এক মাসের কিছু বেশি সময়ের ব্যবধানে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর দ্বিতীয় দফা বিধিনিষেধ আরোপ করল ভারত। গত ৯ এপ্রিল দেশটি তাদের স্থল ও বিমানবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক তৃতীয় দেশে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এরপর গত শনিবার সব স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পোশাক আমদানি নিষিদ্ধ করে দেয়। কয়েকটি স্থলবন্দর দিয়ে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, আসবাবসহ কিছু পণ্য আমদানিতেও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। 

ভারতের বাজারে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকেরা ভালো করছিলেন। তবে ভারতে রপ্তানির চেয়ে দেশটি থেকে বাংলাদেশে আমদানির পরিমাণ অনেক গুণ বেশি। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতে রপ্তানি হয় প্রায় ১৫৭ কোটি ডলারের পণ্য। বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানি করেছে ৯০০ কোটি ডলারের পণ্য। ভারতের নতুন বিধিনিষেধে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির পরিমাণ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা। 

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান খান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে তাদের যে বড় বাজার তৈরি হয়েছিল, সেটি ধরে রাখা কঠিন হবে। বাংলাদেশ থেকে ভারতের চার রাজ্য আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের সব স্থলবন্দর দিয়ে বেশ কিছু পণ্য রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এসব পণ্য রপ্তানিতে ভারত সমুদ্রপথে দুটি পথ খোলা রেখেছে—দেশটির পশ্চিমে মুম্বাইয়ের নভো সেবা ও পূর্ব-ভারতে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা বন্দর। 

বাংলাদেশের পণ্য ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পাঠানোর ক্ষেত্রে এই দুটি বন্দর খুব কাজে দেবে না। কারণ, চট্টগ্রাম থেকে মুম্বাইয়ের নভো সেবায় সরাসরি কোনো কনটেইনার জাহাজ চলাচল করে না, যেতে হয় শ্রীলঙ্কা হয়ে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম-কলকাতার মধ্যেও জাহাজ চলাচল অনিয়মিত। তা ছাড়া এভাবে পণ্য পরিবহনের যে খরচ পড়বে, তাতে আমদানিকারকেরা পণ্য নিতে কোনোভাবেই আগ্রহী হবে না।

স্থলবন্দরের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করায় ভারতে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ল। প্রথম দফায় ভারতের স্থল ও বিমানবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক তৃতীয় দেশে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে ভারতীয় বন্দরগুলোতে পণ্যজটের দোহাই দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এবার স্থলবন্দরে বিধিনিষেধ আরোপ করার যৌক্তিক কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশের পণ্য ভারতে পাঠানো নিরুৎসাহিত করতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ এটিকে পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা বলে দাবি করছেন। যদিও বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত ১৫ এপ্রিল ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল স্থানীয় বস্ত্র শিল্পমালিকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে। দেশটি থেকে স্থল ও সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে আনা সুতায় দামের পার্থক্য থাকায় ব্যবসায়ীরা ওই দাবি করেছিলেন। 

তা ছাড়া দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিকূল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আগাম জানানোর যে রীতি, এবার সেটাও ভারত মানেনি। যে কারণে পণ্যবোঝাই ৫০টি ট্রাক স্থলবন্দরে আটকে পড়েছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাটি সমাধানের ওপর জোর দিয়েছেন। আমরাও মনে করি, দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যসংক্রান্ত বিরোধের সমাধান হওয়া উচিত পারস্পরিক সুবিধা–অসুবিধার নিরিখে। 

ভারতের এই সিদ্ধান্ত কেবল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, ভারতের ভোক্তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, যাঁরা অনেকটা কম দামে ও কম সময়ে বাংলাদেশি পণ্য পেয়ে থাকেন। যে পথে কম সময়ে পণ্য ভোক্তার কাছে পৌঁছানো যাবে, সেই পথ উন্মুক্ত রাখতে হবে। বাণিজ্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের পরস্পর নির্ভরশীলতা রয়েছে এবং আমরা মনে করি দুই দেশের স্বার্থেই তা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। 

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দর দ য় ব যবস আমদ ন র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

প্রথম চালানে ৩৭ হাজার ৪৬০ কেজি ইলিশ গেল ভারতে

দুর্গাপূজা উপলক্ষে যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে প্রথম চালানে ৩৭ হাজার ৪৬০ কেজি ইলিশ মাছ ভারতে রপ্তানি হয়েছে। আজ বুধবার দেশের ছয়টি প্রতিষ্ঠান ১২ দশমিক ৫০ ডলার কেজিতে এই ইলিশ রপ্তানি করা হয়েছে, যা বাংলাদেশি টাকায় ১ হাজার ৫২৫ টাকা।

অথচ এদিন যশোর শহরের মাছের আড়তে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম আকারের প্রতি কেজি ইলিশ মাছ ১ হাজার ৪৫০ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকায় পাইকারি বেচা–কেনা হয়েছে। খুচরা বাজারে সেই ইলিশ কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি দরে ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে; অর্থাৎ দেশের খুচরা বাজারের দামের চেয়ে কম দামে ইলিশ ভারতে রপ্তানি হচ্ছে।

দেশের চেয়ে কম দামে ইলিশ মাছ রপ্তানি কীভাবে সম্ভব হচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে রপ্তানিকারকদের ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সিএন্ডএফ) এজেন্ট জুয়েল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘রপ্তানিকারকেরা ইলিশের জাহাজ থেকে সরাসরি মাছ কেনেন।‌ ছোট–বড় মিলিয়ে যখন কেনেন, তখন একটু কম দামে তাঁরা কিনতে পারেন। এ কারণে তাঁদের পুষিয়ে যায়। এর চেয়ে বেশি কিছু আমার জানা নেই।’

যশোর শহরের বড় বাজারের মাছ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ইলিশ মাছের সরবরাহ কম। যে কারণে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মাছ ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা কেজি দরে বেচাকেনা হচ্ছে। খুচরা ইলিশ বিক্রেতা লিয়াকত আলী বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এ বছর ইলিশ মাছের দাম বাড়তি। বাজারে সরবরাহ কম। যে কারণে এ বছর ইলিশ মাছের দাম কমার সম্ভাবনা আর দেখছি না।’

যশোর বড় বাজার মৎস্যজীবী আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ পিয়ার মোহাম্মদ জানান, আজ যশোরের বাজারে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম আকারের ইলিশ মাছ ১ হাজার ৪৫০ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকা কেজি দরে পাইকারি কেনাবেচা হয়েছে। আর কেজি আকারের ইলিশ প্রতি কেজি ৩ হাজার টাকার ওপরে বেচাকেনা হয়েছে। ভারতের রপ্তানির কারণে স্থানীয় বাজারে এখন ইলিশ মাছ সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে, যে কারণে দাম বেশি। অথচ গত বছর এই সময়ে কেজি আকারের ইলিশ মাছের দাম ছিল সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬০০ টাকা কেজি। এবার প্রায় দ্বিগুণ দামে সেই ইলিশ কেনাবেচা হচ্ছে।

বেনাপোল স্থলবন্দরের মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, এ বছর সরকার ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১ হাজার ২০০ টন ইলিশ ভারতে রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। আজ থেকে ইলিশ মাছ রপ্তানি শুরু হলো। গত বছর ইলিশ রপ্তানির অনুমতি ছিল ২ হাজার ৪২০ টন। বেনাপোল বন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়েছিল মাত্র ৫৩২ টন। এবারও অনুমোদনকৃত ইলিশ রপ্তানির কোটা পূরণ হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ৫ অক্টোবরের মধ্যে ইলিশ রপ্তানি শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর।

জানতে চাইলে বেনাপোল স্থলবন্দরের মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের ফিশারিজ কোয়ারেন্টিন সজীব সাহা বলেন, দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনুমোদিত ইলিশ রপ্তানির প্রথম চালানে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ১২ দশমিক ৫০ ডলার মূল্যে ৩৭ দশমিক ৪৬০ টন ইলিশ রপ্তানি হয়েছে। ছয়টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই ইলিশ ভারতে পাঠানো হয়েছে। রপ্তানি করা ইলিশের একটি বাক্স খুলে দেখা গেছে, ৩৮টি ইলিশ মাছের ওজন ২১ কেজি; অর্থাৎ প্রতিটি ইলিশের ওজন ছিল ৫৫০ গ্রাম। এ ছাড়া ৭০০ থেকে ৮৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মাছও রপ্তানি হয়েছে। ৫৫০ গ্রাম থেকে ৮৫০ গ্রাম আকারের মধ্যে ইলিশ মাছ রপ্তানি হচ্ছে।

পদ্মার রুপালি ইলিশ স্বাদ আর গন্ধে অতুলনীয় হওয়ায় দুই বাংলায় এ মাছ বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে দুর্গাপূজায় অতিথি আপ্যায়নে খাবারের প্রধান তালিকায় ইলিশ রাখেন কলকাতার বাঙালিরা। আগে ইলিশ সাধারণ রপ্তানি পণ্যের তালিকায় উন্মুক্ত থাকলেও উৎপাদন সংকট দেখিয়ে ২০১২ সালে দেশের বাইরে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করে দেয় তৎকালীন সরকার। তবে ২০১৯ সাল থেকে বিশেষ বিবেচনায় কেবল দুর্গাপূজা উপলক্ষে আবারও ইলিশ রপ্তানির সুযোগ দেয় সরকার।

আরও পড়ুনদুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতের ‘বিশেষ অনুরোধে’ ইলিশ রপ্তানির অনুমতি: মৎস্য উপদেষ্টা২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • প্রথম চালানে ৩৭ হাজার ৪৬০ কেজি ইলিশ গেল ভারতে
  • আখাউড়া স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ