মার্ক জাকারবার্গ ঘন ঘন বৈঠকের বদলে যেভাবে প্রতিদিন কাজ করেন
Published: 16th, May 2025 GMT
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার ও থ্রেডস অ্যাপের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ। বয়স মাত্র ৪১ বছর হলেও বিশ্বের সেরা ধনীদের একজন তিনি। সফল মানুষ হিসেবে পরিচিত জাকারবার্গ প্রতিদিন কর্মীদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠকে বিশ্বাসী নন। প্রযুক্তি–দুনিয়ার বেশির ভাগ শীর্ষ নির্বাহী সময়সূচি মেনে চলার পাশাপাশি প্রতিদিন একাধিক বৈঠক করলেও জাকারবার্গের দৈনন্দিন কাজের ধরন একেবারেই আলাদা। তাঁর নেতৃত্ব দেওয়ার ধরন অনেকটাই নির্ভার, অনানুষ্ঠানিক ও কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনাভিত্তিক।
সম্প্রতি স্ট্রাইপের সহপ্রতিষ্ঠাতা জন কলিসনের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় জাকারবার্গ বলেন, ‘আমি মানুষ পরিচালনা করতে পছন্দ করি না। এ জন্য নির্দিষ্ট সময় মেনে নিয়মিত বৈঠক করি না। তবে সহকর্মীদের সঙ্গে আমি প্রায়ই কথা বলে থাকি। সম্ভবত, তাদের চেয়েও বেশি। যখন কোনো বিষয়ে বলার থাকে, তখনই বলি। আর কেউ যদি আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়, আমি চেষ্টা করি সময় ফাঁকা রাখতে।’
জাকারবার্গের সাপ্তাহিক ক্যালেন্ডারে মাত্র দুটি বৈঠকের সময় নির্ধারণ করা থাকে। একটি কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে, আরেকটি প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রাধিকার নির্ধারণে। বাকি সময় তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ফাঁকা রাখেন। এর ফলে চিন্তা, বিশ্লেষণ ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে যুক্ত থাকার সময় পান তিনি। এ বিষয়ে জাকারবার্গ বলেন, ‘প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় নিজের জন্য রাখি। এই সময়টাতে আমি ভাবি, কাজ করি বা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করি। যদি টানা কয়েক দিন এমনটা না করতে পারি, তখন আমি বিরক্ত হই।’
আরও পড়ুনমার্ক জাকারবার্গের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী০৪ অক্টোবর ২০২৪মেটার সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে একটি ‘কোর টিম’ বা মূল দল। এই দলের সদস্যসংখ্যা ২৫ থেকে ৩০। প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেও এই দলের সদস্যরা সরাসরি জাকারবার্গকে প্রতিবেদন পাঠায় না। মেটার পণ্য পরিচালনা কাঠামোও ১৫টি ভাগে বিভক্ত। এর মধ্যে রয়েছে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, বিজ্ঞাপন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) অবকাঠামো ও ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি। এসব বিভাগের কর্মীরাও সরাসরি জাকারবার্গকে প্রতিদিন প্রতিবেদন পাঠায় না। মেটার পুরো কাজের তত্ত্বাবধান করেন প্রধান পণ্য কর্মকর্তা ক্রিস কক্স, প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা হাভিয়ের অলিভান ও প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা অ্যান্ড্রু বোসওয়ার্থ।
আরও পড়ুনস্ত্রীর প্রতি যেভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করলেন জাকারবার্গ ১৬ আগস্ট ২০২৪জাকারবার্গের মতে, নেতৃত্ব মানে শুধু নির্দেশনা দেওয়া নয়, সহকর্মীদের সঙ্গে হাতে-কলমে কাজ করা। আর তাই মেটার পরিচালনাপদ্ধতি নিজের মতো করে সাজিয়েছেন তিনি। এ বিষয়ে জাকারবার্গ বলেন ‘আমি দায়িত্ব ভাগ করে দিয়ে এক পাশে সরে দাঁড়ানোর পক্ষে নই। এই কাঠামোর ফলে আমি অপ্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনাগত কাজ এড়িয়ে চলতে পারি। একই সঙ্গে যেসব বিষয়ে আমার গভীরভাবে যুক্ত থাকা দরকার, সেখানে সরাসরি যুক্ত থাকতে পারি।
সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে
আরও পড়ুনমেয়ের জন্য থ্রিডি প্রিন্টারে পোশাক বানালেন মার্ক জাকারবার্গ০১ মে ২০২৩.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম র ক জ ক রব র গ জ ক রব র গ র কর মকর ত ক জ কর
এছাড়াও পড়ুন:
বাঙালি মুসলমান চিন্তার মেরুকরণ
কিস্তি: ১
১৯২০ সালের কলকাতায় কাজী নজরুল ইসলাম ও মুজফ্ফর আহ্মদ যখন এ কে ফজলুল হকের কাছে পত্রিকা করার নিয়ত নিয়ে সলা-পরামর্শ করতে গেলেন, হক চাইলেন পত্রিকার নামটি হোক মুসলমানি শব্দে। ‘হিন্দুরা তোমাদের কাগজ কিনবেন না। পক্ষান্তরে মুসলমানরাও বুঝতে পারবেন না যে কাগজখানা মুসলমানদের।’ মুজফ্ফর ও নজরুলের বুঝ ছিল ভিন্ন। তাঁরা পত্রিকার নামে আলাদা করে মুসলমানি চিহ্ন প্রকটিত না করে, এমন নাম দিতে চাইলেন যেন দুই সম্প্রদায়ের গ্রাহকই পত্রিকা কেনেন। অগত্যা পত্রিকার নাম হলো ‘নবযুগ’।
এভাবে ১৯২০ সালে নবযুগপত্রিকা শুরু হলো এ কে ফজলুল হকের অর্থায়নে। এই পত্রিকা চালুর আলোচনায় মুজফ্ফর ও নজরুল বাদেও ছিলেন মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, মোজাম্মেল হক, নবনূর পত্রিকার সাবেক ম্যানেজার উমেদ আলী মিয়া, নূর লাইব্রেরির মালিক মঈনুদ্দীন হুসয়ন, সিলেট নিবাসী ফযলুল হক সেলবর্সী প্রমুখ। পত্রিকায় কর্মী হিসেবে যুক্ত হলেন নজরুল, মুজফ্ফর ও সেলবর্সী; অর্থাৎ নজরুলের সাংবাদিক–জীবনের প্রথম দুই সহকর্মী হলেন মুজফ্ফর ও সেলবর্সী। খুবই চিত্তাকর্ষক এই সমাবেশ? কেন? সেটাই এই লেখার প্রতিপাদ্য। এই তিনজনের মধ্যে দুজন কীভাবে বামে চলে গেলেন আর অন্যজন গেলেন ডানে এবং দ্বন্দ্ব উঠল ঘনিয়ে, সে গল্পই এই প্রবন্ধের বিষয়।
বিশ শতকের শুরুর দিকে বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রবল নড়াচড়া শুরু হয়। উপনিবেশি-আধুনিক শিক্ষায় বিপুল সংখ্যায় শরিক হয় তারা। নতুন ধরনের যে শাসন সংশ্রয়; অর্থাৎ কলোনিয়াল প্রশাসন, মুদ্রণমাধ্যম ও লোকজমায়েত—তাতে তারা শামিল হয়। আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালার আল-এসলাম (১৯১৪-১৯১৯), নাসিরউদ্দীনের মাসিকসওগাত আর ত্রৈমাসিকবঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার মতো পত্রিকা নতুন ধরনের মধ্যস্থতা বা মেডিয়েশন সম্ভব করল। আরও এল ‘মোসলেম ভারত’, ‘নবযুগ’, ‘ধূমকেতু’, ‘মোসলেম’, ‘মোহম্মদী’ ইত্যাদি। মতামত ও চিন্তার এই বিপুল উৎপাদন ও সঞ্চালনের সঙ্গে সঙ্গেই এই সমাজের ভেতর নানা প্রবণতা আলাদা হয়ে প্রকটিত হলো। ভেদরেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল।
১৯২০ সালে নবযুগপত্রিকা শুরু হলো এ কে ফজলুল হকের অর্থায়নে। পত্রিকায় কর্মী হিসেবে যুক্ত হলেন নজরুল, মুজফ্ফর ও সেলবর্সী; অর্থাৎ নজরুলের সাংবাদিক–জীবনের প্রথম দুই সহকর্মী হলেন মুজফ্ফর ও সেলবর্সী। এই তিনজনের মধ্যে দুজন কীভাবে বামে চলে গেলেন আর অন্যজন গেলেন ডানে এবং দ্বন্দ্ব উঠল ঘনিয়ে, সে গল্পই এই প্রবন্ধের বিষয়।বর্তমান লেখার চলতি অনুমান হলো, পশ্চিমকেন্দ্রিক আধুনিক দুনিয়ায় ফরাসি বিপ্লবের সিলসিলায় ভাবাদর্শিক দুই মেরু হিসেবে যে দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী ভাগ করা হয়, সেটা বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রথম স্পষ্ট হয় বিশের দশকে। বাম-ডানের এই পরস্পরবিরোধী প্রবণতা বুঝতে ১৯২০ সালের নবযুগপত্রিকার দুই তরুণ সহকর্মী কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) ও ফযলুল হক সেলবর্সী (১৮৯৫-১৯৬৮)—এই দুজনকে নিয়ে সংক্ষেপে এ প্রবন্ধের আলাপ। ১৯২০ সালে যখন দুজনে সহকর্মী হলেন, একজনের বয়স ২৫, আরেকজনের ২১। কলকাতার বুকে কর্মরত এই দুই তরুণ বুদ্ধিজীবীর নিয়ত ও নিয়তিতে পরের ১০ বছর যে মেরুকরণ ঘটে, তার হদিস নিলে বাঙালি মুসলমান সমাজে উদীয়মান ভাবাদর্শিক মেরুকরণের কুলুজিটা ভালোই বোঝা যাবে।
নজরুল আর সেলবর্সী—এ দুজনের মধ্যে তুলনা হয় না, আবার হয়ও। নজরুল বাঙালি জাতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ও অন্যতম প্রধান চরিত্র। আধুনিক বাঙালি মুসলমান সমাজের অনুভবিক আদর্শপুরুষ। অন্যদিকে সেলবর্সীকে ‘খ্যাতনামা মুজাহিদ, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন উত্তরকালের এক লেখায় মুহম্মদ এনামুল হক। মূলধারার আধুনিক জাতীয় ইতিহাসে সেলবর্সী প্রায় বিস্মৃত চরিত্র। তবু উপনিবেশি বাস্তবতায় বাঙালি মুসলমান সমাজে আধুনিক সংশ্রয়ের উন্মেষে এই দুই ‘সাংবাদিক’ যুক্ত ও শরিক ছিলেন। দুটি পরস্পরবিরোধী প্রবণতার স্বর হিসেবে তাঁদের তুলনা করলে সেকালের সামাজিক মুখর বাহাসের পরিচয় পাওয়া যায়, তাই এই বিসদৃশ তুলনা।
তুর্কি-আফগান সমাচারকৃষক অধ্যুষিত বাঙালি মুসলমান সমাজে উনিশ শতকের ফরায়েজি, তরিকায়ে মুহম্মদিয়া ইত্যাদি আন্দোলনের ফলে এই সমাজের বিশ্ববীক্ষা প্রসারিত হয়েছিল। বিশ শতকে এসে প্রথম মহাযুদ্ধ ও খেলাফত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই সমাজের উদীয়মান মধ্যবিত্ত অংশের চিন্তা ও তৎপরতার একটা নতুন পর্যায় শুরু হয়। উপনিবেশি সংশ্রয়ে ভদ্রলোক হিসেবে নিজের সংস্থান করা এবং প্রাধান্যশীল হিন্দু ভদ্রলোক সমাজের সঙ্গে অনুকরণ, সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা—এই ত্রিবিধ সম্পর্কে যুক্ত হয়ে যে বিম্ব-বিড়ম্বনার (মাইমেটিক কনফ্লিক্ট) জন্ম হলো, তা থেকেই বাঙালি মুসলমান সমাজে স্বাতন্ত্র্যের বোধ প্রবলতর হলো। এই সময়ে মুসলমান সমাজের বিশ্ববীক্ষার কল্পিত ভূগোলে দুটি অঞ্চলের স্থান উল্লেখযোগ্য: তুরস্ক ও আফগানিস্তান। বাংলা, তথা উপমহাদেশে মুসলমান রাজবংশগুলো জাতিগতভাবে তুর্কি ও আফগান বলেই বিবেচিত। ফলে কাকতাল নয় যে নজরুল ও সেলবর্সী নিয়ে আমাদের আলাপের সূচনাও তুরস্ক ও আফগানিস্তানকে ঘিরে।
নজরুল বাঙালি জাতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ও অন্যতম প্রধান চরিত্র। আধুনিক বাঙালি মুসলমান সমাজের অনুভবিক আদর্শপুরুষ। অন্যদিকে সেলবর্সীকে ‘খ্যাতনামা মুজাহিদ, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন উত্তরকালের এক লেখায় মুহম্মদ এনামুল হক। মূলধারার আধুনিক জাতীয় ইতিহাসে সেলবর্সী প্রায় বিস্মৃত চরিত্র।ফযলুল হক সেলবর্সী (১৮৯৫-১৯৬৮)