কট্টরবাদীদের জয়ে জার্মানির ভবিষ্যৎ কোন দিকে
Published: 28th, February 2025 GMT
বর্তমানে জার্মানি ও ইউরোপে নব্য নাৎসি বা কট্টর জনতুষ্টিবাদীদের মূল জনপ্রিয় স্লোগান হলো, ‘শরণার্থী আর অভিবাসী হটাও’। একসময় ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীরা শত বছরের বেশি সময় ধরে এশিয়া ও আফ্রিকার নানা দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। তারা এসব দেশে পরোক্ষভাবে যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধে মদদ দিয়ে সেখানকার মানুষকে গৃহহারা করেছে। অথচ এখন তারা শরণার্থী ও অভিবাসীদের রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়ে ইউরোপে রাজনীতি করছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর, অ্যাডলফ হিটলারের গঠিত ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক জার্মান শ্রমিক দল’ (এনএসডিএপি) নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এই দলের আদর্শ ও কর্মসূচি ছিল উগ্র জাতিবিদ্বেষ, জাতীয়তাবাদ এবং গণতন্ত্র ও প্রগতিশীল দলগুলোর বিরোধিতা। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দলটি জার্মানির একমাত্র অনুমোদিত দল ছিল এবং তথাকথিত তৃতীয় রাইখের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল।
প্রায় ৮০ বছর পর জার্মানির ২১তম জাতীয় নির্বাচনে সেই আদর্শের অনুসারী কট্টরপন্থীরা বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছে। জার্মান পার্লামেন্টের ৬৩০টি আসনের মধ্যে নব্য নাৎসি কট্টরবাদী দল অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড (এএফডি) ১৫২টি আসন পেয়েছে। যদিও তারা সরকার গঠন করতে পারবে না, তবে দলটি পার্লামেন্টে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।
নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের দিন জার্মানিজুড়ে অভিবাসনবিরোধী দলটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা গণতান্ত্রিক দলগুলোকে আহ্বান জানিয়েছে যেন তারা এএফডির সঙ্গে কোনো ধরনের জোট গঠন না করে। তবে এসব প্রতিবাদ সত্ত্বেও দলটির উত্থান ঠেকানো যায়নি।
জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার করোনা-পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সমস্যা ও মুদ্রাস্ফীতি, তিন দলের জোটের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দৃঢ়তার অভাব, জলবায়ু নীতি নিয়ে বিতর্ক এবং নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ—এসব কারণে শলৎজের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে।
নির্বাচনের পর ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) নেতা ফ্রিডরিখ মের্ৎস জার্মান অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি নির্বাচনী প্রচারে প্রথম ১০০ দিনের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
চার বছর আগে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের নেতা ও সাবেক চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর পর ওলাফ শলৎজের নেতৃত্বে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, গ্রিন পার্টি ও ফ্রি ডেমোক্র্যাট পার্টি মিলে তিন দলীয় জোট সরকার গঠন করে। তবে জোটের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের ফলে ২০২৪ সালের নভেম্বরে ফ্রি ডেমোক্র্যাট পার্টি সরকার থেকে বেরিয়ে গেলে ওলাফ শলৎজের সরকার পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। এই কারণেই জার্মানির ২১তম জাতীয় নির্বাচন ছয় মাস এগিয়ে আনা হয়।
নির্বাচনের সর্বশেষ ফলাফল অনুযায়ী, ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ ও সিএসইউ) ২০৮টি আসন, অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড (এএফডি) ১৫২টি আসন, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এসপিডি) ১২০টি আসন, গ্রিন পার্টি ৮৫টি আসন এবং বাম দল দ্য লিংকে ৬৪টি আসন পেয়েছে।
এএফডির উত্থানের পেছনে জার্মানির দুই প্রধান দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন ও সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির ভুল নীতি কাজ করেছে। শরণার্থী ও অভিবাসন বিষয়ে তাদের অবস্থান অনেক সময় অস্পষ্ট ছিল। নির্বাচনের আগে ডিসেম্বরে মাগডেবুর্গে একজন সৌদি নাগরিকের ক্রিসমাস মার্কেটে হামলা এবং নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে একজন আফগান নাগরিকের হামলা কট্টরপন্থীদের অভিবাসনবিরোধী প্রচারকে আরও জোরদার করেছে। অর্থনৈতিক সংকট ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি দলটির জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে।
বর্তমানে জার্মানির বড় অংশ এএফডিকে একটি ‘স্বাভাবিক’ দল হিসেবে দেখছে। জরিপে দেখা গেছে, এএফডির সমর্থকেরা অভিবাসীদের সংখ্যা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।
সম্প্রতি জার্মান অর্থনৈতিক ইনস্টিটিউট (আইডব্লিউ) একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে, ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৫ থেকে ২০২৩ সময়কালে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হার দুই-তৃতীয়াংশ হ্রাস পেয়েছে। ফলে রপ্তানি এখন আর জার্মান অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি নয়। এ ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, যা জার্মানির অর্থনীতির দুর্বলতার অন্যতম কারণ।
নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য ক্ষমতাসীন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের লজ্জাজনক হস্তক্ষেপ লক্ষ করা গেছে। প্রযুক্তি ধনকুবের ইলন মাস্ক এএফডির পক্ষে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান এবং দলটির নেত্রী অ্যালিস ভায়ডেলের সঙ্গে কথোপকথনের একটি অডিও শেয়ার করেন। জার্মান রাজনীতিবিদরা একে নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও গ্রিন পার্টি একটি শক্তিশালী জোট সরকার গঠনের পরিকল্পনা করছে। সম্ভাব্য নতুন চ্যান্সেলর হতে যাচ্ছেন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের নেতা ফ্রিডরিখ মের্ৎস। এখন দেখার বিষয়, নতুন সরকার জার্মানির চলমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে দেশকে কতটা এগিয়ে নিতে পারে।
সরাফ আহমেদ
প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শলৎজ র এএফড র র জন ত সরক র দলট র
এছাড়াও পড়ুন:
দাবানলে পুড়ছে ইসরায়েল, ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা
ইসরায়েলের জেরুজালেম শহরের কাছে ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ দাবানল। শুষ্ক আবহাওয়ায় তীব্র বাতাসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খাচ্ছেন অগ্নিনির্বাপণ কর্মীরা। এমন পরিস্থিতিকে ‘জাতীয় জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ। খবর সিএনএন, টাইমস অব ইসরায়েল, বিবিসি, আল জাজিরার
দাবানল নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক সহায়তা চেয়েছে ইসরায়েল। দাবানলে এ পর্যন্ত অন্তত ১৩ জন আহত হয়েছেন। তবে কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।
দাবানলকবলিত কয়েকটি এলাকার মানুষজনকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি সড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কার্তজ বলেছেন, এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা আন্তর্জাতিক সহায়তা চেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা জাতীয় জরুরি অবস্থার মধ্যে আছি।’
জেরুজালেমের অগ্নিনির্বাপণ বিভাগের কমান্ডার শমুলিক ফ্রিডম্যান বলেন, ইসরায়েলের ইতিহাসে এটি সম্ভবত সবচেয়ে বড় দাবানল। সতর্ক করে তিনি বলেন, কিছু সময়ের মধ্যে ঘণ্টায় ৬০ মাইলের বেশি গতিতে বাতাস বইতে পারে, যা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলতে পারে।
এই দাবানলের কারণে বুধবার ইসরায়েলের মেমোরিয়া ডেতে তেল আবিব ও জেরুজালেমের মধ্যে সংযোগকারী প্রধান সড়ক ‘রুট-১’ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, ঘন ধোঁয়ার মধ্যে মানুষ সড়কের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
কয়েক ঘণ্টা পরে জরুরি সেবাকর্মীরা মহাসড়কে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা সারি সারি গাড়ি তল্লাশি করে দেখছিলেন, ওই সব গাড়ির মধ্যে কেউ আটকে আছেন কি না।
অগ্নিনির্বাপণ বিভাগের কমান্ডার শমুলিক ফ্রিডম্যান বলেন, আমরা এখনো জানি না, কী কারণে আগুন লেগেছে। আমরা এখন পর্যন্ত কোনো সূত্রও খুঁজে পাইনি। এখনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি।
ইসরায়েলি পুলিশ বলেছে, তারা সন্দেহভাজন এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। ওই ব্যক্তি একটি খোলা মাঠে আগুন লাগানোর চেষ্টা করছিলেন বলে পুলিশের দাবি।
এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি পুলিশ দাবি করেছে, জেরুজালেমের পুলিশ কর্মকর্তারা পূর্ব জেরুজালেমের একজন বাসিন্দাকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছে। ওই ব্যক্তি তখন শহরের দক্ষিণ প্রান্তের একটি খোলা মাঠে আগুন লাগানোর চেষ্টা করছিলেন। তার কাছ থেকে একটি লাইটার, তুলা ও অন্যান্য দাহ্য পদার্থ উদ্ধার করা হয়েছে।
ইসরায়েলি পুলিশের দাবি, ৫০ বছর বয়সী সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তি পূর্ব জেরুজালেমের উম তুবা এলাকার বাসিন্দা। উম তুবা এলাকায় আরব ফিলিস্তিনিরা বসবাস করে থাকে।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদন সার দাবানল মোকাবিলায় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, এমন ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে কথা বলছেন। তিনি তাদের কাছ থেকে উড়োজাহাজের সহায়তা চেয়েছেন। ইতালি ও মেসিডোনিয়া থেকে তিনটি উড়োজাহাজ শিগগিরই ইসরায়েলে পৌঁছাবে বলে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল জানিয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দাবানল ছড়িয়ে পড়া এলাকা থেকে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কার্তজ বলেন, ‘আমরা জাতীয় জরুরি অবস্থার মধ্যে আছি। জীবন বাঁচাতে এবং দাবানল নিয়ন্ত্রণে আনতে সব বাহিনীকে সক্রিয় করতে হবে।’
ইসরায়েলের ফায়ার অ্যান্ড রেসকিউ সার্ভিস জানিয়েছে, প্রায় ১২০টি দল এবং ১২টি অগ্নিনির্বাপণ বিমান ও হেলিকপ্টার দাবানল মোকাবিলায় কাজ করছে।
শামির মেডিকেল সেন্টার ও কপলান মেডিকেল সেন্টারের তথ্যমতে, দাবানলের কারণে অন্তত ডজন খানেক মানুষকে এই দুটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ইতিমধ্যে জেরুজালেমের উপকণ্ঠে অবস্থিত হাদাসা মেডিকেল সেন্টারের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষের প্রতি অনুরোধ করা হয়েছে, ‘জরুরি প্রয়োজন ছাড়া’ কেউ যেন হাসপাতালে না আসেন। হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও যাদের অবস্থা গুরুতর নয়, তাদের হাসপাতাল থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে দাবানলে আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
গত সপ্তাহে যে এলাকায় দাবানল দেখা দিয়েছিল, এবারও দাবানল প্রায় একই জায়গায় ছড়িয়েছে।