রংপুরের বৈষম্যের প্রশ্নে সরকার কি আগের পথে হাঁটবে
Published: 4th, May 2025 GMT
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে রংপুর বাংলাদেশের একটি অবহেলিত জনপদের নাম। যারাই যখন রাষ্ট্র পরিচালনায় থেকেছে, তারাই এই অবহেলা প্রদর্শন করেছে। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা অন্তর্বর্তী সরকার এসে রাতারাতি ঠিকঠাক করে দেবে, সেটি নিশ্চয়ই কেউ আশা করেন না।
কিন্তু এ সরকার বৈষম্য দূরীকরণে কাজ শুরু করবে, এ প্রত্যাশা করা অমূলক নয়। দেশে যখনই দারিদ্র্য-মানচিত্র প্রকাশিত হয়, দেখা যায়—রংপুর বিভাগের অন্তত পাঁচটি জেলা দারিদ্র্যের শীর্ষে থাকে। সম্প্রতি একটি দারিদ্র্য-মানচিত্র প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে রংপুরের অবস্থান দারিদ্র্যের তলানি থেকে মুক্ত দেখানো হয়েছে। বাস্তবে এই পরিসংখ্যান বিশ্বাসযোগ্য নয়।
কারণ, রংপুর বিভাগে জীবনমান উন্নয়নে এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি, যাতে রংপুরের গড় উন্নয়ন বৃদ্ধি পেতে পারে। বরং নদীভাঙনে লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার কারণে দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি পাওয়ার কথা।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে প্রতিবছর রংপুর বিভাগের জন্য বরাদ্দ থাকে সবচেয়ে কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কেবল গোপালগঞ্জ জেলার বরাদ্দ ছিল মোট বরাদ্দের প্রায় ৫ শতাংশ। রংপুর বিভাগের দুই কোটি মানুষের জন্য বরাদ্দ ছিল ১ শতাংশের নিচে। প্রতিবছরের বাস্তবতা রংপুরের জন্য এ রকমই। কোভিডকালে সারা দেশে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, তা–ও রংপুর বিভাগের জন্য ছিল অনেক কম।
আরও পড়ুনরংপুর কি এ দেশের অঞ্চল নয় নাকি বাংলা মায়ের সতিন১৫ জুন ২০২৪সারা দেশে অনেকগুলো মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। এর একটিও রংপুর বিভাগে নেই। লাখ লাখ কোটি টাকার যে উন্নয়ন হলো, সেই উন্নয়ন রংপুর বিভাগ পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি। রংপুরে বিভাগ, সিটি করোপেরশন, মেট্রোপলিটন পুলিশ ব্যবস্থা চালু হলেও এগুলোর উন্নয়নে তেমন অর্থ বরাদ্দ ছিল না।
এখন পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের মাস্টার প্ল্যানই হয়নি। রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কবে আলোর মুখ দেখবে, আমরা জানি না। সুপেয় পানিরও ব্যবস্থা এখানে নেই। রংপুরে একটি চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় খুব জরুরি ছিল। সেটিও হয়নি। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যলয়, নীলফামারী মেডিকেল কলেজসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও এগুলোতে অর্থ বরাদ্দ প্রায় নামমাত্র। ঠাকুরগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার মধ্যে বন্দী হয়ে আছে।
সারা দেশে সবচেয়ে অবহেলিত রংপুরের রেল। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা ও রংপুরের সঙ্গে ব্রডগেজ যোগাযোগ নেই। দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরের সঙ্গে কুড়িগ্রাম কিংবা লালমনিরহাটের প্রায় ৮০ কিলোমিটার ব্রডগেজ লাইন স্থাপন কর সম্ভব হলে রেল যোগাযোগ অনেক দূর এগিয়ে যেত। রাজশাহী-খুলনা বিভাগের সঙ্গেও রেল যেগাযোগ স্থাপিত হতো। রংপুর থেকে পার্বতীপুরে ৪০ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন হবে হবে শুনে আসছি অন্তত ১৫ বছর ধরে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে কলকাতাকেন্দ্রিক যে রেল যোগাযোগ ছিল, সেটার ওপর ভর করে রংপুরের সঙ্গে ঢাকা রেলপথ তৈরি করা হয়েছে। লালমনিরহাট থেকে ট্রেন নাটোর-পাবনা হয়ে কলকাতায় যেত। বর্তমানে ওই রেলপথ ধরে নাটোর-পাবনা হয়ে এ অঞ্চলের ট্রেন ঢাকায় যায়। একটি বৃত্তের অর্ধেকের বেশি ঘুরে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় যেতে হয়। ব্রহ্মপুত্রের ওপর একটি সেতু স্থাপন করলে মাত্র তিন ঘণ্টায় ঢাকায় যাওয়া যেত। সেই পথ এখন ১২ ঘণ্টায় যেতে হয়।
এসব নিয়ে আমরা সাধারণ মানুষেরা বারবার কথা বলে আসছি। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতারা জোরেশোরে দাবি করতেন না। কী জানি প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি যদি কিছু চাওয়ার কারণে বেজার হন—এই ভাবনায় কিছু চাইতেন না। রংপুর বিভাগে গত ১৮ বছরে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল আছে কাগজ-কলমে।
চব্বিশের জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদ কেবল একটি নাম নয়, আন্দোলনের বাঁকবদলের এক অনন্য শক্তি। আমরা দেখছি, অন্তর্বর্তী সরকারের অনেকেই রংপুরে এলে শহীদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করে যান। প্রধান উপদেষ্টাও এসেছিলেন। কিন্তু এখানকার উন্নয়নে কারও কোনো স্বর শোনা যায় না।বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক জনশক্তি বিদেশে কাজ করছে। সম্পূর্ণ রংপুর বিভাগ মিলে সেই প্রবাসী মানুষের সংখ্যা ১ শতাংশ হবে কি না সন্দেহ। দেশে কোনো কোনো উপজেলা থেকে যতসংখ্যক মানুষ বিদেশে আছেন, সেই সংখ্যক মানুষ রংপুর বিভাগজুড়ে নেই বলে মনে হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারে রংপুর বিভাগের একজন উপদেষ্টাও নেই। কেবল উপদেষ্টা পরিষদেই নয়, অন্তর্বর্তী সরকারের গুরত্বপূর্ণ যত দায়িত্ব আছে, সেগুলোতে রংপুর বিভাগের লোক কতজন আছে, তা হারিকেন দিয়ে খুঁজতে হবে। উপদেষ্টা থাকার অর্থ এমন নয় যে তিনি নিজ অঞ্চলের কাজ করবেন। তারপরও এ দেশে নিজ নিজ সমস্যা-প্রয়োজনীয়তা তুলে না ধরলে উন্নয়ন হয় না। কেবল উপদেষ্টা কিংবা মন্ত্রী পর্যায়ে নয়, আমলা পর্যায়েও এই বাস্তবতা প্রকট।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.                
      
				
চব্বিশের জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদ কেবল একটি নাম নয়, আন্দোলনের বাঁকবদলের এক অনন্য শক্তি। আমরা দেখছি, অন্তর্বর্তী সরকারের অনেকেই রংপুরে এলে শহীদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করে যান। প্রধান উপদেষ্টাও এসেছিলেন। কিন্তু এখানকার উন্নয়নে কারও কোনো স্বর শোনা যায় না।
রংপুরের ঐতিহাসিক বঞ্চনায় অন্তর্বর্তী সরকার অনেক পদক্ষেপ গহণ করতে পারে। রংপুর বিভাগে ঘোষিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শুরু করতে পারে। ব্রডগেজ রেললাইনের কাজটুকু করতে পারে। বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের কাজ শুরু করতে পারে। ব্রহ্মপুত্রের ওপরে একটি সেতু স্থাপনের কাজে হাত দিতে পারে। রংপুর বিভাগে যে জনশক্তি বিদেশে পাঠানো সম্ভব, তাঁদের বিশেষ প্রশক্ষিণ দিয়ে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে বিদেশে পাঠনো শুরু করতে পারে।
বড় শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমোদন দিতে পারে। তিস্তা মহাপরিকল্পার কাজ করতে পারে। এ অঞ্চলে বিশেষত উৎপাদিত ফল কিংবা সবজি বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা নিতে পারে। এ বিভাগের শিক্ষাপ্রতষ্ঠান, সিটি করপোরেশন, বিভাগের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দিতে পারে। রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
বৈষম্য নিরসন মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এতে কেবল রংপুর নয়, সারা দেশে বৈষম্য দূর হবে। অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়নে ভারসাম্য সৃষ্টি হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের হাত ধরে বাংলাদেশে বৈষম্য দূরীকরণের যাত্রা শুরু হোক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এ কাজ করলে মাইলফলক হয়ে থাকবে। আসন্ন বাজেটে তার প্রতিফলন দৃশ্যমান হয়ে উঠুক।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র র জন য বর দ দ
এছাড়াও পড়ুন:
‘নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা বহাল থাকবে’
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা বহাল থাকবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
মঙ্গলবার (৩ নভেম্বর) সচিবালয়ে এক কোর কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি।
আরো পড়ুন:
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ, নির্বাচনি প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা
একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকার আহ্বান সেনাপ্রধানের
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও প্রশাসনিক প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অসুবিধা দেখা দেবে না বলে আমরা আশা করি।”
তিনি আরো বলেন, “নির্বাচন হবে ফ্রি, ফেয়ার, ক্রেডিবল ও উৎসবমুখর। এ জন্য পুলিশ ও প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”
নিরাপত্তা ইস্যু—কার্গো অগ্নিকাণ্ড, অস্ত্র চুরির ঘটনা থেকে শুরু করে অস্ত্র উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিরোধী পক্ষ এসব ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করলেও উপদেষ্টা জানান, তদন্ত চলছে এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অতীতের নির্বাচনে দায়িত্বে থাকা কিছু বিতর্কিত ওসিদের পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে স্বীকার করলেও জানান, সীমাবদ্ধতার কারণে সবাইকে একযোগে বদলি করা সম্ভব হচ্ছে না।
“যারা পরপর তিনটি নির্বাচনে দায়িত্বে ছিলেন, তাদের বাদ দেওয়ার চেষ্টা চলছে,” বলেন তিনি।
আলোচনায় উস্কানিমূলক বক্তব্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজনৈতিক প্রচারণা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কেও প্রশ্ন ওঠে।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক রয়েছে এবং কেউ আইনের বাইরে গেলে তাকে ছাড় দেওয়া হবে না।
ঢাকা/এএএম/ইভা