন্ত ভালোভাবে সামাল দিয়েছেন। জ্যেষ্ঠ নেতাদের বিদ্রোহের মধ্যে জি এম কাদের নতুন মহাসচিব বেছে নিয়েছেন। এরপর জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং দুই কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মুজিবুর রহমান চুন্নুকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘোষণা দেন জি এম কাদের।
তবে জাতীয় পার্টির নাটকের এই অধ্যায় এখনো শেষ হয়নি। আরও অনেক দিন চলবে। এর মধ্যে আশা করা যায় সব শরিকেরা আরও যুদ্ধংদেহী বেশে মাঠে নামবেন। প্রতিদিনই দৈনিক পত্রিকার একটা অংশে তাদের খবর থাকবে।
সমস্যা হলো জাতীয় পার্টির এখন কোনো মুরব্বি নেই। হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ যখন জীবিত ছিলেন, তিনিই ছিলেন সুপ্রিম নেতা। যদিও স্ত্রী রওশন এরশাদ মাঝেমধ্যে তাঁকে টেক্কা দিতেন, সেটা সব সংসারেই হয়ে থাকে। এরশাদ মারা যাওয়ার পর শেখ হাসিনাই জাতীয় পার্টির অভিভাবকত্বের কিছুটা দায়িত্ব নেন বললে অত্যুক্তি করা হবে না।
যাঁরা জাতীয় পার্টিকে এতটা বছর পর্যবেক্ষণ করছেন, তাঁরা বলবেন, জাতীয় পার্টির নেতারা যদি এখনই ভাঙচুর করে দলটা ভেঙে ফেলেন, তাঁরা দারুণ ভুল করবেন। তাঁরা যদি আরও কিছুটা সময় ধৈর্য ধরে একত্র থাকতে পারেন, তাঁদের স্বর্ণযুগ আবারও ফিরে আসতে পারে। এই ধারণার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে।
একটি চিত্র কল্পনা করি। আবার নির্বাচন হবে। নতুন নেতারা আসবেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী শপথ নেবেন। বিরোধী দলও কবজি শক্ত করে সংসদে বসবে। তারা কথায় কথায় সরকারকে গালি দেবে, দুই ঘণ্টা পর পর ওয়াকআউট করবে—সংসদীয় গণতন্ত্রে এটা খুব স্বাভাবিক।
প্রধানমন্ত্রী দারুণ বিরক্ত। কে চায় এত সব ঝামেলার বিরোধী দল? তাই তো শেখ হাসিনা বিএনপিকে সংসদের বাইরে রেখেছিলেন। ধরুন, এখনকার বড় দল ক্ষমতা পেল বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে—অসম্ভব কিছু নয়! যিনি প্রধানমন্ত্রী হলেন, তিনি চিন্তা করলেন—একটা ভালো বিরোধী দল সংসদে প্রয়োজন, যারা ওয়াকআউট করবে না, অনাস্থা দেবে না; বরং দেশের উন্নয়নের জন্য সরকারের সঙ্গে কাজ করবে।
যেই কথা সেই কাজ। যেহেতু দলের আছে বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা, প্রধানমন্ত্রী ৪০ জন সদস্যকে পদত্যাগ করতে বললেন। ডাক পড়ল জাতীয় পার্টির। উপনির্বাচনে তারা দখল করবে এই ৪০টা আসন। আসল বিরোধী যারা, তারা হইচই করবে। তাতে কী? ঐকমত্যে কি আছে উপনির্বাচন করা যাবে না?
আর বিরোধী দল হিসেবে নতুন প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পার্টিকে খুব পছন্দ হওয়ার কথা। কারণ, বিরোধী দল হিসেবে তাদের রয়েছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। তারা আগে কখনো ওয়াকআউট করেনি। অনাস্থা প্রস্তাবও তাদের কখনো চর্চা করতে দেখা যায়নি। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীও খুশি-নিশ্চিন্তে দেশ চালাতে পারবেন।
তা ছাড়া জাতীয় পার্টির সঙ্গে কাজ করার ও জোট বাধার পূর্ব অভিজ্ঞতা ক্ষমতাসীন দলটির আছে। জাতীয় পার্টিরও সবাই এখন শান্ত-সিনিয়র নেতারা, সবাই এখন সংসদ সদস্য; কেউ আর দল ভাঙতে চান না। তবে বিরোধী দলে থেকে মন্ত্রিত্ব চাওয়া যাবে না, ঐকমত্যে মানা আছে।
সব যে এভাবে হবে তা কেউ নিশ্চিতভাবে বলে দিতে পারবে না। তবে রাজনীতিতে শেষ কথা কিছু নেই। আজকের মাঠশত্রু কালকের কোয়ালিশন পার্টনার—এ রকম হরদম হচ্ছে।
সুতরাং জাতীয় পার্টির সব শেষ হয়ে যায়নি। তারা অন্তর্দ্বন্দ্ব করে দল ভাঙচুর করলে সবদিক হারাবেন। এর চেয়ে যে যে পদে আছেন, চুপচাপ থেকে ভালো দিনের অপেক্ষা করতে পারেন। হয়তো একসময় ডাক পড়বে। আর এর মধ্যে নৌকাও মেরামত হয়ে যেতে পারে!
সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ই-মেইল: salehpublic 711 @gmail. com
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: রওশন এরশ দ গণতন ত র দল র ন ত এম ক দ র ন এরশ দ এরশ দ ম ঐকমত য র জন ত এই ধ র মন ত র কর ছ ন সরক র ক ষমত সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
জাতীয় পার্টি যে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে পারে
সামনেই নির্বাচন। যাদের মাঠে যাওয়ার অনুমতি মিলেছে, তারা সংসদে যাওয়ার তোড়জোড় করছেন। যাঁদের অনুমতি মেলেনি, তাঁরা এই আশায় ‘ভাঙা নৌকা’ পাহারা দিচ্ছেন, হয়তো নৌকা ‘মেরামত’ করা হতে পারে।
শেখ হাসিনার রাজত্বকালে যে দলটা এত বছর সংসদে ‘বিরোধী দল’ ছিল, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জনগণ তাদের মাথায় নিয়ে নাচার কথা। ১৫ বছর শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে সংসদে বিরোধী দলে বসা কম সাহসের ব্যাপার নয়! সংসদীয়ই গণতন্ত্রের নিয়মকানুনের বই খুললে দেখা যাবে, সরকার পতনের পর নতুন সরকার গঠনের প্রথম দাবিদার হলো বিরোধী দল।
কিন্তু বিধি বাম। এত বছর বিরোধী দলে থেকেও জাতীয় পার্টি সেই সম্মানটা পেল না। এখন তারা মাঠে নামতেই ভয় পাচ্ছে—সবাই বলে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’। দেশে সংস্কার নিয়ে এত এত কথা হচ্ছে, যেসব দলের সদস্যসংখ্যা দুই থেকে দশ জনে সীমিত, তারাও ঐকমত্য কমিশনে গিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চা-নাশতা খাচ্ছেন। আর জাতীয় পার্টির কত কত ব্যারিস্টার আর ১৫ বছরের সরকারবিরোধী সংসদীয় অভিজ্ঞতা—এই সবকিছুই কাজে আসছে না। কেউ তাদের কোনো ইনপুট দিতেও বলছে না। কীভাবে ভালো বিরোধী দল হওয়া যায়, এ ব্যাপারে তারা সংস্কার কমিশনে কত-না সুচিন্তিত মত দিতে পারত!
জাতীয় পার্টির এই দুরবস্থা দেখে তাদের সিনিয়র তিন নেতা সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং দুই কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও সাবেক মহাসচিব মুজিবুর রহমান চুন্নু এগিয়ে এলেন। তাঁরা চাইছেন দলের গঠনতন্ত্রটা বদলিয়ে গণতন্ত্রের ছাপ মারতে। এখনই সময় জাতীয় সংস্কারে তাল মেলানোর। নিজেদের দলে সংস্কার করতে পারলে হয়তোবা ঐকমত্য কমিশনেও ডাক পড়বে।
সিনিয়র নেতারা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নিয়ে দারুণ নাখোশ। সবকিছু একজনের হাতে, এটা কীভাবে হয়? এত দিন দল থেকে মন্ত্রী-সংসদ সদস্য থাকাতে কিছু বলা যায়নি, কিন্তু আর কতকাল চুপ থাকা যায়?
এই তিন নেতা জাতীয় পার্টির ২০-এর ১ (ক) ধারা বাতিল করতে বলেছেন। এই ধারাটা যোগ করেছেন জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। জাতীয় পার্টির বর্তমান যত নেতা, সবাই এই ধারাবলেই মনোনীত হয়ে আঁটসাঁটভাবে এত বছর নেতৃত্ব দিয়েছেন। জি এম কাদেরকে মনোনীত করেছেন এরশাদ, চুন্নুকে সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনীত করেছেন জি এম কাদের। কিন্তু এখন দেশে গণতন্ত্রের জোয়ার—মনোনয়নের দিন শেষ। জাতীয় পার্টিকে জাতীয় সংস্কারে না ডাকলেও তারা নিজেরাই তো নিজেদের সংস্কারটা করে ফেলতে পারে! দেশের অনেকেই নিশ্চয় তাদের তিনজনকে বাহবা দেবেন, অন্তত একটা দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রকে কিছুটা এগিয়ে নিতে চেষ্টা করা হচ্ছে। জাতীয় সংস্কার কমিশনও সাহস করে এই প্রয়োজনটা তুলে ধরতে পারেনি।
সুতরাং জাতীয় পার্টির সব শেষ হয়ে যায়নি। তারা অন্তর্দ্বন্দ্ব করে দল ভাঙচুর করলে সবদিক হারাবেন। এর চেয়ে যে যে পদে আছেন, চুপচাপ থেকে ভালো দিনের অপেক্ষা করতে পারেন। হয়তো একসময় ডাক পড়বে। আর এর মধ্যে নৌকাও মেরামত হয়ে যেতে পারে!আমাদের দেশে যত রাজনৈতিক দল আছে, জামায়াতে ইসলামী ছাড়া সব দলেই ২০-এর ১ (ক) ধারা নামে-বেনামে বা অন্য নামে তাদের গঠনতন্ত্রে লেখা আছে। দলের প্রধান ‘তাঁকে দেওয়া ক্ষমতাবলে’ যে কাউকে দলের যে কোনো পদ দিতে পারেন। কার কি বলার আছে? সবই বিধিবদ্ধভাবে দলের কোনো না কোনো ধারামতে করা হয়েছে।
জি এম কাদের কেন গঠনতন্ত্র বদলাতে যাবেন? তাঁর বড় ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ হলেও তাঁর অধিকার আছে এই ধারা আঁকড়ে ধরে রাখার। আর তিনি চাইলেই কি পারবেন ধারা বদলাতে? তাঁর স্ত্রী শরীফা কাদের এখন দলে বেশ ক্ষমতাশালী। তিনি কি দেবেন জি এম কাদেরকে এই ধারা বদলাতে? তাঁকেও দোষ দেওয়া যায় না, সরকার ব্যাংকের সব টাকাকড়ি ফ্রিজ করে রেখেছে, স্বামীর চেয়ারম্যানশিপটাও যদি চলে যায়, তাহলে আর রইল কী!
এর মধ্যে ঐক্যের বাণী নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন দলটির রওশন এরশাদপন্থী অংশের মহাসচিব কাজী মো. মামুনূর রশিদ। এক বিবৃতিতে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির ওপর আস্থা রেখে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মামুন।
এত কিছুর পরেও কি বিদিশা চুপ থাকবেন? তিনিও যদি এরিক এরশাদের স্বাক্ষরের কাগজ হাতে নিয়ে বের হয়ে আসেন জাতীয় পার্টিতে তাঁদের অংশীদারত্বের দাবি জানাতে, তা হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
জাতীয় পার্টির এই দুর্দশা দেখলে অনেকেই বলবেন, জাতীয় পার্টিও হাসিনার ফ্যাসিবাদের ভিকটিম। হাসিনা যদি এত বাড়াবাড়ি না করতেন, তাহলে এখনো ক্ষমতায় থাকতেন। জাতীয় পার্টিকেও এত টানাপোড়েনে পড়তে হতো না।
সব দেশে নির্বাচনের আগে আলোচনা হয়, কোন দল ক্ষমতায় আসবে? শেখ হাসিনার সময়, বাংলাদেশে আলোচনা হতো কে বিরোধী দলের নেতা হবেন? কারণ, যেকোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে, সেটা ছিল অবধারিত আর রংপুরের কয়টা সিট পেয়ে জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হবে—সেটাও ছিল নির্ধারিত।
২০১৪ সালে শেখ হাসিনা ডিবির লোক পাঠিয়ে এরশাদকে ধরে সিএমএইচে নিয়ে রোগী বানিয়ে রাখলেন। তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ নিজেই জাতীয় পার্টির নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। এরশাদকে মেনে নিতে হলো।
কিন্তু এরশাদ মারা যাওয়ার পর দ্বন্দ্বটা শুরু হলো, জাতীয় পার্টি থেকে কে হবেন বিরোধী দলের নেতা? রওশন এরশাদ যত দিন সুস্থ ছিলেন, বিরোধী দলের নেতার চেয়ার শেখ হাসিনা তাঁকেই দিয়েছিলেন। জাতীয় পার্টিতে এ নিয়ে টানাপোড়েন লেগেই ছিল। জি এম কাদের রাজনীতিতে ছিলেন কিছুটা আনাড়ি, সুতরাং রওশন এরশাদের মতো পাকা রাজনীতিবিদের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। আনিসুল ইসলাম ও রুহুল আমিন হাওলাদার পাল্লার ওপর চোখ রাখতেন—কোন দিক ভারী। আনিসুল ইসলাম দুবার বিরোধী দল থেকে শেখ হাসিনার মন্ত্রী হয়ে যথেষ্ট কৌতুকের জন্ম দিয়েছিলেন।
২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে রওশন এরশাদ খুব অসুস্থ ছিলেন। তার চারপাশে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের ওপর হাসিনা ভরসা করতে পারেননি। তিনি বিরোধী দলের নেতা বানালেন জি এম কাদেরকে।
এরশাদ মারা যাওয়ার পর যখন জি এম কাদেরকে দলের দায়িত্ব দেওয়া হলো, তাঁকে মনে করা হতো একজন ‘অনিচ্ছুক রাজনীতিবিদ’। বলা হতো, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দলের নেতাদের সঙ্গে তাঁর তেমন যোগাযোগ ছিল না। রাজনীতির কুটিলতা বা চাতুর্যও তিনি খুব রপ্ত করতে পারেননি। একসময় তাঁর রংপুরের আসনটিও ভাতিজা সাদের দখলে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়। রংপুরের তৎকালীন মেয়র মোস্তফা ও স্থানীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে তাঁর মানসম্মান রক্ষা পায়।
এখন তিনি সম্ভবত রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ কিছুটা রপ্ত করেছেন। দলের বিদ্রোহীদের এই পর্যন্ত ভালোভাবে সামাল দিয়েছেন। জ্যেষ্ঠ নেতাদের বিদ্রোহের মধ্যে জি এম কাদের নতুন মহাসচিব বেছে নিয়েছেন। এরপর জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং দুই কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মুজিবুর রহমান চুন্নুকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘোষণা দেন জি এম কাদের।
তবে জাতীয় পার্টির নাটকের এই অধ্যায় এখনো শেষ হয়নি। আরও অনেক দিন চলবে। এর মধ্যে আশা করা যায় সব শরিকেরা আরও যুদ্ধংদেহী বেশে মাঠে নামবেন। প্রতিদিনই দৈনিক পত্রিকার একটা অংশে তাদের খবর থাকবে।
সমস্যা হলো জাতীয় পার্টির এখন কোনো মুরব্বি নেই। হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ যখন জীবিত ছিলেন, তিনিই ছিলেন সুপ্রিম নেতা। যদিও স্ত্রী রওশন এরশাদ মাঝেমধ্যে তাঁকে টেক্কা দিতেন, সেটা সব সংসারেই হয়ে থাকে। এরশাদ মারা যাওয়ার পর শেখ হাসিনাই জাতীয় পার্টির অভিভাবকত্বের কিছুটা দায়িত্ব নেন বললে অত্যুক্তি করা হবে না।
যাঁরা জাতীয় পার্টিকে এতটা বছর পর্যবেক্ষণ করছেন, তাঁরা বলবেন, জাতীয় পার্টির নেতারা যদি এখনই ভাঙচুর করে দলটা ভেঙে ফেলেন, তাঁরা দারুণ ভুল করবেন। তাঁরা যদি আরও কিছুটা সময় ধৈর্য ধরে একত্র থাকতে পারেন, তাঁদের স্বর্ণযুগ আবারও ফিরে আসতে পারে। এই ধারণার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে।
একটি চিত্র কল্পনা করি। আবার নির্বাচন হবে। নতুন নেতারা আসবেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী শপথ নেবেন। বিরোধী দলও কবজি শক্ত করে সংসদে বসবে। তারা কথায় কথায় সরকারকে গালি দেবে, দুই ঘণ্টা পর পর ওয়াকআউট করবে—সংসদীয় গণতন্ত্রে এটা খুব স্বাভাবিক।
প্রধানমন্ত্রী দারুণ বিরক্ত। কে চায় এত সব ঝামেলার বিরোধী দল? তাই তো শেখ হাসিনা বিএনপিকে সংসদের বাইরে রেখেছিলেন। ধরুন, এখনকার বড় দল ক্ষমতা পেল বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে—অসম্ভব কিছু নয়! যিনি প্রধানমন্ত্রী হলেন, তিনি চিন্তা করলেন—একটা ভালো বিরোধী দল সংসদে প্রয়োজন, যারা ওয়াকআউট করবে না, অনাস্থা দেবে না; বরং দেশের উন্নয়নের জন্য সরকারের সঙ্গে কাজ করবে।
যেই কথা সেই কাজ। যেহেতু দলের আছে বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা, প্রধানমন্ত্রী ৪০ জন সদস্যকে পদত্যাগ করতে বললেন। ডাক পড়ল জাতীয় পার্টির। উপনির্বাচনে তারা দখল করবে এই ৪০টা আসন। আসল বিরোধী যারা, তারা হইচই করবে। তাতে কী? ঐকমত্যে কি আছে উপনির্বাচন করা যাবে না?
আর বিরোধী দল হিসেবে নতুন প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পার্টিকে খুব পছন্দ হওয়ার কথা। কারণ, বিরোধী দল হিসেবে তাদের রয়েছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। তারা আগে কখনো ওয়াকআউট করেনি। অনাস্থা প্রস্তাবও তাদের কখনো চর্চা করতে দেখা যায়নি। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীও খুশি-নিশ্চিন্তে দেশ চালাতে পারবেন।
তা ছাড়া জাতীয় পার্টির সঙ্গে কাজ করার ও জোট বাধার পূর্ব অভিজ্ঞতা ক্ষমতাসীন দলটির আছে। জাতীয় পার্টিরও সবাই এখন শান্ত-সিনিয়র নেতারা, সবাই এখন সংসদ সদস্য; কেউ আর দল ভাঙতে চান না। তবে বিরোধী দলে থেকে মন্ত্রিত্ব চাওয়া যাবে না, ঐকমত্যে মানা আছে।
সব যে এভাবে হবে তা কেউ নিশ্চিতভাবে বলে দিতে পারবে না। তবে রাজনীতিতে শেষ কথা কিছু নেই। আজকের মাঠশত্রু কালকের কোয়ালিশন পার্টনার—এ রকম হরদম হচ্ছে।
সুতরাং জাতীয় পার্টির সব শেষ হয়ে যায়নি। তারা অন্তর্দ্বন্দ্ব করে দল ভাঙচুর করলে সবদিক হারাবেন। এর চেয়ে যে যে পদে আছেন, চুপচাপ থেকে ভালো দিনের অপেক্ষা করতে পারেন। হয়তো একসময় ডাক পড়বে। আর এর মধ্যে নৌকাও মেরামত হয়ে যেতে পারে!
সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ই-মেইল: salehpublic 711 @gmail. com
(মতামত লেখকের নিজস্ব)