মহানবী (সা.) যেভাবে সমালোচনা মোকাবেলা করতেন
Published: 9th, May 2025 GMT
সমালোচনা মোকাবিলা কারও জন্যই সহজ নয়। অন্যায় বা অশোভন সমালোচনা মানুষের হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে, এমনকি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেও ফাটল ধরাতে পারে। তবে মহানবী মুহাম্মদ (সা.) এই ক্ষেত্রে এক অপ্রতিম দৃষ্টান্ত। তিনি শুধু সমালোচনাকে ধৈর্য ও বিনয়ের সঙ্গে গ্রহণ করতেন না; বরং তা থেকে ইতিবাচক ফলাফল অর্জনের পথও দেখিয়েছেন। তাঁর জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি কীভাবে সমালোচনার মুখে শান্ত থাকতে হয়, কীভাবে দয়া ও ন্যায়বিচার দিয়ে পরিস্থিতি সামলাতে হয় এবং কীভাবে মানুষের হৃদয় জয় করতে হয়। এই নিবন্ধে তাঁর জীবনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার মাধ্যমে সমালোচনা মোকাবিলার শিক্ষা তুলে ধরা হলো।
নবীজির (সা.
) দৃষ্টিভঙ্গি
মহানবী (সা.) তাঁর নবুয়তের সময়ে বিভিন্ন ধরনের সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। এই সমালোচনা এসেছিল অবিশ্বাসীদের (মুশরিক, মুনাফিকসহ) থেকে এবং কিছুসংখ্যক মুসলিমের পক্ষ থেকেও। অবিশ্বাসীদের সমালোচনা প্রায়ই ছিল ভিত্তিহীন, ব্যক্তিগত আক্রমণ বা অপবাদ, যা তাঁর হৃদয়ে ব্যথার সৃষ্টি করত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাঁর এই কষ্টের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘আমরা অবশ্যই জানি যে তারা যা বলে, তা তোমার হৃদয়কে কষ্ট দেয়।’ (সুরা আল–হিজর, ১৫: ৯৭)
অন্যদিকে মুসলিমদের সমালোচনা ছিল ভুল–বোঝাবুঝি বা অপর্যাপ্ত তথ্যের কারণে। তবে উভয় ক্ষেত্রে নবীজি (সা.)–এর প্রতিক্রিয়া ছিল ধৈর্য, ক্ষমা ও দূরদর্শিতার। তিনি কখনো ব্যক্তিগতভাবে সমালোচনাকে গ্রহণ করতেন না এবং শুধু আল্লাহর বিধান লঙ্ঘিত হলে তাঁর সন্তুষ্টির জন্য প্রতিক্রিয়া দেখাতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নবী (সা.) কখনো নিজের জন্য প্রতিশোধ নেননি, যতক্ষণ না আল্লাহর সম্মান লঙ্ঘিত হয়েছে। তখন তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রতিশোধ নিতেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬১২৬)
ঘটনা–১: ইহুদি রাব্বির সমালোচনা ও দয়ার প্রতিক্রিয়া
একবার ইহুদি রাব্বি জায়েদ ইবনে সুনআহ নবীজি (সা.)–এর কাছে তাঁর ঋণের টাকা দাবি করতে আসেন। তিনি অভদ্রভাবে নবীজি (সা.)–এর চাদর টেনে নামান এবং বলেন,‘তুমি, আবদুল মুত্তালিবের সন্তান, দেরি করছ।’
এই অশোভন আচরণে উমর (রা.) ক্ষুব্ধ হয়ে রাব্বিকে ধমক দেন এবং তলোয়ার দিয়ে হত্যার হুমকি দেন। কিন্তু নবীজি শান্তভাবে হেসে উমর (রা.)–কে বলেন, ‘এ মানুষটি তোমার কাছ থেকে ভালো আচরণের অধিকারী। তোমার উচিত ছিল আমাকে সময়মতো ঋণ পরিশোধের পরামর্শ দেওয়া এবং তাকে ভদ্রভাবে তার দাবি জানানোর অনুরোধ করা।’
তিনি জায়েদকে জানান যে পরিশোধের সময়সীমা এখনো তিন দিন বাকি। এরপর উমর (রা.)–কে ঋণ পরিশোধ করতে ও উমরের আচরণের ক্ষতিপূরণ হিসেবে অতিরিক্ত ২০ মাপ দিতে বলেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৩৮৮৪)
এ ঘটনা থেকে আমরা শিখি যে নবীজি (সা.) অভদ্র সমালোচনার মুখেও শান্ত থাকতেন, প্রতিশোধের পরিবর্তে দয়া ও ন্যায়বিচার প্রদর্শন করতেন এবং পরিস্থিতি থেকে ইতিবাচক ফলাফল অর্জন করতেন। তাঁর এই আচরণ জায়েদের হৃদয়ে ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা জাগিয়েছিল।
ঘটনা–২: আনসারদের অসন্তোষ ও হৃদয় জয়ের কৌশল
হুনাইনের যুদ্ধের পর নবীজি (সা.) যুদ্ধ–লব্ধ সম্পদ বণ্টন করেন। এই সম্পদের মধ্যে ছিল প্রায় ৬ হাজার বন্দী, ২৪ হাজার উট, ৪০ হাজার পশু ও ৪ হাজার পাউন্ড রুপা। তিনি নব্য মুসলিমদের, বিশেষ করে মক্কার কুরাইশদের বেশি অংশ দেন, যাতে তাদের হৃদয় ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। কিন্তু এই বণ্টনে আনসারদের কম অংশ দেওয়ায় তারা অসন্তোষ প্রকাশ করে। তারা মনে করে নবীজি (সা.) তাঁর আত্মীয়দের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছেন।
হজরত সা’দ ইবনে উবাদা (রা.) এই অসন্তোষের কথা নবীজি (সা.)–এর কাছে জানান। নবীজি (সা.) প্রথমে সা’দের নিজস্ব অবস্থান জানতে চান। সা’দ বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘আমি আমার কওমের একজন মাত্র।’
নবীজি (সা.) তখন আনসারদের একত্র করতে বলেন। তিনি তাঁবুতে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা করেন এবং বলেন, ‘হে আনসাররা, আমি শুনেছি তোমরা আমার ওপর অসন্তুষ্ট। আমি কি তোমাদের পথভ্রষ্ট অবস্থায় পাইনি, আর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদের হেদায়েত দেননি? তোমরা কি দরিদ্র ছিলে না, আর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদের ধনী করেননি? তোমরা কি শত্রু ছিলে না, আর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদের হৃদয়ে মিলন ঘটাননি?’
আনসাররা বলেন, ‘হ্যাঁ, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সবচেয়ে দয়ালু ও মহৎ।’
নবীজি (সা.) আরও বলেন, ‘তোমরা যদি বলতে, তাহলে সত্য বলতে, “তুমি আমাদের কাছে অবিশ্বাসী হয়ে এসেছিলে, আমরা তোমাকে বিশ্বাস করেছি; তুমি সাহায্যহীন হয়ে এসেছিলে, আমরা তোমাকে সাহায্য করেছি; তুমি বহিষ্কৃত হয়ে এসেছিলে, আমরা তোমাকে আশ্রয় দিয়েছি; তুমি দরিদ্র হয়ে এসেছিলে, আমরা তোমাকে সমৃদ্ধ করেছি।” হে আনসাররা, তোমরা কি সেই পার্থিব জিনিসের জন্য অসন্তুষ্ট, যা আমি কিছু লোককে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য দিয়েছি? তোমরা কি সন্তুষ্ট নও যে লোকেরা ভেড়া ও উট নিয়ে চলে যাবে, আর তোমরা আল্লাহর রাসুলকে তোমাদের বাসভূমিতে নিয়ে যাবে? আল্লাহর কসম, যদি হিজরত না হতো, আমি আনসারের একজন হতাম।’
রাসুল (সা.) শেষে দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ, আনসারদের, তাদের সন্তানদের ও তাদের সন্তানদের সন্তানদের ওপর করুণা কর।’
এই কথাগুলো শুনে আনসাররা অশ্রুসিক্ত হয়ে বলেন, ‘আমরা আল্লাহর রাসুল (সা.)–কে আমাদের ভাগ্য ও অংশ হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪৩৩০)
এ ঘটনা থেকে আমরা শিখি যে নবীজি (সা.) সমালোচনার মুখে তিরস্কারের পরিবর্তে তাদের অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেন, তাদের মর্যাদা উঁচু করেন এবং তাঁর সিদ্ধান্তের পেছনের দূরদর্শী কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি আনসারদের অসন্তোষের মূল কারণ—প্রত্যাখ্যাত বোধ করার অনুভূতি বুঝতে পেরেছিলেন এবং তাদের ভালোবাসা ও সম্মান দিয়ে হৃদয় জয় করেছিলেন।
আরও পড়ুনযেকোনো সময় এই দোয়া করা যায়০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫সমালোচনা মোকাবিলায় নবীজি (সা.)–এর কৌশল
সমালোচনা মোকাবিলায় মহানবী (সা.)–এর পদ্ধতি ছিল অনন্য। তিনি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতেন, তবে তাঁর প্রতিক্রিয়ার মূলে ছিল ধৈর্য, দয়া ও আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতি প্রতিশ্রুতি। তাফসির ইবনে কাসিরে সুরা আল–হিজরের ব্যাখ্যায় তাঁর কয়েকটি কৌশল উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে—
১। শান্ত ও বিনয়ী প্রতিক্রিয়া: জায়েদ ইবনে সুনআহর অভদ্রতার মুখেও তিনি শান্ত থেকেছেন এবং প্রতিশোধের পরিবর্তে দয়া দেখিয়েছেন। তিনি সমালোচনাকে ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করেননি; বরং পরিস্থিতির উন্নতি করেছেন।
২। সমালোচনার মূল কারণ অনুসন্ধান: আনসারদের অসন্তোষের ক্ষেত্রে তিনি প্রথমে সা’দের মাধ্যমে তথ্য যাচাই করেন এবং তাদের অসন্তোষের প্রকৃত কারণ বোঝার চেষ্টা করেন। এটি তাঁর দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বের গুণ প্রকাশ করে।
৩। সমালোচকদের মর্যাদা দেওয়া: আনসারদের সমালোচনার জবাবে তিনি তাদের তিরস্কার করেননি; বরং তাদের অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে তাদের মর্যাদা বাড়িয়েছেন। এটি তাদের হৃদয়ে শান্তি ও সন্তুষ্টি ফিরিয়ে এনেছে।
৪। সিদ্ধান্তের পেছনের জ্ঞান ব্যাখ্যা: তিনি আনসারদের বোঝান যে নব্য মুসলিমদের বেশি সম্পদ দেওয়ার পেছনে ছিল ইসলামের প্রতি তাদের আকর্ষণ বাড়ানোর উদ্দেশ্য। এই ব্যাখ্যা তাদের ভুল–বোঝাবুঝি দূর করে।
৫। আল্লাহর প্রশংসা ও দোয়ার আশ্রয়: অবিশ্বাসীদের ভিত্তিহীন সমালোচনার ক্ষেত্রে তিনি আল্লাহর প্রশংসা, সিজদা ও ইবাদতের মাধ্যমে হৃদয়ের শান্তি খুঁজতেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাঁকে বলেন, ‘তাহলে তোমার প্রভুর প্রশংসায় মহিমান্বিত করো এবং সিজদাকারীদের মধ্যে থেকো।’ (সুরা আল–হিজর, আয়াত: ৯৮)
আরও পড়ুনপাপ থেকে প্রত্যাবর্তন করার নাম তওবা২৮ জানুয়ারি ২০২৫আধুনিক পটভূমিতে নবীজি (সা.)–এর শিক্ষা
আজকের বিশ্বে সমালোচনা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, কর্মক্ষেত্র বা ব্যক্তিগত জীবনে আমরা প্রায়ই অবিচারপূর্ণ বা কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হই। নবীজি (সা.)–এর জীবন থেকে আমরা কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি—
ধৈর্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণ: সমালোচনার মুখে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে শান্ত থাকা এবং পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা।
ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি: সমালোচনাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ হিসেবে না নিয়ে তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করা।
দয়া ও ক্ষমা: সমালোচকদের প্রতি দয়া ও ক্ষমা প্রদর্শন, যা তাদের হৃদয় পরিবর্তন করতে পারে।
আল্লাহর ওপর ভরসা: কঠিন সমালোচনার সময় ইবাদত ও দোয়ার মাধ্যমে মানসিক শান্তি খোঁজা।
হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘তাঁর চরিত্র ছিল কোরআন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৭৪৬)
নবীজি (সা.) পবিত্র কোরআনের শিক্ষার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি ছিলেন। তিনি পবিত্র কোরআনের নির্দেশ—‘যা মন্দ, তা যা উত্তম, তা দিয়ে প্রতিরোধ করো’ (সুরা ফুসসিলাত, ৪১: ৩৪) নিজের জীবনে প্রয়োগ করেছেন। তাঁর প্রতিক্রিয়া প্রতিটি পরিস্থিতির জন্য উপযুক্ত ছিল, যা তাঁকে সম্মান ও মর্যাদার উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
সারকথা
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সমালোচনা মোকাবিলায় ধৈর্য, দয়া ও দূরদর্শিতার অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ইহুদি রাব্বির অভদ্রতার মুখে তিনি ক্ষমা ও উদারতা দেখিয়েছেন, আনসারদের অসন্তোষের সময় তাদের মর্যাদা ও ভালোবাসা দিয়ে হৃদয় জয় করেছেন। তিনি সমালোচনাকে ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ না করে তার মূল কারণ বুঝতে চেষ্টা করতেন এবং পরিস্থিতির উন্নতির জন্য কাজ করতেন। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় যে সমালোচনা একটি সুযোগ হতে পারে—নিজেকে উন্নত করার, সম্পর্ক মজবুত করার এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের। আজকের মুসলিমদের জন্য তাঁর এই শিক্ষা একটি পথনির্দেশ, যা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়।
আরও পড়ুনসুরা নিসা: নারীর অধিকারের কথা২৬ জানুয়ারি ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ র অসন ত ষ র অব শ ব স পর স থ ত ইসল ম র দ রদর শ আল ল হ র জন য এস ছ ল আম দ র কর ছ ন ধ র পর র জ বন র সময় আনস র করত ন
এছাড়াও পড়ুন:
ইরান বনাম পশ্চিমা বিশ্ব : সভ্যতার ভণ্ডামির পাঠ
ইরান কেবল একটি রাষ্ট্র নয়, বরং গোটা এক সভ্যতা। প্রাচীন ও আত্মসচেতন এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে শত শত বছর ধরে দর্শন, শিল্প ও আধ্যাত্মিকতার চর্চার মধ্য দিয়ে। এই সভ্যতাগত চরিত্রই যুগে যুগে ইরানের রাজনৈতিক ও নৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে।
আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক ছিল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বচ্ছ। তবে তা আত্মসম্মানবোধ থেকে, আত্মসমর্পণ থেকে নয়। তবু পশ্চিমা গণমাধ্যম ও তাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকেরা ইরানকে এক ‘দুষ্ট রাষ্ট্র’ হিসেবে তুলে ধরেছে। যেন পশ্চিমের নৈতিকতার মিথ ধরে রাখার জন্য ইরান এক সুবিধাজনক ‘অপর’।
ইরানের পররাষ্ট্রনীতি বরাবরই দাঁড়িয়ে আছে প্রতিরোধের নীতির ওপর। হিজবুল্লাহ ও হামাসকে ইরানের সমর্থন কখনোই অন্ধ সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ ছিল না। সেই সমর্থন মূলত এমন এক আঞ্চলিক শক্তির বিরুদ্ধে, যারা আজও ফিলিস্তিনিদের পিষ্ট করে চলেছে গণহত্যার মতো নির্যাতনের মাধ্যমে।
আরও পড়ুনআরব দেশগুলো এখন বুঝছে—ইরান নয়, ইসরায়েলই তাদের জন্য বড় হুমকি১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫যেখানে ইসরায়েল শরণার্থীশিবির ও হাসপাতাল বোমাবর্ষণকেও নিজেদের ‘আত্মরক্ষা’ হিসেবে দাবি করে, সেখানে ইরানের সংহতি আক্রমণ নয়, বরং নৈতিক দায়িত্ব। পশ্চিমা গণমাধ্যমে যেভাবে ইরানকে রহস্যঘেরা ও গোপনীয়তার আড়ালে ঢেকে রাখা এক রাষ্ট্র হিসেবে দেখানো হয়, বাস্তবতা তার থেকে অনেক জটিল এবং ভিন্ন।
ওয়াশিংটনের নৈতিক চশমা দিয়ে ইরানের আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে বোঝা যায় না। পারস্যের উত্তরসূরি হিসেবে এই ইসলামি প্রজাতন্ত্র এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে, যেখানে সম্পর্কের ভিত্তি সততা আর শক্তি মানেই সংযম। আধুনিক ইতিহাসে ইরান কোনো দেশে আক্রমণ বা উপনিবেশ স্থাপন করেনি। বরং আক্রমণ, নিষেধাজ্ঞা ও বিশ্বের থেকে একঘরে হয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা সয়েছে। তবু ইরান আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থেকে সরে দাঁড়ায়নি।
ইরানের অভ্যন্তরীণ জটিলতা যা–ই থাকুক, এই নৈতিক উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তারা প্রতিরোধ করেছে। ওয়াশিংটনের কথামতো না চলার জন্যই ইরানকে শাস্তি দেওয়া হয়, নিজের জনগণকে দমন করার কারণে নয়।ইরান পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের পথে হাঁটতে চাইলে (যদি সত্যিই সেই পথ বেছে নেয়) তাকে আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিতের বাইরে বিচার করা যায় না। ইসরায়েলের একটি অঘোষিত পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার আছে। দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে সই করেনি এবং আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার কাছেও তাদের কোনো জবাবদিহি নেই।
তাহলে ইরান কেন প্রতিরোধক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হবে? বিশেষ করে এমন এক পরিবেশে, যেখানে পশ্চিমের নৈতিকতা প্রয়োগ হয় বেছে বেছে। আর আন্তর্জাতিক আইন ব্যবহৃত হয় দুর্বলদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে। সেখানে তো প্রতিরোধই টিকে থাকার উপায়।
পশ্চিমা দেশগুলো মানবাধিকার নিয়ে দুনিয়াকে নসিহত করে, কিন্তু অস্ত্র বিক্রি করে ইসরায়েল ও সৌদি আরবের কাছে। গাজায় ‘সন্ত্রাসীদের’ নিন্দা করে, অথচ শিশুদের অনাহারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়াকে ক্ষমা করে দেয়। ইরানকে তারা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মানার দাবি জানায়, কিন্তু নিজেরা সুযোগ পেলেই তা লঙ্ঘন করে। এই ভণ্ডামি ব্যক্তিগত নয়, এর শিকড় গাথা আছে ঔপনিবেশিক ঔদ্ধত্যের শত শত বছরের অভ্যাসে। যে শক্তিগুলো একসময় এশিয়া ও আফ্রিকা লুট করে বেরিয়েছে, আজ তারাই গণতন্ত্র ও শান্তি নিয়ে জ্ঞান দেয়।
আরও পড়ুনইরান–আমেরিকা ‘দ্বিতীয় যুদ্ধ’ যে চার কারণে আসন্ন৩১ আগস্ট ২০২৫ইরানের অভ্যন্তরীণ জটিলতা যা–ই থাকুক, এই নৈতিক উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তারা প্রতিরোধ করেছে। ওয়াশিংটনের কথামতো না চলার জন্যই ইরানকে শাস্তি দেওয়া হয়, নিজের জনগণকে দমন করার কারণে নয়।
গাজায় ইসরায়েলের চলমান কর্মকাণ্ড পশ্চিমা দ্বিমুখিতার সর্বোচ্চ অশ্লীল প্রদর্শন। বিশ্ব তাকিয়ে দেখেছে শিশুরা ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ছে, হাসপাতালে বোমা হামলা হচ্ছে, শরণার্থীরা অনাহারে মরছে। আর এসবই ন্যায্যতা পাচ্ছে ‘নিরাপত্তার’ নামে। আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিটি নীতি পায়ের তলায় পিষ্ট করা হচ্ছে, তবু কোনো নিষেধাজ্ঞা আসে না। যে সরকারগুলো একসময় ইউক্রেনের দুর্দশায় চোখের জল ফেলেছিল, তারাই এখন ফিলিস্তিনে গণহত্যার অর্থ জোগাচ্ছে।
পার্সেপোলিস থেকে তেহরান পর্যন্ত, কবি থেকে বিপ্লবী পর্যন্ত ইরান এমন এক ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে, যা কোনো সাম্রাজ্যই মুছে দিতে পারেনি। ইরানের রাজনীতি বিতর্কিত হতে পারে, শাসনব্যবস্থা অপূর্ণ হতে পারে কিন্তু তার সভ্যতাগত মনন অটুট। এর বিপরীতে পশ্চিমারা অস্ত্র চুক্তি ও তেল-স্বার্থের বিনিময়ে বিসর্জন দিয়েছে নিজেদের নৈতিক দিশা।
● রঞ্জন সলোমন গোয়াভিত্তিক রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও মানবাধিকারকর্মী
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজিতে থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত