অনেকেই ভেবেছিল রাশিয়ার ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিজয় দিবস’–এর কুচকাওয়াজে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং যোগ দেওয়ায় হয়তো তিনি এবার পুতিনকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বলবেন। এতে অনেকের মনে আশা জেগেছিল, সম্ভবত চীন এবার শান্তির পক্ষে কাজ করবে। কিন্তু বাস্তবে রাশিয়া যখন ইউক্রেনে আক্রমণ চালিয়ে তিন বছর পার করেছে, তখনো চীনের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট উদ্যোগ দেখা যায়নি যে তারা সত্যি যুদ্ধ থামাতে চায় বা শান্তি আলোচনায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে চায়।

এর বদলে চীন বরং রাশিয়াকে রাজনৈতিক (কূটনৈতিক), অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। চীন কখনোই এই যুদ্ধকে ‘আগ্রাসন’ বলে স্বীকার করেনি, অর্থাৎ তারা কখনো বলেনি যে রাশিয়া অন্য দেশের ওপর অন্যায়ভাবে হামলা চালিয়েছে।

এমনকি রাশিয়া ইউক্রেনের কিছু অংশ দখল করে নেওয়ার পরও চীন তা সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। জাতিসংঘে যখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব উঠেছে, তখন চীন ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। মানে তারা রাশিয়ার বিপক্ষে কোনো অবস্থান নেয়নি।

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এখন পর্যন্ত একবারও বলেননি বা কোনো ইঙ্গিত দেননি যে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে ভাবতে চান বা যুদ্ধ নিয়ে চিন্তিত। বরং তাঁর ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সম্পর্ক আগের চেয়ে আরও গভীর হয়েছে। গত তিন বছরে তাঁরা নয়বার মুখোমুখি দেখা করেছেন।

২০২৫ সালে যখন ট্রাম্প আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হলেন, তখন সি ও পুতিন একসঙ্গে জানিয়ে দেন, তাঁরা একে অন্যকে আরও জোরালোভাবে সমর্থন করবেন, একসঙ্গে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করবেন এবং কৌশলগতভাবে আরও ঘনিষ্ঠ হবেন।

অর্থনৈতিকভাবে চীন রাশিয়াকে টিকিয়ে রেখেছে। যখন পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তখন চীন রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা আরও বাড়িয়েছে। ২০২১ সালে যেখানে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ছিল ১৪৭ বিলিয়ন ডলার, ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪৫ বিলিয়ন ডলারে।

যখন পশ্চিমা কোম্পানিগুলো রাশিয়া থেকে চলে যাচ্ছে, তখন চীনা কোম্পানির গাড়ি, মুঠোফোন ইত্যাদি রাশিয়ার বাজার দখল করছে। ২০২৩ সালের শুরুতেই দেখা যায়, রাশিয়ার বাজারে ৭০ শতাংশ মুঠোফোন ছিল চীনের তৈরি।

চীন রাশিয়ার কাছ থেকে তেল-গ্যাসও বেশি করে কিনছে, (যদিও অনেক ছাড়ে) যাতে পুতিন সেই টাকায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারেন। ২০২৩ সাল থেকে চীন রাশিয়ার সবচেয়ে বড় তেল ক্রেতা হয়ে উঠেছে। অনেক ব্যাংক নিষেধাজ্ঞার ভয়ে রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেন বন্ধ করে দিলেও চীনের ছোট আঞ্চলিক ব্যাংকগুলো এখনো রাশিয়ার জন্য লেনদেন চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও চীন সরাসরি যুদ্ধের জন্য কোনো মারাত্মক অস্ত্র দেয়নি, তারা মাইক্রোচিপের মতো এমন সব যন্ত্রাংশ বা যন্ত্রপাতি দিয়েছে, যেগুলো অস্ত্র তৈরিতে কাজে লাগে।

এ অবস্থায় চীন আবার নিজেকে ‘শান্তির দূত’ হিসেবে দেখাতে চায়। ২০২৩ সালে তারা একটি শান্তির পরিকল্পনা দেয়, আর ২০২৪ সালে ব্রাজিলের সঙ্গে মিলে ছয়টি প্রস্তাব দেয় যুদ্ধ থামানোর জন্য। এরপর চীনের এক বিশেষ দূত ইউক্রেন ও রাশিয়া সফর করেছেন। কিন্তু এসব পরিকল্পনা শুধু কাগজে–কলমে।

মুখে অনেক সুন্দর কথা থাকলেও বাস্তবে চীনের কোনো পদক্ষেপ নেই। চীনের মূল উদ্দেশ্য আসলে যুদ্ধ থামানো নয়; তারা শুধু চায় গ্লোবাল সাউথ (বৈশ্বিক দক্ষিণের উন্নয়নশীল দেশগুলো) এবং ইউরোপে তাদের ভাবমূর্তি ভালো দেখাক। অর্থাৎ তারা যেন শান্তিপ্রিয় ও দায়িত্বশীল শক্তি বলে পরিচিত হয়।

চীন চায় না ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ দ্রুত শেষ হোক। এটি একেবারে অস্বাভাবিক নয়। কারণ, যুদ্ধ যতক্ষণ ইউক্রেনের সীমার মধ্যে থাকে, পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি না থাকে, আর রাশিয়া যতক্ষণ পুরোপুরি হার না মানে, ততক্ষণ চীনের জন্য এটি কৌশলগতভাবে লাভজনক।

যুদ্ধ চলায় যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ নিয়ে বেশি ব্যস্ত। ফলে এশিয়ায়, বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন অনেক বেশি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে। একই সঙ্গে রাশিয়া এখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে চীনের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এতে চীন রাশিয়ার সম্পদ আরও সহজে এবং এমন রুট দিয়ে পাচ্ছে, যেগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নেই।

চীনের কিছু বড় ড্রোন নির্মাতা কোম্পানি (যেমন ডিজেআই, ইহ্যাং, অটেল) এই যুদ্ধ থেকে সরাসরি আর্থিক লাভ করছে। তারা ড্রোন ইউক্রেন ও রাশিয়া—উভয়ের কাছে বিক্রি করেছে। ২০২৩ সালে চীনের কাছ থেকে ইউক্রেন দুই লাখ ডলারের ড্রোন কিনেছে, আর রাশিয়া কিনেছে প্রায় দেড় কোটি ডলারের ড্রোন। এই ড্রোনগুলো সরাসরি না পাঠিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও ছোট ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও চীন ফাঁক গলে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

এখন যদি ধরেও নিই যে চীন সত্যিই যুদ্ধ থামাতে চায়, তবু ইউক্রেন কখনোই চীনকে নিরপেক্ষ মনে করবে না। কারণ, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি অনেকবার অনুরোধ করলেও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তাঁর সঙ্গে দেখা করেননি।

২০২২ সালে ইউক্রেন নিজে একটি ১০ দফা শান্তি–পরিকল্পনা দিয়েছিল। কিন্তু চীন এতে আগ্রহ দেখায়নি। ২০২৪ সালে শান্তি নিয়ে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছিল, যেখানে ৯২টি দেশ অংশ নেয়, কিন্তু চীন সেখানে যায়নি; বরং তারা ব্রাজিলকে সঙ্গে মিলে আলাদা একটি প্রস্তাব দেয়। ইউক্রেন মনে করছে, তাদের প্রচেষ্টাকে দুর্বল করার চেষ্টা হিসেবেই চীন এই প্রস্তাব দিয়েছে।

থমাস গ্রাহাম কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের ডিস্টিংগুইশড ফেলো

ঝোংইউয়ান জো লিউ কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের চীনবিষয়ক সিনিয়র ফেলো

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ২০২৩ স ল প রস ত ব ইউক র ন র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

গাজায় নিহতের সংখ্যা ৫২ হাজার ৮০০ ছাড়াল

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহতের মোট সংখ্যা ৫২ হাজার ৮০০ ছাড়িয়ে গেছে। শনিবার (১০ মে) গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে। খবর তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলুর।

মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় ২৩ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১২৪ জন আহত হয়েছেন। এর ফলে গাজায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি হামলায় নিহত মোট ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৫২ হাজার ৮১০ জনে পৌঁছেছে। একইসঙ্গে অবরুদ্ধ নগরীতে আহতের সংখ্যা এখন ১ লাখ ১৯ হাজার ৪৭৩ জনে পৌঁছেছে।

মন্ত্রণালয় আরো জানিয়েছে, নিহত ও আহতের প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি। কারণ অনেক মানুষ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় পড়ে থাকলেও উদ্ধারকারীরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারেননি।

আরো পড়ুন:

গাজায় ওয়াশিংটনের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন প্রতিষ্ঠার আলোচনা শুরু

গাজা পুরোপুরি দখলের পরিকল্পনা অনুমোদন ইসরায়েলি মন্ত্রিসভার

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের দাবি, এই হামলায় প্রায় ১২০০ নিহত ও দুই শতাধিক ইসরায়েলিকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে গেছে হামাস যোদ্ধারা। এর জবাবে ওই দিনই গাজায় বিমান হামলা ও পরে স্থল অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। 

দীর্ঘ ১৫ মাস ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের পর যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় হামাস ও ইসরায়েল। তবে এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে গত ১৮ মার্চ থেকে গাজায় ফের তীব্র হামলা শুরু করে ইসরায়েল।

অব্যাহত হামলার পাশাপাশি ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় ব্যাপক অবরোধ আরোপ করেছে, যার ফলে এর জনসংখ্যা, বিশেষ করে উত্তর গাজার বাসিন্দারা দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।

জাতিসংঘ বলছে, ইসরায়েলের ব্যাপক সামরিক অভিযানের ফলে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং প্রায় ৮৫ শতাংশ জনসংখ্যা অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

জাতিসংঘের মতে, দীর্ঘ এ সময় ধরে চলা সংঘাতের কারণে মানবিক সংকটে দিন পার করছেন ফিলিস্তিনিরা। খাবার, পানি, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তার অভাবে উপত্যকাটির ২৩ লাখেরও বেশি বাসিন্দা চরম ক্ষুধা ও ভয়াবহ অপুষ্টিতে ভুগছেন।

গাজায় ইসরায়েলি হামলা নিহত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। জানুয়ারিতে একটি অন্তর্বর্তীকালীন রায়ে তেল আবিবকে গণহত্যা বন্ধ করতে এবং গাজার বেসামরিক নাগরিকদের মানবিক সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে রায় উপেক্ষা করে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুবাইদা রহমানের দুর্নীতির মামলায় সাজার বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি  
  • চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন প্রযোজনায় গুগলের নতুন উদ্যোগ
  • গাজায় নিহতের সংখ্যা ৫২ হাজার ৮০০ ছাড়াল