রংপুরের বৈষম্যের প্রশ্নে সরকার কি আগের পথে হাঁটবে
Published: 4th, May 2025 GMT
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে রংপুর বাংলাদেশের একটি অবহেলিত জনপদের নাম। যারাই যখন রাষ্ট্র পরিচালনায় থেকেছে, তারাই এই অবহেলা প্রদর্শন করেছে। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা অন্তর্বর্তী সরকার এসে রাতারাতি ঠিকঠাক করে দেবে, সেটি নিশ্চয়ই কেউ আশা করেন না।
কিন্তু এ সরকার বৈষম্য দূরীকরণে কাজ শুরু করবে, এ প্রত্যাশা করা অমূলক নয়। দেশে যখনই দারিদ্র্য-মানচিত্র প্রকাশিত হয়, দেখা যায়—রংপুর বিভাগের অন্তত পাঁচটি জেলা দারিদ্র্যের শীর্ষে থাকে। সম্প্রতি একটি দারিদ্র্য-মানচিত্র প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে রংপুরের অবস্থান দারিদ্র্যের তলানি থেকে মুক্ত দেখানো হয়েছে। বাস্তবে এই পরিসংখ্যান বিশ্বাসযোগ্য নয়।
কারণ, রংপুর বিভাগে জীবনমান উন্নয়নে এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি, যাতে রংপুরের গড় উন্নয়ন বৃদ্ধি পেতে পারে। বরং নদীভাঙনে লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার কারণে দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি পাওয়ার কথা।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে প্রতিবছর রংপুর বিভাগের জন্য বরাদ্দ থাকে সবচেয়ে কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কেবল গোপালগঞ্জ জেলার বরাদ্দ ছিল মোট বরাদ্দের প্রায় ৫ শতাংশ। রংপুর বিভাগের দুই কোটি মানুষের জন্য বরাদ্দ ছিল ১ শতাংশের নিচে। প্রতিবছরের বাস্তবতা রংপুরের জন্য এ রকমই। কোভিডকালে সারা দেশে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, তা–ও রংপুর বিভাগের জন্য ছিল অনেক কম।
আরও পড়ুনরংপুর কি এ দেশের অঞ্চল নয় নাকি বাংলা মায়ের সতিন১৫ জুন ২০২৪সারা দেশে অনেকগুলো মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। এর একটিও রংপুর বিভাগে নেই। লাখ লাখ কোটি টাকার যে উন্নয়ন হলো, সেই উন্নয়ন রংপুর বিভাগ পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি। রংপুরে বিভাগ, সিটি করোপেরশন, মেট্রোপলিটন পুলিশ ব্যবস্থা চালু হলেও এগুলোর উন্নয়নে তেমন অর্থ বরাদ্দ ছিল না।
এখন পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের মাস্টার প্ল্যানই হয়নি। রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কবে আলোর মুখ দেখবে, আমরা জানি না। সুপেয় পানিরও ব্যবস্থা এখানে নেই। রংপুরে একটি চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় খুব জরুরি ছিল। সেটিও হয়নি। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যলয়, নীলফামারী মেডিকেল কলেজসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও এগুলোতে অর্থ বরাদ্দ প্রায় নামমাত্র। ঠাকুরগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার মধ্যে বন্দী হয়ে আছে।
সারা দেশে সবচেয়ে অবহেলিত রংপুরের রেল। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা ও রংপুরের সঙ্গে ব্রডগেজ যোগাযোগ নেই। দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরের সঙ্গে কুড়িগ্রাম কিংবা লালমনিরহাটের প্রায় ৮০ কিলোমিটার ব্রডগেজ লাইন স্থাপন কর সম্ভব হলে রেল যোগাযোগ অনেক দূর এগিয়ে যেত। রাজশাহী-খুলনা বিভাগের সঙ্গেও রেল যেগাযোগ স্থাপিত হতো। রংপুর থেকে পার্বতীপুরে ৪০ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন হবে হবে শুনে আসছি অন্তত ১৫ বছর ধরে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে কলকাতাকেন্দ্রিক যে রেল যোগাযোগ ছিল, সেটার ওপর ভর করে রংপুরের সঙ্গে ঢাকা রেলপথ তৈরি করা হয়েছে। লালমনিরহাট থেকে ট্রেন নাটোর-পাবনা হয়ে কলকাতায় যেত। বর্তমানে ওই রেলপথ ধরে নাটোর-পাবনা হয়ে এ অঞ্চলের ট্রেন ঢাকায় যায়। একটি বৃত্তের অর্ধেকের বেশি ঘুরে কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় যেতে হয়। ব্রহ্মপুত্রের ওপর একটি সেতু স্থাপন করলে মাত্র তিন ঘণ্টায় ঢাকায় যাওয়া যেত। সেই পথ এখন ১২ ঘণ্টায় যেতে হয়।
এসব নিয়ে আমরা সাধারণ মানুষেরা বারবার কথা বলে আসছি। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতারা জোরেশোরে দাবি করতেন না। কী জানি প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি যদি কিছু চাওয়ার কারণে বেজার হন—এই ভাবনায় কিছু চাইতেন না। রংপুর বিভাগে গত ১৮ বছরে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল আছে কাগজ-কলমে।
চব্বিশের জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদ কেবল একটি নাম নয়, আন্দোলনের বাঁকবদলের এক অনন্য শক্তি। আমরা দেখছি, অন্তর্বর্তী সরকারের অনেকেই রংপুরে এলে শহীদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করে যান। প্রধান উপদেষ্টাও এসেছিলেন। কিন্তু এখানকার উন্নয়নে কারও কোনো স্বর শোনা যায় না।বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক জনশক্তি বিদেশে কাজ করছে। সম্পূর্ণ রংপুর বিভাগ মিলে সেই প্রবাসী মানুষের সংখ্যা ১ শতাংশ হবে কি না সন্দেহ। দেশে কোনো কোনো উপজেলা থেকে যতসংখ্যক মানুষ বিদেশে আছেন, সেই সংখ্যক মানুষ রংপুর বিভাগজুড়ে নেই বলে মনে হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারে রংপুর বিভাগের একজন উপদেষ্টাও নেই। কেবল উপদেষ্টা পরিষদেই নয়, অন্তর্বর্তী সরকারের গুরত্বপূর্ণ যত দায়িত্ব আছে, সেগুলোতে রংপুর বিভাগের লোক কতজন আছে, তা হারিকেন দিয়ে খুঁজতে হবে। উপদেষ্টা থাকার অর্থ এমন নয় যে তিনি নিজ অঞ্চলের কাজ করবেন। তারপরও এ দেশে নিজ নিজ সমস্যা-প্রয়োজনীয়তা তুলে না ধরলে উন্নয়ন হয় না। কেবল উপদেষ্টা কিংবা মন্ত্রী পর্যায়ে নয়, আমলা পর্যায়েও এই বাস্তবতা প্রকট।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.
চব্বিশের জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদ কেবল একটি নাম নয়, আন্দোলনের বাঁকবদলের এক অনন্য শক্তি। আমরা দেখছি, অন্তর্বর্তী সরকারের অনেকেই রংপুরে এলে শহীদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করে যান। প্রধান উপদেষ্টাও এসেছিলেন। কিন্তু এখানকার উন্নয়নে কারও কোনো স্বর শোনা যায় না।
রংপুরের ঐতিহাসিক বঞ্চনায় অন্তর্বর্তী সরকার অনেক পদক্ষেপ গহণ করতে পারে। রংপুর বিভাগে ঘোষিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শুরু করতে পারে। ব্রডগেজ রেললাইনের কাজটুকু করতে পারে। বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের কাজ শুরু করতে পারে। ব্রহ্মপুত্রের ওপরে একটি সেতু স্থাপনের কাজে হাত দিতে পারে। রংপুর বিভাগে যে জনশক্তি বিদেশে পাঠানো সম্ভব, তাঁদের বিশেষ প্রশক্ষিণ দিয়ে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে বিদেশে পাঠনো শুরু করতে পারে।
বড় শিল্পকারখানা স্থাপনের অনুমোদন দিতে পারে। তিস্তা মহাপরিকল্পার কাজ করতে পারে। এ অঞ্চলে বিশেষত উৎপাদিত ফল কিংবা সবজি বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা নিতে পারে। এ বিভাগের শিক্ষাপ্রতষ্ঠান, সিটি করপোরেশন, বিভাগের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দিতে পারে। রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
বৈষম্য নিরসন মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এতে কেবল রংপুর নয়, সারা দেশে বৈষম্য দূর হবে। অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়নে ভারসাম্য সৃষ্টি হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের হাত ধরে বাংলাদেশে বৈষম্য দূরীকরণের যাত্রা শুরু হোক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এ কাজ করলে মাইলফলক হয়ে থাকবে। আসন্ন বাজেটে তার প্রতিফলন দৃশ্যমান হয়ে উঠুক।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র র জন য বর দ দ
এছাড়াও পড়ুন:
শ্রমিক অসন্তোষ বনাম টেকসই বৈদেশিক বিনিয়োগ পরিবেশ
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বৈদেশিক বিনিয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি। বর্তমানে দেশে প্রায় ৬৩৪ টির বেশি বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হলেও, শ্রমিক অসন্তোষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতির কারণে এই বিনিয়োগ প্রবাহ বারবার হুমকির মুখে পড়ছে, যা একটি বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ তৈরিতে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এই সংকটগুলো বৈদেশিক বিনিয়োগে দৃশ্যমান প্রভাব ফেলেছে। নিরাপদ ও স্থিতিশীল পরিবেশের অভাবে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী নতুন বিনিয়োগ থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন, যা দেশের শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতিকে শ্লথ করে দিচ্ছে।
শ্রমিক অসন্তোষের প্রধান কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সময়মতো বেতন ও বোনাস না পাওয়া, ন্যায্য মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের অভাব, বৈষম্যমূলক আচরণ, অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং অভিযোগ নিষ্পত্তিতে গাফিলতি। এছাড়াও নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাব, অগ্নি নিরাপত্তা ও সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের ঘাটতিও শ্রমিকদের উদ্বেগ বাড়ায়। ট্রেড ইউনিয়নে অংশগ্রহণে সীমাবদ্ধতা, জীবনমানের দুরবস্থা, প্রশিক্ষণের অভাব, অর্থনৈতিক চাপ, স্থানীয় প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাও অসন্তোষকে ত্বরান্বিত করে। এসব উপাদান শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করে, যা শেষ পর্যন্ত আন্দোলনে রূপ নেয়।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শ্রমিকদের মধ্যে নতুন প্রত্যাশা ও চাপ তৈরি হয়। একই সঙ্গে ভারত-চীন-মালয়েশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের শিল্প স্থিতিশীলতাকে জটিল করে তোলে। অনেক সময় পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা তৈরি করে গার্মেন্টস সেক্টরের অর্ডার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের দিকে সরিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়, যা শিল্পখাতকে দুর্বল করে, বিনিয়োগকারীদের আস্থায় আঘাত হানে এবং শ্রমিক অসন্তোষকে ত্বরান্বিত করে তোলে।
শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমছে। অনেকেই নিরাপত্তাহীনতার কারণে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার চিন্তা করছেন বা নতুন বিনিয়োগে পিছিয়ে যাচ্ছেন। ২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বরে কিছু জাপানি কোম্পানি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। ২০১৩ সালের রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বিদেশি ব্র্যান্ড অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়া ও মিয়ানমারে স্থানান্তরিত করেছে।
বর্তমান শিল্প পরিবেশে একটি নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষণীয়—আমরা প্রতিক্রিয়া নির্ভর পদক্ষেপ নিচ্ছি, প্রতিরোধমূলক নয়। কোনো অসন্তোষ শুরু হলে তখন আলোচনা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ, ও কখনো কখনো শিল্প পুলিশ, র্যাব বা সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু এসব হচ্ছে তাৎক্ষণিক সমাধান; দীর্ঘমেয়াদী ও কাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে না।
এই প্রেক্ষাপটে, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি তুলনামূলকভাবে একটি কার্যকর সমাধান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যদি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করা হয়, তবে অনেক শ্রমিক অসন্তোষ উৎপত্তির আগেই তার মীমাংসা সম্ভব হবে। শ্রীলঙ্কা, ভারত, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়া সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ব্যবস্থার মাধ্যমে শিল্প পরিবেশ অনেক বেশি স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে ইপিজেড অঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি সম্পূর্ণভাবে প্রয়োগের ফলে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে তুলনামূলকভাবে সফল ফলাফল পাওয়া গেছে।
শুধু আইন প্রণয়ন নয়, তার যথাযথ বাস্তবায়ন ও তদারকি জরুরি। শ্রম আইন ২০০৬ , সংশোধনী ২০১৩, ২০১৮, বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইন, ২০১৯ , ইপিজেড শ্রমবিধিমালা ২০২২ -এর নানা ধারা বাস্তবিক পরিপ্রেক্ষিতে উপযোগী করে তোলা এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। শ্রম আদালতের কার্যকারিতা বাড়াতে হলে দক্ষ বিচারক, শ্রম আইনে পারদর্শী আইনজীবী এবং দ্রুত রায় কার্যকর করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর শ্রম পরিদর্শকদের পরিদর্শন কার্যক্রম আরও দক্ষ ও কার্যকর করতে হবে। পরিদর্শনকালীন সময়ে অভিযোগ নিষ্পত্তিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করলে বড় ধরনের শ্রমিক অসন্তোষ সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যখন একটি দেশে পুঁজি বিনিয়োগ করেন, তখন তারা শুধু উৎপাদন খরচ, কর অব্যাহতি বা বাজার বিবেচনাই করেন না বরং, শ্রম পরিস্থিতি ও শ্রম অসন্তোষ একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিবেচ্য বিষয়। বিশ্বব্যাংক ও আঙ্কটাডের রিপোর্টে দেখা গেছে, শ্রম অস্থিরতা বিনিয়োগ সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন ২০২৩ সালের একটি জরিপে জানায়, শ্রম অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাংলাদেশে বিনিয়োগে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে মালিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা জরুরি। অনেক মালিক অভিযোগ ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব না দিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়মিত সভা করেন না এবং কল্যাণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। এতে শ্রমিকদের মধ্যে অবিশ্বাস ও অসন্তোষ তৈরি হয়, যা দ্রুত বিক্ষোভে রূপ নিতে পারে। লাইন লিডার ও সুপারভাইজাররা অভিযোগের তাৎক্ষণিক সমাধান না করে বরং বকাঝকা করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। তাই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে গ্রিভেন্স রিড্রেস সিস্টেম (জিআরএস) চালু ও নিয়মিত পর্যালোচনা অত্যাবশ্যক, যাতে শান্তিপূর্ণ কর্মপরিবেশ বজায় থাকে যেকোনো শ্রমিক অসন্তোষের সূচনালগ্নে শিল্প পুলিশ উপস্থিত হয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করে। তবে এ ক্ষেত্রেও শ্রম আইন, শ্রমিকদের মনস্তত্ত্ব এবং অসন্তোষ নিরসনের কৌশল নিয়ে শিল্প পুলিশের আরও গভীর জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের প্রয়োজন রয়েছে। যদি তাদের এ বিষয়ে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় এবং তারা কৌশলীভাবে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়, তাহলে শ্রমিক অসন্তোষ দ্রুত, শান্তিপূর্ণ ও কার্যকরভাবে নিরসন করা সম্ভব হবে।
শ্রমিকদের মধ্যে শিল্পবান্ধব মনোভাব গড়ে তুলতে প্রেষণা, সচেতনতা এবং মোটিভেশনাল প্রচার কার্যক্রম গ্রহণ জরুরি। এর মাধ্যমে তাদের দায়িত্ববোধ ও কাজে আগ্রহ বাড়ানো সম্ভব, যা শিল্পের স্থিতিশীলতা এবং কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি, বন্ধ বা অচল কারখানার বিক্রয় ও পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়া সহজ ও কার্যকর করতে বিদ্যমান আইনগত জটিলতা দূর করে একটি স্বচ্ছ, দ্রুত ও বাস্তবমুখী ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন, যাতে মালিক, বিনিয়োগকারী ও শ্রমিক—সবারই স্বার্থ রক্ষা হয়। সেইসাথে, যারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গুজব রটিয়ে বা নাশকতার মাধ্যমে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি করে, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এই সব পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই শিল্পখাতে টেকসই শান্তি ও স্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব।
শ্রমিক অসন্তোষ বাংলাদেশের শিল্প ও বৈদেশিক বিনিয়োগের অগ্রগতিতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাধা মোকাবেলায় কেবল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি, কাঠামোগত ও অংশীদারিত্বমূলক সমাধান। শ্রমিক, মালিক, সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে শ্রমিকদের প্রেষণা, নিরাপত্তা ও ন্যায্যতার নিশ্চয়তা দেওয়া গেলে বিনিয়োগবান্ধব, স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ শিল্প পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব। এই পথেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক বিনিয়োগ নিশ্চিত হবে।
ড. সোহেল মিয়া: শ্রম সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ