আমাদের দেশে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ-সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট বিধান নেই। স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে বর্তমান সরকারের মেয়াদ কত দিন? গত বছর ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পরাজয় ও পতনের পর ৮ আগস্ট এই সরকার গঠিত হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের যেমন একটি লক্ষ্য ছিল, তেমনি অভ্যুত্থানের পর মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কিছু বিষয়ে সংস্কার সরকারের এজেন্ডাভুক্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে সরকার ৯ মাস অতিক্রম করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই সময়ে সরকার গণঅভ্যুত্থানের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কতটা সক্ষমতা ও আন্তরিকতা দেখাতে পেরেছে? এই সরকারের মেয়াদ কি অনির্দিষ্টকাল? 

মানসিক সুস্থতা আছে, এমন সবারই বোঝার কথা যে কোনো সরকারের মেয়াদই অনির্দিষ্টকাল হতে পারে না। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দেশের রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের মেয়াদের সঙ্গে অনিবার্যভাবে যে প্রশ্নটি আসে, তা হলো, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন কবে? সরকারের পক্ষ থেকে তাদের মেয়াদ এবং সাধারণ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় সম্পর্কে শুরু থেকেই ‘২০২৬ সালের জুনের মধ্যে’ বলে আসা হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, সরকারের মেয়াদ ও নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। 

গত ১৬ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির প্রতিনিধি দলের আলোচনা এবং সফররত মার্কিন কূটনীতিকদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির প্রতিনিধি দলের আলোচনা শেষে নির্বাচনের সময় নিয়ে সংশয় নতুন মাত্রায় উন্নীত। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল প্রকাশ্যে বলেছেন, নির্বাচনের রোডম্যাপ না দেওয়ায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় তারা সন্তুষ্ট নন। তারা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চান। পাশাপাশি বিএনপি মহাসচিব সন্দেহ দূর করার উপায় বিষয়ে বলেছেন, সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেসব সংস্কারের কথা বলছে, তা দু-এক মাসের মধ্যেই সম্পন্ন করা সম্ভব। কাজেই ডিসেম্বরে নির্বাচন দিতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আবার জামায়াতে ইসলামী কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের বলেছে, তারা আগামী রমজানের আগেই নির্বাচন চায়; অর্থাৎ ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে। জামায়াতের এই অবস্থান পরিবর্তনে দলটির শীর্ষ নেতার লন্ডনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সাম্প্রতিক সাক্ষাতের ভূমিকা থাকতেই পারে। 

আবার আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই সেনাবাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা স্পষ্ট। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে আসছেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। বুধবার সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে আয়োজিত ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ সভায়ও আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে নিজের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন তিনি (সমকাল, ২২ মে ২০২৫)।

ওদিকে গত কয়েক দিন রাখাইনের জন্য ‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে অনেক প্রশ্ন, আলোচনা-সমালোচনার মুখে অবশেষে সরকার ব্যাখ্যা দিয়েছে। এর পরও রয়ে গেছে প্রশ্ন। সরকারের ব্যাখ্যায় জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে সংশয় কাটেনি। ‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে সেনাবাহিনীরও ভিন্ন বক্তব্য রয়েছে। বুধবারের অফিসার্স অ্যাড্রেসেও সেনাবাহিনী প্রধান বলেছেন, রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নির্বাচিত সরকার থেকেই আসতে হবে। 

এই ইস্যুতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বক্তব্য আরও ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেছে। তিনি করিডোরের বদলে ত্রাণ সহায়তার পাথওয়ে বা চ্যানেলের কথা বলছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে, শুধু শব্দের মারপ্যাঁচ। চ্যানেল, পাথওয়ে ও করিডোরের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কিনা? থাকলে এর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক পার্থক্য কী? 

এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের তিনজন উপদেষ্টাকে ‘বিএনপির মুখপাত্র’ বলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে দেওয়া তাদের সুপারিশ মানা না হলে বড় কর্মসূচি দিয়ে এই তিন উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। আবার বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারে থাকা দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিও করা হচ্ছে। বিএনপির নেতাকর্মীরা মাঠে নেমেছেন দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি সামনে রেখে। এর পর এনসিপি কর্মসূচি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে। দল দুটির দাবি ভিন্ন হলেও এটাকে কার্যত পাল্টাপাল্টি ধরে নেওয়া যায়। 

এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্নগুলো আরও জোরালো হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কতদিন? নির্বাচন ও সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চলমান আলোচনা কতদিন চলবে? আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান আসবে কিনা? দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার গতি-প্রকৃতি নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। 

আমরা দেখছি, সংস্কার আগে, না নির্বাচন আগে– এই বিতর্ক চালু করে রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় স্বার্থের স্থলে দলীয় বা গোষ্ঠী স্বার্থই প্রাধান্য দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে যেসব বিষয়ে বেশির ভাগ দল ঐকমত্য প্রকাশ করেছে, সেগুলো নিয়েই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে এগোতে হবে। সব বিষয়ে সব দল একমত নাও হতে পারে। গণতান্ত্রিক সমাজে তা আশা করাও যায় না। ভিন্নমত আছে বলেই তারা ভিন্ন দল করেছে। নির্বাচন করতে গিয়ে যেমন সংস্কারকে বাদ দেওয়া যাবে না, তেমনি সংস্কারের নামে নির্বাচনকে অযথা বিলম্বিত করাও সমীচীন হবে না। 

দেখা গেছে, কয়েকটি সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে সরাসরি নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। অনেক সংস্কার সরকারের নির্বাহী আদেশেও বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এসব বাস্তবায়নে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। তাই সরকারের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন, সন্দেহ। কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে সরকারের নতি স্বীকার এ ধরনের সংশয় আরও বাড়াবে। 

উপদেষ্টা পরিষদের উচিত সরকারের মেয়াদ, নির্বাচনের রোডম্যাপ, সংস্কারের সীমা নিয়ে সংশয় দূর করা। এসব নিয়ে সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা, বিশষ সহকারী বা সচিবরা যা বলছেন, তাতে সংশয় বাড়ছে বৈ কমছে না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টারই এগিয়ে আসা উচিত। সরকারের মধ্যে তাঁর ওপর দেশবাসীর আস্থা এখনও অটুট। তিনিই পারেন সরকারের মেয়াদ, নির্বাচনের তারিখ, সংস্কারের সীমা নিয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দিয়ে সব সংশয় দূর করতে।

এহ্‌সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক, সমকাল; কথাসাহিত্যিক
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সরক র র ম য় দ গণঅভ য ত থ ন র জন ত ক ব এনপ র ঐকমত য বল ছ ন কর ড র দ র কর

এছাড়াও পড়ুন:

ঐকমত্য কমিশন: মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবে মতপার্থক্য

রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ হয়েছে। পাঁচটি সংস্কার কমিশনের অনেকগুলো সুপারিশ বা প্রস্তাবের বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও ক্ষমতার ভারসাম্যসহ মৌলিক প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে মতপার্থক্য রয়ে গেছে।

ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, প্রথম পর্যায়ের আলোচনার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দলগুলোর সঙ্গে শিগগিরই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু হবে। এ পর্যায়ে মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবগুলো আলোচনায় গুরুত্ব পাবে। যেসব বিষয়ে মতভিন্নতা আছে, সেগুলো নিয়ে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা হবে। পবিত্র ঈদুল আজহার (জুনের প্রথম সপ্তাহ) আগে দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু হতে পারে। দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ‘জুলাই সনদ’ তৈরি করা হবে। আগামী জুলাই মাসে এ সনদ চূড়ান্ত করার লক্ষ্য রয়েছে ঐকমত্য কমিশনের।

মৌলিক যেসব পরিবর্তনের প্রস্তাব আছে, সেগুলো মূলত সংবিধান–সম্পর্কিত। সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে সংস্কারের যেসব উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করেছে, তার অন্যতম হলো ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার উত্থান রোধ এবং রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ—নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা।

জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে অনেকটা কাছাকাছি অবস্থানে আছে। এনসিপি জোর দিচ্ছে মৌলিক সংস্কারে।

ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে এবং এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা যাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে না যায়, সে জন্য সংবিধানে বেশ কিছু সংস্কার আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানো; এক ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না; একই ব্যক্তি একাধারে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলের প্রধান হতে পারবেন না; সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের জন্য জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন; আইনসভা (সংসদ) দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা এবং উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব–পদ্ধতিতে (একটি দল সারা দেশে যত ভোট পাবে, সে অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন পাবে) নির্বাচন; অর্থবিল ছাড়া নিম্নকক্ষের সদস্যরা তাঁদের দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা পাবেন ইত্যাদি।

এসব প্রস্তাবের মধ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ করার প্রস্তাবের সঙ্গে প্রায় সব দলই একমত হয়েছে; কিন্তু নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে মতভিন্নতা আছে। অন্য প্রস্তাবগুলোর ক্ষেত্রে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির মতপার্থক্য বেশি। জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে অনেকটা কাছাকাছি অবস্থানে আছে। এনসিপি জোর দিচ্ছে মৌলিক সংস্কারে।

মৌলিক যেসব পরিবর্তনের প্রস্তাব আছে, সেগুলো মূলত সংবিধান–সম্পর্কিত। সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে সংস্কারের যেসব উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করেছে, তার অন্যতম হলো ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার উত্থান রোধ এবং রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ—নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা।

সংস্কার বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়েও দলগুলোর মধ্যে বড় ধরনের মতভিন্নতা আছে। অবশ্য সংস্কার বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া নিয়ে এখনো দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় এ বিষয় আসতে পারে।

রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য গত বছরের অক্টোবরে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে এ কমিশন।

ঐকমত্য তৈরির অংশ হিসেবে পুলিশ সংস্কার কমিশন ছাড়া সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে স্প্রেড শিটে (ছক) রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে মতামত নেয় ঐকমত্য কমিশন। যেসব সুপারিশের বিষয়ে আংশিক একমত বা ভিন্নমত ছিল, সেগুলো নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলাদা আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত ২০ মার্চ শুরু করে গতকাল সোমবার দলগুলোর সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ হয়েছে। দুই মাসে ৩৩টি দলের সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে বিএনপি তিন দিন, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি দুই দিন করে প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় অংশ নেয়।

এনসিসি ও সাংবিধানিক পদে নিয়োগ

ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগ—রাষ্ট্রের এই তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ (এনসিসি) গঠন করার প্রস্তাব ছিল সংবিধান সংস্কার কমিশনের। তাদের প্রস্তাবে বলা হয়, প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধানদের এবং বিভিন্ন সাংবিধানিক পদে নিয়োগের জন্য এই কাউন্সিল রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠাবে। রাষ্ট্রপতি তাঁদের নিয়োগ দেবেন।

বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে অন্য যেকোনো কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করতে হয়। এনসিসি গঠন করা হলে সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমবে।

তবে এ প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপি একমত নয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এনসিসি গঠনের প্রস্তাব নিয়ে বিএনপির জোরালো আপত্তি আছে। তারা মনে করে, এ বিধান করা হলে সরকার দুর্বল হবে।

অন্যদিকে এ প্রস্তাবের সঙ্গে নীতিগতভাবে একমত এনসিপি। জামায়াতে ইসলামীও এ প্রস্তাবের সঙ্গে নীতিগতভাবে একমত। তবে দলটি রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিকে এ কাউন্সিলে না রাখার পক্ষে।

অবশ্য বিএনপি বলেছে, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য আনা তাদের অঙ্গীকার। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একটি আইন করার প্রস্তাব দিয়েছে দলটি। তবে সে আইনে রাষ্ট্রপতিকে কী কী ক্ষমতা দেওয়া হবে, তা তারা স্পষ্ট করেনি। দলটি বলেছে, এ বিষয়ে পরবর্তী সংসদে আলোচনা করে তা ঠিক করা হবে।

সংবিধানের মূলনীতি, জরুরি অবস্থা জারির বিধান, সংবিধান সংশোধনপ্রক্রিয়া, আন্তর্জাতিক চুক্তি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি, সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচনপদ্ধতিসহ কিছু প্রস্তাব নিয়েও এখনো মতপার্থক্য আছে।প্রধানমন্ত্রী–সংক্রান্ত

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। একই ব্যক্তি একাধারে প্রধানমন্ত্রী, দলের প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না। এই দুটি প্রস্তাবে এনসিপি একমত। তবে এ দুটি প্রস্তাব নিয়ে ভিন্নমত জানিয়েছে বিএনপি। বিএনপি চায় কোনো ব্যক্তি টানা দুবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিরতি দিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, এমন বিধান। আর দলের প্রধান, সরকারপ্রধান ও সংসদ নেতা কে হবেন, তা দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়।

এ ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান হলো একই ব্যক্তি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী এবং দলের প্রধান থাকতে পারবেন না। এক ব্যক্তি সারা জীবনে ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না।

সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভোট

বিদ্যমান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদ সদস্যরা নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন না। তাতে বলা আছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন বা সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলে সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে।

এখানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, অর্থবিল ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদের নিম্নকক্ষের সদস্যদের নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে।

এ প্রস্তাব নিয়েও পুরোপুরি ঐকমত্য হয়নি। অনেকগুলো দলই অর্থ বিলের পাশাপাশি আস্থা ভোট, সংবিধান সংশোধন বিলে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা দেওয়ার বিপক্ষে।

বিএনপির অবস্থান হলো সংসদে আস্থা ভোট, অর্থ বিল, সংবিধান সংশোধনী বিল এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, এমন সব বিষয়ে দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়া যাবে না।

জামায়াতে ইসলামীও অর্থ বিল, সংবিধান সংশোধন বিল ও আস্থা ভোট ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা দেওয়ার পক্ষে।

অন্যদিকে এনসিপির অবস্থান হলো সংসদ সদস্যরা সংসদে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারবেন। পাশাপাশি সরকারের স্থিতিশীলতাও যেন রক্ষিত হয়, সে ধরনের সাংবিধানিক ব্যবস্থা থাকতে হবে।

সংবিধানের মূলনীতি, জরুরি অবস্থা জারির বিধান, সংবিধান সংশোধনপ্রক্রিয়া, আন্তর্জাতিক চুক্তি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি, সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচনপদ্ধতিসহ কিছু প্রস্তাব নিয়েও এখনো মতপার্থক্য আছে।

তবে এসব মৌলিক বিষয়ের বাইরে সংবিধান ও অন্য চারটি সংস্কার কমিশনের বেশ কিছু প্রস্তাবের সঙ্গে দলগুলো একমত হয়েছে। প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষে বিএনপি জানিয়েছিল, তারা বেশির ভাগ সুপারিশের সঙ্গে একমত। জামায়াতে ইসলামী বলেছিল, ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে তারা ১২০টির বেশি সুপারিশে একমত হয়েছে।

এখন দলগুলো যা বলছে

প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু সুপারিশে ঐকমত্য হয়নি। দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় কতটা অগ্রগতি হতে পারে বলে মনে করেন, এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, কতটা ক্ষেত্রে ঐকমত্য হয়েছে বা হয়নি, তার বিস্তারিত এখনো তাঁরা জানেন না। দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু হলে বিষয়গুলো সামনে আসবে। তখন বিষয়গুলো নিয়ে তাঁরা মন্তব্য করবেন।

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের দল এনসিপি গুরুত্ব দিচ্ছে মৌলিক সংস্কারে। তারা ইতিমধ্যে ঐকমত্য কমিশনের কাছে মৌলিক সংস্কারের একটি রূপরেখাও তুলে ধরেছে। তবে তারা যৌক্তিক ছাড় দিতে রাজি আছে। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সাত-আটটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতানৈক্য আছে। এনসিপি সর্বোচ্চ ‘ফ্লেক্সিবল’ (নমনীয়)। ক্ষমতাকাঠামোর গণতান্ত্রিক সংস্কার নীতিকে ঠিক রেখে সর্বোচ্চ ছাড় দিতে এনসিপি প্রস্তুত আছে।

দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার মাধ্যমে দলগুলো একটি কাছাকাছি পর্যায়ে আসতে পারবে বলে আশা করছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের প্রথম আলোকে বলেন, যেসব সুপারিশের বিষয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা আছে, সেগুলো নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে কমিশন আলোচনা করবে। সেখানে সবাই নিজ নিজ যুক্তি দেবে। এর মধ্য দিয়ে একটি কাছাকাছি অবস্থানে আসা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা করেন। তিনি বলেন, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ, এমন বিষয়গুলোও গণভোটে দেওয়ার পক্ষে তাঁরা। গণভোটে যে রায় আসবে, তার বিপক্ষে কারও কিছু বলার থাকবে না। কারণ, গণভোট হলো জনগণের সম্মতি।

আশাবাদী কমিশন

গতকাল বিকেলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে ঐকমত্য কমিশনের প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ হয়। গতকাল আলোচনার শুরুতে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অব্যাহত এই আলোচনায় অনেকগুলো বিষয়ে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছি এবং বেশ কিছু বিষয়ে আমাদের ভিন্নমতও রয়েছে। খুব শিগগির দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু করে যেসব বিষয়ে মতভিন্নতা রয়েছে, তা বিষয়ভিত্তিকভাবে আলোচনা করে দ্রুত জাতীয় সনদ তৈরিতে অগ্রসর হতে পারব।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • উচ্চ আদালতের রায়ে জনগণের বিজয় হয়েছে: মির্জা ফখরুল
  • তিন উপদেষ্টাকে ‘বিএনপির মুখপাত্র’ আখ্যায়িত করে এনসিপির হুঁশিয়ারি
  • কোন পথে সংস্কার ও রাজনৈতিক ঐকমত্য
  • শেষ মাইলটি অতিক্রমে দুদিক থেকেই এগিয়ে আসতে হবে
  • নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করা জরুরি
  • সীমান্তের অতিরিক্ত সেনা সরাচ্ছে ভারত-পাকিস্তান
  • নাগরিক কোয়ালিশনের সাত প্রস্তাব কেন গুরুত্বপূর্ণ
  • ঐকমত্যের ভিত্তিতেই ‘জাতীয় সনদ’ হবে
  • ঐকমত্য কমিশন: মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবে মতপার্থক্য