গত ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদের অভূতপূর্ব ও অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতা ও তিক্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে।
এরপর সমস্বরে সব স্তরের পুলিশ সদস্যরা একটি দাবি তুলেছিলেন। তা হলো, পুলিশ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে চায়।
পুলিশ কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বের আর তাঁবেদারি করতে চায় না। বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত ২ লাখ ১২ হাজারের বেশি পুলিশ সদস্যের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে ভিন্ন মত-পথ থাকলেও এই ইস্যুতে তাঁরা সবাই একমত হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই রাষ্ট্রের বাহিনী হিসেবে নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে চান।
৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে পুলিশের সংস্কার নিয়ে ইউনিট পর্যায় থেকে আসা বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাবের প্রায় শতভাগ ইউনিটের প্রধান দাবি বা প্রস্তাব ছিল, বাংলাদেশ পুলিশকে পরিচালনার জন্য স্বাধীন একটি কমিশন গঠন করা হোক।
আরও পড়ুনপুলিশের যে সমস্যাগুলোর কথা কেউ বলে না ০৯ মার্চ ২০২৫বাংলাদেশ পুলিশের সব পর্যায়ের সব স্তরের পুলিশ সদস্যরা কেন এমন দাবি তুলেছিলেন, তার সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, পতিত স্বৈরাচার পুলিশকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করেছে। বাধ্য হয়ে তাঁদের অনেকেই গণহত্যায় অংশ নিয়েছেন। খুবই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে তাঁরা জনরোষের শিকার হয়েছেন (ঢাকা পোস্ট, ১৭ নভেম্বর ২০২৪)।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য থেকে একটি বিষয় নিশ্চিত যে পতিত সরকার আইনকে তোয়াক্কা না করে পুলিশকে তাদের কর্মীর মতো ব্যবহৃত হতে বাধ্য করেছে। ফলে এই আন্দোলনে কমপক্ষে ৪৪ জন পুলিশ সদস্য হত্যার শিকার হয়েছেন (প্রথম আলো, ১৮ আগস্ট ২০২৪)।
থানা, পুলিশ অফিস, পুলিশ লাইনসসহ অন্তত ৪৬০টি পুলিশ অবকাঠামো এবং পুলিশের ১ হাজার ৭৪টি যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে (বার্তা বাজার, ১ ডিসেম্বর ২০২৪)।
২০২৪–এর পয়লা জুলাই থেকে শুরু হওয়া কোটা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেওয়ার এই ৩৬ দিনের জার্নিতে বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন বাহিনী, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো মাঠে থেকে কাজ করেছে।
কিন্তু এককভাবে পুলিশ সদস্য, পুলিশ স্থাপনা ও পুলিশের যানবাহনকে টার্গেট করে আক্রমণ করা নিশ্চিতভাবেই পুলিশের প্রতি মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ কিংবা পুলিশের নেতিবাচক ভূমিকার প্রতি মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
আরও পড়ুনপুলিশ সংস্কারের সুপারিশ: যা কিছু বাদ পড়ে গেল২২ জানুয়ারি ২০২৫কিন্তু প্রশ্নটি হলো, এটি কেন হলো? আইনানুযায়ী পুলিশের প্রতিটি পদক্ষেপ আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত ও লিখিত হওয়ার কথা।
এ ছাড়া বিদ্যমান সরকারি নিয়ন্ত্রণ কাঠামোতে পুলিশ সরকারের অধীনে থাকা একটি প্রতিষ্ঠানমাত্র।
তাহলে প্রশ্ন হলো, বিদ্যমান আইন, বিধি ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো থাকার পরও পুলিশ কীভাবে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহৃত হলো বা হতে বাধ্য হলো?
কেন পুলিশ এই নির্দেশের বাইরে যেতে পারেনি?
কার ভুলে পুলিশ সদস্যরা জীবন হারালেন?
কেন আজও পুলিশ মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে জনরোষের শিকার হচ্ছেন?
পুলিশের ওপর এমন অকল্পনীয় ঝড় বয়ে যাওয়ার পর কেন পুলিশ সদস্যরা সমস্বরে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের দাবি জানালেন?
সত্যিকার অর্থেই যদি বাংলাদেশ পুলিশকে জনগণের পুলিশ কিংবা এই রাষ্ট্রের পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হয়, অতীতের এসব ভুলের কারণ ও এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।
১৮২৯ সালে ব্রিটিশ মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্ট পাস হয়। অন্যদিকে সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতীয় উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনের অবসান হলে সরাসরি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে যাওয়ার পর ১৮৬১ সালে পুলিশ অ্যাক্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হয়, যা বর্তমান বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ ওই সময়ের ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থাকা উপমহাদেশের সব অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য হয়।
আরও পড়ুনআমরা পুলিশ, বিশ্বাস করুন আমরা আপনাদের শত্রু নই০৬ আগস্ট ২০২৪আপনি যদি এই দুটি আইনের প্রথম পাঠকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করেন, তাহলে দেখবেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া এই দুটি পুলিশ আইনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।
যেখানে ব্রিটিশ মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্ট অনুযায়ী, পুলিশকে জনগণের আস্থা অর্জনের প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সেখানে ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য পাস করা পুলিশ অ্যাক্ট–১৮৬১–এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনকে টিকিয়ে রাখা।
আরও অবাক করা বিষয় হলো, সময়ের সঙ্গে ব্রিটিশ মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্টকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন, আধুনিকায়ন করা হয়েছে।
পক্ষান্তরে আমাদের বিদ্যমান পুলিশ অ্যাক্টকে পাকিস্তান আমলে কিছু নাম আর টার্মকে পরিবর্তন করেছি, আরেকবার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও কিছু নাম আর টার্মকে পরিবর্তন করেছি।
এর বাইরে আপনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটি দেখবেন, তা হলো ব্রিটিশ আমলে ইন্সপেক্টর জেনারেলকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, যা পর্যায়ক্রমিকভাবে সংকুচিত করে দেওয়া হয়েছে।
আরও সহজ করে বললে ব্রিটিশ আমলের করা আইনে ইন্সপেক্টর জেনারেল যেসব বিষয়ে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন, সময়ের সঙ্গে তাঁর ক্ষমতাকে সংকুচিত করে পুরোপুরি সরকারের আজ্ঞাবহ করে ফেলা হয়েছে।
আরও মজার বিষয় হলো, রাস্তায় সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের (জন উপদ্রব বা পাবলিক নুইসেন্স) জন্য পুলিশ আইনানুযায়ী অনূর্ধ্ব ৫০ টাকার জরিমানা করার বিধানটি এখনো বহাল আছে (দেখুন পুলিশ অ্যাক্ট ১৮৬১–এর ৩৪ ধারা)!
অথচ মানুষ পুলিশের কাজকে সরকারি কাজ হিসেবে বিবেচনা না করে বরং পুরো ক্ষোভটাই পুলিশের ওপর ঝাড়ল। নিহত হলেন, আহত হলেন অসহায় পুলিশ সদস্যরা। কিছু ব্যতিক্রম বাদে নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। জনগণের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। সত্যিকার অর্থে, স্বাধীন পুলিশ কমিশন ও পুলিশ আইন সংস্কার করার দাবির মাধ্যমে পুলিশ যেকোনো কর্তৃপক্ষের অবৈধ, অন্যায় ও বেআইনি হুকুমকে জোরালোভাবে ‘না’ বলার সুযোগ চায়।গত জুলাই আন্দোলনকে ঘিরে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন।
প্রশ্ন তোলার মতো যথেষ্ট কারণও আছে। কিন্তু এখন যদি পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, বিদ্যমান আইনে সরকারি সিদ্ধান্তকে মান্য না করার জন্য পুলিশের কি আইনি সুযোগ বা সুরক্ষা আছে?
পুলিশ আইন ১৮৬১–এর ২৩ ধারা অনুযায়ী, ‘প্রত্যেক পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্ব ও কর্তব্য হইবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত সকল বৈধ আদেশ ও পরোয়ানা দ্রুত পালন ও কার্যকর করা।’
অথচ এই আইনের কোথাও আপনি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ থেকে প্রাপ্ত আদেশের বৈধতা বা অবৈধতা নিরূপণ বা চ্যালেঞ্জ করার কোনো সুযোগ নেই।
এমনকি অবৈধ আদেশ না মানার সুযোগ বা এ–সংক্রান্ত কোনো আইনি সুরক্ষা দেওয়া হয়নি। কাজেই বিদ্যমান আইনে পুলিশ সরকারের হুকুম মানতে বাধ্য।
এ কারণেই গত জুলাই আন্দোলনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তৎকালীন সরকারের নির্দেশনা মেনেই পুলিশকে বল প্রয়োগ করতে হয়েছে।
আপনি হয়তো আমার সঙ্গে দ্বিমত হতে পারেন, তবে বিদ্যমান আইনানুযায়ী এর বিকল্প কিছু করার সুযোগ কি পুলিশের ছিল বা আছে?
পুলিশ যদি সরকারের আদেশ না মানত, তাহলে সেটি কি পুলিশ আইনের লঙ্ঘন হতো না?
অথচ মানুষ পুলিশের কাজকে সরকারি কাজ হিসেবে বিবেচনা না করে বরং পুরো ক্ষোভটাই পুলিশের ওপর ঝাড়ল। নিহত হলেন, আহত হলেন অসহায় পুলিশ সদস্যরা। কিছু ব্যতিক্রম বাদে নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। জনগণের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে।
সত্যিকার অর্থে, স্বাধীন পুলিশ কমিশন ও পুলিশ আইন সংস্কার করার দাবির মাধ্যমে পুলিশ যেকোনো কর্তৃপক্ষের অবৈধ, অন্যায় ও বেআইনি হুকুমকে জোরালোভাবে ‘না’ বলার সুযোগ চায়।
রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থেকে বিদ্যমান আইনানুযায়ী দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সত্যিকার অর্থেই একটি পেশাদার বাহিনী হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়।
যেখানে যেকোনো রাজনৈতিক শক্তি তাদের নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য পুলিশকে ব্যবহার করতে পারবে না।
পুলিশ এমন একটি ব্যবস্থা চায়, যেখানে জবাবদিহির আওতায় থেকেই বাংলাদেশ পুলিশ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে।
বাংলাদেশ পুলিশের এই চাওয়া কি খুব বেশি অযৌক্তিক? এটি কি গণমানুষের চাওয়া নয়? আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে এর বিকল্প আছে কি?
মো.
ইমরান আহম্মেদ, পিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পুলিশ এবং বর্তমানে পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইক, যুক্তরাজ্য।
ই–মেইল: [email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ল শ সদস য আইন ন য য় প ল শ আইন র জন য প সরক র র জনগণ র ক জ কর অন য য় পর য য় আগস ট ব যবহ আইন র
এছাড়াও পড়ুন:
আমানত রক্ষা করা ইসলামের সামাজিকতার সৌন্দর্য
আধুনিক বিশ্বে ক্রমবর্ধমান আত্মকেন্দ্রিকতার প্রভাবে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও দায়িত্ববোধ দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে ইসলামের একটি মৌলিক মূল্যবোধ—‘আমানত’—চিন্তা ও চর্চা থেকে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে।
অথচ আমানত শুধু একটি সামাজিক বা অর্থনৈতিক ধারণা নয়, বরং এটি একটি বিস্তৃত আত্মিক ও নৈতিক দায়িত্ব, যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মানুষের ওপর অর্পণ করেছেন।
পবিত্র কোরআনে এই আমানতের গুরুত্ব অত্যন্ত জোরালোভাবে বর্ণিত হয়েছে: ‘নিশ্চয়ই আমরা আমানত পেশ করেছিলাম আসমান, জমিন ও পাহাড়ের সামনে, তারা তা বহন করতে অস্বীকৃতি জানাল এবং তা হতে ভীত ছিল; কিন্তু মানুষ তা বহন করল। নিশ্চয়ই সে ছিল অত্যন্ত জুলুমকারী ও মূর্খ।’ (সুরা আহযাব, আয়াত: ৭২)
এই আয়াতে আমানতের মর্যাদা ও এর ওজনের গভীরতা প্রকাশ পায়। আল্লাহর এই দায়িত্ব মানুষের ওপর অর্পিত হওয়া তার বিশেষত্বের প্রমাণ, তবে এটি একই সঙ্গে তার জন্য একটি বড় পরীক্ষা।
নিশ্চয়ই আমরা আমানত পেশ করেছিলাম আসমান, জমিন ও পাহাড়ের সামনে, তারা তা বহন করতে অস্বীকৃতি জানাল এবং তা হতে ভীত ছিল। কিন্তু মানুষ তা বহন করল।সুরা আহযাব, আয়াত: ৭২আমানতের ব্যাপকতা‘আমানত’ শব্দটির অর্থ শুধু আর্থিক বা সামাজিক বিশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি ব্যাপক ধারণা, যা মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমানতের মধ্যে রয়েছে:
ব্যক্তিগত আচরণে সততা: কথায়, কাজে ও প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সত্যবাদিতা।
সামাজিক দায়িত্ব: পরিবার, সমাজ ও সম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন।
পরিবেশের প্রতি যত্ন: আল্লাহর সৃষ্টির খিলাফা হিসেবে প্রকৃতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকা।
আধ্যাত্মিক আনুগত্য: আল্লাহর প্রতি পূর্ণ সমর্পণ ও তাঁর আদেশ পালন।
আমানত একটি ইবাদতের অংশ, যা শুধু দুনিয়ার জন্য নয়, বরং আখিরাতের জবাবদিহির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। এটি মানুষের নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা ও সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে তোলে।
আরও পড়ুনইসলামে আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষার গুরুত্ব২২ জুলাই ২০২২নবী–যুগে আমানতের উদাহরণইসলামের প্রাথমিক যুগে নবীজি (সা.)-এর প্রতিষ্ঠিত মদিনার সমাজ আমানতের একটি জীবন্ত উদাহরণ। মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যে অভূতপূর্ব ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠেছিল, তা আমানতের বাস্তব প্রয়োগ। আনসাররা তাদের ঘরবাড়ি, সম্পদ এবং এমনকি হৃদয়ের ভালোবাসা মুহাজিরদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন।
এই সম্পর্ক শুধু সম্পদের বণ্টন নয়, বরং পারস্পরিক দায়িত্ব ও বিশ্বাসের একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিল। এমনকি আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-এর সঙ্গে তাঁর আনসারি ভাই সা’দ ইবনে রাবী (রা.) তাঁর সম্পদের অর্ধেক এবং এমনকি তাঁর স্ত্রীদের একজনকে তালাক দিয়ে তাঁকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই ত্যাগ ও বিশ্বাস আমানতের প্রকৃত চিত্র। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৭৮০)
মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যে অভূতপূর্ব ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠেছিল, তা আমানতের বাস্তব প্রয়োগ। আনসাররা তাদের ঘরবাড়ি, সম্পদ এবং এমনকি হৃদয়ের ভালোবাসা মুহাজিরদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন।এই ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে মদিনার সমাজে একতা, সহানুভূতি ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তি গড়ে উঠেছিল, যা আজও মুসলিম সমাজের জন্য একটি আদর্শ।
আধুনিক সমাজে আমানতের অবক্ষয়দুর্ভাগ্যবশত, আজকের সমাজে আমানতের চর্চা দুর্বল হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে অভিবাসী মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, গোষ্ঠীবদ্ধতা ও সংকীর্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মসজিদগুলোতে জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বিভেদ, পারিবারিক স্বার্থপরতা এবং একে অপরের প্রতি সন্দেহ সমাজের ঐক্যকে ভঙ্গ করছে। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও প্রায়ই দেখা যায়, অসৎ আচরণ, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও বিশ্বাসের অপব্যবহার।
এমনকি ব্যক্তিগত জীবনেও ‘নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা’ একটি নতুন সামাজিক আদর্শ হয়ে উঠেছে। মানুষ অন্যের প্রতি দায়িত্ব পালনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এটি শুধু সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, বরং পরিবেশের প্রতি দায়িত্ববোধ: আল্লাহ তা’আলা মানুষকে এই পৃথিবীর খলিফা বানিয়েছেন, যার মধ্যে পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বও অন্তর্ভুক্ত।
কিন্তু আজকের উন্নয়নের নামে বনভূমি ধ্বংস, নদী ও বাতাসের দূষণ এবং প্রাণপ্রবাহের ক্ষতি আমানতের এই দিকটিকে উপেক্ষা করছে। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার পর পৃথিবীতে পুনরায় বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৫৬)
প্রকৃতির প্রতি আমাদের দায়িত্ব হলো এটিকে সংরক্ষণ করা, অপচয় রোধ করা এবং সৃষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখা।
আরও পড়ুনপ্রলোভনের এই যুগে নিজেকে রক্ষার উপায়০২ আগস্ট ২০২৫আমানতের নষ্টের ভবিষ্যদ্বাণীনবীজি (সা.) আমানতের অবক্ষয় সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছেন: ‘মানুষ ঘুমাবে আর আমানত তার হৃদয় থেকে উঠিয়ে নেওয়া হবে...এমন সময় আসবে যখন বলা হবে, অমুক গোত্রে একজন বিশ্বস্ত মানুষ আছে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭০৮৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪৫)
এই হাদিসটি একটি গভীর সতর্কবাণী। এটি ইঙ্গিত করে যে একটি সময় আসবে যখন বিশ্বস্ততা এতটাই বিরল হয়ে পড়বে যে একজন আমানতদার ব্যক্তিকে ব্যতিক্রম হিসেবে গণ্য করা হবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী আধুনিক সমাজের বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে স্বার্থপরতা ও অবিশ্বাস বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মানুষ ঘুমাবে আর আমানত তার হৃদয় থেকে উঠিয়ে নেওয়া হবে...এমন সময় আসবে যখন বলা হবে, অমুক গোত্রে একজন বিশ্বস্ত মানুষ আছে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭০৮৬আমানতের পুনর্জাগরণের উপায়আমানতের মূল্যবোধকে পুনরায় জীবন্ত করতে হলে আমাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে:
সত্যবাদিতা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা: কথা ও কাজে সততা বজায় রাখা এবং প্রতিশ্রুতি পূরণ করা।
দায়িত্বশীলতা ও সততা: পরিবার, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বশীল আচরণ।
ন্যায়পরায়ণ আর্থিক আচরণ: ব্যবসা ও আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা ও বিশ্বস্ততা।
প্রকৃতির প্রতি যত্ন: পরিবেশ সংরক্ষণ, অপচয় রোধ ও সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষা।
পারস্পরিক সহযোগিতা: সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য গড়ে তোলা।
আমানত শুধু একটি সামাজিক দায়িত্ব নয়, বরং এটি একটি ইবাদত, যা আল্লাহর প্রতি আমাদের আনুগত্যের প্রকাশ। এটি ব্যক্তি, সমাজ ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যম। আমানতের চর্চাকে পুনরুজ্জীবিত করার মাধ্যমে আমরা একটি দয়ালু, ন্যায়ভিত্তিক ও ঐক্যবদ্ধ মুসলিম সমাজ গড়ে তুলতে পারি। এটি আমাদের দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের সাফল্যের পথ প্রশস্ত করবে।
আরও পড়ুনআখিরাতে বিশ্বাস সত্কর্মের অনুপ্রেরণা০৪ মে ২০১৮