যে পথে পালিয়েছিলেন মোগল রাজপুত্র শাহ সুজা
Published: 14th, May 2025 GMT
মোগল সিংহাসনের দুর্ভাগা প্রার্থীদের একজন ছিলেন শাহ সুজা। সিংহাসন দখলের লড়াইয়ে ভাইদের রক্তাক্ত দ্বন্দ্বে পরাজিত হন তিনি। বাংলার সুবেদার, প্রভাবশালী এই শাসক যেন হঠাৎ পরিণত হন এক শরণার্থীতে, জীবন বাঁচাতে যাঁকে পালাতে হয়েছে। পলায়ন পথের গন্তব্য ছিল আরাকানের রাজধানী ম্রোহং। সুজার এই ম্রোহং যাত্রার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে চট্টগ্রাম।
সুজার আরাকান যাত্রা নিয়ে কিছু বিবরণ পাওয়া যায় ‘গেরিট ফন ফুরবুর্গ’ (Gerrit van Voorburg) নামের এক ব্যক্তির লেখা তিনটি চিঠিতে। আরাকানের ম্রোহংয়ে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘চিফ ফ্যাক্টর’ বা প্রধান বণিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। তখন ইন্দোনেশিয়ায় (বাটাভিয়া) অবস্থিত কোম্পানির সদর দপ্তরে ফুরবুর্গ তাঁর এসব চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ১৬৬০ সালের ৩ জুন আরাকানরাজের পাঠানো নৌবহরে ‘দেয়াং’ বন্দর এলাকায় পৌঁছান শাহ সুজা। দেয়াং এলাকাটি অবস্থিত চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে।
মনে রাখা ভালো, তখন দেয়াং তো বটেই, ফেনী নদীর সীমানা পর্যন্ত ছিল আরাকান রাজ্যের অন্তর্গত। ঐতিহাসিকেরা উল্লেখ করেছেন, এই সময়টাতে দেয়াং, চক্রশালা ও পেনুয়া—এই তিনটি বিভাগে বিভক্ত ছিল চট্টগ্রাম।
একটু আগে ফিরে যাক। রাজসিংহাসনের টানাপোড়েনের লড়াইয়ে চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করেছেন শাহ সুজা। সৈন্য পুনর্গঠনও তাঁর আর সম্ভব নয়। সুজা মনস্থির করেন এমন একটি নিরাপদ স্থানে পৌঁছাতে, যেখান থেকে তিনি মক্কা যেতে পারবেন। পরে সেখান থেকে পারস্য বা তুরস্কে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর। হুগলি নদীর তীরবর্তী বন্দরগুলো মীর জুমলার বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ। বর্ষা সন্নিকটে, যার কারণে ভারত মহাসাগর পাড়ি দিতেও করতে হবে অপেক্ষা। আরাকানরাজের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় নেই শাহ সুজার। সেটিই হলো। আরাকানরাজের পাঠানো নৌবহরে বর্তমান ভোলার কাছ থেকে নৌপথে আরাকানের উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয় তাঁর (মতান্তর রয়েছে)। ডাচ বণিকের চিঠির সূত্রে জানা যায়, দিনটি ছিল ৬ মে, ১৬৬০ সাল।
মোগল রাজপুত্র শাহ সুজাকে আরাকানে নিয়ে যেতে পাঠানো হয়েছিল পর্তুগিজ নাবিক। পরিবারের সদস্য, সঙ্গী-সাথি, দেহরক্ষীদের নিয়ে নৌপথে আরাকানের উদ্দেশে শাহ সুজার যাত্রা। ফুরভুর্গের চিঠি অনুযায়ী, পর্তুগিজ নাবিকেরা শাহ সুজার বিপুল ধনসম্পদ লুটে নেন। প্রায় ২৩ টন স্বর্ণমূল্যের গয়না, নগদ অর্থ ও স্বর্ণ লুট করা হয়। ‘ম্যানুয়েল কোয়েলহো’ নামের এক পর্তুগিজ এই লুণ্ঠনে নেতৃত্ব দেন বলে জানা যায় নিকোলো মানুচি নামের এক ভেনিসিয়ান পর্যটকের তথ্যে। মানুচি শাহ সুজার ভাই দারাশিকোর গোলন্দাজ বাহিনীতে চাকরি করেছেন।
শাহ সুজা যখন চট্টগ্রামে আসেন, তখন সত্যিকার অর্থেই দেয়াংয়ের আশপাশে জলদস্যুদের প্রচণ্ড উৎপাত। ফলে শাহ সুজাকে আরাকানে পৌঁছানোর দায়িত্বে থাকা পর্তুগিজ নাবিকেরা ধনসম্পদ লুট না করলেও নৌযান জলদস্যুদের কবলে পড়া তখনকার জন্য খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
যাই হোক, দক্ষ পর্তুগিজ নাবিকদের নৌপথে দিয়াং পৌঁছাতে বড়জোর দুই সপ্তাহ লাগার কথা। তবে এক মাস সময় লেগে যাওয়ায় ঐতিহাসিকদের অনেকেই মনে করেন, শাহ সুজা স্থলপথেই চট্টগ্রাম পৌঁছেছিলেন। যেহেতু পথে অনেক নদী পার হওয়ার প্রয়োজন ছিল, সেখানে হয়তো পর্তুগিজ নাবিকদের নৌকা ব্যবহার করেছেন।
বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস বলা হয় ‘রিয়াজ-উস-সালাতীন’কে। ফারসি ভাষায় লিখিত এই ইতিহাসগ্রন্থেও উল্লেখ করা হয়েছে, দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর ভ্রমণের পর ত্রিপুরার পাহাড় ধরে শাহ সুজা চট্টগ্রাম পৌঁছেছিলেন। এই মত পরবর্তী ঐতিহাসিকদের অনেকেই সমর্থন করেছেন। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ‘সুজানগর’ নামে একটি এলাকা রয়েছে। বলা হয়ে থাকে ত্রিপুরার উদয়পুর থেকে ফটিকছড়ি হয়ে যাওয়ার সময় যে যে স্থানটিতে সুজা যাত্রাবিরতি দিয়েছিলেন, সেটিই পরে সুজানগর নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। তবে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নৌপথে শাহ সুজার চট্টগ্রামে পৌঁছানোর পক্ষে যাঁরা, তাঁদের অনেকরই মত সম্ভবত শাহ সুজার সঙ্গীদের একটি অংশ স্থলপথে চট্টগ্রামে গেছে।
পথ নিয়ে যত ভিন্নতাই থাকুক, ডগ-রেজিস্টারে সংরক্ষিত ডাচ বণিকের চিঠি, ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ার-মানুচির মতো ভ্রমণকারীদের তথ্যসহ সমসাময়িক সব সূত্রেই নিশ্চিত হওয়া যায় শাহ সুজার চট্টগ্রামে অবস্থানের কথা। সুজা চট্টগ্রাম থেকে যে স্থলপথ ধরে ম্রোহং যান, সেই পথটিও পরে সুজা সড়ক নামে পরে পরিচিত হয়ে ওঠে। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, কক্সবাজারের ডুলাহাজারা-ঈদগাঁওসহ বিভিন্ন অঞ্চলের নামকরণের সঙ্গেও সুজার যাত্রা জড়িয়ে আছে বলে মনে করা হয়। ঈদগাঁও নিয়ে বলা হয়, যাত্রাপথে সুজা নিজের সৈন্যসামন্তসহ এলাকাটিতে ঈদের নামাজ আদায় করেন। যার কারণে ‘নয়াবাদ’ নামের এলাকাটি পরে ঈদগাঁও নামে পরিচিত হয়েছে। একইভাবে লোহার খুঁটি গেড়ে যাওয়ায় লোহাগাড়া এবং হাজারো ঢুলি বা পালকি নিয়ে অবস্থানের কারণে ডুলাহাজারা নামটি এসেছে বলে ধারণা করা হয়। যাই হোক, পরিবার, সঙ্গী-সাথিদের নিয়ে নাফ নদী পেরিয়ে ১৬৬০ সালের ২৬ আগস্ট সুজা ম্রোহং পৌঁছাতে সমর্থ হন। তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন আরাকানরাজ সান্দা থু ধম্মা (শ্রীচন্দ্র সুধর্মা)।
চট্টগ্রামে শাহ সুজার অবস্থানকালে তাঁর কার্যক্রম নিয়ে ঐতিহাসিক সূত্রে খুব বেশি জানা যায় না। তবে স্থানীয় ঐতিহ্য এবং লোককাহিনিতে কিছু তথ্য মেলে। ১৯৩২ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় দীনেশচন্দ্র সেনের সম্পাদনায় ‘পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা’–এর চতুর্থ খণ্ডের দ্বিতীয় সংখ্যা। এতে সংকলিত হয় ‘পরীবানুর হাঁহলা’ নামে একটি পালা। শাহ সুজা চট্টগ্রামে পীর বদরের দরগায় গিয়েছিলেন—এমন কথা এই পালায় রয়েছে। সোনাদানা দান করার বিবরণও পাওয়া যায় পালাটিতে, ‘চাডিগাঁতে আসি তারা বদরের মোকাম/ বহুত খরাত দিলা সোনা ভরী ভরী রে’।
তখন চট্টগ্রাম আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও ধারণা করা হয়, মীর জুমলার বাহিনীর ধাওয়াসহ নানা কারণে নিরাপত্তা শঙ্কায় শাহ সুজা চট্টগ্রাম ছেড়ে ম্রোহংয়ে অবস্থান করতে মনস্থির করেন। এই শঙ্কার কিছুটা ইঙ্গিত মেলে পরীবানুর হাঁহলাতে, ‘নসীবের লেখা কভু না যায় খণ্ডন/ চাডিগাঁ ছাড়িতে বাদসা করিল মনন/ দহিন মিক্যা আইল তারা হাতীর উয়র চড়িরে’।
পালাটির সূত্র ধরে জানা যায়, চট্টগ্রাম থেকে যাত্রার ১৩ দিন, ১৩ রাত পার হয়ে শাহ সুজার সামনে পড়ে বিশাল দরিয়া (সম্ভবত নাফ নদী)। সেখানে তিন দিন অবস্থানের পর ‘রোসাং’ (ম্রোহং) যান সুজা।
‘আরাকান রাজসভায়’ রচিত অনেক বাংলা কাব্যেই সুজার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। মহাকবি আলাওলের ‘সয়ফল মুলুক বদিউজ্জামাল’-এর দ্বিতীয় ভূমিকায় এসেছে সুজা প্রসঙ্গ, ‘তার পাছে সাহ সুজা নৃপ-কুলেশ্বর/ দৈব পরিপাকে আইল রোসাঙ্গ শহর/.
আরাকান থেকে আর মক্কায় যেতে পারেননি শাহ সুজা। আরাকানে তাঁর মৃত্যুর ঘটনাও এখনো রহস্যময়। এ বিষয়ে প্রচলিত মতের একটি হলো, কন্যাকে আরাকানরাজের বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন সুজা। সে কারণেই সুজাকে পরিবারসহ হত্যা করা হয়েছে। প্রচলিত এই মত এতটাই প্রবল যে এর ওপর ভিত্তি করে অনেক লোককাহিনি, কাব্য, গল্প তৈরি হয়ে আসছে। তবে সুজার মৃত্যুর নেপথ্যে কি সত্যিই এই ঘটনা, নাকি রয়েছে অন্য কোনো রাজনৈতিক কারণ, তা এখনো রয়ে গেছে ধোঁয়াশাপূর্ণ।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ত গ জ ন ব ক আর ক ন র অবস থ ন কর ছ ন উল ল খ
এছাড়াও পড়ুন:
যে পথে পালিয়েছিলেন মোগল রাজপুত্র শাহ সুজা
মোগল সিংহাসনের দুর্ভাগা প্রার্থীদের একজন ছিলেন শাহ সুজা। সিংহাসন দখলের লড়াইয়ে ভাইদের রক্তাক্ত দ্বন্দ্বে পরাজিত হন তিনি। বাংলার সুবেদার, প্রভাবশালী এই শাসক যেন হঠাৎ পরিণত হন এক শরণার্থীতে, জীবন বাঁচাতে যাঁকে পালাতে হয়েছে। পলায়ন পথের গন্তব্য ছিল আরাকানের রাজধানী ম্রোহং। সুজার এই ম্রোহং যাত্রার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে চট্টগ্রাম।
সুজার আরাকান যাত্রা নিয়ে কিছু বিবরণ পাওয়া যায় ‘গেরিট ফন ফুরবুর্গ’ (Gerrit van Voorburg) নামের এক ব্যক্তির লেখা তিনটি চিঠিতে। আরাকানের ম্রোহংয়ে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘চিফ ফ্যাক্টর’ বা প্রধান বণিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। তখন ইন্দোনেশিয়ায় (বাটাভিয়া) অবস্থিত কোম্পানির সদর দপ্তরে ফুরবুর্গ তাঁর এসব চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ১৬৬০ সালের ৩ জুন আরাকানরাজের পাঠানো নৌবহরে ‘দেয়াং’ বন্দর এলাকায় পৌঁছান শাহ সুজা। দেয়াং এলাকাটি অবস্থিত চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে।
মনে রাখা ভালো, তখন দেয়াং তো বটেই, ফেনী নদীর সীমানা পর্যন্ত ছিল আরাকান রাজ্যের অন্তর্গত। ঐতিহাসিকেরা উল্লেখ করেছেন, এই সময়টাতে দেয়াং, চক্রশালা ও পেনুয়া—এই তিনটি বিভাগে বিভক্ত ছিল চট্টগ্রাম।
একটু আগে ফিরে যাক। রাজসিংহাসনের টানাপোড়েনের লড়াইয়ে চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করেছেন শাহ সুজা। সৈন্য পুনর্গঠনও তাঁর আর সম্ভব নয়। সুজা মনস্থির করেন এমন একটি নিরাপদ স্থানে পৌঁছাতে, যেখান থেকে তিনি মক্কা যেতে পারবেন। পরে সেখান থেকে পারস্য বা তুরস্কে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর। হুগলি নদীর তীরবর্তী বন্দরগুলো মীর জুমলার বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ। বর্ষা সন্নিকটে, যার কারণে ভারত মহাসাগর পাড়ি দিতেও করতে হবে অপেক্ষা। আরাকানরাজের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় নেই শাহ সুজার। সেটিই হলো। আরাকানরাজের পাঠানো নৌবহরে বর্তমান ভোলার কাছ থেকে নৌপথে আরাকানের উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয় তাঁর (মতান্তর রয়েছে)। ডাচ বণিকের চিঠির সূত্রে জানা যায়, দিনটি ছিল ৬ মে, ১৬৬০ সাল।
মোগল রাজপুত্র শাহ সুজাকে আরাকানে নিয়ে যেতে পাঠানো হয়েছিল পর্তুগিজ নাবিক। পরিবারের সদস্য, সঙ্গী-সাথি, দেহরক্ষীদের নিয়ে নৌপথে আরাকানের উদ্দেশে শাহ সুজার যাত্রা। ফুরভুর্গের চিঠি অনুযায়ী, পর্তুগিজ নাবিকেরা শাহ সুজার বিপুল ধনসম্পদ লুটে নেন। প্রায় ২৩ টন স্বর্ণমূল্যের গয়না, নগদ অর্থ ও স্বর্ণ লুট করা হয়। ‘ম্যানুয়েল কোয়েলহো’ নামের এক পর্তুগিজ এই লুণ্ঠনে নেতৃত্ব দেন বলে জানা যায় নিকোলো মানুচি নামের এক ভেনিসিয়ান পর্যটকের তথ্যে। মানুচি শাহ সুজার ভাই দারাশিকোর গোলন্দাজ বাহিনীতে চাকরি করেছেন।
শাহ সুজা যখন চট্টগ্রামে আসেন, তখন সত্যিকার অর্থেই দেয়াংয়ের আশপাশে জলদস্যুদের প্রচণ্ড উৎপাত। ফলে শাহ সুজাকে আরাকানে পৌঁছানোর দায়িত্বে থাকা পর্তুগিজ নাবিকেরা ধনসম্পদ লুট না করলেও নৌযান জলদস্যুদের কবলে পড়া তখনকার জন্য খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
যাই হোক, দক্ষ পর্তুগিজ নাবিকদের নৌপথে দিয়াং পৌঁছাতে বড়জোর দুই সপ্তাহ লাগার কথা। তবে এক মাস সময় লেগে যাওয়ায় ঐতিহাসিকদের অনেকেই মনে করেন, শাহ সুজা স্থলপথেই চট্টগ্রাম পৌঁছেছিলেন। যেহেতু পথে অনেক নদী পার হওয়ার প্রয়োজন ছিল, সেখানে হয়তো পর্তুগিজ নাবিকদের নৌকা ব্যবহার করেছেন।
বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস বলা হয় ‘রিয়াজ-উস-সালাতীন’কে। ফারসি ভাষায় লিখিত এই ইতিহাসগ্রন্থেও উল্লেখ করা হয়েছে, দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর ভ্রমণের পর ত্রিপুরার পাহাড় ধরে শাহ সুজা চট্টগ্রাম পৌঁছেছিলেন। এই মত পরবর্তী ঐতিহাসিকদের অনেকেই সমর্থন করেছেন। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ‘সুজানগর’ নামে একটি এলাকা রয়েছে। বলা হয়ে থাকে ত্রিপুরার উদয়পুর থেকে ফটিকছড়ি হয়ে যাওয়ার সময় যে যে স্থানটিতে সুজা যাত্রাবিরতি দিয়েছিলেন, সেটিই পরে সুজানগর নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। তবে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নৌপথে শাহ সুজার চট্টগ্রামে পৌঁছানোর পক্ষে যাঁরা, তাঁদের অনেকরই মত সম্ভবত শাহ সুজার সঙ্গীদের একটি অংশ স্থলপথে চট্টগ্রামে গেছে।
পথ নিয়ে যত ভিন্নতাই থাকুক, ডগ-রেজিস্টারে সংরক্ষিত ডাচ বণিকের চিঠি, ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ার-মানুচির মতো ভ্রমণকারীদের তথ্যসহ সমসাময়িক সব সূত্রেই নিশ্চিত হওয়া যায় শাহ সুজার চট্টগ্রামে অবস্থানের কথা। সুজা চট্টগ্রাম থেকে যে স্থলপথ ধরে ম্রোহং যান, সেই পথটিও পরে সুজা সড়ক নামে পরে পরিচিত হয়ে ওঠে। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, কক্সবাজারের ডুলাহাজারা-ঈদগাঁওসহ বিভিন্ন অঞ্চলের নামকরণের সঙ্গেও সুজার যাত্রা জড়িয়ে আছে বলে মনে করা হয়। ঈদগাঁও নিয়ে বলা হয়, যাত্রাপথে সুজা নিজের সৈন্যসামন্তসহ এলাকাটিতে ঈদের নামাজ আদায় করেন। যার কারণে ‘নয়াবাদ’ নামের এলাকাটি পরে ঈদগাঁও নামে পরিচিত হয়েছে। একইভাবে লোহার খুঁটি গেড়ে যাওয়ায় লোহাগাড়া এবং হাজারো ঢুলি বা পালকি নিয়ে অবস্থানের কারণে ডুলাহাজারা নামটি এসেছে বলে ধারণা করা হয়। যাই হোক, পরিবার, সঙ্গী-সাথিদের নিয়ে নাফ নদী পেরিয়ে ১৬৬০ সালের ২৬ আগস্ট সুজা ম্রোহং পৌঁছাতে সমর্থ হন। তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন আরাকানরাজ সান্দা থু ধম্মা (শ্রীচন্দ্র সুধর্মা)।
চট্টগ্রামে শাহ সুজার অবস্থানকালে তাঁর কার্যক্রম নিয়ে ঐতিহাসিক সূত্রে খুব বেশি জানা যায় না। তবে স্থানীয় ঐতিহ্য এবং লোককাহিনিতে কিছু তথ্য মেলে। ১৯৩২ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় দীনেশচন্দ্র সেনের সম্পাদনায় ‘পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা’–এর চতুর্থ খণ্ডের দ্বিতীয় সংখ্যা। এতে সংকলিত হয় ‘পরীবানুর হাঁহলা’ নামে একটি পালা। শাহ সুজা চট্টগ্রামে পীর বদরের দরগায় গিয়েছিলেন—এমন কথা এই পালায় রয়েছে। সোনাদানা দান করার বিবরণও পাওয়া যায় পালাটিতে, ‘চাডিগাঁতে আসি তারা বদরের মোকাম/ বহুত খরাত দিলা সোনা ভরী ভরী রে’।
তখন চট্টগ্রাম আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও ধারণা করা হয়, মীর জুমলার বাহিনীর ধাওয়াসহ নানা কারণে নিরাপত্তা শঙ্কায় শাহ সুজা চট্টগ্রাম ছেড়ে ম্রোহংয়ে অবস্থান করতে মনস্থির করেন। এই শঙ্কার কিছুটা ইঙ্গিত মেলে পরীবানুর হাঁহলাতে, ‘নসীবের লেখা কভু না যায় খণ্ডন/ চাডিগাঁ ছাড়িতে বাদসা করিল মনন/ দহিন মিক্যা আইল তারা হাতীর উয়র চড়িরে’।
পালাটির সূত্র ধরে জানা যায়, চট্টগ্রাম থেকে যাত্রার ১৩ দিন, ১৩ রাত পার হয়ে শাহ সুজার সামনে পড়ে বিশাল দরিয়া (সম্ভবত নাফ নদী)। সেখানে তিন দিন অবস্থানের পর ‘রোসাং’ (ম্রোহং) যান সুজা।
‘আরাকান রাজসভায়’ রচিত অনেক বাংলা কাব্যেই সুজার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। মহাকবি আলাওলের ‘সয়ফল মুলুক বদিউজ্জামাল’-এর দ্বিতীয় ভূমিকায় এসেছে সুজা প্রসঙ্গ, ‘তার পাছে সাহ সুজা নৃপ-কুলেশ্বর/ দৈব পরিপাকে আইল রোসাঙ্গ শহর/...যতেক মোছলমান তার সঙ্গে ছিল/ নৃপতির শাস্তি পাইআ সর্ব্ব লোক মৈল’।
আরাকান থেকে আর মক্কায় যেতে পারেননি শাহ সুজা। আরাকানে তাঁর মৃত্যুর ঘটনাও এখনো রহস্যময়। এ বিষয়ে প্রচলিত মতের একটি হলো, কন্যাকে আরাকানরাজের বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন সুজা। সে কারণেই সুজাকে পরিবারসহ হত্যা করা হয়েছে। প্রচলিত এই মত এতটাই প্রবল যে এর ওপর ভিত্তি করে অনেক লোককাহিনি, কাব্য, গল্প তৈরি হয়ে আসছে। তবে সুজার মৃত্যুর নেপথ্যে কি সত্যিই এই ঘটনা, নাকি রয়েছে অন্য কোনো রাজনৈতিক কারণ, তা এখনো রয়ে গেছে ধোঁয়াশাপূর্ণ।