১৯৭৫ সালে সিঙ্গাপুর যাওয়ার প্রথম সুযোগ আসে। আহা! বিদেশ যাচ্ছি, বিদেশ যাচ্ছি।
সে বয়সে প্রথম বিদেশ যাওয়া মানে অনেক উত্তেজনা, ছটফটানি থাকে। তখন বয়স কম। মাথায় গুরুত্বপূর্ণ ভাবনাই হচ্ছে, নিজেকে খুব ভালো দেখাতে হবে। বিদেশে গিয়ে পরতে হবে এমন পোশাক, যেন বিদেশিরা অবাক হয়ে যায়। যেন দেখে ভাবে, এই আধুনিক যুবকগুলো কোন দেশ থেকে এল!
তখন বেল বটম হচ্ছে সর্বাধুনিক ফ্যাশন। সেসব প্যান্ট তখন ওপরের দিক আঁটসাঁট-টাইট, নিচের দিকে ২৫–২৭ ইঞ্চি ঢোলা। বেছে বেছে বেশি ঢোলা দেখে কয়েকটা প্যান্ট সু৵টকেসে ভরে ফেলা হলো। নস্যি রঙের একটা ডাবল ব্রেস্ট কোট ছিল, সেটাও নেওয়া হলো। প্যান্টের সঙ্গে কোট না হলে কি বিদেশে যাওয়া মানায়?
পৌঁছালাম সিঙ্গাপুরে। শহরে প্রথম দিনটার অভিজ্ঞতা জীবনভর মনে রাখার মতো। ১৯৭৫ সাল। ঢাকা শহর থেকে যাওয়া ঝাঁকড়া চুলের কয়েকজন ফ্যাশনেবল তরুণের রাস্তা দিয়ে বুক চিতিয়ে হাঁটার কথা, হাঁটছে তারা; কিন্তু বুক ফুলছে না। অনুভব করছি, প্রত্যেকেই ফুটো হয়ে যাওয়া বেলুনের মতো ক্রমে চুপসে যাচ্ছি। হাঁটছি, সে হাঁটায় প্রত্যয় নেই। প্রায়ই পায়ে পা জড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের। মনে হতে থাকে, এই বোধ হয় হোঁচট খেয়ে পড়ে যাব।
সে শহর আমাদের চেয়ে আলাদা। আমাদের শহরে আমরা যেন সবার চোখে চোখে থাকি। ওখানে তার উল্টো। তারা কেউ কারও দিকে তাকায় না। আলাদাভাবে কেউই আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না—তবু বেল বটমের লজ্জা–সংকোচে আমাদের মরো মরো অবস্থা।
প্রায় পুরো একটা দিন পার হতে চলেছে—সে শহরে কাউকেও দেখা গেল না পরনে বেল বটম প্যান্ট রয়েছে। আমরা বুঝে ফেলেছি, আমাদের আধুনিকতা এ দেশে একদা এসেছিল, পুরোনো হয়েটয়ে উধাও হয়ে গেছে। সেই উধাও হওয়া বা বাতিল হয়ে যাওয়া ফ্যাশন আধুনিকতম ভেবে আমরা তা পরে বিদেশ ভ্রমণে এসেছি।
ইজ্জত রক্ষার্থে সবাই সেই সন্ধ্যায় কেনাকাটা করতে যাব ঠিক করে ফেলি। তা না হলে কাল সকালে বের হব কোন মুখে! খোঁজখবর নিয়ে আমরা হুটোপুটি করে যাই ‘মান বাঁচানো’ শপিং করতে। ঢাকার কজন মনভাঙা যুবক সে শহর থেকে ঘুরে ঘুরে সেদিন কিনে ফেলে জীবনের প্রথম জিনস প্যান্ট।
প্রথম জিনস পরিধানের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সেদিন আরও একটা নতুন শব্দের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে—ওয়ান ওয়ে। বুঝে উঠতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ট্যাক্সিতে চড়ে বলি, অমুক জায়গায় যাব। ট্যাক্সি উল্টো রাস্তায় চলতে শুরু করে। আমরা হইচই করে উঠি—ভুল হচ্ছে ভাই, এই দিকে, এই দিকে যাব আমরা। চালকেরা হেসে বলে, নো নো মহাশয়—ওয়ান ওয়ে, ওয়ান ওয়ে।
জেনে যাই ওয়ান ওয়ের মানে কী। চলাচলে যেন ঝামেলা না বাধে, তার জন্য যাওয়া ও আসার রাস্তা ভাগ করে দেওয়া। যে রাস্তা শুধু যাওয়ার, তা শুধু যাওয়ারই—সে পথে আসা একেবারেই নিষেধ।
রোজ যেখানেই যেতে চাই, ওয়ান ওয়ে আমাদের মেজাজ গরম করে দিতে থাকে। অধিকাংশ সময়েই অনেকটা পথ যেতে হয় উজিয়ে উজিয়ে। তা আমাদের অভ্যাসের অন্তর্গত নয়, তাই পোষায় না কারও। নিজেরা গজর গজর করি। মনে মনে বিরক্ত হওয়া ছাড়া উপায় কী আর? নিরুপায় হয়ে মানি, মানতে বাধ্য হই—দেশটা তো আমাদের কারও নয়।
আমাদের দেশ হলে আহা! গান গাইতে গাইতে সোজা রাস্তায় উল্টো যেতে পারতাম। ব্যস্ত রাস্তা হলেও রাস্তা পার হতে গাড়ি থামিয়ে বন্ধুর ঘাড়ে হাত চড়িয়ে দিয়ে কী চমৎকার গল্প করতে করতে রাস্তা পার হতে পারতাম। তখন সিঙ্গাপুরের রাস্তায় ময়লাটয়লা চোখে পড়েনি। আমাদের অস্বস্তি হতো—মানুষ এত নিয়মকানুন মেনে চলতে পারে কী করে?
আমাদের শহরে এখানে–ওখানে লেখা থাকে, যেখানে–সেখানে ময়লা ফেলিবেন না। পড়ি, দেখি, কিন্তু ইচ্ছাকে দমন করি না আমরা। অনেক স্থানে সতর্ক করা থাকে—এখানে ধূমপান করিবেন না, করিলে জরিমানা করা হইবে। জরিমানা করার ভয় দেখানো হলেও আমরা জানি, যা লেখা থাকে, তা কথার কথা।
সিঙ্গাপুরে এসে দেখি, এখানে কিছুই কথার কথা নয়। যা না করা হয়, নিষেধ করা হয়েছে—ওখানকার মানুষেরা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। আমি ধূমপান করি না। সঙ্গের বন্ধুরা করে। তারা মহাবিরক্ত—যেখানে সেখানে সিগারেট খাওয়া যায় না। নেশা চাপলে বিরক্ত হয় ধূমপায়ী বন্ধুরা নিজের কান মলে আর বলে, আর কোনো দিন আসবে না এ কঠিন নিয়মের শহরে।
কানমলা খাওয়া প্রতিজ্ঞা টিকে থাকেনি কারও। সেই প্রথমের অভিজ্ঞতা মনে রেখে বা না রেখে আমরা বন্ধুরা আরও বহুবার সে শহরে বেড়াতে গেছি। ‘আর আসব না’র প্রতিজ্ঞা মনে করিয়ে দিলে কেউ বলে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। কেউ হাসতে হাসতে বলে—আরে সেটা তরুণকালে যাওয়া, তখনকার মনমানসিকতা এখনো কি আছে? এখন মনে হয়, সেটি পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন, সুন্দর ছবির মতো শহর। সেখানে গিয়ে এখন মনে হয়, পাঁচ–সাত দিন সিগারেট না খেয়ে থাকলে কী এমন ক্ষতি?
মনমানসিকতার বদল হওয়া উচিত—নিজের দেশে, শহরে ও সংসারে থেকে সেটা মনে হয় না। হয় না তার কারণ, আপন আপন ও পরপর অনুভব অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে।
বিদেশে বাস করা এক বন্ধু কদিন আগে দেশে এসে বেড়িয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে এক আড্ডায় দুঃখ করে বলছিল, ঢাকা শহরের ওপরের দিকে তাকালে বিদেশ বিদেশ মনে হয়, নিচে তাকালেই যেখানে সেখানে ময়লা পড়ে থাকতে দেখে ঘোর ভেঙে যায়—মনে হয়, সেই অনেক কালের চেনা ঢাকা। মনে হয়, রয়েছি বাংলাদেশেই।
যখন একটা শহরকে নোংরা বলা হয়, সে দোষ মোটেও শহরের নয়, শহরের বাসিন্দাদের। যখন দেশের কোনো মন্দ নিয়ে কথা হয়, সে মন্দ দেশের নাগরিকের কাঁধেই চাপে।
উন্নত জীবনযাপনের জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে—দেশে, সমাজে নিয়ম আর শৃঙ্খলা থাকা এবং সবাই তা মান্য করে চলা। আমরা মনমানসিকতায় আলাদা প্রকারের। অধিকাংশের বিবেচনাজুড়ে থাকে নিজের হিসাব। লাভ–লোকসানের অঙ্ক। কোনটা করতে গেলে সময়ের অপচয়; আর কোন পথ নিলে দ্রুত উন্নতি! প্রচলিত রীতিই হচ্ছে আইন অমান্য করে নিজের মতো চলা। অনিয়মই দ্রুত এগোনোর উপায়।
যে শহরের গল্প দিয়ে সব কথার শুরু—সেখানকার মানুষেরা ৫০ বছর ধরে নিয়ম মেনে মেনে ক্লান্ত নয়। শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নিয়ম মেনে চলার গুরুত্ব তারা বোঝে। যখন উন্নতির দেখা মেলেনি, ভেবেছে, নিয়মশৃঙ্খলার পথ বেয়ে তা এগিয়ে আসবে। এসে যাওয়ার পরও ভাবে, এ উন্নতি টিকিয়ে রাখতেও চলতে হবে, নিয়মের পথে।
আমাদের নানান ভাবচক্কর দেখে মনে হয়, নিয়ম মানতে নয়, ভাঙতে পারলেই সম্মান বৃদ্ধি হয়। সময়ের মূল্য আমরা প্রকৃতপক্ষে কতটা বুঝি, তা স্পষ্ট নয়। জরুরি কাজে সময়মতো পৌঁছানোর তাগিদ থাকে না অধিকাংশের—আবার খুব দরকার নেই; কিন্তু বহুজনের মনে হয়, যেতে হবে তাড়াতাড়ি। তখন নিয়মের তোয়াক্কা করতে দেখা যায় না। নিয়মকানুন–শৃঙ্খলা ইত্যাদি মান্য করতে বলা অনেকের কাছে অপমানজনক বলেও মনে হয়।
নিকট অতীতে আমরা দেখেছি, উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা কতটা উচ্চ তার প্রমাণ দিতে লজ্জা–শরমের মাথা খেয়ে উল্টো পথে গাড়ি চালিয়ে আসছেন। আমরা দেখেছি, চিহ্নিত চোর–ডাকাত—দেশটা আমার, এমন ভাব দেখিয়ে চলেছে এবং বলেছে। এমন মানুষেরা হোঁচট খেলে রাস্তাকে শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছে। মৃত চার্লি চ্যাপলিন আমাদের কাণ্ডকীর্তি দেখতে পেলে কান ধরে ওঠবস করতে করতে বলতেন, এত দিনে করা আমার সব কৌতুক আমি অত্যন্ত লজ্জার সঙ্গে ফিরিয়ে নিচ্ছি।
দেশে বদল এসেছে। আমাদের স্বভাবে সামান্য বদলও কি এসেছে? অর্ধশত বছরের বেশি সময় ধরে আমরা ভাগে ভাগে সচেতনতা দেখিয়ে চলেছি। দাবি করি দেশ আমাদের প্রিয় কিন্তু দেশের ভালো চাই ভাগ হয়ে হয়ে।
অর্ধশত বছরের বেশি সময় ধরে জোর করে ক্ষমতায় থাকাটাকেই বিশেষ যোগ্যতা বলে বিবেচনা করা হয়। ক্ষমতা থেকে টেনেহিঁচড়ে নামাতে পারাও বিশেষ যোগ্যতা। তাহলে নিয়ম আর শৃঙ্খলা কোথায় রইল? আমরা দাবি করি দেশ ভালোবাসি কিন্তু পণ করেছি নিজ নিজ মতো ভালোবাসব। অন্যের দোষ, ভুল ধরব—তোমাদেরটা ভালোবাসা নয়, আমাদেরটাই ষোলো আনা খাঁটি ভালোবাসা।
আমরা ভাগে ভাগে অসাধারণ। কী রকম সে অসাধারণত্ব? সবাই সবাইকে তীব্রভাবে অপমান করতে পারি, এমন বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। কারও সঙ্গে কারও ভদ্র, সুস্থ আচরণকে আমরা দেখি দুর্বলতা হিসেবে। ভালো ভাষায় নয়, মন্দ করে ও বলে বোঝাতে হয়, শিক্ষাদীক্ষা ও ওজন কার কত বেশি।
দেশটা থাকে মাঝখানে; আমরা ভাগ হয়ে তার দখল নেওয়ার জন্য দড়ি–টানাটানি করে চলেছি। এই যে ভাগে ভাগে ভাগ্য রচনার খেলা, এমন ভয়ংকর কত ধানে কত চাল দেখানোর প্রতিযোগিতায় দেশ ও জনগণের ওঠে নাভিশ্বাস। পরস্পরের দোষ ধরে ধরে জীবনের পর জীবন চুরমার হয়ে যাচ্ছে। তবু সগৌরবে চলমান আধুনিক কালে প্রাচীন খেলা।
সবাই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একেকজন দারুণ দেশপ্রেমিক, কিন্তু প্রেমিকজনেরা প্রায় প্রতিদিনই প্রমাণ দিয়ে চলেন—অন্ধের মতো ভালোবাসে নিজ নিজ দলকে। দলপ্রেমের রসে মত্ত থেকে থেকে ভাই, বন্ধুরা পরিণত হয়েছে শত্রুতে। আঘাতের বদলে প্রত্যাঘাতে দেশেরও হয় রক্তক্ষরণ। বেচারা, অভাগা দেশের মুখ দেখে বোঝাও যায় না, কতখানি কাবু সে বেদনায়।
মানুষের দেশ যদি মানুষদের মতো বেয়াড়া প্রকৃতির হতো, চোখ রাঙিয়ে বলতে পারত, দেশপ্রেমিক দাবি করার আগে দেশপ্রেমের বানান ও মানে শিখে নিতে হবে বাছারা।
আফজাল হোসেন অভিনেতা, নির্মাতা, লেখক ও চিত্রশিল্পী
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র বন ধ র প রথম শহর র
এছাড়াও পড়ুন:
নওগাঁয় প্রেমিকাকে বিয়ে করতে ব্যর্থ হওয়ায় যুবকের ‘আত্মহত্যা’
নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলায় প্রেমিকাকে বিয়ে করতে ব্যর্থ হওয়ায় অভিমান করে বিষ পানে সাগর হোসেন (২১) নামের এক যুবক আত্মহত্যা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।
নিহত সাগর হোসেন উপজেলা ধামইরহাট ইউনিয়নের রামরামপুর তেলিপাড়া গ্রামের রহিদুল ইসলামের ছেলে।
নিহতের বাবা রহিদুল ইসলাম জানান, গত ৮ মে বৃহস্পতিবার রাতে অজ্ঞাত কারণে অভিমান করে সাগর নিজ ঘরে বিষ পান করে। বিষয়টি জানতে পেরে ওই রাতে তাকে উদ্ধার করে ধামইরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করানো হয়। সেখানে চিকিৎসাকালে অবস্থার অবনতি হলে গতকাল শুক্রবার তাকে প্রথমে জয়পুরহাট আধুনিক জেলা হাসপাতাল ও পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে নেওয়ায় হয়। পথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে সাগর হোসেন।
স্থানীয়রা বলছেন, ২০২১ সালে হরিতকীডাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন সাগর। কিছুদিন ধরে একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। পছন্দের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে না দেওয়ায় সে এমন আত্নহননের পথ বেছে নেয়।
পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে না পারায় সাগর আত্নহত্যা করেছে বলে ধারণা করছেন তার বড় চাচা আব্দুর রহিম ও তার প্রতিবেশীরা।
ধামইরহাট থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল মালেক জানান, কি কারণে সাগর আত্মহত্যা করেছে, তা জানা যায়নি। মরদেহ উদ্ধার করে থানা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে আজ শনিবার সকালে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য নওগাঁ মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে।