আমাদের দেশে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ-সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট বিধান নেই। স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে বর্তমান সরকারের মেয়াদ কত দিন? গত বছর ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পরাজয় ও পতনের পর ৮ আগস্ট এই সরকার গঠিত হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের যেমন একটি লক্ষ্য ছিল, তেমনি অভ্যুত্থানের পর মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কিছু বিষয়ে সংস্কার সরকারের এজেন্ডাভুক্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে সরকার ৯ মাস অতিক্রম করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই সময়ে সরকার গণঅভ্যুত্থানের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কতটা সক্ষমতা ও আন্তরিকতা দেখাতে পেরেছে? এই সরকারের মেয়াদ কি অনির্দিষ্টকাল? 

মানসিক সুস্থতা আছে, এমন সবারই বোঝার কথা যে কোনো সরকারের মেয়াদই অনির্দিষ্টকাল হতে পারে না। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দেশের রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের মেয়াদের সঙ্গে অনিবার্যভাবে যে প্রশ্নটি আসে, তা হলো, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন কবে? সরকারের পক্ষ থেকে তাদের মেয়াদ এবং সাধারণ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় সম্পর্কে শুরু থেকেই ‘২০২৬ সালের জুনের মধ্যে’ বলে আসা হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, সরকারের মেয়াদ ও নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। 

গত ১৬ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির প্রতিনিধি দলের আলোচনা এবং সফররত মার্কিন কূটনীতিকদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির প্রতিনিধি দলের আলোচনা শেষে নির্বাচনের সময় নিয়ে সংশয় নতুন মাত্রায় উন্নীত। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল প্রকাশ্যে বলেছেন, নির্বাচনের রোডম্যাপ না দেওয়ায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় তারা সন্তুষ্ট নন। তারা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চান। পাশাপাশি বিএনপি মহাসচিব সন্দেহ দূর করার উপায় বিষয়ে বলেছেন, সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেসব সংস্কারের কথা বলছে, তা দু-এক মাসের মধ্যেই সম্পন্ন করা সম্ভব। কাজেই ডিসেম্বরে নির্বাচন দিতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আবার জামায়াতে ইসলামী কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের বলেছে, তারা আগামী রমজানের আগেই নির্বাচন চায়; অর্থাৎ ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে। জামায়াতের এই অবস্থান পরিবর্তনে দলটির শীর্ষ নেতার লন্ডনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সাম্প্রতিক সাক্ষাতের ভূমিকা থাকতেই পারে। 

আবার আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই সেনাবাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা স্পষ্ট। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে আসছেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। বুধবার সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে আয়োজিত ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ সভায়ও আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে নিজের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন তিনি (সমকাল, ২২ মে ২০২৫)।

ওদিকে গত কয়েক দিন রাখাইনের জন্য ‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে অনেক প্রশ্ন, আলোচনা-সমালোচনার মুখে অবশেষে সরকার ব্যাখ্যা দিয়েছে। এর পরও রয়ে গেছে প্রশ্ন। সরকারের ব্যাখ্যায় জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে সংশয় কাটেনি। ‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে সেনাবাহিনীরও ভিন্ন বক্তব্য রয়েছে। বুধবারের অফিসার্স অ্যাড্রেসেও সেনাবাহিনী প্রধান বলেছেন, রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নির্বাচিত সরকার থেকেই আসতে হবে। 

এই ইস্যুতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বক্তব্য আরও ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেছে। তিনি করিডোরের বদলে ত্রাণ সহায়তার পাথওয়ে বা চ্যানেলের কথা বলছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে, শুধু শব্দের মারপ্যাঁচ। চ্যানেল, পাথওয়ে ও করিডোরের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কিনা? থাকলে এর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক পার্থক্য কী? 

এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের তিনজন উপদেষ্টাকে ‘বিএনপির মুখপাত্র’ বলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে দেওয়া তাদের সুপারিশ মানা না হলে বড় কর্মসূচি দিয়ে এই তিন উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। আবার বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারে থাকা দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিও করা হচ্ছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা মাঠে নেমেছেন দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি সামনে রেখে। এর পর এনসিপি কর্মসূচি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে। দল দুটির দাবি ভিন্ন হলেও এটাকে কার্যত পাল্টাপাল্টি ধরে নেওয়া যায়। 

এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্নগুলো আরও জোরালো হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কতদিন? নির্বাচন ও সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চলমান আলোচনা কতদিন চলবে? আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান আসবে কিনা? দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার গতি-প্রকৃতি নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। 

আমরা দেখছি, সংস্কার আগে, না নির্বাচন আগে– এই বিতর্ক চালু করে রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় স্বার্থের স্থলে দলীয় বা গোষ্ঠী স্বার্থই প্রাধান্য দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে যেসব বিষয়ে বেশির ভাগ দল ঐকমত্য প্রকাশ করেছে, সেগুলো নিয়েই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে এগোতে হবে। সব বিষয়ে সব দল একমত নাও হতে পারে। গণতান্ত্রিক সমাজে তা আশা করাও যায় না। ভিন্নমত আছে বলেই তারা ভিন্ন দল করেছে। নির্বাচন করতে গিয়ে যেমন সংস্কারকে বাদ দেওয়া যাবে না, তেমনি সংস্কারের নামে নির্বাচনকে অযথা বিলম্বিত করাও সমীচীন হবে না। 

দেখা গেছে, কয়েকটি সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে সরাসরি নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। অনেক সংস্কার সরকারের নির্বাহী আদেশেও বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এসব বাস্তবায়নে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। তাই সরকারের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন, সন্দেহ। কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে সরকারের নতি স্বীকার এ ধরনের সংশয় আরও বাড়াবে। 

উপদেষ্টা পরিষদের উচিত সরকারের মেয়াদ, নির্বাচনের রোডম্যাপ, সংস্কারের সীমা নিয়ে সংশয় দূর করা। এসব নিয়ে সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা, বিশষ সহকারী বা সচিবরা যা বলছেন, তাতে সংশয় বাড়ছে বৈ কমছে না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টারই এগিয়ে আসা উচিত। সরকারের মধ্যে তাঁর ওপর দেশবাসীর আস্থা এখনও অটুট। তিনিই পারেন সরকারের মেয়াদ, নির্বাচনের তারিখ, সংস্কারের সীমা নিয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দিয়ে সব সংশয় দূর করতে।

এহ্‌সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক, সমকাল; কথাসাহিত্যিক
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সরক র র ম য় দ গণঅভ য ত থ ন র জন ত ক ব এনপ র ঐকমত য বল ছ ন কর ড র দ র কর

এছাড়াও পড়ুন:

বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য না হলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই: এবি পার্টি

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে অংশ নিয়ে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে আজ বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক হয়। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এবি পার্টির চেয়ারম্যান এ কথা বলেন।

ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে মজিবুর রহমান বলেছেন, ‘সংবিধান পরিবর্তন, সংস্কার, সংশোধন, নতুন করে লেখা বা বাতিলের চূড়ান্ত ক্ষমতা জনগণের। আমরা ঐক্যবদ্ধ মতামতের ভিত্তিতে জুলাই সনদ তৈরি করেছি, হয়তো কয়েকটি বিষয়ে কারও কারও “নোট অব ডিসেন্ট” (দ্বিমত) আছে। কিন্তু চূড়ান্ত কোনটা হবে, তা নির্ধারণের মূল ক্ষমতা জনগণের।’

কমিশনের আজকের প্রস্তাবে জুলাই ঘোষণাপত্রের ২২ নম্বর অনুচ্ছেদকে রেফারেন্স আকারে উল্লেখ করায় কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ও নেতা জুলাই ঘোষণাপত্রের বৈধতা নিয়ে মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে এবি পার্টির চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে যাঁরা আজ প্রশ্ন তুলছেন, কাল তাঁরা সংসদে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবেন এবং এই সনদকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না, তার নিশ্চয়তা কী?

এবি পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সানী আবদুল হক বলেন, সংবিধানে এটা নেই, ওটা নেই বলে সংবিধান সংস্কার করা যাবে না—এই ধারণা অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাপরিপন্থী। রাজনৈতিক দলগুলো যদি জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতির প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান থেকে নমনীয় না হয়, তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পুরো প্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়বে।

আশঙ্কা প্রকাশ করে এবি পার্টির এই নেতা বলেন, এমন পরিস্থিতি জাতিকে এক গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দেবে। সুতরাং জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি; অন্যথায় গণভোট ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

আরও পড়ুনবর্ধিত মেয়াদের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে চায় কমিশন: আলী রীয়াজ৪ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের সুপারিশ, একমত নয় দলগুলো
  • ‘সংবিধান আদেশ’ জারির সুপারিশ করতে পারে কমিশন: আলী রীয়াজ
  • জুলাই সনদের বাস্তবায়নে দেরি হলে জনগণ আবারও রাস্তায় নামবে: জামায়াত নেতা রফিকুল
  • কমিটি গঠন, প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত 
  • বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য না হলে গণভোট ছাড়া উপায় নেই: এবি পার্টি
  • বর্ধিত মেয়াদের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে চায় কমিশন: আলী রীয়াজ
  • বিএনপি নির্বাচনমুখী কর্মসূচিতে যাবে
  • দলগুলোর সঙ্গে বুধবার আবার আলোচনায় বসছে ঐকমত্য কমিশন
  • ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন হতে হবে
  • জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ ফের এক মাস বাড়ল