পতিসরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কৃষি সমবায় ব্যাংক স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সুদখোর মহাজনের হাত থেকে গরিব, অসহায়, হতদরিদ্র প্রজাদের মুক্ত করা। তা–ই হয়েছিল। ১৯০৫ সালে ধারদেনা করে প্রথম ব্যাংক খুলেছিলেন। পরে নোবেল পাওয়ার পর সব টাকা গরিব প্রজাদের মধ্যে স্বল্পসুদে ঋণ দিলেন আর মহাজনেরা এলাকা ছাড়ল। দাসত্ব ও গোলামির জিঞ্জির থেকে মুক্ত হলো কালীগ্রাম পরগনাবাসী। অন্যদিকে অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করা সম্ভব হয়েছিল। অর্থাৎ অর্থবিত্তের সঙ্গে শিক্ষার যোগসূত্র বোধ করেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন।

পতিসরে এসে দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামবাসীকে উপলব্ধি করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘তোমরা যে পারো এবং যেখানে পারো এক-একটি গ্রামের ভার গ্রহণ করিয়া সেখানে গিয়ে আশ্রয় লও। গ্রামগুলিকে ব্যবস্থাবদ্ধ করো। শিক্ষা দাও, কৃষি শিল্প ও গ্রামের ব্যবহার সামগ্রী সম্বন্ধে নতুন চেষ্টা প্রবর্তিত করো।’ (রবীন্দ্র–রচনাবলী দশম খণ্ড) কালীগ্রাম পরগনার পল্লিগঠনের কাজে হাত দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন কৃষকদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা। শোষিত–বঞ্চিত কৃষকদের বাস্তব অবস্থা অবলোকন করে এক চিঠিতে লিখলেন, ‘কোথায় প্যারিসের আর্টিস্ট সম্প্রদায়ের উদ্দাম উন্মত্ততা আর কোথায় আমার কালীগ্রামের সরল চাষী প্রজাদের দুঃখ দৈন্য-নিবেদন! এদের অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং এদের অসহ্য কষ্ট দেখলে আমার চোখে জল আসে।…বাস্তবিক এরা যেন আমার একটি দেশ জোড়া বৃহৎ পরিবারের লোক।’ (ছিন্নপত্র ১১১)

রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন, কৃষক সমাজ মহাজনদের কাছে ঋণী। এখান থেকে মুক্ত করতে না পারলে তাদের পক্ষে কোনো কাজে যোগ দেওয়া সম্ভব নয়। সেই লক্ষ্যে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়–পরিজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে (১৯০৫) পতিসরে ব্যাংক খুললেন, নাম দিলেন ‘পতিসর কৃষি সমবায় ব্যাংক’। উদ্দেশ্য স্বল্পসুদে প্রজাদের টাকা ধার দিয়ে মহাজনের গ্রাস থেকে তাঁদের মুক্ত করে অর্থবিত্তে স্বাবলম্বী করা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘পতিসরে আমি কিছুকাল হইতে পল্লীসমাজ গড়িবার চেষ্টা করিতেছি যাহাতে দরিদ্র চাষী প্রজারা নিজেরা একত্র মিলিয়া দারিদ্র্য, অস্বাস্থ্য ও অজ্ঞতা দূর করিতে পারে.

..প্রায় ৬০০ পল্লী লইয়া কাজ ফাঁদিয়াছি.....আমরা যে টাকা দিই ও প্রজারা যে টাকা উঠায়..এই টাকা ইহারা নিজে কমিটি করিয়া ব্যয় করে। ইহারা ইতিমধ্যে অনেক কাজ করিয়াছে।’ (পল্লীপ্রকৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী, ১৯৬২, পৃষ্ঠা ২৬১)

গবেষকেরা মনে করেন, ‘রবীন্দ্রনাথের পল্লীসমাজ পরিকল্পনার সর্বোত্তম প্রকাশ যদি গণতান্ত্রিক গ্রামীণ পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় এবং এর অর্থনৈতিক ভিত্তি সর্বজনীন সমবায় ব্যবস্থায় ঘটে থাকে, তাহলে সে সমবায় চিন্তার অসামান্য প্রকাশ ঘটেছে পতিসর কৃষি সমবায় ব্যাংক স্থাপনে। আমাদের ভেবে দেখা দরকার রবীন্দ্রনাথের পল্লী উন্নয়ন ভাবনা ছিল এ দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির অন্যতম সোপান, তার প্রকাশ পতিসরের কৃষি সমবায় ব্যাংক। ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ফলে গ্রামের শোষিত বঞ্চিত মানুষেরা ভয়াবহ মহাজনী ঋণের কবল থেকে মুক্তি পেল, কৃষক-কৃষির উন্নতি হলো, গ্রামের মানুষ শিক্ষার সুযোগ পেল স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন হলো। রবীন্দ্রনাথের পল্লী উন্নয়ন ও পল্লীসমাজ গঠনের চেষ্টায় কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ছিল একটি অসাধারণ মাইলফলক।’ (রবীন্দ্র ভুবনে পতিসর, আহমদ রফিক)

কবির লেখা ছয় পৃষ্ঠার চিঠি, কবি প্রতিষ্ঠিত ‘পতিসর কৃষি সমবায় ব্যাংক’–এর হিসাবের খাতা, কালীগ্রামের শেষ জমিদার কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ও পুত্রবধু প্রতিমা দেবীর মূল্যবান বেশ কিছু চিঠি, কবির ব্যবহৃত খাট, টিপট, আলমারি, ওয়ার্ডরোব, নাগোর বোটের দরজা-জানালাসহ সমমানের আরও নির্দশন।

রবীন্দ্রনাথের কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার শত বছর পর আমাদের দেশে গ্রামীণ মানুষের উন্নতির জন্য বেসরকারি কিছু সংস্থা (এনজিও) ক্ষুদ্রঋণ প্রদান কর্মসূচি দেখে অবাক হতে হয় এই ভেবে যে শত বছর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ পল্লি উন্নয়ন ও পল্লি গঠনের কাজে কী গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও দূরদর্শিতার পরিচয় রেখেছিলেন পতিসরে। ব্রিটিশ ভারতে যখন সমবায় কার্যক্রম শুরু হয়নি, ব্যাংক ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, কো–অপারেটিভ ব্যাংক, লোন কোম্পানি যখন ছিল না, তখন পতিসরের মতো অখ্যাত পল্লিগ্রামে কৃষি ব্যাংক খুলে কৃষকদের ঋণমুক্ত হতে সহযোগিতা করা শুধু অসামান্য কর্মদক্ষতাই নয়, বরং ক্ষুদ্রঋণের গোড়াপত্তন করে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন।

ব্যাংকটি চলেছিল ২৫ বছর—১৩২০ থেকে ১৩৪৫ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত (সম্প্রতি আমার উদ্ধারকৃত রবীন্দ্রনাথের কৃষি ব্যাংকের লেজারের হিসাব অনুযায়ী)। অমিতাভ চৌধুরী লিখেছেন, ‘ব্যাংক চলেছে কুড়ি বছর।’ প্রথমে ধারদেনা করে ১৯০৫ সালে পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করার পর কৃষকদের মধ্যে ব্যাংক এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে তাঁদের ঋণের চাহিদা মেটানো স্বল্পশক্তির এ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। অবশ্য সমস্যার কিছুটা সমাধান হয় নোবেল পুরস্কারের টাকা ১৯১৪ সালের প্রথম দিকে কৃষি ব্যাংকে জমা হওয়ার পর। কত টাকা ব্যাংকে মূলধন ছিল, তা নিয়েও মতভেদ আছে। কেউ বলছেন, ১ লাখ ৮ হাজার, কারও মতে, ১ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। (রবিজীবনী, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, পৃ. ৪৬২)

শুধু নোবেল পুরস্কার আর ধারদেনার টাকাই নয়, ব্যাংকের অবস্থা অস্থিতিশীল দেখে ১৯১৭ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বইয়ের রয়্যালটি এবং আমেরিকায় বক্তৃতা বাবদ পাওয়া টাকা থেকে ৯ হাজার টাকা জমা দেন। তবু শেষ পর্যন্তু ব্যাংক আর টিকল না।

রবীন্দ্র–পরবর্তী পতিসর কাছারিবাড়ি থেকে ব্যাংকের মূল্যবান নথিপত্রসহ সমস্ত রবীন্দ্রস্মৃতিচিহ্ন হারিয়ে যায়। সেই সমস্ত মূল্যবান স্মৃতিচিহ্ন পুনরায় উদ্ধার করে পতিসরে পূর্ণাঙ্গ রবীন্দ্র জাদুঘর করার চেষ্টা করেছি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ রবীন্দ্রস্মৃতি উদ্ধার করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে হস্তান্তর করেছি। কবির লেখা ছয় পৃষ্ঠার চিঠি, কবি প্রতিষ্ঠিত ‘পতিসর কৃষি সমবায় ব্যাংক’–এর হিসাবের খাতা, কালীগ্রামের শেষ জমিদার কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ও পুত্রবধু প্রতিমা দেবীর মূল্যবান বেশ কিছু চিঠি, কবির ব্যবহৃত খাট, টিপট, আলমারি, ওয়ার্ডরোব, নাগোর বোটের দরজা-জানালাসহ সমমানের আরও নির্দশন। লেজারটি উদ্ধার করেছিলাম রানীনগরে বিলকৃষ্ণপুর নিবাস মোহাম্মদ আহম্মদ আলী শাহের নাতজামাই কলেজশিক্ষক আবদুল হামিদের বাসা থেকে।

বলে রাখা দরকার, মোহাম্মদ আহম্মদ আলী শাহ রবীন্দ্রনাথের কৃষি ব্যাংকেই কর্মরত ছিলেন। মূল্যবান খাতা হাতে আসার পর জানতে পারলাম, এমন লেজার দুই বাংলার কোথাও নেই। পতিসর কৃষি ব্যাংকের তথ্যাদি শুধু গবেষকদের কলমেই ছিল, বাস্তব এ ধরনের দালিলিক প্রমাণ ছিল না। পরিতাপের বিষয, রবীন্দ্রনাথের কৃষি ব্যাংকের এই দুর্লভ খাতা কেনার জন্য সভ্যসংস্কৃতির দেশের মানুষ মরিয়া হয়েছিল, কিন্তু আমার নীতিতে আমি অটল ছিলাম।

যাহোক, লেজারটির গুরুত্ব বিবেচনা করে ২০০৯ সালের ৮ মে, ২৫ বৈশাখ তৎকালীন নওগাঁর জেলা প্রশাসকের কাছে হস্তান্তর করেছিলাম। পরে মূল্যবান লেজারটি জাতীয় আর্কাইভে সংরক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছে বলে জেনেছি। আজ দেশ ও দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা লেজারটি গবেষণায় নেওয়ার জন্য বারবার পতিসরে ছুটে এসে না দেখার যন্ত্রণা নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন।

মহামূল্যবান এই লেজার পতিসর মিউজিয়ামে সংরক্ষণ অতিজরুরি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এম মতিউর রহমান মামুন রবীন্দ্রস্মৃতি সংগ্রাহক ও গবেষক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সমব য় ব য রব ন দ র ক ষকদ র ব যবস থ র পল ল র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে আজ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে পৌঁছেছেন।

প্রধান উপদেষ্টা ও তাঁর সফরসঙ্গীদের বহনকারী এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইট স্থানীয় সময় বিকেল ৩টায় জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে।

এ বছর প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীদের মধ্যে ছয় রাজনৈতিক নেতা রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন ও যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. তাসনিম জারা ঢাকা থেকে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে যোগ দেন।

এছাড়া জামায়াত নেতা নকিবুর রহমান তারেক যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতিনিধি দলে যুক্ত হন।

এর আগে ২২ সেপ্টেম্বর রাত ১টা ৪০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময়) প্রধান উপদেষ্টা ও তাঁর সফরসঙ্গীদের বহনকারী এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা দেয়।

সূচি অনুযায়ী অধ্যাপক ইউনূস আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ