সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির উপকারভোগী বাছাইয়ে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ অনেক পুরোনো। বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপে দেখা গেছে, রাজনৈতিক প্রভাবে দরিদ্র মানুষের পরিবর্তে সচ্ছলদের সরকারি ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হয়। দীর্ঘদিনের এ অনিয়ম দূর করতে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তালিকা সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এ কাজ এখনও চিঠি চালাচালির মধ্যেই আটকে আছে। ঘোষণার পর সাত মাসেও এ কাজ শেষ হয়নি। 

গত ৬ অক্টোবর সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ জানিয়েছিলেন, জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফ সরকারের কাছে একটি জরিপ প্রতিবেদন দিয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, সামাজিক সুরক্ষার উপকারভোগীদের ৪৩ শতাংশই ত্রুটিপূর্ণ। যারা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, অনেকেই তার যোগ্য নন। সরকার তালিকা পর্যালোচনা করবে।

সর্বশেষ তথ্য হলো, গত জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন প্রান্তিকে আগের তালিকা অনুযায়ী ভাতা দেওয়া হয়েছে। কাজ শেষ করতে কতদিন লাগবে, তা নিশ্চিত করে বলছে না সমাজসেবা অধিদপ্তর। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সদিচ্ছা থাকলে তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে তালিকা যাচাই করা সম্ভব ছিল। 

গত ৮ অক্টোবর সমাজসেবা অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক ড.

আবু সালেহ মোস্তফা কামাল সমকালকে জানিয়েছিলেন, যাচাই-বাছাইয়ের পর তালিকা চূড়ান্ত করে যোগ্যদের হাতেই চলতি অর্থবছরের

প্রথম প্রান্তিকের 
(জুলাই-সেপ্টেম্বর) ভাতা দেওয়া হবে। সম্প্রতি অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, যে গাইডলাইনের ভিত্তিতে তালিকা যাচাই করা হবে, সেটিই এখনও হয়নি। অথচ এ উদ্যোগকে কেন্দ্র করে প্রথম প্রান্তিকের ভাতা সময়মতো দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় প্রান্তিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ভাতাও ত্রুটিপূর্ণ তালিকা অনুযায়ী দেওয়া হয়। সামাজিক নিরাপত্তা-সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি (সিএমসি) ৩০ মার্চের মধ্যে উপকারভোগীর তালিকা যাচাই করে চূড়ান্ত করার নির্দেশনা দিয়েছিল। ওই নির্দেশনাও বাস্তবায়ন হয়নি। তৃতীয় প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ) ভাতাও আগের তালিকা অনুযায়ী দেওয়া হচ্ছে।

গত মার্চে সিএমসি সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে বৈঠক হয়। সভায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের একজন জানান, মার্চের মধ্যে মাঠ পর্যায়ের ট্যাগ অফিসার নিয়োগ এবং নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ী প্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ উপকারভোগীর তথ্য যাচাই করা সম্ভব হয়নি। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য ভান্ডারে উপকারভোগীদের প্রায় ৫০ ধরনের তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। এর মধ্যে বয়স, বার্ষিক আয়সহ অন্তত ১০টি তথ্য মাঠ পর্যায়ে যাচাই করার প্রয়োজন হবে। তথ্য যাচাই করে তালিকা হালনাগাদ করতে কমপক্ষে আরও তিন মাস লাগবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গত মঙ্গলবার সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে কোন প্রক্রিয়ায় হবে তার একটি গাইডলাইন প্রয়োজন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে এখনও তা চূড়ান্ত হয়নি। তাই এ কাজ পিছিয়ে আছে। এ বছর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন,  কখন চূড়ান্ত হবে, বলা যাচ্ছে না। মন্ত্রণালয় যে নিদের্শনা দেবে, সে অনুযায়ী কাজ করা হবে। গাইডলাইনের বিষয়ে কথা বলার জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. মহিউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

যা বলছেন অর্থনীতিবিদরা
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, বর্তমানে জাতীয় পরিচয়পত্র, মোবাইল নম্বরসহ সব ধরনের তথ্য রয়েছে। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সদিচ্ছা ও দক্ষতা থাকলে খুব দ্রুত এ কাজ করা সম্ভব। অন্তর্বর্তী সরকার যদি এ কাজ করে যেতে না পারে আদৌ এখানে সংস্কার হবে কিনা, সন্দেহ রয়েছে। সাধারণত রাজনৈতিক সরকার এ ধরনের সংস্কার করতে চায় না।

গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও বের হওয়া সম্ভব হয়নি। তালিকা থেকে অযোগ্যদের খুব সহজেই বাদ দেওয়া সম্ভব। তবে বাদ দেওয়ার পর যথাযথ যোগ্যতার ভিত্তিতে নতুন উপকারভোগী অন্তর্ভুক্তিতে একটু সময় লাগতে পারে। কিন্তু সরকারের প্রতিনিধিরা স্থানীয় নাগরিক সমাজের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করলে এতদিনে দুটি কাজই সম্ভব ছিল।

কর্মসূচির আওতা ও ভাতা
বর্তমানে ২৬টি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১৪০টি কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, স্বামী পরিত্যক্ত ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ ২৭ ধরনের ভাতা দেওয়া হয়। এসব কর্মসূচিকেই প্রকৃত অর্থে সামাজিক সুরক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

চলতি অর্থবছরে বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন ৬০ লাখ। তাদের মাথাপিছু মাসিক ভাতা ৬০০ টাকা। বিধবা ভাতা পান প্রায় ২৮ লাখ এবং মাথাপিছু ভাতা ৫৫০ টাকা। অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা পান ৩২ লাখ এবং মাথাপিছু ভাতা ৮৫০ টাকা। হিজড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিশেষ ভাতা পান ১৩ লাখ। তাদের মাথাপিছু ভাতা ৬০০ টাকা। বেদে জনগোষ্ঠীর ৬ হাজার জন ভাতা পান। তাদের মাথাপিছু ভাতা ৫০০ টাকা। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিশেষ ভাতা পান ৬০ হাজার। তাদের মাথাপিছু মাসিক ভাতা ৫০০ টাকা। সাধারণত তিন মাস পরপর উপকারভোগীদের টাকা দেওয়া হয়।

তালিকা সংশোধন কেন দরকার 
অর্থ ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচিতদের মধ্যে অনেকেই পেনশন, ভিজিডি বা অন্যান্য ভাতা নিচ্ছেন। অনেকেই একাধিক ভাতা নিচ্ছেন। মূলত উপকারভোগী নির্বাচনে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের পক্ষপাত ও দুর্নীতির কারণে এমন হয়।

অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত টাস্কফোর্সের রিপোর্টে বলা হয়েছে, অনেক মানুষকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ও দুর্নীতির মাধ্যমে বাছাই করা হয়। যোগ্যতা থাকলেও অনেকে ভাতা পান না। দেশের দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রায় ৫৪ শতাংশ পরিবার সামাজিক সুরক্ষা আওতার বাইরে। অন্যদিকে সামাজিক সুরক্ষার সুবিধা পায়, এমন ৬২ শতাংশ পরিবার গরিব নয় এবং তারা কোনো ঝুঁকির মধ্যেও নেই। এসব ত্রুটি দূর করা গেলে আরও অন্তত ১১ লাখ মানুষকে অতিদরিদ্র ও ২৫ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনা সম্ভব হতো।

গবেষণা সংস্থা সিপিডির গত বছর চালানো জরিপে দেখা গেছে, বয়স্ক ভাতা পাওয়ার জন্য কার্ড পেতে গড়ে ২ হাজার ৬৫৩ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হয়। অনেকে ভাতা পাওয়ার যোগ্য হলেও ঘুষ দিতে না পারায় তা পান না।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ম ঠ পর য য় য চ ই কর ক জ কর অন য য় সরক র ধরন র

এছাড়াও পড়ুন:

চট্টগ্রামে বকেয়া বেতনের দাবিতে শ্রমিকদের তিন ঘণ্টা সড়ক অবরোধ

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার মইজ্জারটেক-ব্রিজঘাট সড়ক প্রায় তিন ঘণ্টা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন গোল্ডেন সন লিমিটেড নামে একটি কারখানার শ্রমিকেরা। বকেয়া বেতন পরিশোধ করার দাবিতে আজ রোববার সকাল ৬টা থেকে সকাল পৌনে ৯টা পর্যন্ত শ্রমিকদের এই অবরোধ কর্মসূচি চলে। পরে সেনাবাহিনীর একটি দল এসে শ্রমিকদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়।

গোল্ডেন সন লিমিটেড নামের কারখানাটি অবস্থিত উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের খোয়াজনগর গ্রামে সৈন্যারটেক এলাকায়। এর বিভিন্ন ইউনিটে ইলেকট্রনিক ফ্যান, খেলনা, পারফিউমসহ নানা ধরনের পণ্য উৎপাদন করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভোরে দুই মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে কারখানার ফটকের সামনে সড়ক অবরোধ শুরু করেন শ্রমিকেরা। অবরোধের কারণে সড়কের দুই পাশে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন আটকে পড়ে।

বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা জানান, গত মার্চ ও এপ্রিলের বেতন শোধ করেনি কারখানা কর্তৃপক্ষ। এর বাইরে কিছু শ্রমিক রয়েছেন, যাঁরা বেশ কয়েক মাস ধরে বেতন পাননি। ফলে বাসাভাড়াসহ বিভিন্ন ব্যয় নির্বাহ করতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাঁদের।

শ্রমিকদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে কারখানার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ( সিইও) আমিনুল ইসলাম এবং মানবসম্পদ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. রুম্মান ইমামকে ফোন করা হয়। তাঁরা দুজনই কল রিসিভ করেননি। তাই তাঁদের বক্তব্যও জানা সম্ভব হয়নি।

জানতে চাইলে কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ শরীফ বলেন, কারখানার মালিকপক্ষের সঙ্গে শ্রমিকদের আলোচনা হয়েছে। শিগগিরই দুই মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে, এমন আশ্বাসে শ্রমিকেরা কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ