যুদ্ধবিরতি: মোদির ‘অপারেশন সিঁদুর’ কি হিতে বিপরীত হলো
Published: 11th, May 2025 GMT
ভারত–পাকিস্তানের যুদ্ধ বা সংঘাত নতুন কিছ নয়। ১৯৪৮ সাল থেকে এ দুই দেশ মাঝেমধ্যে যুদ্ধ ও সংঘাত করছে। কখনো শুরু করে এক পক্ষ, আবার কখনো অন্য পক্ষ। শুরু হয় আক্রমণ ও প্রতি–আক্রমণ। কয় দিন চলে, তারপর যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। কখনো নিজেদের প্রচেষ্টায়, আবার কখনো অন্যদের মধ্যস্থতায়। এর আগের বড় যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৬৫ সালে, যা ১৭ দিন স্থায়ী ছিল। আসল যুদ্ধ শেষ হলেও এ দুই দেশের ঠান্ডা যুদ্ধ ও বাগ্বিতণ্ডা বছরের পর বছর চলতেই থাকে।
ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধ যেভাবেই শুরু হোক না কেন, শেষটা মোটামুটি বলে দেওয়া যায়। যুদ্ধ শেষে, আজাদ কাশ্মীর ‘আজাদ’ই থাকবে। ভারত অধিকৃত কাশ্মীর ভারতের অংশ হয়েই থাকবে। সীমান্তের দুই পাশে অনেক সাধারণ মানুষ মারা যাবে দুই পক্ষেই। ভারতের কয়েকজন জেনারেলকে ভূষিত করা হবে ‘পরম বীরচক্র’ ও ‘মহাবীরচক্র’—এসব পদকে। পাকিস্তানি জেনারেলরা পাবেন ‘নিশানে হায়দার’ ও ‘নিশানে ইমতিয়াজ’। স্থগিত আইপিএল আবার শুরু হবে। শুরু হবে পিসিএলও। সবই আবার ঠিকঠাক। তাহলে যুদ্ধটা কেন হলো?
পৃথিবীর অন্য জায়গায় যুদ্ধ কেন হয়? ইউক্রেনের যুদ্ধে রুশরা ইউক্রেনের কিছু জায়গা দখল করতে চায়। কারণ, ওই জায়গাগুলোর অধিবাসীরা রুশ বংশোদ্ভূত। ইসরায়েল ফিলিস্তিনের জায়গা দখল করতে যুদ্ধ করে; কারণ, তাদের অনেক জায়গা দরকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ইহুদিদের তাদের ‘স্বপ্নের দেশ’ ইসরায়েলে স্থান দিতে।
ভারতের এই যুদ্ধে এসব জায়গাজমি দখলের ব্যাপার নেই। এবারের ভারত–পাকিস্তানের যুদ্ধটা হলো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘হিন্দু প্রাইডের’ যুদ্ধ। এর নাম নামও দেওয়া হয় ‘অপারেশন সিঁদুর’। শুরু হয়েছিল কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলাকে নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের নেতাদের বাগ্যুদ্ধ দিয়ে। এই কথার যুদ্ধ দিয়ে ব্যাপারটা চাপা দেওয়া যেত।
কিন্তু মোদির ওপর পাকিস্তানের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো থেকে চরম চাপ শুরু হলো। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উগ্র হিন্দু জাতীয়বাদী আদর্শ সামনে রেখে রাজনীতি করেন এবং হিন্দু ভোটারদের কড়া সমর্থন নিয়ে বারবার প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। কাশ্মীরের এই হামলার জবাব না দিলে তাঁর ভোট ব্যাংকে ধস নামবে। তাই তিনি জেনারেলদের নির্দেশ দিলেন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে। মোদ্দাকথা, পাকিস্তানকে শাস্তি দিয়ে মোদির ‘হিন্দু প্রাইড’ ও হিন্দু ভোট ব্যাংক টিকিয়ে রাখাই ছিল এ যুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য।
সব মিলিয়ে দেখা যাবে মোদির ‘হিন্দু প্রাইডের’ যুদ্ধ মোদির জন্য সম্ভবত হিতে বিপরীত হলো।পাকিস্তানও আঁচ করে নিয়েছিল যে ভারতীয় হামলা আসছে। ভারতের সঙ্গে যেকোনো সংঘাত মোকাবিলা করতে পাকিস্তানি জেনারেলরা মোটামুটি সব সময় প্রস্তুত থাকেন। আসলে এটাই পাকিস্তানের জাতীয় আকাঙ্ক্ষার একটা মূল স্তম্ভ। জন্মের পর থেকেই এই ‘ভারত জুজু’র ভয় দেখিয়ে পাকিস্তানি জেনারেলরা কখনো সামরিক শাসন দিয়ে, কখনো বেসামরিক প্রক্সি দিয়ে দেশ শাসন করছেন। যেহেতু ভারতের সঙ্গে বেশির ভাগ সংঘর্ষই কাশ্মীরকে ঘিরে, একে জেনারেলদের ‘কাশ্মীর কার্ড’ নাম অভিহিত করা হয়। পাকিস্তানি জেনারেলদের ‘কাশ্মীর কার্ড’ আর মোদির ‘হিন্দু প্রাইড’ হয়েছিল মুখোমুখি।
যুদ্ধটা ভারত বলেকয়েই শুরু করেছে। যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি দেখে অনেকেই প্রশ্ন করছেন, ভারত যুদ্ধে যাওয়ার আগে তাদের ‘হোম ওয়ার্ক’ কি ঠিকমতো করেছে? যুদ্ধ ভারতীয়রা যে রকম চেয়েছিল, সে রকম কি হয়েছে? নাকি এই যুদ্ধ মোদির জন্য হিতে বিপরীত হলো?
যুদ্ধের শুরুতেই আধা ঘণ্টার মধ্যেই ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তর কয়েকটা ‘কাশ্মীরি ট্রেনিং ক্যাম্প’ ধ্বংস করে। ভারত দাবি করে আসছে, এগুলো থেকেই কাশ্মীরে হামলাকারীদের ট্রেনিং দেওয়া হয়। পাকিস্তান যদি চুপচাপ প্রাথমিক হামলা হজম করে নিত, তাহলে যুদ্ধটা হয়তো তখনই থেমে যেত। আর মোদি তাঁর লোকদের অপারেশন সিঁদুরের সাফল্য দেখিয়ে, ‘হিন্দু প্রাইড’ পুনরুদ্ধার করতে পারতেন। কিন্তু পাকিস্তান তাদের জাতীয় অহংকার বিসর্জন দেবে কেন?
পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সমানতালে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে গেছে। যুদ্ধের প্রথম পর্বটা দুই পক্ষেই সীমাবদ্ধ ছিল মোটামুটি বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুকে ঘিরে। যদিও যুদ্ধবিমান, ড্রোন ও মিসাইল—সবই ব্যবহার করা হয়েছে।
রয়টারের খবরে বলা হয়েছে, পাকিস্তান বিমানযুদ্ধে ছিল এগিয়ে, ভারতের কমপক্ষে দুটি ফ্রান্স নির্মিত সর্বাধুনিক রাফাল যুদ্ধবিমানকে পাকিস্তান ভূপাতিত করেছে তাদের চীনে নির্মিত অত্যাধুনিক জে-১০সি ফাইটার বিমানের সাহায্যে। এই প্রথম কোনো যুদ্ধে চীনা জে-১০সি ব্যবহার করা হলো। চীন এই যুদ্ধে তাই অনেক লাভবান।
ড্রোনযুদ্ধে দুই দেশই সমানতালে ছিল। ভারতের আছে ইসরায়েলে তৈরি ড্রোন। পাকিস্তানের তুরস্কের তৈরি। মিসাইল দুই দেশ নিজেরাই তৈরি করছে। তা সমানতালে ব্যবহার করা হয়েছে।
কলকাতার বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা জম্মুতে মিসাইল হামলার বিবরণ দিয়েছে এভাবে, ‘জম্মুর আকাশে উড়ে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে লাল বল, বিয়ের রোশনাই নাকি? সংবিত ফিরল হ্যাঁচকা টানে, ওগুলো সব মিসাইল!’ দুই দেশের ১৯৬৫ সালের ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ মূলত ছিল একে অন্যের জায়গা দখল করার যুদ্ধ। এবার জায়গা নিয়ে যুদ্ধ হয়নি। তাই ট্যাংক ব্যবহার করা হয়নি তেমন।
যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ে পাকিস্তান ও ভারত দুই পক্ষই একে অপরের সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলোয় হামলা করে। তখনই আশা করা হচ্ছিল, বিশ্বের মুরব্বিরা এই যুদ্ধ আরও বিস্তৃত হওয়ার আগেই পারমাণবিক অস্ত্রধারী এ দুই দেশ যুদ্ধ থামাবে। হলোও তা–ই।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গতকাল শনিবার ঘোষণা দিয়েছেন, ‘সারা রাত ধরে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার ফলে’ ভারত ও পাকিস্তান অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজি হয়েছে। পাকিস্তান ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ঘোষণায়ও যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়েছে। যুদ্ধ থেমে যাবে। শুরু হবে জয়-পরাজয়ের হিসাব।
ভারতীয় বিরোধী দল যুদ্ধের সময় চুপচাপ থেকে সমর্থন জানিয়ে আসছিল। এখন প্রশ্ন উঠবে, এ যুদ্ধে ভারত কী পেল? যেভাবে ভারতীয় হামলার জবাব দিয়েছে, তাতে পাকিস্তান এই যুদ্ধ থেকে ভারতের চেয়েও বেশি সমীহ আদায় করে নিয়েছে, তা বলে দেওয়া যায়। কিন্তু এখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘হিন্দু প্রাইডের’ কী হবে? মোদি বোধ হয় এই যুদ্ধ লাগিয়ে তাঁর ও ভারতের সম্মানের অনেক ক্ষতি করেছেন। এমনিতে মোদির দলের লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই।
বিজেপি বিহারের নীতীশ কুমারের জনতা পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন করে সরকার বাঁচিয়ে রেখেছে। গত নির্বাচনে মোদির দল অনেক আসন হারিয়েছিল। এবার এই যুদ্ধের পর মোদির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। যুদ্ধের লাভ-ক্ষতি আর মোদির নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধী দল, এমনকি হিন্দুত্ববাদী দলগুলো থেকেও প্রশ্ন আসবে। অনেকেই বলবেন, মোদির রাজনীতির শেষের বোধ হয় এবার শুরু হবে।
সব মিলিয়ে দেখা যাবে মোদির ‘হিন্দু প্রাইডের’ যুদ্ধ মোদির জন্য সম্ভবত হিতে বিপরীত হলো।
সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর এই য দ ধ র জন য র জন ত
এছাড়াও পড়ুন:
গণসার্বভৌমত্ব ও গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ কেন জরুরি
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ ২০২৫’ শিরোনামে একটি খসড়া আইন নিয়ে আলোচনা শুরু করছে। আমরা সরকারকে সাধুবাদ জানাই। কারণ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম এবং শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল নাগরিকদের ‘গুম’ (এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স) করার বিরুদ্ধে লড়াই। মানবিক অধিকার লঙ্ঘনের ক্রূর অভিজ্ঞতাই মূলত জনগণকে গণ-অভ্যুত্থানের শামিল হতে এবং অকাতরে প্রাণ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। বিভিন্ন দাবি আদায়ে এখনো তাদের বিক্ষোভ ও রাজপথে আন্দোলন করতে হচ্ছে।
কিন্তু ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও গণদাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে গণ-অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক ও আইনি মর্ম বুঝতে হবে। এই ক্ষেত্রে গণ-আন্দোলনের মারাত্মক ঘাটতি আছে। যার ফলে জনগণের তরফ থেকে কী ধরনের ঘোষণা বা দাবি আমাদের একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়ন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের দিকে নিয়ে যেতে পারে, তার রণনীতি ও রণকৌশল সম্পর্কে ছাত্র-তরুণেরা এখনো অতিশয় অস্পষ্ট। ছাত্র-তরুণদের আত্মত্যাগ সে কারণে ইতিবাচক সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। পড়াশোনা, বিশেষত বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে তাঁদের আগ্রহ দুঃখজনকভাবে কম। তাই আমরা এখনো পরিষ্কার বুঝতে পারছি না যে আমাদের লড়াই বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
এই বিষয়গুলো আমাদের ভালোভাবে বুঝতে হবে। জনগণকে দমন-পীড়ন করা, আইনবহির্ভূত হত্যা ও গুমের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী লড়াইয়ের মর্ম না বুঝলে আমরা আমাদের বাস্তবসম্মত কর্তব্যগুলো সঠিকভাবে ধরতে পারব না। ইউরোপে ১৬৪৮ সালে স্বাক্ষর করা ওয়েস্টফিলীয় চুক্তির জেরে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র নিজে সার্বভৌম। মানুষ সেখানে সার্বভৌম নয়। আমরা এখনো পুরোনো সেই ওয়েস্টফিলীয় রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের বিপরীতে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা বা গণ-সার্বভৌমত্বের (পপুলার সভরেন্টি) ধারণা সম্পর্কে কিছুই প্রায় জানি না।
জনগণকে দমন-পীড়ন, আইনবহির্ভূত হত্যা ও গুমের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী লড়াই চলছে। এই লড়াইয়ের প্রধান মর্ম হচ্ছে তথাকথিত রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে জনগণের সার্বভৌম সামষ্টিক কর্তাসত্তার প্রতিষ্ঠা, যা একই সঙ্গে গণতন্ত্রেরও মর্ম; অর্থাৎ গণতন্ত্র হচ্ছে এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে তথাকথিত ‘রাষ্ট্র’ নয়; বরং জনগণই রাষ্ট্রের সব নীতি প্রণয়ন, প্রশাসনিক পরিচালনাসহ সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী।
জনগণের ক্ষমতার বিপরীতে রয়েছে রাষ্ট্রের নামে সামরিক-বেসামরিক আমলা, রাষ্ট্রের নামেই গড়ে ওঠা নানা পরজীবী প্রতিষ্ঠান, লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণির করপোরেট ক্ষমতা, নানা কিসিমের গণবিরোধী রাজনৈতিক দল ইত্যাদি। অথচ ক্ষমতাকে হতে হবে জনগণের ক্ষমতা। যার দ্বারা ব্যক্তির অধিকার ও ব্যক্তির মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং সেই অধিকার ও মর্যাদা সামষ্টিক গণরাজনৈতিক শক্তির বলে টিকিয়ে রাখাই গণতন্ত্রের কাজ। এ ছাড়া গণতন্ত্র কায়েম অসম্ভব।
সেই ক্ষেত্রে নাগরিকদের ‘গুম’ করা চরম গণবিরোধী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের অতি কুৎসিত ও দৃশ্যমান উপদংশ। যে কারণে মানবাধিকার রক্ষার বিবিধ আন্তর্জাতিক আইন থাকা সত্ত্বেও জাতিসংঘ আলাদা করে গুমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ ঘোষণা করেছে। তথাকথিত রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের বিপরীতে জনগণের সামষ্টিক গণতান্ত্রিক অভিপ্রায়ের মর্ম বুঝতে হবে। আর এর জন্য সারা দুনিয়ার নিপীড়িত মজলুম জনগণের লড়াইয়ের ফসল হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স (আইসিপিপিইডি) সনদটি আমাদের পাঠ ও পর্যালোচনা করা অত্যন্ত জরুরি। গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক ২০০৬ সালে সনদটিও গৃহীত হয় ২০১০ সালে সনদটি বলবৎ হয়। এটা বিশ্বব্যাপী গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের লড়াইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। বাংলাদেশ ২০২৪ সালের ২৯ আগস্ট সনদটি স্বাক্ষর করেছে।
আন্তর্জাতিক সনদ হিসেবে আইসিপিপিইডি এর সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এর ইতিবাচক তাৎপর্য এবং সীমাবদ্ধতা বুঝতে হলে গণসার্বভৌমত্বের (পপুলার সভরেনটি) আলোকে সনদটি পর্যালোচনা করতে হবে। তা ছাড়া এর মর্ম বুঝতে এবং বাংলাদেশে তা প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে আমরা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর কতটা প্রস্তুত? কীভাবে ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর খসড়া তৈরির ক্ষেত্রে আইসিপিপিইডিকে আমরা কাজে লাগাব, সেটা বোঝার জন্য গণসার্বভৌমত্বের আলোকে এই আন্তর্জাতিক সনদের একটি পর্যালোচনা এখানে পেশ করছি।
আমরা প্রশ্ন করতে পারি, আইসিপিপিইডি সনদটি কি জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার ধারণাকে কেন্দ্র করে গঠিত, নাকি এটি রাষ্ট্রকেন্দ্রিক মানবাধিকারের সুরক্ষার একটি চুক্তিমাত্র?
আইসিপিপিইডির মৌলিক নীতিমালা পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে আমরা তা অনুধাবনের চেষ্টা করতে পারি।
১. এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সের সংজ্ঞা (আর্টিকেল ২): ‘ ...বাই এজেন্টস অব দ্য স্টেট অর বাই পারসন্স অ্যাক্টিং উইথ দ্য অথরাইজেশন, সাপোর্ট অর অ্যাকুয়েসেন্স অব দ্য স্টেট...’; অর্থাৎ এই সনদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারকে গুমের অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে। এটি জনগণের নিরাপত্তাকে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার বিরুদ্ধে রক্ষার চেষ্টা করে।
২. অস্বীকার ও তথ্য গোপনের বিরুদ্ধে অধিকার (আর্টিকেল ১৮, ২০): আন্তর্জাতিক সনদে পরিবারের সদস্যদের ডিটেইনির অবস্থান সম্পর্কে তথ্য জানার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এটি একটি নাগরিক-কেন্দ্রিক (পিপল-সেন্টার্ড) দৃষ্টিভঙ্গি।
৩. প্রতিরোধের সাংগঠনিক কাঠামো (আর্টিকেল ২৩): আন্তর্জাতিক সনদে রাষ্ট্রকে এমন আইন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে, যা গুমের পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধ করবে।
৪. ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন (আর্টিকেল ১৫-১৬): গুমের মতো অপরাধকে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে, বহুরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ও বিচারব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে।
গণসার্বভৌমত্বের আলোকে যদি আন্তর্জাতিক সনদের ধারাগুলো আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে আইসিপিপিইডি গণসার্বভৌমত্বের ধারণাকে ধারণ করে।
ক. আইসিপিপিইডি রাষ্ট্রের ক্ষমতার সীমারেখা নির্ধারণ করে। এর দ্বারা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব-সংক্রান্ত প্রচলিত ধারণার বিপরীতে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতাকে সামনে আনে। সনদটি মূলত রাষ্ট্রকে দায়বদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত রাখার একটি ব্যবস্থা, যেন রাষ্ট্র জনগণের ওপরে নয়; বরং জনগণের অধীনে জনগণের পক্ষের ক্ষমতা হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে।
খ. জনগণের জানার ও প্রতিবাদের অধিকার আইসিপিপিইডিতে স্বীকৃত। পরিবার, নাগরিক সমাজ ও আইনি প্রতিনিধিদের অধিকার ও তথ্যপ্রাপ্তি সনদে নিশ্চিত করা হয়েছে, যা গণনিয়ন্ত্রণমূলক চিন্তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
গ. সনদটি আন্তর্জাতিক স্তরে জনগণের পক্ষ থেকে ন্যায়সংগত দাবি উত্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছে। সনদ অনুযায়ী ভুক্তভোগীরা জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ বা অপর আন্তর্জাতিক ফোরামে অভিযোগ জানাতে পারেন। এটি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের একটি রূপ। যার চর্চার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় গণসার্বভৌমত্বের ধরন কী হতে পারে, তা আমরা স্পষ্ট করে তুলতে পারি। কিন্তু আইসিপিপিইডির কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে, যা গণসার্বভৌমত্বকে সীমিত করে। এই সীমাবদ্ধতাগুলোর দিকে তাকানো যাক।
ক. এখনো রাষ্ট্রই প্রধান কর্তা, জনগণ নয়। যদিও সনদটি রাষ্ট্রকে গুরুত্বপূর্ণ বাধ্যবাধকতার অধীনস্থ করে; তবু আইন প্রণয়ন, প্রয়োগ ও প্রতিকারব্যবস্থায় জনগণের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ বা অংশগ্রহণের কথা বলা হয়নি; অর্থাৎ সনদটি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ নয়; বরং রাষ্ট্রের ওপর ‘নৈতিক নিয়ন্ত্রণ’ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী।
খ. প্রচলিত ওয়েস্টফিলিয়ান সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই ন্যায়ের সন্ধান করা হয়েছে। ভুক্তভোগীর বিচার পাওয়ার পথটি রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। এতে জনগণের প্রতিরোধ বা গণ-আন্দোলনের ক্ষমতা স্বীকৃত নয়।
গ. আন্তর্জাতিক সনদে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুমের পরিপ্রেক্ষিত উপেক্ষিত। গুমকে প্রায়ই ‘আইনি’ এবং ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ হিসেবে দেখা হয়েছে, কিন্তু এর রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত, যেমন গণ-আন্দোলন দমন, জাতিগোষ্ঠী নিধন, শাসকগোষ্ঠীর কর্তৃত্ব বজায় রাখার প্রকল্প অনুপস্থিত।
সংক্ষেপে বলা যায়, আইসিপিপিইডি আংশিকভাবে গণসার্বভৌমত্ব ধারণাকে ধারণ করে, বিশেষত যেখানে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার বিরুদ্ধে জনগণের তথ্য, সুরক্ষা ও বিচার চাওয়ার অধিকারের স্বীকৃতি আছে। তবে এটি মূলত একটি রাষ্ট্রকেন্দ্রিক মানবাধিকার প্রতিরক্ষাকাঠামো। এই কাঠামো গণতন্ত্র বা জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে (কনস্টিটিউয়েন্ট পাওয়ার) কেন্দ্র করে কাজ করে না। এটি বরং রাষ্ট্রীয় শাসনকে নৈতিকভাবে পরিশুদ্ধ করার প্রচেষ্টামাত্র।
অতএব গণসার্বভৌমত্বের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য আইসিপিপিইডির পাশাপাশি যা প্রয়োজন তা হলো:
১. জনগণের নেতৃত্বে সত্য নির্ণয় ও ইনসাফ কায়েম কমিশন
২. জনগণের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন ন্যায়বিচার ফোরাম (ট্রানজিশনাল জাস্টিস ফোরাম)
৩. আইন প্রণয়নে সরাসরি গণ-অংশগ্রহণ এবং রাষ্ট্রের বাইরে থেকেও গণতান্ত্রিক ন্যায়বিচারের ক্ষমতা নির্মাণ।
ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে অবিলম্বে ‘গুম প্রতিরোধ ও গণসুরক্ষার ঘোষণা’ হাজির করা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রস্তাবিত ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর খসড়া গণসার্বভৌমত্বের আলোকেই আমাদের পর্যালোচনা করতে হবে।
ফরহাদ মজহার কবি ও চিন্তক
(মতামত লেখকের নিজস্ব)