খালেদা জিয়ার ফিরে আসা যে কারণে তাৎপর্যপূর্ণ
Published: 8th, May 2025 GMT
প্রায় চার মাস যুক্তরাজ্যের লন্ডনে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তাঁর সঙ্গে দেশে ফিরেছেন দুই পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান ও সৈয়দা শর্মিলা রহমান। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা দেশে ফিরলেন প্রায় ১৭ বছর পর। বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত পুরো পথে খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন বিএনপি নেতাকর্মীর পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ। উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ৮ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের লন্ডনে যান বাংলাদেশের এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
মনে হতে পারে, একটি দলের শীর্ষ নেতার বিদেশ থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসার ঘটনা কেন এত উদযাপিত হলো? গত প্রায় চার দশকে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক পরিক্রমা দেখলেই এই ফিরে আসার তাৎপর্য বোঝা যাবে।
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে কতিপয় বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে শাহাদাতবরণ করেন। সে সময় খালেদা জিয়া ছিলেন নিতান্তই গৃহবধূ। দুই সন্তান নিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিলেন তিনি। জিয়াউর রহমানের অবর্তমানে বিএনপির হাল কে ধরবে, সেটি নিয়ে নানা আলোচনা চলতে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপিতে প্রাথমিক সদস্য হিসেবে যোগ দেন। নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় পরের বছর মার্চে তিনি দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। তিনি ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন এবং একই বছরের ১০ মে চেয়ারপারসন পদে নির্বাচিত হন। ১৯৯৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর দলের চতুর্থ কাউন্সিলে দ্বিতীয়বার, ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে তৃতীয়বার এবং ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলের দশম কাউন্সিলে চতুর্থবারের মতো বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তারপর থেকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। দেশের মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ‘আপসহীন নেত্রী’ আখ্যা দিয়েছে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কারাগারে যাওয়ার পর গত সাত বছরে কোনো জনসমাবেশে সশরীরে অংশ নেননি তিনি। খালেদা জিয়া এখনও বিএনপির ঐক্যের প্রতীক। সুতরাং তিনি রাজনীতিতে থাকুন বা না থাকুন, দেশে তাঁর উপস্থিতিই দলটির নেতাকর্মীর কাছে বড় ধরনের আশীর্বাদের মতো।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দেশে তাঁর শারীরিক অনুপস্থিতিতে নেতাকর্মীর মধ্যে এক ধরনের শূন্যতা অনুভূত হয়। খালেদা জিয়া দেশে থাকলে সে শূন্যতা পূরণ হয়ে যায়। তাই তাঁর ফিরে আসার ঘটনায় ব্যাপক উদযাপনে মাতেন দলের নেতাকর্মী। উপরন্তু আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দাবি করছে বিএনপি। খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করে কার্যত একটি রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করল বিএনপি।
তবে এ তো গেল বিএনপির দলীয় বিবেচনা। খালেদা জিয়ার সঙ্গে কিন্তু বাংলাদেশের গণতন্ত্রের নিয়তিও লটকে আছে। তাঁর চিকিৎসা নিয়ে জল কম ঘোলা হয়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ও চিকিৎসা নিয়ে বহু বাঁকা কথা বলতেন। এর একটি ছিল– ‘রোজই শুনি এই মরে মরে, এই যায় যায়। বয়স তো আশির উপরে। সময় হয়ে গেছে। তার মধ্যে অসুস্থ। এখানে এত কান্নাকাটি করে লাভ নাই’ (ইনকিলাব, ৪ অক্টোবর, ২০২৩)। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। এর পর উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া লন্ডনে যান।
তাঁর এই বিদেশে যাওয়ার পরও সেই বহুল চর্চিত ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’র আলোচনা আবার শুরু হয়। কিন্তু খালেদা জিয়া দেশে ফিরে আসায় সেসব প্রচারণা ব্যর্থ হয়েছে। আমরা স্মরণ করতে পারি, গৃহবধূ থেকে নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশের জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন খালেদা জিয়া। মানুষ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়ে বারবার তাঁকে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত করেছে। নির্বাচনের ইতিহাসে খালেদা জিয়ার অনন্য রেকর্ড হচ্ছে পাঁচটি সংসদ নির্বাচনে ২৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব ক’টিতেই তিনি জয়লাভ করেছেন। শেখ হাসিনা জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন প্রতিপক্ষের প্রার্থীর কাছে।
বিএনপির দায়িত্ব নেওয়ার পরই নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়েন খালেদা জিয়া। দল ঐক্যবদ্ধ রেখে আপসহীনভাবে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেনা সমর্থিত ওয়ান-ইলেভেনের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়াকে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়। দীর্ঘদিন কারাবাসের পর তিনি আইনি লড়াই করে সব মামলায় জামিনে মুক্তি পান। কারাগারে থাকাকালে তাঁকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি যেতে অস্বীকার করেন। ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। এত কিছু করেও তাঁকে দমানো যায়নি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা হয়েছিল। সব মামলা তিনি আইনিভাবে মোকাবিলা করেছেন। মামলা থেকে মুক্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে তিনি এমন সময়ে দেশের বাইরে গিয়েছিলেন, যখন বাংলাদেশ নতুন করে গণতান্ত্রিক ধারা সচল করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। তাই তাঁর চিকিৎসা নিয়ে ফিরে আসা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেই ১৯৮২ সাল থেকে ২০২৪ অবধি বাংলাদেশ বারবার স্বৈরাচারের কবলে পড়েছে। প্রতিবারই খালেদা জিয়া সেই স্বৈরাচার হটাতে আপসহীন ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর সামনে এখন আরেকটি সুযোগ এসেছে। সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে স্থায়ী ভিত্তি দিতে ভূমিকা রাখা। খালেদা জিয়ার দল বিএনপি এ ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। নিজের নিয়তিকে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের নিয়তির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা এবং সুস্থ হয়ে ফিরে আসায় খালেদা জিয়াকে অভিনন্দন।
এহ্সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক,
সমকাল; কথাসাহিত্যিক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ল দ শ র গণতন ত র ন ত কর ম র জন ত ক ব এনপ র র জন য র র জন রহম ন
এছাড়াও পড়ুন:
আ.লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে ৩৫ সংগঠনের নতুন জোটের আত্মপ্রকাশ
জুলাই হত্যাকাণ্ডের দায়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে ৩৫টি সংগঠনের সমন্বয়ে ‘জুলাই ঐক্য’ নামে একটি জোটের আত্মপ্রকাশ হয়েছে। আজ মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নতুন এই জোটের ঘোষণা দেওয়া হয়।
এই জোটের শরিকদের মধ্যে রয়েছে ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ-আপ বাংলাদেশ, ইনকিলাব মঞ্চ, জুলাই রেভল্যুশনারি জার্নালিস্ট অ্যালায়েন্স, জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স, বিপ্লবী ছাত্র পরিষদ, অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট কোয়ালিশন, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-পুনাব, এসএডি (স্টুডেন্টস অ্যালায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি), প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস অব বাংলাদেশ-পুসাব, জুলাই মঞ্চ ইত্যাদি।
সংবাদ সম্মেলনে জুলাই ঐক্যের অন্যতম সংগঠক মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। তিনি বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। বিগত সাড়ে ১৫ বছরের দমন-নিপীড়ন, দুর্নীতি, লুটপাট ও গণতন্ত্র হরণের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব এক জাগরণে সংঘটিত হয় ছাত্র-জনতার জুলাই গণ-অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানে জীবন দিতে হয় দুই হাজারে বেশি মানুষকে। আহত হন প্রায় ৩১ হাজার মানুষ।
মুসাদ্দিক আলী দাবি করেন, ‘ওই সময় রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের দ্বারা পরিচালিত হামলা আন্তর্জাতিক মহলে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু আমরা দেখছি, জুলাই বিপ্লবের আট মাস পেরিয়ে গেলেও গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারপ্রক্রিয়া এখনো অনিশ্চিত।’
জুলাই ঐক্যের এই সংগঠক বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন দেশে স্বাভাবিক গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার শামিল। সেই সঙ্গে জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী বিপ্লবীদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা শঙ্কিত। জুলাই বিপ্লব–পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা বিভিন্ন দাবি তুলে জুলাইয়ে অংশ নেওয়া বিপ্লবীদের বিতর্কিত করতে চায়। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেই আমরা বিভিন্ন মতাদর্শের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে নিয়ে আজ “জুলাই ঐক্য” নামে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় জোটের ঘোষণা করছি।’
সংবাদ সম্মেলনে ইনকিলাব মঞ্চের প্রতিনিধি ফাতিমা ঝুমা বলেন, ‘জুলাই–পরবর্তী সময়ে যখন আমাদের কথা ছিল, আওয়ামী লীগের বিচারটা সবার আগে নিশ্চিত হবে, সেখানে আমরা কোনো বিচারিক কার্যক্রম তো দূরে থাক, এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতিই দেখতে পাইনি।’
আপ বাংলাদেশের প্রতিনিধি প্লাবন তারিক বলেন, ‘দেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো কিন্তু আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের ইস্যুকে একেবারেই এড়িয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখছি, আওয়ামী লীগের যেসব নেতা অপরাধে যুক্ত ছিলেন, তাঁরা জেলে যাওয়ার কয়েক দিন পর ছাড়া পেয়ে আবার তাঁদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এগুলো নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।’