গত ৫ জুলাই সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা ইন্তেকাল করেছেন। আমার সৌভাগ্য, আমি তাঁর স্নেহ লাভ করেছি। তাঁর সান্নিধ্যে কিছু অনুভূতি স্মৃতিপটে অক্ষয় হয়ে আছে। 
২০০৭ সালে ড. শামসুল হুদা প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এই দায়িত্ব গ্রহণের শুভলগ্নে তাঁর কৃতিত্বের অনেক গল্প তাঁরই পরিচিত গুণীজনের মুখে শুনেছি। কিন্তু গুণেরও যে একটা ধরন আছে, তাঁর সান্নিধ্যে না থেকে আবিষ্কার করা অসম্ভব। মানুষ ক্ষমতায় আসে ক্ষমতা উপভোগ করার জন্য। ক্ষমতা যে দুষ্টের দমন, শিষ্টের লালন এবং দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োগ করতে হয়, তা তিনি নিজের জীবনে অনুসরণ করে দেখিয়ে গেছেন। 

আধুনিক যুগে তথাকথিত বুদ্ধিমান লোকেরা কোনো কিছু নতুনভাবে গড়ার ঝুঁকি নিয়ে বোকা হতে চায় না। নতুন কিছু গড়তে হলে যে পরিমাণ সময় দিতে হয়, তাতে নিজের আরাম-আয়েশ করার সুযোগ একেবারেই সংকুচিত হয়ে যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সাধারণত পুরোনো জিনিস ঝুঁকি নিয়ে নতুন করে গড়ে তোলার সাহস করি না। ড.

হুদা ছিলেন তার ব্যতিক্রম। সময়ের প্রয়োজনে পুরোনো অবয়ব ভেঙে নতুন অবয়ব তৈরির পরিকল্পনা তাঁকে সব সময় তাড়া দিত। সৃষ্টির নেশা তাঁকে সব সময় আচ্ছন্ন করে রাখত। এসব করতে গিয়ে বিশ্রামহীনতা ও কঠোর শ্রমকে তিনি সানন্দে গ্রহণ করেছেন। বিশ্বমানের এনআইডি, বর্তমানে যা নাগরিক সত্তার অপরিহার্য নিয়ামক, তাঁরই অনবদ্য সৃষ্টি। উপজেলা কিংবা থানা পর্যায়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন ভবন স্থাপনে তাঁর ক্যারিশমা ছিল মেঘ না চাইতেই বারি বর্ষণের মতো। আমলাতন্ত্রের দুর্ভেদ্য প্রাচীর তিনি ভারী কুঠারের আঘাতে ছিন্ন করেছেন। নেতিবাচক মনোভাবকে নানা কৌশলে ইতিবাচক মনোভাবে রূপান্তর করে জনস্বার্থ রক্ষা করেছেন। 

সংস্কারের কথা বলতে গেলে, নির্বাচন কমিশন-সংশ্লিষ্ট আইনের প্রায় সব শাখা-উপশাখায় তিনি প্রয়োজনীয় সংস্কার করেছেন। নতুন আইন প্রণয়ন কিংবা আইন সংশোধন প্রক্রিয়াকে প্রচলিত ধারণায় সব সময় একটি দীর্ঘসূত্রতা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। কথিত এই দীর্ঘসূত্রতা এড়ানোর জন্য তিনি একের পর এক মিটিং করেছেন। প্রতিটি মিটিং যেন ছিল পরীক্ষার হল। সভাকক্ষে কী অলৌকিক শক্তি, ধৈর্য, মনোযোগ তাঁর ওপর ভর করত, তা বিধাতাই জানেন। অপেক্ষাকৃত তরুণ কর্মকর্তারা মিটিং চলাকালে সময়ের ব্যাপ্তিতে হাঁপিয়ে উঠলেও সর্বশেষ এজেন্ডা পর্যন্ত তিনি থাকতেন দৃঢ় ও অবিচল। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁর দূরদর্শিতা যেন অন্তরদৃষ্টিকে ছাপিয়ে যেত। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যে কৌশল তিনি অবলম্বন করতেন, তা ছিল প্রচলিত পদ্ধতি থেকে আলাদা। 

মানবসম্পদ উন্নয়নে ড. হুদার দর্শন ও পরিকল্পনা ছিল পক্ষপাতহীন। ব্যক্তির যোগ্যতা বাড়ানো, যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য স্থানে পদায়নে তিনি থাকতেন অনড়। তোষামোদকারীরা তোষামোদের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর ব্যক্তিত্বের উচ্চতা ছিল হিমালয়সম। তোষামোদকারীর হাত সেই উচ্চতা অতিক্রম করতে পারত না। তাঁর আমলে নথি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে নোট প্রদানকারী যেভাবে স্বাধীনতা ভোগ করেছেন, আজকাল তা বিরল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ন্যায়ানুগ যুক্তি নিয়ে যে কেউ খুব সহজেই তাঁর কাছে পৌঁছাতে পারতেন। আরও যা উল্লেখযোগ্য, তিনি সশরীরে কিংবা অনলাইনে তৃণমূলেও পৌঁছে যেতেন। তৃণমূলের নাড়ির স্পন্দন তাঁর ব্যক্তিত্বকে শতগুণে বিকশিত করেছে। শ্রদ্ধেয় এই গুণীজনের গুণের মূল্যায়ন লিখে বা বলে বর্ণনা করা অসম্ভব। আলাদা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই তাঁর বিশাল কর্মযজ্ঞের মূল্যায়ন হতে পারে।
ড. এটিএম শামসুল হুদা এখন আমাদের মাঝে সশরীরে নেই, তবে তাঁর কাজ রয়ে গেছে। জনস্বার্থে গৃহীত তাঁর মহৎ কাজগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি এ জগতে বেঁচে থাকবেন। বিধাতা তাঁকে তাঁর কর্মের বিনিময়ে জান্নাত দান করুন। আমিন।

মো. ফখর উদ্দীন শিকদার: 
সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: কর ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

সাবেক অধ্যক্ষসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে ১১ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

নওগাঁর বদলগাছী মহিলা ডিগ্রি কলেজের সাবেক অ্যাডহক কমিটির সভাপতি, সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও সিনিয়র প্রভাষকের বিরুদ্ধে ১১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগকারীদের দাবি, দুর্নীতি ঢাকতেই কলেজে ‘অধ্যক্ষের চেয়ার’ নিয়ে শুরু হয়েছে নাটকীয়তা।

অভিযোগে বলা হয়, সাবেক সভাপতি লুৎফর রহমান, সদ্যপ্রয়াত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মমতাজ জাহান ও প্রভাষক এস এইচ এম মাহমুদুল হাসান গাজী কলেজ ফান্ড ও শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণ বাবদ নেওয়া টাকার হিসাব দিতে পারেননি। ২০২৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৩ লাখ ৪০ হাজার ২০ টাকা ফি নেওয়া হলেও এর মধ্যে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৬৬ টাকার কোনো ব্যয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং ব্যাংক থেকে উত্তোলিত ৮ লাখ ৮ হাজার ৫০০ টাকাসহ মোট ১১ লাখ ৫৫ হাজার ১২১ টাকার হিসাব নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ব্যাংক থেকে উত্তোলনের স্টেটমেন্ট এরই মধ্যে গণমাধ্যম কর্মীদের হাতে এসেছে।

কলেজে গেলে দেখা যায়, অধ্যক্ষের অফিস কক্ষে মাহবুব আলম বসে রয়েছেন। অন্যদিকে, দোতলায় একটি ঘরের সামনে বসেছিলেন অন্য এক পক্ষের নিয়োগপ্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ইমামুল হোসেন।

এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে সাবেক সভাপতি লুৎফর রহমান বলেন, হজে ছিলাম। তখন শুনলাম, আমি সভাপতি নেই। টাকা আত্মসাতের প্রশ্নই ওঠে না। আমি কেবল চেকে সই দিয়েছি। খরচের দায়িত্ব ছিল অধ্যক্ষের। তিনি আরও বলেন, মামলা পরিচালনার খরচও কিছু হয়েছিল। তবে শিক্ষার্থীদের অর্থ কোথায় খরচ হয়েছে, আমার জানা নেই।

অভিযুক্ত প্রভাষক মাহমুদুল হাসান গাজীর দাবি, টাকা ব্যাংকে আছে। সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের সই ছাড়া টাকা তোলা সম্ভব নয়।
আরেক অভিযুক্ত ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘টাকা কখন তোলা হয়েছে, সেটা বলা সম্ভব নয় রেজিস্ট্রার ছাড়া।’

অন্যদিকে, বর্তমান অধ্যক্ষ মাহবুব আলম বলেন, তারা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে দুর্নীতি ঢাকতে চাইছেন। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিষয়টি নিয়ে কলেজের বর্তমান অ্যাডহক কমিটির সভাপতি ফজলে হুদা বাবুল বলেন, কলেজে কোনো অনিয়ম বরদাস্ত করা হবে না। নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষ দিয়ে অডিট করা হবে। সত্যতা মিললে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে কলেজের শিক্ষার্থীরা এই বিশৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক দ্বন্দ্বে হতাশ। তারা দ্রুত একটি শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছে।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ