শতাধিক পণ্যে শুল্ক-কর বাড়ানোর অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের দাবি নাগরিক কমিটির
Published: 11th, January 2025 GMT
শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর জন্য অন্তর্বর্তী সরকার যে অধ্যাদেশ জারি করেছে, তা অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। এই মুহূর্তে টিসিবির ট্রাক সেল চালু করারও দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর বাংলামোটরে জাতীয় নাগরিক কমিটির কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে জাতীয় নাগরিক কমিটির অবস্থান তুলে ধরেন সংগঠনটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন। দেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে বিকল্প হিসেবে কয়েকটি প্রস্তাবও তুলে ধরেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি।
লিখিত বক্তব্যে আখতার হোসেন বলেন, সম্প্রতি সরকার রাজস্ব আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর জন্য দুটি অধ্যাদেশ জারি করেছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি ও ব্যবসায়ের খরচ বাড়বে, যা সাধারণ মানুষের জীবনমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সরকার তার রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য করের আওতা বাড়াবে, এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু কর বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারকে স্মরণ রাখতে হবে যে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান যাতে নেমে না যায় এবং তাদের ভোগান্তি যাতে না বাড়ে।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, বিগত অবৈধ সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও বিদেশে অর্থ পাচারের কারণে দেশের অর্থনীতির অবস্থা খুবই ভঙ্গুর ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে। এ অবস্থায় বিগত অবৈধ সরকার আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যেকোনো দেশের জন্য আইএমএফের ঋণ হলো ঋণপ্রাপ্তির সর্বশেষ আশ্রয়। এই কঠিন ঋণের শর্ত হিসেবে কয়েকটি ধাপে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি এ অধ্যাদেশগুলো জারি করেছে। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট সরকারের কাছে প্রশ্ন—অবৈধ সরকারের ঋণের এই শর্ত বর্তমান সরকার পুনর্বিবেচনার জন্য আইএমএফকে আহ্বান জানিয়েছে কি? তা স্পষ্ট নয়। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট সরকার একটি অবৈধ সরকারের চুক্তির ধারাবাহিকতা বজায় রেখে জনগণের দুর্ভোগ বাড়াতে পারে না।
প্রস্তাবঅবিলম্বে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক অধ্যাদেশ প্রত্যাহার ও টিসিবির ট্রাক সেল চালুর দাবির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে বিকল্প হিসেবে কয়েকটি প্রস্তাব তুলে ধরেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি।
আখতার হোসেন বলেন, সরকার এ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করের আওতা বাড়াতে পারে, যা সরাসরি সাধারণ মানুষের জীবনমানের ক্ষতি করবে না। প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে অবশ্যই সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যমান করের কাঠামোয় যে সীমাহীন দুর্নীতি হয়, তা বন্ধ করার উদ্যোগ নিলে রাজস্ব আয় বাড়বে বলে মনে করেন তাঁরা।
প্রস্তাবের মধ্যে আরও রয়েছে, বিগত সরকার ১৫ সময়ে বিদেশে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার করেছে বলে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে। সেগুলো দেশে ফেরত আনার জন্য সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করে ৯২ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে ও খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ কোটি টাকার বেশি। এগুলো আদায়ের উদ্যোগ নিতে হবে। বিদ্যমান অর্থঋণ আদালত (২০০৩) সরকারকে দ্রুত ট্রাইব্যুনাল গঠন করার যাবতীয় আইনি সুযোগ দিয়েছে। সরকার এ সুযোগ ব্যবহার করে দ্রুত একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে খেলাপি অর্থ আদায় ও অনাদায়ে তাঁদের সম্পত্তি ক্রোক করতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নাগরিক কমিটির আরও কয়েকজন নেতা বক্তব্য দেন।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
নভেম্বরে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ও মৃত্যু বেড়েছে
নভেম্বর মাসে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা অক্টোবরের তুলনায় বেড়েছে। অক্টোবরে ৪৯টি সহিংসতার ঘটনায় ৫৪৭ জন আহত ও ২ জন নিহত হয়েছিলেন। পরের মাসে ৭২টি রাজনৈতিক সহিংসতায় ৭২৪ জন আহত হয়েছেন আর নিহত হয়েছেন ৯ জন। সেই হিসাবে গত মাসের চেয়ে নভেম্বরে রাজনৈতিক সহিসংতায় মৃত্যু সাতজন বেড়েছে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) নভেম্বর মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরেছে। আজ রোববার গণমাধ্যমে এ প্রতিবেদন পাঠিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনটি। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন এবং নিজেদের তথ্যানুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
গণপিটুনিতে মৃত্যু বেড়েছেএমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নভেম্বর মাসেও একই ধারাবাহিকতায় গণপিটুনি বা মব (উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ আক্রমণ) সন্ত্রাসে হতাহতের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে ঘটেই চলেছে। নভেম্বরে কমপক্ষে ৪৩টি গণপিটুনির ঘটনায় ১৯ জন নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন ৩৮ জন। গণপিটুনির শিকার ২৩ জনকে আহত অবস্থায় পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। গণপিটুনিতে নিহতের মধ্যে ১ জনকে ছিনতাইয়ের অভিযোগে, ১৪ জনকে চুরির অভিযোগে, ২ জনকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে, ১ জনকে ডাকাতি ও ১ জনকে সালিসে হত্যা করা হয়।
অক্টোবর মাসে মোট গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছিল ৪৪টি। ওই মাসে গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ১২। আগের মাসে নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন।
এমএসএফ বলছে, আইন অবজ্ঞা করে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। এ ক্ষেত্রে গণপিটুনির সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব।
কারা হেফাজতে মৃত্যুএমএসএফের পরিসংখ্যান বলছে, নভেম্বরে কারা হেফাজতে মোট ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আগের মাসে এর সংখ্যা ছিল ১৩। চলতি মাসে ১ জন কয়েদি ও ১০ জন হাজতির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মী বলে জানা গেছে।
মানবাধিকার সংগঠনটি বলছে, কারা অভ্যন্তরে চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি বন্দীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে হেফাজতে মৃত্যুর কারণ যথাযথভাবে তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এ ছাড়া সরকারকে অবশ্যই যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত সমাধান খুঁজে বের করে বন্দীদের চিকিৎসাসেবার সুযোগ দিতে হবে। চিকিৎসাসেবা থেকে কোনোভাবেই কারাবন্দীদের বঞ্চিত করা যাবে না।
নাজুক সীমান্তে পরিস্থিতিএমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নভেম্বরে সীমান্ত পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত নাজুক। এ মাসে ভারতীয় জলসীমার কাছে বঙ্গোপসাগর থেকে ১০৮ জেলেকে ধরে নিয়ে যায় ভারতীয় কোস্টগার্ড। এ ছাড়াও নাফ নদী থেকে নৌকাসহ ৪৭ জেলেকে ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি।
এ ছাড়া নভেম্বরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে এক বাংলাদেশি নিহত ও চারজন আহত হয়েছেন। ভারতীয় নাগরিকের গুলিতে নিহত হয়েছেন আরও একজন। ভারতীয় সীমান্তে অজ্ঞাত আরও এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। চোরাকারবারিদের হামলা ঠেকাতে গিয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) গুলিতেও এক যুবক নিহত হয়েছেন।
এমএসএফ বলছে, সীমান্তে পরিস্থিতির বিষয়ে প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আশাব্যঞ্জক প্রতিকার হচ্ছে না। সীমান্তে এ ধরনের ঘটনা কখনোই কাম্য হতে পারে না। অপর দিকে প্রতিবাদ সত্ত্বেও মিয়ানমার আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে চলেছে। সীমান্তে এমন ঘটনা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।
অজ্ঞাতনামা মরদেহ উদ্ধারএমএসএফ বলছে, নভেম্বরেও আগের ধারাবাহিকতায় অজ্ঞাতনামা মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা বাড়ছে। অজ্ঞাতনামা মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। পাশাপাশি পরিচয় উদ্ধারে অপারগতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১৩ জন নারী ও ৪৫ জন পুরুষসহ মোট ৫৮টি অজ্ঞাতনামা মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। অল্পসংখ্যক ঘটনা ছাড়া সব কটি মরদেহের পরিচয় অজ্ঞাতই থেকে যাচ্ছে। আগের মাসে ৬৬টি অজ্ঞাতনামা মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল।
উদ্ধার হওয়া মরদেহের বেশির ভাগই নদী বা ডোবায় ভাসমান, মহাসড়ক বা সড়কের পাশে, সেতুর নিচে, রেললাইনের পাশে, ফসলি জমিতে ও পরিত্যক্ত স্থানে পাওয়া যায়। কিছু মরদেহ গলা কাটা, বস্তাবন্দী, হাত-পা বাঁধা ও রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।