ঢাকার হাজারীবাগে অবস্থিত বৃহত্ত্ব আর্ট স্পেসে ‘পাল: ভূমি, জল, বায়ু’ শিরোনামে যে প্রদর্শনীটি সম্প্রতি (২৫ এপ্রিল থেকে ২ মে) অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা নিছক একটি শিল্প প্রদর্শনী নয়; বরং এক অন্তর্দৃষ্টি ও অনুধাবনের যাত্রা। প্রদর্শনীটি ‘গঙ্গাবুড়ি নদী ঐতিহ্য প্রকল্প’-এর অংশ হিসেবে বাস্তবায়িত হয়েছে, যার মূল উদ্দেশ্য নদী ও তার আশপাশের মানুষের সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্ক, ইতিহাস এবং সংস্কৃতিকে শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করা।
প্রদর্শনীর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল একটি বৃহৎ পাল; যা শুধুই নৌযানের অংশ নয়, বরং এখানে এটি রূপ নিয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং পরিবেশ-সচেতনতাকে ধারণকারী এক প্রতীকী মাধ্যম হিসেবে। পালটির কাঠামো, এর গায়ে জড়ানো কাপড়, কাঁচা রং, খনার বচনের পঙ্ক্তি, নদীর পারের মানুষের কণ্ঠে ধারণ করা গান–এসব কিছু মিলিয়ে এটি এক বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা তৈরি করেছে।
এই প্রদর্শনী তিনটি প্রাকৃতিক উপাদান–ভূমি, জল এবং বায়ুকে থিম হিসেবে গ্রহণ করেছে। ‘ভূমি’ অংশে কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি, খনার বচন ও লোকজ জ্ঞানকে তুলে ধরা হয়েছে। এটি দর্শককে আমাদের মাটির শিকড়ে ফিরে যেতে উদ্বুদ্ধ করে, যেখানে কৃষি শুধু খাদ্য উৎপাদনের পদ্ধতি নয়, বরং একটি জীবনদর্শন। ‘জল’ অংশে নদী এবং জলস্রোতের সঙ্গে মানুষের অস্তিত্বের অটুট বন্ধন তুলে ধরা হয়েছে–লোকগান, নৌকা, নদীতীরের জীবনের টানাপোড়েন এবং জলবায়ুর প্রভাব এই অংশে বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ‘বায়ু’ বা হাওয়া অংশে বাতাসের গতি, স্থানান্তর এবং যাত্রার প্রতীক হিসেবে পালের দেওয়া গতিশীলতা, স্মৃতি ও মিথের সংমিশ্রণ ঘটেছে।
দর্শক হিসেবে প্রদর্শনীটি আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। প্রতিটি উপস্থাপনা যেন একটি জীবন্ত গল্প; যা কেবল চিত্র বা বস্তু নয়, বরং অনুভবযোগ্য। প্রদর্শনীজুড়ে ব্যবহৃত লোককবিতা, গান ও শব্দচিত্র দর্শকের মননে অতীতের নদীকেন্দ্রিক জীবন ছায়া ফেলে। যেন শিল্পের মাধ্যমে স্মৃতিচারণা, প্রতিবাদ এবং ভবিষ্যতের প্রতি দায়িত্ববোধ একসঙ্গে মিলেমিশে গেছে।
আরও যা আমাকে মুগ্ধ করেছে তা হলো, স্থানীয় শিল্পী ও সম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ। এই প্রদর্শনীতে কেবল একজন কিউরেটর বা শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গিই নয়, বরং নানা মানুষের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি ও আবেগ মিশে গিয়ে একটি সামষ্টিক শিল্পরূপ লাভ করেছে।
এই এক্সিবিশনটি আমাকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে–নদী আর শুধুই প্রাকৃতিক জলাধারই নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক সত্তা। আর শিল্প তখনই সফল, যখন তা দর্শকের ভেতর প্রশ্ন তোলে, সংযোগ তৈরি করে, এবং নতুন উপলব্ধির দ্বার খুলে দেয়। ‘পাল: ভূমি, জল, বায়ু’ ঠিক তেমনই একটি অভিজ্ঞতা দিয়েছে।
হাজারীবাগে বৃহত্ত্বের প্রদর্শনীস্থল নিয়েও কিছু কথা না বললেই নয়। হাজারীবাগ এলাকায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে মনে হতে পারে, সময়ের পর্দা সরিয়ে কেউ বুঝি খানিকটা অতীতে চলে এসেছে। কর্মচঞ্চল ঝলমলে ঢাকার সমান্তরালে যে আরেক আদি ঢাকা বাস করে, তা নতুন ঢাকার নাগরিকদের খুব একটা মনে পড়ে কি?
হাজারীবাগের নদীবর্তী রাস্তাঘাট দেখলে চট করে ঔপনিবেশিককালে চলে এসেছি মনে হয়। কোনো অন্ধগলির ভেতর থেকে এই বুঝি কোনো বৃটিশ সৈন্য বেরিয়ে আসবে। হাজারীবাগে চামড়াশিল্পের বিকাশ ঘটেছে অনেক আগেই। মুক্তি ট্যানারি এখানে আগে থেকেই পরিচিত। তবে সম্প্রতি বৃহত্ত্বের প্রদর্শনীস্থল হিসেবে এর পরিচিতি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে বলে মনে করি।
প্রবেশপথে নিচতলায় স্তূপ স্তূপ শুকিয়ে রাখা প্রক্রিয়াজাত চামড়ার ছোট ছোট স্তম্ভ। মোড় ঘুরে সিঁড়িতে পার রাখলেই ট্যানারির প্রকট, যদিও তুলনামূলক পরিচ্ছন্ন, বাস্তবতা ছাড়িয়ে কেউ যখন সিঁড়ি ভেঙে বৃহত্ত্বের প্রদর্শনী স্থল অর্থাৎ ছাদের দিকে যেতে শুরু করবে, তার মন বদলাতে শুরু করবে। যখন উদার ছাদে পা রাখবে, চারদিকে সুসজ্জিত গাছপালা, উঠোনসজ্জা দেখে হয়তো তার মনে হবে, শিল্পের পুণ্য এই জায়গাটিকে যে স্পর্শ করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রদর্শনী ছাড়াও, বৃহত্ত্বের প্রদর্শনী স্থলটিও আমার মনে প্রিয় স্মৃতি তৈরি করেছে। v
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
বিলীন আরও ২০০ মিটার বাঁধ, হুমকির মুখে তিন গ্রাম
পদ্মা সেতু প্রকল্প রক্ষা বাঁধ ধসের এক দিন পর শরীয়তপুরের জাজিরায় মঙ্গলবার ভাঙন আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। পদ্মার প্রবল স্রোতে সেতুর কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড-সংলগ্ন রক্ষা বাঁধের আরও ২০০ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
স্থানীয়দের ভাষ্য, সোমবার বিকেলে শুরু হওয়া ভাঙনের স্রোত এতটাই তীব্র ছিল যে, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বিলীন হয়ে গেছে অন্তত ৯টি বসতবাড়ি ও ১০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। হুমকির মুখে রয়েছে মাঝিরঘাট বাজারসহ আশপাশের তিনটি গ্রাম। আতঙ্কে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিয়েছে অন্তত ২৫টি পরিবার। কেউ খোলা আকাশের নিচে, কেউ আবার আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন। অনেকেই তাদের শেষ সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন।
ভাঙনের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড মঙ্গলবার সকাল থেকেই জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলার (ডাম্পিং) কাজ শুরু করে। তবে প্রবল স্রোত ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে এই কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এর আগে গত নভেম্বর ও চলতি বছরের জুনে ২ দফায় প্রায় ৩০০ মিটার বাঁধ ভেঙে যায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবহেলা এবং দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়ায় ভাঙনের এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
পাউবো, জাজিরা উপজেলা পরিষদ এবং স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত নভেম্বরে পদ্মা সেতু রক্ষা বাঁধের প্রায় ১০০ মিটার অংশ নদীতে বিলীন হয়। প্রায় চার মাস পর চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল থেকে ২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয়ে জিও ব্যাগ ও সিসি ব্লক ফেলে কাজ শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
এদিকে অবস্থার অবনতি ঠেকাতে সোমবারই পরিদর্শনে আসেন পানি উন্নয়ন বোর্ড ফরিদপুর অঞ্চলের প্রধান অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শাজাহান সিরাজ। তিনি বলেন, ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। জিও ব্যাগ ফেলা ও ব্লক বসানোর কাজ দ্রুত শুরু হবে।
আমরা দেখেছি, ভাঙনের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ। অতি দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
স্থানীয় বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘প্রতি বছরই আমরা নদী ভাঙনের মুখে পড়ি। কিন্তু এবার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। চোখের সামনে মাত্র এক
ঘণ্টায় ১০টি ঘর নদীতে চলে গেল। আতঙ্কে দিন কাটছে আমাদের। সরকারের কোনো প্রতিনিধি নজর রাখে না। বর্ষার শুরুতে কিছু জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছিল, কিন্তু সেগুলো কোনো কাজেই আসেনি। শুধু আশ্বাস আর আশ্বাস—বাস্তব ব্যবস্থা নেই। আমরা চাই দ্রুত স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হোক, না হলে পুরো এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।’
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হারানো সুজন ফকির বলেন, ‘বাড়িতে দুপুরে খাবার খেতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ চিৎকার শুনি—পদ্মা সব ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে। এসে দেখি
নদীর ভেতরে আমার দোকানটি পড়ে আছে। সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম। সর্বনাশা নদী প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেওয়ার
সময়ও দিল না। এখন পরিবার নিয়ে কীভাবে চলব, বুঝতে পারছি না।’
বাড়ি হারানো খলিল মাদবর বলেন, ‘হঠাৎ করে পানিতে কিছু একটা ভেঙে পড়া শব্দ পাই। গিয়ে দেখি কয়েকটি দোকান ভেঙে নদীতে চলে গেছে।
এরপর ঘরের আসবাবপত্র সরিয়ে ফেলি। আধা ঘণ্টার মধ্যেই পদ্মা আমার বাড়ি কেড়ে নিল। নিঃস্ব হয়ে গেলাম। মাথা গোঁজার ঠাঁই রইলো না। গত বছর বাঁধ ভাঙার পর যদি দ্রুত মেরামত করা হতো, তাহলে হয়তো আজকের এই দুর্দিন দেখতে হতো না।’
স্থানীয় প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে শুকনো খাবার ও নগদ অর্থ বিতরণ শুরু হয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, সাময়িক সহায়তার পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে স্থায়ী বাঁধ পুনর্নির্মাণ ও পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায় ভাঙনের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তারেক হাসান বলেন, প্রায় ১২-১৩ বছর আগে সেতু বিভাগ পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা রক্ষার জন্য এই বাঁধ নির্মাণ করেছিল। বর্তমানে জাজিরার নাওডোবা জিরো পয়েন্ট এলাকায় প্রায় ১০০ মিটার অংশ ভেঙে পড়েছে। আমরা পাউবো এবং বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) যৌথভাবে সমীক্ষা চালিয়েছি। তাতে দেখা গেছে, প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকায় নদীর গভীরতা বেড়েছে এবং তলদেশ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। ফলে পুরো বাঁধ এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
তিনি আরও জানান, সোম ও মঙ্গলবার দুই দিনে উজান ও ভাটি মিলিয়ে আনুমানিক ২০০ মিটার বাঁধ ভেঙে গেছে। ভাঙন ঠেকাতে
জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হচ্ছে। বাঁধ মজবুতকরণের জন্য একটি ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে আগামী বর্ষার আগে পুরোপুরি বাঁধ মেরামত সম্ভব নয়।
গত বছরের নভেম্বরে জাজিরা উপজেলার পূর্ব নাওডোবা এলাকায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের তীর রক্ষা বাঁধে প্রায় ১০০ মিটার ভাঙন দেখা দেয়। পদ্মা সেতুর ১ হাজার ৭০০ মিটার পূর্বদিকে মঙ্গল মাঝির ঘাট এলাকায় সেই ভাঙন শুরু হয়।
পাউবো সূত্র জানায়, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে পদ্মার ভাঙনে শরীয়তপুরের নড়িয়া ও জাজিরা উপজেলার প্রায় ৩০টি গ্রাম নদীতে বিলীন হয়। গৃহহীন হয়ে পড়ে প্রায় ২০ হাজার পরিবার। শুধু ২০১৮ সালেই ৫ হাজার ৫০০ পরিবার ঘরবাড়ি হারায়, হারিয়ে যায় নড়িয়ার পাঁচটি বাজার। হাসপাতাল ভবনও রেহাই পায়নি।