গাজার আকাশ সব সময় লাল হয়ে থাকে। মেঘের ভেতর জ্বলজ্বল করে ইসরায়েলি হামলার আগুন। হাওয়ায় ভাসে পোড়া মানুষের মাংসের গন্ধ। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর এখানে জন্মানো কোনো শিশু জানে না জীবনের মানে কী। তারা শুধু মৃত্যুই দেখেছে। 

দেড় বছরের বেশি সময় ধরে ইসরায়েল হত্যা করেছে ৫২ হাজারের বেশি মানুষ। ধ্বংসস্তূপের নিচে যাদের দেহ চাপা পড়ে আছে, তাদের ধরলে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। কিন্তু মানুষ তো সংখ্যা নয়। প্রতিটি মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে একেকটি গল্প—ভালোবাসার, কষ্টের, বেদনার।

গাজায় সন্তানকে মরতে দেখছে মা-বাবা। মায়ের লাশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে সন্তানদের। এমনকি কবরস্থানের ওপরও হামলা হয়েছে। যাকে সভ্যতা বলি, তার প্রতিটি টুকরো মুছে দেওয়া হয়েছে। হামলা চালানো হয়েছে হাসপাতালেও। হামাস বেসামরিক মানুষদের ‘মানবঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করছে এই অপ্রমাণিত অভিযোগে অসুস্থ শিশু, বৃদ্ধকে করা হচ্ছে নির্যাতন।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর সকালে সাইরেন বাজতেই গাজার নিজের মাটিতে বন্দী মানুষদের জীবনে আরেক দফা ভয়াবহতা নেমে আসে। এবার সবাইকে বাড়িঘর ছেড়ে শরণার্থীশিবিরে যেতে বাধ্য করা হলো। ইসরায়েলি দখলদার সেনারা লিফলেট ফেলে জানায়, নিরাপদ এলাকায় চলে যান। কিন্তু সেসব ‘নিরাপদ’ জায়গাতেই চালায় বোমা হামলা। কোনো কারণ ছাড়াই সাধারণ মানুষদের চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায়, নির্যাতন করে।

আজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গাজার যে ধ্বংস, রক্ত, কান্না দেখি; তা এসেছে দীর্ঘ আট দশকের দখলদারি আর দমন-পীড়নের ধারাবাহিক ফল হিসেবে। যেসব সাহসী ফিলিস্তিনি নিজের জীবন দিয়ে ইসরায়েলের অপরাধের প্রমাণ তুলে ধরেছেন, তাঁদের কারণেই এসব আমরা জানতে পেরেছি।

প্রতিবছর ১৫ মে ফিলিস্তিনিরা পালন করে ‘নাকবা’ দিবস অর্থাৎ ‘বিপর্যয়ের দিন’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির সহায়তায় গড়ে তোলা হলো ইসরায়েল নামের নতুন এক রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র গঠনের পেছনে ছিল এক সশস্ত্র জায়নবাদী মিলিশিয়া, যারা পরে রূপ নেয় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে। সেই সময় প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার ফিলিস্তিনিকে বন্দুকের মুখে বাড়ি থেকে তাড়ানো হয়েছিল।

একবার ভাবুন, আপনার ছোট বোনের পা ভেঙেছে। ধানমন্ডি থেকে কলাবাগানে হাসপাতালে নিতে চান। মাঝপথে দাঁড় করিয়ে রাখে চেকপয়েন্টে। বোন ব্যথায় চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু আপনি মুখ চেপে ধরেন, কারণ ইসরায়েলি সেনারা যদি এই চিৎকার শোনে, তাহলে গুলি করতে পারে, এমনই ভয়। প্রতিটি দিন, জীবনের প্রতিটি ক্ষণে ফিলিস্তিনিদের অমানবিক জীবনযাপন করতে হয়। স্বাধীনভাবে কোথাও যাওয়ার অধিকার নেই তাদের। ঠিক যেমন একসময় নাৎসি জার্মানিতে বাহুতে নির্দিষ্ট ব্যাজ পরে বাইরে বের হতে হতো।

আজ যাঁরা গাজার মানুষের পাশে দাঁড়াতে চান, তাঁদের আগে ‘নাকবা’ বোঝা জরুরি। নাকবা কেবল কাগজে-কলমে কোনো দুর্যোগ নয়। নাকবা ছিল পরিকল্পিত এক জাতিগত নির্মূল অভিযান। নাকবা শেষ হয়নি। এটি আজও চলছে। ইসরায়েলি দখলের নিচে বেঁচে থাকা গাজা, পশ্চিম তীর আর জেরুজালেমের প্রতিটি শিশুর মধ্যে বেঁচে আছে নাকবা। এখনো ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে, এখনো তাদের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টায় ব্যস্ত দখলদার ইসরায়েল। আজও এই নাকবা বেঁচে আছে—প্রতিটি গাজাবাসী শিশুর চোখে, পশ্চিম তীর আর জেরুজালেমে দখলদারত্বের নিপীড়নে। 

ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের আরও জমি দখল করার উদ্দেশ্যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। চাইছে ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে। ফিলিস্তিনিরা লুকিয়ে থাকে। জানে না কখন ইসরায়েলি স্নাইপারের গুলি তাদের ছিন্নভিন্ন করে দেবে। এভাবেই একদিন নাৎসিদের চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে লুকিয়ে থাকত ইহুদি পরিবারগুলো।

পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের গাড়িতে লাগাতে হয় সবুজ কার প্লেট। শুধু মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে ফিলিস্তিনিরা নিজের মাটিতেই দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ। পদে পদে চেকপয়েন্ট। সেখানে ফিলিস্তিনি সব গাড়ি লাইন ধরে দাঁড়ায়। তাদের তল্লাশি হয়। আর হলুদ কার প্লেটের ইসরায়েলি গাড়ি পাশ দিয়ে চলে যায় বীরদর্পে। ওরা এখানে অভিজাত। প্রতিটি চেকপয়েন্টে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ফিলিস্তিনিদের।

একবার ভাবুন, আপনার ছোট বোনের পা ভেঙেছে। ধানমন্ডি থেকে কলাবাগানে হাসপাতালে নিতে চান। মাঝপথে দাঁড় করিয়ে রাখে চেকপয়েন্টে। বোন ব্যথায় চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু আপনি মুখ চেপে ধরেন, কারণ ইসরায়েলি সেনারা যদি এই চিৎকার শোনে, তাহলে গুলি করতে পারে, এমনই ভয়। প্রতিটি দিন, জীবনের প্রতিটি ক্ষণে ফিলিস্তিনিদের অমানবিক জীবনযাপন করতে হয়। স্বাধীনভাবে কোথাও যাওয়ার অধিকার নেই তাদের। ঠিক যেমন একসময় নাৎসি জার্মানিতে বাহুতে নির্দিষ্ট ব্যাজ পরে বাইরে বের হতে হতো।

এই দখল এখন শুধু নিপীড়ন নয়, এক লাভজনক ব্যবসাও। ফিলিস্তিনিদের নিজেদের জলের উৎস খোঁজাও নিষিদ্ধ। ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েলি কোম্পানিগুলো। সেই পানি ফিলিস্তিনিদেরই কাছে বেশি দামে বিক্রি করে তারা। ইসরায়েলের চাপিয়ে দেওয়া দারিদ্র্যের মধ্যে মানুষকে চড়া দামে কিনতে হয় নিজেদের পানি।

২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত, ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা ৪০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে তাদের ঘর থেকে বের করে দিয়েছে, অনেককে হত্যা করেছে, শত শত জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

ফিলিস্তিনিদের জীবন ও জমি এখন ব্যবসায়িক লেনদেনের অংশ। ইসরায়েলি সরকার ঘর ভাঙার জন্য দরপত্র দেয়। ইসরায়েলি বেসরকারি কোম্পানি এসে ফিলিস্তিনিদের ঘর গুঁড়িয়ে দেয়। ভাঙা ঘরের জিনিসপত্র দিয়ে ইসরায়েলিদের জন্য নতুন বসতি স্থাপন হয়। এই ‘বসতি স্থাপন’ মানে কী? ভাবুন, একদিন দুপুরে খেতে বসেছেন পরিবারের সঙ্গে। হঠাৎ সেনা নিয়ে একদল লোক দরজায় এসে দাঁড়ায়। আপনি বেরিয়ে যান জানতে, কী হয়েছে। আর তখনই একটা বুলডোজার আপনার বাড়িতে উঠে পড়ে। ঘর ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। প্রতিবাদ করলে গুলি খেতে হবে। এভাবেই প্রতিদিন নাকবা চলতে থাকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, ফিলিস্তিনিরা ‘ভুক্তভোগীদেরও ভুক্তভোগী’ হয়ে আছে। জাতিসংঘের কোনো প্রস্তাব কাজ করেনি। আন্তর্জাতিক আদালতের কোনো পরোয়ানায় থামেনি নেতানিয়াহুর যুদ্ধযজ্ঞ। আর আজ যখন আমি এই লেখা লিখছি, তখন গাজার শিশুরা না খেয়ে মারা যাচ্ছে। ইসরায়েল জাতিসংঘের ৩ হাজার খাদ্যবাহী ট্রাক আটকে রেখেছে। অথচ আর চার মাসের খাবার আছে ১০ লাখ মানুষের জন্য। ক্ষুধায় কাঁদছে শিশুরা। তাদের বাবা–মায়েরা বুঝিয়ে উঠতে পারছেন না খাবার পাশে থাকা সত্ত্বেও কেন তারা খেতে পাচ্ছে না? কীভাবে বোঝাবেন এই শিশুকে? তার প্রতিবেশী চায় সে না খেতে পেয়ে মারা যাক। কীভাবে বলবেন, তোমাকে তারা মানুষই ভাবে না? আর তখনই প্রশ্ন ওঠে—এই ভয়াবহতাকে থামাতে বিশ্ব কিছু করছে না কেন?

আজ নাকবার ৭৭তম বর্ষে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলোয় সফরে গেছেন। নেতানিয়াহুকে এক পাশে রেখে আলোচনায় উঠেছে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনা। এই রাজনীতির ছায়ায় আমরা একটু আশার খোঁজ করি। যদি রাজনৈতিক চুক্তির পরিবর্তে কিছুটা শান্তি আসে।

তবে আমাদের আসল ভরসা কোথায় জানেন? ভরসা বাংলাদেশসহ সেই দেশগুলোর পাশে দাঁড়ানো মানুষদের মধ্যে, যাদের বুকে আমাদের বেদনা বাজে। প্রতি মাসে নতুন নতুন উপায়ে ইসরায়েল আমাদের দেশ থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারা আমাদের ঘর ভাঙতে পারে, আমাদের শরীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন করতে পারে, কিন্তু ফিলিস্তিনি মানুষের মনোবল কখনো ভাঙতে পারবে না।

প্রিয় বাংলাদেশি ভাই-বোনেরা! আজ আপনাদের আমন্ত্রণ জানাই—আমাদের সঙ্গে নাকবাকে স্মরণ করুন। ফিলিস্তিনের সংগ্রাম শুধু আমাদের নয়। এই সংগ্রাম পুরো বিশ্বের। যেন আর কোথাও অন্যায় না ঘটে। আর কারও বুকে যেন আমাদের মতো ক্ষত না জমে।

ইউসেফ এস ওয়াই রামাদান বাংলাদেশে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত

ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন

(মতামত লেখকের নিজস্ব )

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল দখলদ র র জন য আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

পাহাড়ে কাজুবাদাম চাষ

২ / ৮প্যাকেটজাত করার জন্য কাজুবাদাম পরিষ্কার করা হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ