সাত মাসেও উপকারভোগীর তালিকা সংশোধন হয়নি
Published: 4th, May 2025 GMT
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির উপকারভোগী বাছাইয়ে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ অনেক পুরোনো। বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপে দেখা গেছে, রাজনৈতিক প্রভাবে দরিদ্র মানুষের পরিবর্তে সচ্ছলদের সরকারি ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হয়। দীর্ঘদিনের এ অনিয়ম দূর করতে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তালিকা সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এ কাজ এখনও চিঠি চালাচালির মধ্যেই আটকে আছে। ঘোষণার পর সাত মাসেও এ কাজ শেষ হয়নি।
গত ৬ অক্টোবর সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ জানিয়েছিলেন, জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফ সরকারের কাছে একটি জরিপ প্রতিবেদন দিয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, সামাজিক সুরক্ষার উপকারভোগীদের ৪৩ শতাংশই ত্রুটিপূর্ণ। যারা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, অনেকেই তার যোগ্য নন। সরকার তালিকা পর্যালোচনা করবে।
সর্বশেষ তথ্য হলো, গত জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন প্রান্তিকে আগের তালিকা অনুযায়ী ভাতা দেওয়া হয়েছে। কাজ শেষ করতে কতদিন লাগবে, তা নিশ্চিত করে বলছে না সমাজসেবা অধিদপ্তর। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সদিচ্ছা থাকলে তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে তালিকা যাচাই করা সম্ভব ছিল।
গত ৮ অক্টোবর সমাজসেবা অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক ড.
প্রথম প্রান্তিকের
(জুলাই-সেপ্টেম্বর) ভাতা দেওয়া হবে। সম্প্রতি অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, যে গাইডলাইনের ভিত্তিতে তালিকা যাচাই করা হবে, সেটিই এখনও হয়নি। অথচ এ উদ্যোগকে কেন্দ্র করে প্রথম প্রান্তিকের ভাতা সময়মতো দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় প্রান্তিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ভাতাও ত্রুটিপূর্ণ তালিকা অনুযায়ী দেওয়া হয়। সামাজিক নিরাপত্তা-সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি (সিএমসি) ৩০ মার্চের মধ্যে উপকারভোগীর তালিকা যাচাই করে চূড়ান্ত করার নির্দেশনা দিয়েছিল। ওই নির্দেশনাও বাস্তবায়ন হয়নি। তৃতীয় প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ) ভাতাও আগের তালিকা অনুযায়ী দেওয়া হচ্ছে।
গত মার্চে সিএমসি সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে বৈঠক হয়। সভায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের একজন জানান, মার্চের মধ্যে মাঠ পর্যায়ের ট্যাগ অফিসার নিয়োগ এবং নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ী প্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ উপকারভোগীর তথ্য যাচাই করা সম্ভব হয়নি। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য ভান্ডারে উপকারভোগীদের প্রায় ৫০ ধরনের তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। এর মধ্যে বয়স, বার্ষিক আয়সহ অন্তত ১০টি তথ্য মাঠ পর্যায়ে যাচাই করার প্রয়োজন হবে। তথ্য যাচাই করে তালিকা হালনাগাদ করতে কমপক্ষে আরও তিন মাস লাগবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গত মঙ্গলবার সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে কোন প্রক্রিয়ায় হবে তার একটি গাইডলাইন প্রয়োজন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে এখনও তা চূড়ান্ত হয়নি। তাই এ কাজ পিছিয়ে আছে। এ বছর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কখন চূড়ান্ত হবে, বলা যাচ্ছে না। মন্ত্রণালয় যে নিদের্শনা দেবে, সে অনুযায়ী কাজ করা হবে। গাইডলাইনের বিষয়ে কথা বলার জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. মহিউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
যা বলছেন অর্থনীতিবিদরা
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, বর্তমানে জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নম্বরসহ সব ধরনের তথ্য রয়েছে। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সদিচ্ছা ও দক্ষতা থাকলে খুব দ্রুত এ কাজ করা সম্ভব। অন্তর্বর্তী সরকার যদি এ কাজ করে যেতে না পারে আদৌ এখানে সংস্কার হবে কিনা, সন্দেহ রয়েছে। সাধারণত রাজনৈতিক সরকার এ ধরনের সংস্কার করতে চায় না।
গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও বের হওয়া সম্ভব হয়নি। তালিকা থেকে অযোগ্যদের খুব সহজেই বাদ দেওয়া সম্ভব। তবে বাদ দেওয়ার পর যথাযথ যোগ্যতার ভিত্তিতে নতুন উপকারভোগী অন্তর্ভুক্তিতে একটু সময় লাগতে পারে। কিন্তু সরকারের প্রতিনিধিরা স্থানীয় নাগরিক সমাজের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করলে এতদিনে দুটি কাজই সম্ভব ছিল।
কর্মসূচির আওতা ও ভাতা
বর্তমানে ২৬টি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১৪০টি কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, স্বামী পরিত্যক্ত ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ ২৭ ধরনের ভাতা দেওয়া হয়। এসব কর্মসূচিকেই প্রকৃত অর্থে সামাজিক সুরক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
চলতি অর্থবছরে বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন ৬০ লাখ। তাদের মাথাপিছু মাসিক ভাতা ৬০০ টাকা। বিধবা ভাতা পান প্রায় ২৮ লাখ এবং মাথাপিছু ভাতা ৫৫০ টাকা। অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা পান ৩২ লাখ এবং মাথাপিছু ভাতা ৮৫০ টাকা। হিজড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিশেষ ভাতা পান ১৩ লাখ। তাদের মাথাপিছু ভাতা ৬০০ টাকা। বেদে জনগোষ্ঠীর ৬ হাজার জন ভাতা পান। তাদের মাথাপিছু ভাতা ৫০০ টাকা। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিশেষ ভাতা পান ৬০ হাজার। তাদের মাথাপিছু মাসিক ভাতা ৫০০ টাকা। সাধারণত তিন মাস পরপর উপকারভোগীদের টাকা দেওয়া হয়।
তালিকা সংশোধন কেন দরকার
অর্থ ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচিতদের মধ্যে অনেকেই পেনশন, ভিজিডি বা অন্যান্য ভাতা নিচ্ছেন। অনেকেই একাধিক ভাতা নিচ্ছেন। মূলত উপকারভোগী নির্বাচনে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের পক্ষপাত ও দুর্নীতির কারণে এমন হয়।
অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত টাস্কফোর্সের রিপোর্টে বলা হয়েছে, অনেক মানুষকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ও দুর্নীতির মাধ্যমে বাছাই করা হয়। যোগ্যতা থাকলেও অনেকে ভাতা পান না। দেশের দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রায় ৫৪ শতাংশ পরিবার সামাজিক সুরক্ষা আওতার বাইরে। অন্যদিকে সামাজিক সুরক্ষার সুবিধা পায়, এমন ৬২ শতাংশ পরিবার গরিব নয় এবং তারা কোনো ঝুঁকির মধ্যেও নেই। এসব ত্রুটি দূর করা গেলে আরও অন্তত ১১ লাখ মানুষকে অতিদরিদ্র ও ২৫ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনা সম্ভব হতো।
গবেষণা সংস্থা সিপিডির গত বছর চালানো জরিপে দেখা গেছে, বয়স্ক ভাতা পাওয়ার জন্য কার্ড পেতে গড়ে ২ হাজার ৬৫৩ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হয়। অনেকে ভাতা পাওয়ার যোগ্য হলেও ঘুষ দিতে না পারায় তা পান না।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম ঠ পর য য় য চ ই কর ক জ কর অন য য় সরক র ধরন র
এছাড়াও পড়ুন:
ইসিকে নিশানা করে ‘অ্যাটম বোমা’ ফাটালেন রাহুল গান্ধী, এখনো বাকি ‘হাইড্রোজেন বোমা’
ভারতের নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ভোটচুরির অভিযোগ এনে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, এটা ‘অ্যাটম বোমা’। তবে আরও ভয়ংকর তথ্য তিনি পরে আনবেন, যা ‘হাইড্রোজেন বোমার সমতুল্য’।
আজ বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আবার বিস্ফোরক অভিযোগ এনে রাহুল বলেন, নির্বাচন কমিশনের মদদে কিছু লোক, সংস্থা ও কল সেন্টার সংগঠিতভাবে কেন্দ্রে কেন্দ্রে বেছে বেছে কংগ্রেস, দলিত, আদিবাসী ভোটারদের নাম বাদ দিচ্ছে।
আজ সংবাদ সম্মেলন করে রাহুল বলেন, নির্দিষ্ট সফটওয়্যারের মাধ্যমে নকল আবেদন করে ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।
‘অ্যাটম বোমা’ ফাটানোর দিন রাহুল কর্ণাটকের মহাদেবপুরা বিধানসভা কেন্দ্রের ‘ভোট চুরির’ নমুনা পেশ করেছিলেন। আজ তিনি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন কর্ণাটকেরই আলন্দ কেন্দ্রকে।
রাহুলের অভিযোগ, নকল আবেদনের মাধ্যমে ওই কেন্দ্রের ৬ হাজার ১৮ জন ভোটারের নাম বাদ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। যেসব কেন্দ্রে কংগ্রেস শক্তিশালী, বেছে বেছে সেসব কেন্দ্রকেই নিশানা করা হয়েছে। ভুয়া ভোটারের নাম তোলার পাশাপাশি বৈধ ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে। এটা সংগঠিতভাবে করা হচ্ছে। কর্ণাটক পুলিশ সেই বিষয়ে তথ্য জানতে চাইলেও নির্বাচন কমিশন কোনো তথ্য দিচ্ছে না।
রাহুলের অভিযোগ, যাঁদের নামে আবেদন জানানো হচ্ছে এবং যাঁদের নাম মোছার আরজি জানানো হচ্ছে, তাঁদের কেউ–ই তা জানতে পারছেন না। সংবাদ সম্মেলনে এই ধরনের কিছু মানুষকে রাহুল হাজিরও করান।
কিছু নম্বরও দাখিল করে রাহুল বলেন, এসব নম্বর থেকে ভোটারদের নাম বাদ দেওয়ার আবেদন জানানো হয়। তাঁর প্রশ্ন, ওই নম্বরগুলোয় ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড বা ‘ওটিপি’ কীভাবে গেল?
কংগ্রেস নেতা বলেন, নির্দিষ্ট কিছু ঠিকানা থেকে নির্দিষ্ট ‘আইপি’ অ্যাড্রেস ব্যবহার করে নাম বাদ দেওয়ার আবেদন জানানো হচ্ছে। অভিযোগ তদন্ত করে দেখতে কর্ণাটক পুলিশের গোয়েন্দারা ইসির কাছে কিছু তথ্য চেয়েছিলেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) জ্ঞানেশ কুমার কোনো তথ্যই দেননি। এতেই বোঝা যাচ্ছে, ইসি ভোটচোরদের আড়াল করছে।
রাহুল বলেন, কর্ণাটক সিআইডি ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া বিষয়ে তথ্য জানতে চেয়ে ইসিকে ১৮ বার চিঠি লিখেছে। অথচ একটি চিঠিরও জবাব ইসি দেয়নি। ইসিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রাহুল বলেন, কমিশন স্বচ্ছ হলে এক সপ্তাহের মধ্যে কর্ণাটক সিআইডিকে যাবতীয় তথ্য দিয়ে সাহায্য করুক।
রাহুল মহারাষ্ট্রের রাজুরা বিধানসভা আসনের ভোটার তালিকা তুলে ধরে বলেন, সেখানে অনলাইনে ৬ হাজার ৮৫০ জনের নাম অবৈধভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাঁর অভিযোগ, বিভিন্ন রাজ্যে ভোটার তালিকায় এভাবে সংযোজন–বিয়োজন চলছে।
এর আগেও রাহুল নিশানা করেছিলেন সিইসি জ্ঞানেশ কুমারকে। আজও তিনি তাঁকে কাঠগড়ায় তোলেন। রাহুল বলেন, নির্বাচন স্বচ্ছ ও অবাধ করার বদলে তিনি পক্ষপাতমূলক আচরণ করেই চলেছেন। ভোট চুরি করাচ্ছেন। ভোটচোরদের রক্ষাও করছেন।
রাহুলের অভিযোগ এবারও খারিজ করে দিয়েছে ইসি। রাহুলের ডাকা সংবাদ সম্মেলনের পর আজ ইসি এক বিবৃতি দেয়। তাতে রাহুলের অভিযোগ ‘অসত্য ও ভিত্তিহীন’ জানিয়ে বলা হয়, অনলাইনে কেউ কোনো ভোটারের নাম বাদ দিতে পারেন না। নাম বাদ দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বক্তব্য শোনা হয়।