ঝুঁকিপূর্ণ শাসন ফেরার পথ কীভাবে বন্ধ করতে হবে
Published: 6th, May 2025 GMT
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো কর্তৃত্ববাদ নিয়ন্ত্রণের সদিচ্ছা থেকে রচিত। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের দাবি রাখে। নিঃসন্দেহে প্রস্তাবগুলো গণতান্ত্রিক জবাবদিহি দুর্বল, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রান্তিক এবং নির্বাহী, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে শক্তির ভারসাম্য ব্যাহত করবে না। বৈশ্বিক ইতিহাস ও প্রাতিষ্ঠানিক বাস্তবতার আলোকে এই আশঙ্কা থেকে মুক্ত থাকা জরুরি।
অনির্বাচিত অলিগার্কির উত্থান রোধ
সবারই আকাঙ্ক্ষা, প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সংস্কারে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে বিপন্ন করতে পারে—এমন মৌলিক ত্রুটি থাকবে না। আশঙ্কা হলো ‘ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল’ (এনসিসি) ও ‘জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশন’ (জেএসি) গঠনের মাধ্যমে একধরনের অনির্বাচিত অলিগার্কির উত্থান হতে পারে। প্রস্তাবগুলো এখন যেভাবে আছে, তাতে তাদের জনগণের প্রত্যক্ষ জবাবদিহির বাইরে থাকার সুযোগ রয়েছে। এই প্রস্তাবিত সংস্থাগুলো বিচারপতি, আমলা ইত্যাদির সমন্বয়ে এক অভিজাত গোষ্ঠী বা অলিগার্কি সৃষ্টি করতে পারে।
আরও পড়ুনজাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তা কীভাবে নির্ধারণ করব২৮ এপ্রিল ২০২৫এই প্রবণতার নজির ভারতের ২০১৪ সালে প্রণীত ‘ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশন’–এর মধ্যে ছিল। যদিও ভারতের ব্যবস্থায় বিচারক নিয়োগে রাজনৈতিক সমাজের কিছু অংশগ্রহণ ছিল, প্রস্তাবিত কাঠামোয় নির্বাচিত প্রতিনিধিত্ব পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ এ প্রস্তাবকে ইরানের ‘গার্ডিয়ান কাউন্সিল’–এর অভিজ্ঞতার সঙ্গে সাদৃশ্য হিসেবে দেখতে পারেন। তাঁরা যুক্তি দেবেন, অনির্বাচিত ধর্মীয় ও আইনি বিশেষজ্ঞরা জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহি ছাড়াই চূড়ান্ত কর্তৃত্ব প্রয়োগ করেন।
ইতিহাস প্রমাণ করে, বিচার-আমলাতান্ত্রিক অলিগার্কি যখন কোনো গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই গড়ে ওঠে, তখন তারা ক্রমে জন-ইচ্ছা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং নিজেদের স্বার্থে শক্তি কেন্দ্রীভূত করে। সব দুর্বলতা সত্ত্বেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা যথাযথ সংযম ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা ছাড়া অন্য ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো গণতান্ত্রিক কাঠামোকে অতিক্রম করে নিজেদের স্বার্থরক্ষার নতুন কেন্দ্র গড়ে তোলে। গণতন্ত্র রক্ষার নাম করে অনির্বাচিত অভিজাতদের হাতে সর্বময় কর্তৃত্ব অর্পণ করলে বিপরীতমুখী পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা থেকে যায়।
এ ধরনের গঠনগত ত্রুটিযুক্ত সুপারিশগুলো গৃহীত হলে প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের একধরনের অবক্ষয় ডেকে আনতে পারে। যাঁরা কখনো ভোটারদের সামনে নিজেদের জবাবদিহির আওতায় আনবে না—এমন ব্যক্তিরা নির্বাচন, বিচারিক নিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলে আশঙ্কা থেকেই যায়। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা বলছে, এ ধরনের ‘নিজে টিকিয়ে রাখা কাঠামো’ অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেদের পক্ষপাতযুক্ত এজেন্ডা বিকশিত করে। শেষ পর্যন্ত যে পুরোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করার সদিচ্ছা ছিল, তা ততটাই জবাবদিহিহীন ও অস্বচ্ছ হয়ে উঠতে পারে।
নির্বাচিত নেতৃত্বকে দুর্বল করা নয়
সংস্কার প্রস্তাবে নির্বাচিত নেতৃত্বের শাসনব্যবস্থা চালানোর জন্য দরকারি ক্ষমতা সংকুচিত করার আশঙ্কাজনক প্রবণতাও বিদ্যমান। প্রধানমন্ত্রীকে দলীয় নেতৃত্ব থেকে বাদ দিলে এবং কড়া মেয়াদসীমা আরোপের মাধ্যমে সরকার গঠনের ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীলতা ব্যাহত হবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। ইতালির রাজনৈতিক ইতিহাসে দুর্বল দলীয় শৃঙ্খলা ও একের পর এক সরকার পতনের যে চিত্র দেখা গেছে, একই ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে না—সেই নিশ্চয়তা কোথায়?
আমলাতন্ত্রের আধিপত্যও বাড়তে পারে। যেমন মেক্সিকোতে দেখা গেছে। মেয়াদ-সীমাবদ্ধ রাষ্ট্রপতির তুলনায় পেশাদার আমলারা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষমতা ধরে রেখে জনকল্যাণ ব্যাহত করার নজির স্থাপন করেছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সৃষ্ট ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি বেশি বলেই এ ধরনের সংস্কার প্রস্তাব চুলচেরা বিবেচনার দাবি রাখে।
৭০ অনুচ্ছেদের পরিবর্তনের প্রস্তাব ও এর প্রভাবগুলো নিয়ে বিভিন্ন দৃশ্যকল্প নির্মাণ আবশ্যিক। যেমন সংসদ সদস্যদের দলত্যাগের ওপর বিধিনিষেধ তুলে দিলে সংসদ একটি ব্যক্তিগত সুবিধাভিত্তিক বাজারে পরিণত হতে পারে। নীতির চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থে ভোট কেনাবেচার সুযোগ থাকবে। ফলে গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলা ভেঙে যেতে পারে এবং নির্বাচনী ম্যান্ডেট থেকে সরে এসে এ প্রক্রিয়া শাসনব্যবস্থাকে ব্যক্তিস্বার্থের আস্তানায় পরিণত করতে পারে। এ বিষয়ে অনেক তর্কবিতর্ক দরকার।
আরও পড়ুনরাজনৈতিক দল সংস্কার একবারে হয় না ১৮ এপ্রিল ২০২৫বিভ্রম কমাবে ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালান্সেস’
‘চেকস অ্যান্ড ব্যালান্সেস’–এর কোনো নির্ভুল নিখুঁত কাঠামো বিশ্বে নেই। সব কাঠামোতেই গলদ আছে। চেষ্টা করা যেতে পারে উপনিবেশ-উত্তর বিনির্মাণাধীন রাষ্ট্রের ও অভ্যুত্থানপূর্ব নাগরিকের জন-ইচ্ছার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালান্সেস’ কাঠামো নির্ধারণ। বিচার বিভাগীয় নিয়োগের জন্য প্রস্তাবিত নিজে নিয়োগপদ্ধতি আইনসভার কোনো সম্মতির প্রয়োজনীয়তা ছাড়াই কার্যত বিচার বিভাগের দায়মুক্তি দেবে।
সুপারিশ অনুযায়ী জরুরি পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির ওপর এনসিসির অনুমোদন বাধ্যতামূলক করলে নির্বাহী শাখার দুর্বলীকরণের মাধ্যমে বিপজ্জনক অব্যবস্থাও তৈরি হতে পারে। জাতীয় সংকটকালে সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুতর বিলম্ব হতে পারে। এ ধরনের কাঠামো পরিবর্তনকারী সুপারিশমালা আরও জটিল সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে নির্বাচিত উচ্চকক্ষ এবং দলত্যাগের মুক্ত সুযোগ আইন প্রণয়নকে বিশৃঙ্খলও করতে পারে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা শিক্ষা দেয়—বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ স্বনিয়ন্ত্রণ নিরাপদ নয়; বরং নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বের সঙ্গে একটি মিশ্র পদ্ধতি বেশি কার্যকর। যুক্তরাজ্যের জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টসমেন্ট কমিশন বিচার বিভাগের রাজনৈতিকীকরণ কমালেও এলিট–তান্ত্রিকতার অভিযোগ এড়াতে পারেনি। দক্ষিণ আফ্রিকার জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন দেখিয়েছে, এমনকি ভারসাম্যপূর্ণ কাঠামোও রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত নয়।
ইতালি ও গ্রিসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের টেকনোক্র্যাট সরকারগুলোর (২০১১-১৫) অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, অনির্বাচিত শাসন শেষ পর্যন্ত ব্যাপক জনরোষের জন্ম দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের ‘যুদ্ধ ক্ষমতা আইন (১৯৭৩)’ এ বার্তাই দেয়, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ নির্বাহী শাখার অচলাবস্থাও সৃষ্টি করতে পারে। এসব বৈশ্বিক উদাহরণ সম্মিলিতভাবে সতর্ক করছে, টেকনোক্রেটিক শাসনব্যবস্থা মডেল নয়, গণতান্ত্রিক জবাবদিহিই টেকসই সমাধান।
টেকনোক্রেটিক শাসনব্যবস্থা মডেল নয়
বাংলাদেশের সাংবিধানিক সংস্কারকে সফল করতে হলে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহি সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। গণতান্ত্রিক সংস্কার টেকনোক্রেটিক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
সংসদীয় অনুমোদনের পদ্ধতি নিয়ে জনবিতর্ক প্রয়োজনীয় শর্ত। নিঃসন্দেহে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় সংসদীয় অনুমোদনে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের সম্মতি পদ্ধতি একটি মানদণ্ড। নিয়োগে বিচারপতি, বিরোধী নেতাদের পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্ব থাকতে পারে। বড় চিন্তার বিষয়, বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থায় সংসদের ভূমিকা নিরূপণ।
এ ক্ষেত্রে ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালান্সেস’ একমাত্র মানদণ্ড। দলত্যাগ–সংক্রান্ত বিধান বিষয়ে ভারতের দশম তফসিল দেখা যেতে পারে। নীতিগত ভিন্নমত বজায় থাকে, কিন্তু অশুভ ঘোড়া বিক্রয় বন্ধও দরকারি। নির্বাহী ক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে নিরুপদ্রবে শাসন পরিচালনার সুযোগ থাকতে হবে।
জার্মানিতে জরুরি ক্ষমতাকালে পরামর্শমূলক ব্যবস্থা আছে, কিন্তু চূড়ান্ত কর্তৃত্ব সংসদের হাতে। এগুলো উদাহরণ; এর অর্থ এই নয় যে ওই পদ্ধতিগুলো বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে উপযোগী।
নির্বাচিত নেতৃত্বের বিকল্প নেই
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, গণতন্ত্র সমুন্নত করতে ‘টেকনোক্রেটিক শাসনব্যবস্থা মডেল’–এর ওপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকার সামরিক জান্তা থেকে ইউরোপের ইতালি ও গ্রিসের টেকনোক্র্যাট সরকার—সব ক্ষেত্রেই জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণহীন শাসনব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত বিশাল জনরোষের জন্ম দিয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য পথ একটিই: জন-ইচ্ছা থেকে উৎসারিত নির্বাচিত শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। অন্যথায় একটি কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে আরেকটি কর্তৃত্ববাদ কায়েম হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।
একটি কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন জবাবদিহির আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা শক্তিশালী নির্বাচিত নেতৃত্ব, কেবল সদিচ্ছাপূর্ণ টেকনোক্র্যাট নয়। গণতন্ত্রের শক্তি আসে জন-ইচ্ছা থেকে এবং সেই ইচ্ছা কখনোই টেকনোক্র্যাট শাসনপদ্ধতির মডেলের কাছে সঁপে দেওয়া যায় না।
● ড.
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক অন র ব চ ত প রস ত ব ত ব যবস থ ক গণতন ত র অল গ র ক র জন ত ক কর ত ত ব এ ধরন র দ র বল র জন য আশঙ ক সরক র ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সহিংসতা: ত্রুটিপূর্ণ গ্রেপ্তার, ঝুঁকিপূর্ণ বিচার
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের গুলিতে শত শত মানুষ নিহত এবং হাজারো মানুষ আহত হন। পাশাপাশি বিক্ষোভকারীদের হাতেও কিছু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার বিষয়টি গত বছরের ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সবচেয়ে কঠিন বিষয়গুলোর একটি হয়ে দাঁড়ায়।
প্রায় এক বছর পর সরকার এই বিচারপ্রক্রিয়ায় কতটা সফল হয়েছে, তা মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে। এখানে ‘প্রক্রিয়া’ শব্দটি ব্যবহার করাই যথার্থ। কারণ, তদন্ত সঠিক এবং বিচারিক কার্যক্রম ন্যায্য হলেই জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা দ্রুত হয় না। তাই এখনো কোনো মামলার নিষ্পত্তি না হওয়াকে একচেটিয়াভাবে ব্যর্থতার নিদর্শন হিসেবে দেখা উচিত নয়।
একজন কৌঁসুলির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত যে বিচারগুলো এক দশক আগে হয়েছিল, তার তুলনায় বর্তমান পরিস্থিতি প্রমাণসমৃদ্ধ। কারণ, এখানে ভিডিও ফুটেজ ও টেলিফোন যোগাযোগের রেকর্ড পাওয়া সহজ। এ ছাড়া ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের ঘটনা অতি সম্প্রতি ঘটায় পর্যাপ্ত ও নির্ভরযোগ্য প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য পাওয়া যাচ্ছে। এসব উপাদান থাকায় কৌঁসুলির জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী মামলা উপস্থাপন করা সহজ হয়ে গেছে। মামলাগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য এমন কোনো উপায় অবলম্বনের প্রয়োজন নেই, যা বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে, যে দোষে ১০ বছর আগের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম দুষ্ট ছিল।
বাংলাদেশে জুলাইয়ের আন্দোলন-সংক্রান্ত অপরাধগুলোর জবাবদিহি নিয়ে দুটি সমান্তরাল ফৌজদারি ব্যবস্থা চলছে। প্রথমটি হলো, ভুক্তভোগী বা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের থানায় করা মামলাগুলো, যা ‘প্রাথমিক তথ্যবিবরণী’ (এফআইআর) আকারে নথিভুক্ত হয়েছে। এসব অভিযোগে বলা হয়েছে, শত শত মানুষ—প্রধানত স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং দলের সুপরিচিত সমর্থকেরা নির্দিষ্ট মৃত্যু বা আহত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তারাই হত্যাকাণ্ড বা হত্যাচেষ্টার অপরাধে দোষী।
দ্বিতীয়টি হলো, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) করা মামলাগুলো, যা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের আওতায় বিচারাধীন।
আরও পড়ুনশেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের একই আইনজীবী নিয়ে বার্গম্যানের প্রশ্ন২২ ঘণ্টা আগেসাধারণ আদালত
জুলাইয়ের আন্দোলন নিয়ে ১৭ জুলাই পর্যন্ত করা ১ হাজার ৬০১ মামলার মধ্যে ৬৩৭টি হত্যা মামলা। এসব মামলায় হাজার হাজার না হলেও শত শত মানুষকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এফআইআরে যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁদের মধ্যে অনেকে আছেন, যাঁরা আন্দোলনের সময় প্রকৃতপক্ষে অপরাধ করেছেন এবং সে কারণে তাঁদের গ্রেপ্তার আইনসংগত হতে পারে।
কিন্তু যে মুহূর্তে কারও নাম একটি এফআইআরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেখান থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত—যখন অনেকেই মাসের পর মাস, কেউ কেউ প্রায় এক বছর ধরে গ্রেপ্তার রয়েছেন, চলমান এই বিচারিক ব্যবস্থাটি মূল অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের সঙ্গে নির্দোষ ব্যক্তিদের পার্থক্য নির্ধারণের কোনো বাস্তব প্রয়াস দেখাচ্ছে না।
বাংলাদেশে জুলাইয়ের আন্দোলন-সংক্রান্ত অপরাধগুলোর জবাবদিহি নিয়ে দুটি সমান্তরাল ফৌজদারি ব্যবস্থা চলছে।অপরাধে জড়িত ও নির্দোষ—দুই শ্রেণির মানুষই গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে গ্রেপ্তার রয়েছেন। কাউকে গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রে মূল মানদণ্ড প্রমাণ ছিল না; বরং সবচেয়ে বড় বিবেচ্য ছিল তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক।
এ মুহূর্তে বাংলাদেশে এসব মামলার ক্ষেত্রে যা চলছে, ‘বিচারের আগের আটক’ বা ‘অভিযোগ গঠনের আগের আটক’ নয় (অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু এই দুই ধরনের পদক্ষেপই যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ)। তবু বিষয়টি এখানেই শেষ হয়নি; বরং আরও গুরুতর ও সমালোচনাযোগ্য আরেকটি বিষয় যা ঘটছে, তা হলো ‘তদন্ত শুরুর আগেই আটক’। কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ পরে আংশিক তদন্ত করলেও আদালতকে জানায় না যে গ্রেপ্তার ব্যক্তির সঙ্গে অপরাধের কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সরকার বা পুলিশকে এমন হয়রানিমূলক গ্রেপ্তার ঠেকানোর কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে সময় লেগেছে ৯ মাস। ইতিমধ্যে শত শত, এমনকি হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২০২৫ সালের ৯ এপ্রিল ঢাকার পুলিশ কর্তৃপক্ষের জারি করা এক নির্দেশনায় বলা হয়, জুলাই-আগস্ট মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করতে হলে অবশ্যই ‘যথাযথ প্রমাণ’ থাকতে হবে। যেমন ‘প্রত্যক্ষদর্শী’, ‘ভিডিও’, ‘ছবি’ এবং এর সঙ্গে অবশ্যই ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের’ অনুমতি থাকতে হবে। নিঃসন্দেহে এই উদ্যোগ ২০২৪ সালের আগস্ট–সেপ্টেম্বর মাসেই বাস্তবায়িত হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল।
পুলিশের ওই নির্দেশনাকে সংবিধানবিরোধী উল্লেখ করে হাইকোর্টে আবেদন করা হয়। হাইকোর্ট পুলিশের ওই নির্দেশনা স্থগিত করেন। তবে এর পর থেকে সরকার স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেনি। আইন পরিবর্তনের জন্য কোনো অধ্যাদেশও জারি করেনি।
সরকার গত ১০ জুলাই ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করে। এর মাধ্যমে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে অনুমতি দেওয়া হয় যে ‘প্রাথমিক তদন্ত’ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ‘প্রমাণ অপর্যাপ্ত’ বলে প্রমাণ করলে তিনি (কর্মকর্তা) সেই ব্যক্তির নাম এফআইআর থেকে বাদ দিতে পারবেন। এটি স্বাগতযোগ্য পদক্ষেপ, তবে সংশোধিত আইনটি এখনো ত্রুটিপূর্ণ গ্রেপ্তার বন্ধ করতে পারেনি। প্রমাণ ছাড়া আটক ব্যক্তিদের সহায়তা করতেও কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি।
সমানভাবে উদ্বেগজনক বিষয় হলো জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচারিক ব্যবস্থার দুর্বলতা, বিশেষ করে যখন অভিযুক্ত ব্যক্তি জাতীয়ভাবে পরিচিত। ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা আদালত কখনো জামিন দেন না; অন্তত জাতীয়ভাবে পরিচিত কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে দেওয়া হয় না। হাইকোর্টের বেঞ্চগুলো তুলনায় জামিন প্রদানে বেশি অনুকূল। তবে কিছু কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয় না। যেমন অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় সব অন্তর্বর্তী জামিন আদেশ স্থগিতের আবেদন করে; আপিল বিভাগ অন্তর্বর্তী জামিন আটকানোর সেসব আবেদন মঞ্জুর করে এবং সেই সঙ্গে নতুন কোনো মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুলিশের গ্রেপ্তার দেখিয়ে দেয়।
সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান