আমরা শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে চাই রাস্তায় নয়
Published: 15th, May 2025 GMT
বুধবার দুপুর থেকেই মনটা খারাপ। শিক্ষার্থীরা ক্লাস ছেড়ে কাকরাইল মোড়ে। ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ। পুলিশের বেদম পিটুনিতে আহত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অনেকেই এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন। অন্যদিকে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সমস্যা নিয়ে আলাপ করতে এসে বোতল নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন। এ কাজ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য, আমরা এর নিন্দা জানাই।
চলমান এই আন্দোলন ও নানা ঘটনার ডামাডোলে আমার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে দুটো কথা বলার তাগিদ অনুভব করছি।
চলতি সেমিস্টারে আমার তিনটি কোর্সে সপ্তাহে অন্তত এক দিন ক্লাস থাকে দুপুর সাড়ে ১২টায়। ওই সময় যখন আমি ক্লাসে ঢুকি, বিশ্বাস করুন, আমার ক্লাস নিতে ইচ্ছা করে না। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এ সময় থাকেন ক্লান্ত। তাঁদের চোখে-মুখে থাকে টানা ক্লান্তিকর দিনযাপনের অবসাদ। কেন এমনটা ঘটে?
আবাসিক হলের সুবিধাবঞ্চিত এই শিক্ষার্থীরা সকাল ছয়টার দিকে রাস্তায় থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের জন্য। তারপর আটটার দিকে ক্যাম্পাসে পৌঁছে ক্লাসে যান। আর দুপুর নাগাদ সব প্রাণশক্তি নিঃশেষ করে তাঁরা থাকেন ক্লান্ত–বিধ্বস্ত। চিন্তা করুন, সপ্তাহে পাঁচটা দিন একই রুটিন। আমার ধারণা, প্রতিদিন ক্লাসে যোগ দিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে ধরনের কষ্ট সহ্য করেন, তা মনে হয় বাংলাদেশের আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের করতে হয় না।
কয়েক মাস আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বিভাগ ভলিবল প্রতিযোগিতায় আমি বিভাগের সমন্বয়ক ছিলাম। জানিয়ে রাখি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের একমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, যাদের একটিও খেলার মাঠ নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিটি করপোরেশনের অনুমতি নিয়ে ধূপখোলা মাঠ ব্যবহার করে। যদিও একবার এই সুযোগও বাতিল করা হয়েছিল। যাহোক, আমার দল নিয়ে মাঠে গেলাম। তখন ধূপখোলা মাঠের সংস্কার চলছে। মাঠ তো নয়, যেন বালুর ভাগাড়। কয়েক ঘণ্টায় ফুসফুসে প্রচুর বালু নিয়ে বিভাগে ফিরেছিলাম। আর চিন্তা করছিলাম, কেন এই অভাগা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সবুজ মাঠ নেই?
আরেকটি তিক্ত অভিজ্ঞতা। বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭টি অনুষদ, ২টি ইনস্টিটিউট ও ৩৮টি বিভাগে প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন। আর পুরান ঢাকার এই ক্যাম্পাসের আয়তন মাত্র ১১ একর। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন একাডেমিক ভবন মাত্র একটি। বাকিগুলো কলেজের পুরোনো ভবন, যেগুলোর বেশির ভাগই জারাজীর্ণ ও ব্যবহারের অনুপযোগী।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তিনটি বিষয় নিয়ে আন্দোলন করছেন। আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন বৃত্তি কার্যকর করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাজেট কাটছাঁট না করা এবং দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ পরবর্তী একনেক সভায় অনুমোদন করে অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন করা। বর্তমান বাস্তবতায় সব কটি দাবি এখনই মেনে নেওয়া হয়তো অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সম্ভব নয়। কিন্তু সমস্যাগুলো সমাধানের দৃশ্যমান চেষ্টা তো থাকতে হবে।বর্তমান প্রশাসন পরিচালনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আইকনিক যে ভবন ব্যবহার করা হয়, সেটি সিটি করপোরেশন কর্তৃক ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে বহু আগে। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একাডেমিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশের জন্য এক ভিনদেশি অধ্যাপক আমাদের বিভাগে এসেছিলেন। ইউজিসির একটি প্রকল্পের আত্ততায় তিনি তিন দিন আমাদের সঙ্গে থেকে বিভাগের কারিকুলাম ও অন্যান্য দিক নিরীক্ষা করেছিলেন।
শেষ দিন বিকেলের নাশতা শেষে যখন আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম, তখন তিনি বলেছিলেন, তাঁর দেখা সবচেয়ে নোংরা শিক্ষাঙ্গন ছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস! এর টয়লেটগুলো শুধু ব্যবহারের অনুপযোগীই নয়, এগুলোর পাশের ক্লাসরুমগুলোয় ক্লাস পরিচালনা করাও কষ্টকর।
২০১৬ সালে আমি যখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিই, তখন ক্লাসে শিক্ষার্থী ছিলেন ৬০ জন করে। বর্তমানে এই সংখ্যা ৮০। বর্তমানে আগের ব্যাচের ৫ থেকে ৭ জন মিলে গড়ে ৮৫ জনের ক্লাস পরিচালনা করতে হয়। অন্য কোনো সুযোগ–সুবিধা না বাড়িয়ে ক্লাসে ২০ জন করে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী যুক্ত করার এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা মানেনি। তাদের অজুহাত ছিল, ইউজিসি চেয়েছে আরও শিক্ষার্থী যুক্ত করতে হবে। তাই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তিনটি বিষয় নিয়ে আন্দোলন করছেন। আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন বৃত্তি কার্যকর করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাজেট কাটছাঁট না করা এবং দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ পরবর্তী একনেক সভায় অনুমোদন করে অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন করা। বর্তমান বাস্তবতায় সব কটি দাবি এখনই মেনে নেওয়া হয়তো অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সম্ভব নয়। কিন্তু সমস্যাগুলো সমাধানের দৃশ্যমান চেষ্টা তো থাকতে হবে।
আবাসন বৃত্তি স্বল্প পরিসরে হলেও তো শুরু করা যায়, প্রয়োজন বিবেচনায় জগন্নাথের বাজেট নিয়ে সরকার নিশ্চিতভাবে বিশেষ বিবেচনা করতে পারে। আর দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নিয়ে যে স্থবিরতা, সেটি কাটিয়ে ওঠাও কঠিন নয়। এ বিষয়গুলোয় সরকার ইতিবাচক মনোভাব দেখাতে পারে।
শেষ কথা হিসেবে বলা প্রয়োজন, কাকরাইলের অবরোধ দ্রুত অবসান হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের আমরা ক্লাসে চাই, ক্যাম্পাসে চাই, অনিরাপদ রাজপথে নয়। আন্দোলন করতে গিয়ে আমার শিক্ষার্থীরা পুলিশের বেদম প্রহারের শিকার হচ্ছেন—এই দৃশ্য আমাদের দগ্ধ করে। আরও খারাপ কিছু ঘটার আগে অন্তর্বর্তী সরকার একটি যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছাবে, এটাই প্রত্যাশা। আর শিক্ষার্থীদেরও সংযম প্রদর্শন জরুরি।
রাহাত মিনহাজ সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র র জন য ব যবহ র র একট সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
শুক্রবার জুমার পর জবি শিক্ষার্থীদের গণঅনশন
শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে শুক্রবার জুমার নামজের পর জবি শিক্ষার্থীদের গণঅনশন ঘোষণা করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
বৃহস্পতিবার রাত ১১ টা ৫০ মিনিটে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন নেতৃবৃন্দের মতামতের ভিত্তিতে ‘জবি ঐক্যের’ পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. রইছ উদ্দীন এ ঘোষণা দেন।
অধ্যাপক ড.রইছ উদ্দীন বলেন, আমরা সরকারের নিকট আমাদের অধিকার আদায়ের দাবি জানিয়েছিলাম। তারা আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বেধড়ক পিটিয়েছে। কিন্তু আমাদের অধিকারের বিষয়ে কোনো কর্ণপাত করেনি। এমনকি ৩৫ ঘণ্টা পার হলেও কোন সিদ্ধান্ত জানায়নি প্রশাসন। সরকার থেকে কোন বার্তা আসেনি।
তিনি বলেন, দাবি আদায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কাল জুমার পরে গণঅনশন শুরু করবে। এতে সকল সাবেক ও বর্তমান জবিয়ানদের অংশ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এদিন শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে আন্দোলন স্থলে শুরু হবে জবিয়ান সমাবেশ। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির আন্দোলনে পুলিশ কর্তৃক শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনার প্রতিবাদে ১৪ মে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কালো দিবস পালনের ঘোষণা দেন তিনি।