পাউবো ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন
Published: 5th, May 2025 GMT
হাওরাঞ্চলে কৃষকের ফসল রক্ষায় সরকারি কোষাগারের বিপুল অর্থ ব্যয় এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে গাফিলতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে পরিশেষে সব ব্যয় কার্যত অপব্যয়ে পর্যবসিত হওয়ার চিত্র বহু বছর ধরে জাতি পৌনঃপুনিকভাবে প্রত্যক্ষ করে আসছে। সুনামগঞ্জের ১৪টি হাওরে ৩০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের বিদ্যমান গতিপ্রকৃতি সেই ধারায় ধাবিত হচ্ছে।
এই প্রকল্পের কাজ শেষ হতে অনেক বাকি, অথচ কাজের মেয়াদ শেষ হতে মাত্র দুই মাস বাকি। এই অবস্থায় মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ঠিকাদারদের ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতিতে কাজ শেষ করার তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে। এতে হাওরাঞ্চলে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের নামে সরকারি কোষাগারের শত শত কোটি টাকা যে শুধু অপচয় হচ্ছে তা নয়, বরং প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিটি স্তরে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে কীভাবে দুর্নীতি ও ঔদাসীন্য কৃষকের ভাগ্যকে ধ্বংস করে।
খাই হাওরে মেসার্স মোস্তফা অ্যান্ড সন্সের মতো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো নির্মাণকাজের মানকে স্পষ্টতই তুচ্ছজ্ঞান করেছে। সেখানে মাটির স্তর ঠিকমতো না কেটে, বালু ও জিও ব্যাগের প্রয়োজনীয় স্তর ছাড়াই পাকা ব্লক বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ অংশে ইতিমধ্যেই বৃষ্টিতে ধস ও ফাটল দেখা দিয়েছে। ঠিকাদার আতাউর রহমান খান লিমিটেড এবং মেসার্স প্রীতম এন্টারপ্রাইজের যৌথ প্রকল্পেও একই চিত্র। সেখানে নদীতীরবর্তী অংশে খাড়া মাটি ফেলে রেখে ব্লক বসানো হয়েছে, যা বর্ষার প্রথম ধাক্কাতেই ভেসে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা স্পষ্ট বলছেন, ঠিকাদারেরা শুষ্ক মৌসুমের সঠিক সময়ে কাজ শুরু না করে বর্ষার ঠিক আগে তাড়াহুড়া করে নির্মাণের নামে কাগজে-কলমে প্রকল্পকে ‘সম্পন্ন’ দেখানোর ফন্দি আঁটছেন। এই অসাধুতা শুধু বর্তমান প্রকল্পেই সীমাবদ্ধ নয়। ২০১৭ সালে হাওরে ফসলহানির পর ঠিকাদারদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। পুনরায় তাঁদের দায়িত্ব দেওয়ায় পাউবো কীভাবে দুর্নীতির দুষ্টচক্রকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, তা স্পষ্ট।
মেসার্স নুনা ট্রেডার্সের প্রতিনিধি ভজন তালুকদার দাবি করছেন, ‘মাটির কাজ শেষ’। অথচ সরেজমিনে দেখা গেছে, বরাম হাওরের বাঁধে মাটির কাজ এখনো অসম্পূর্ণ। এ রকম মিথ্যা দাবি এবং তদারকি কমিটির নিষ্ক্রিয়তা প্রকল্পটিকে কেলেঙ্কারির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
অভিযোগের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে পাউবো কর্তৃপক্ষের ভূমিকা। স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়, পাউবো কর্মকর্তারা নির্মাণকাজের তদারকির নামে শুধু কাগজে-কলমে প্রতিবেদন বানিয়েছেন। খাই হাওরের বাঁধে মাটির কাজ অসম্পূর্ণ রেখে বালু-জিও ব্যাগ ছাড়াই পাকা ব্লক বসানো হয়েছে—এমন জঘন্য ত্রুটি চোখের সামনে থাকলেও তাঁরা চুপচাপ দেখেছেন। উপরন্তু ঠিকাদারদের অর্ধেক কাজের বিনিময়ে ৪৫ শতাংশ বিল মঞ্জুর করেছেন।
পাউবো কর্মকর্তারা স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়ে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করছেন। এটি অনিয়মকে বৈধতা দেওয়ার চক্রান্ত বলে ধরে নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। প্রথম আলোয় প্রকাশিত এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদনে হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতা ওবায়দুল হক ‘পাউবো আর ঠিকাদার একাকার’ বলে যে মন্তব্য করেছেন, বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় সেটিকে যথার্থ বলেই মনে হয়।
এই সংকটের সমাধান কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়। দুর্নীতিগ্রস্ত ঠিকাদারদের কালোতালিকাভুক্ত করা, দায়িত্বপ্রাপ্ত পাউবো কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং প্রকল্পের সামগ্রিক আর্থিক অস্বচ্ছতার তদন্ত জরুরি। পাশাপাশি স্থানীয় কৃষক ও সুবিধাভোগীদের তদারকিতে সরাসরি সম্পৃক্ত করতে হবে, যাতে সরকারি টাকার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয়। না হলে হাওরের বাঁধ শুধু কাগজেই থাকবে, আর কৃষকের ফসল বারবার ভেসে যাওয়ার করুণ গল্পের পুনরাবৃত্তি হতে থাকবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রকল প র
এছাড়াও পড়ুন:
জীবনব্যাপী হজের শিক্ষা প্রতিফলিত হয়
হজ শারীরিক, আর্থিক ও আত্মিক ইবাদত। হজে রয়েছে সামাজিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা, যা জীবনব্যাপী প্রতিফলিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সুবিদিত মাসসমূহে হজব্রত সম্পাদিত হয়। অতঃপর যে কেউ এই মাসগুলোতে হজ করা স্থির করে, তার জন্য অশ্লীলতা, কুৎসা, অন্যায় আচরণ, ঝগড়া ও কলহ-বিবাদ বিধেয় নয়।’ (সুরা-২ বাকারা; আয়াত: ১৯৭)
অনেকে সঠিকভাবে হজ সম্পন্ন করতে পারেন না। হজ করে এলেও অনেকে জীবনব্যাপী হজের শিক্ষা ধারণ ও পালন করতে পারেন না।
হজ প্রকৃত অর্থে মানবতার প্রশিক্ষণ। হজ শেখায় পৃথিবীর সব মানুষ একই পিতা-মাতার সন্তান। মানুষে মানুষে কোনো ধরনের ভেদাভেদ নেই, সাদা-কালোয় কোনো প্রভেদ নেই। জিলহজ মাসের ৭ তারিখে সব হাজি মিনার তাঁবুতে গণবিছানায় গিয়ে একাত্মতার ঘোষণা দেন।
৯ জিলহজ হাজিরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে ঐক্যের অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেন; মিলিত হন আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলনে। এদিন সন্ধ্যায় (জিলহজের ১০ তারিখ রাতে) হাজিরা মুজদালিফায় গিয়ে সব কৃত্রিমতার অবসানের মাধ্যমে মানবতার পূর্ণতা ও আদি আসল প্রকৃত মানব রূপ প্রকাশ করেন। সবার পরনে একই সাদা কাপড়। পোশাকে বাহুল্য নেই, খোলা মাথা-পাগড়ি টুপি ও বাহারি চুলের আড়ম্বর নেই; সঙ্গে চাকর-কর্মচারী নেই, নিজের শক্তি-সামর্থ্য ও জ্ঞান-গরিমার প্রকাশ নেই, বুদ্ধিবিবেচনা ও কৌশল প্রয়োগের সুযোগ নেই; শুধুই আল্লাহর ওপর ভরসা।
হজে প্রতীকীভাবে শয়তানকে পাথর মারা হয়। হজের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো কোরবানি। কোরবানির মূল প্রতিপাদ্য হলো রবের জন্য অন্য সবকিছু বিসর্জন দেওয়া। পশু কোরবানি একটি প্রতীকমাত্র। মনের মধ্যে যে পশুবৃত্তি বিদ্যমান, তাকে পরাভূত ও পরাজিত করাই হলো পশু জবাই বা পশু কোরবানির মূল শিক্ষা।
হজে ভাষা, বর্ণ, শ্রেণি, দেশ, জাতি, মত, পথ ও পেশানির্বিশেষে সব দেশের সব মানুষ এক ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করেন। এ হলো ‘ভিন্নমতসহ ঐক্য’-এর অনন্য দৃষ্টান্ত। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ সহাবস্থান করেন বলে ভাষার দূরত্ব দূর হয়ে মনের নৈকট্য অর্জন হয় এবং প্রকৃত মানবিক অনুভূতি জাগ্রত হয়।
মনের সংকীর্ণতা দূর হয়; দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হয়, চিন্তার বিকাশ সাধিত হয়। একদেশদর্শী মনোভাব দূরীভূত হয়ে বহুদর্শিতা ও দূরদর্শিতা অর্জন হয়; যা বিশ্বশান্তির জন্য অপরিহার্য।
হজের শিক্ষা আমাদের আজীবন লালন ও ধারণ করতে হবে। সর্বদা তর্কবিতর্ক ও ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করতে হবে। কারও ব্যবহার পছন্দ না হলেও রাগ করা যাবে না বা কটু কথা বলা যাবে না, কারও মনে কষ্ট দেওয়া যাবে না। কারও দ্বারা যদি কারও কোনো ক্ষতি হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। সব সময় অজুর সঙ্গে থাকার চেষ্টা করতে হবে এবং মনে সব সময় আল্লাহর স্মরণ রাখতে হবে। নিজের স্বার্থ উদ্ধারের মানসিকতা পরিহার করতে হবে। নিজের আগে অন্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারও অধিকার খর্ব করা যাবে না। নফসকে নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাবদ্ধতা, নম্রতা, ভদ্রতা ও উদারতা শিক্ষায়-দীক্ষায় ও উন্নীত করতে হবে।
যাঁরা হজের শিক্ষা লাভে ধন্য হন, তাঁরাই প্রকৃত হাজি। যাঁরা হজকে জীবন পরিবর্তনের অপূর্ব সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং হজ-পরবর্তী জীবনে হজের শিক্ষা বজায় রেখে জীবন পরিচালনা করেন। এরূপ হাজির সংখ্যা বাড়লে দেশ ও জাতির মঙ্গল সাধিত হবে, জনমানুষের কল্যাণ হবে; অন্যথা অর্থের অপচয়, সময়ের অপচয়, শক্তি-সামর্থ্যের অপব্যবহার ও নফসের গোলামি বা আত্মপূজাই সার হবে।
হজ একটি ফরজ ইবাদত, এটি কোনো সার্টিফিকেট কোর্স নয় এবং কোনো পদপদবি বা উপাধি নয়। হজ করার পর নিজ থেকেই নামের সঙ্গে হাজি বিশেষণ যোগ করা সমীচীন নয়। অন্য কেউ তা করলে দোষ নেই।
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী, যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
[email protected]