সম্প্রতি একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে ফেসবুকে। অকুস্থল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ‍্যালয়ের উপাচার্যের অফিস। সেখানে হট্টগোল হচ্ছিল বিশ্ববিদ‍্যালয়ের সংস্কৃতি বিভাগের একজন শিক্ষককে নিয়ে, যাঁর সেই কক্ষে সেই সময়ে পদোন্নতির ভাইভা হওয়ার কথা। ভিডিওতে দেখা যায়, উপাচার্যের উপস্থিতিতে বেশ কয়েকজন ছাত্র সেই শিক্ষকের সঙ্গে তর্ক করছে এবং তাঁকে পদোন্নতি দেওয়া যাবে না বলে চিৎকার করছে। এক পর্যায়ে একজন ছাত্র উপাচার্যকে উদ্দেশ করে বলে, ‘আপনি নিজ যোগ‍্যতায় বসেননি, আপনাকে আমরা বসিয়েছি। আপনি আমাদের কথা শুনতে বাধ‍্য।’ 

অতীতে রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ‍্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দিত। এ কারণে বিশ্ববিদ‍্যালয়ের মতো জায়গায় উপাচার্যরা সরকারের এক প্রকার গোলাম হয়ে থাকতেন। কোনো বিষয়েই সরকারের বাইরে গিয়ে তাদের কোনো স্বতন্ত্র অবস্থান নিতে দেখা যেত না। প্রায় সর্বক্ষেত্রে সরকার-সমর্থিত ছাত্র সংগঠন তাদের ওপর ছড়ি ঘোরাত। কিন্তু গত বছরের জুলাইয়ের পর এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিল। দুঃখজনক যে, তা দেখা যাচ্ছে না। অন্তত আলোচ্য ভিডিওটি সেটাই প্রমাণ করে। স্বাভাবিকভাবেই এই ভিডিও সামাজিক মাধ‍্যমে নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।
গত ২২ জুন রাজধানীর এক আলোচনা অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ‍্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, শিক্ষার দায়িত্বে থাকাকালে তিনি উপাচার্যের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেছিলেন– ‘আওয়ামী লীগ তো হওয়া যাবে না। কাজেই মৃদু বিএনপি হওয়া যাবে অথবা নিষ্ক্রিয় বিএনপি হওয়া যাবে।’ বাস্তবেও দেখা যাচ্ছে, বর্তমানের প্রায় সব উপাচার্য বিএনপি কিংবা জামায়াত ঘরানার। তবে কি ছাত্ররা ঠিকই বলেছে? তারাই উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছে? লক্ষণীয়, ওই উপাচার্য কিন্তু ছাত্রদের এমন ঔদ্ধত্যের জবাবে তেমন কিছুই বলতে পারেননি। 

তবে কি গোড়াতেই গলদ ছিল? গত বছরের আগস্টে বিবিসি বাংলার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা ড.

মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ছাত্ররা তাদের (উপদেষ্টা পরিষদ) প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। তারা যখন বলবে, তখন তারা চলে যাবেন।’ এ কারণেই কি তারা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মব সৃষ্টির মাধ্যমে বহু শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনায় কোনো কার্যকর প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেননি? 
ছাত্ররা নিশ্চিতভাবেই তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলবে; গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করবে। বাংলাদেশের ইতিহাস তো একভাবে ছাত্র আন্দোলনেরই ইতিহাস। পৃথিবীতে বাংলাদেশ সম্ভবত একমাত্র দেশ, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একটি দেশের জন্ম দিয়েছে। তবে কোনো আন্দোলনের পর ছাত্রদের এ ধরনের মব সহিংসতা আগে খুব একটা দেখা যায়নি। 

বলার অপেক্ষা রাখে না, বিগত সময়ে শিক্ষকদের ক্ষমতাসীন দলের লেজুড়বৃত্তি শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ করেছিল। কিন্তু তা কোনোভাবেই শিক্ষাঙ্গনে মবতন্ত্রের অনুমোদন দেয় না। ছাত্রদের এজেন্সি থাকাটা জরুরি। তার মানে এই নয়– এখন ছাত্র পরিচয়টি ভয়ের হতে হবে। শিক্ষকদের এখন ছাত্রদের ভয় পেতে হবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ‍্যালয়ে পুরোপুরি একাডেমিক পরিবেশ ফিরে এসেছে; বলা যায় না। শিক্ষক বয়কট, এমনকি মব সৃষ্টি করে শিক্ষকদের বাসায় গিয়ে হাজির হওয়া– সবই এখানে ঘটেছে। অনেক শিক্ষকই ছেড়েছেন ক‍্যাম্পাসের বাসা। এখনও পাঠদানসহ একাডেমিক অন‍্যান‍্য কাজে ফিরতে পারেননি অনেক শিক্ষক। সব ছাত্রই এ ধরনের মব করছে, তা নয়। কিন্তু এই ছাত্র সবারই কোনো না কোনো রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। আগে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা যা করেছে, এখন এরাও সেই মনস্তত্ত্বেই আছে; হয়তো পদ্ধতি ভিন্ন। 

তাই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এখন অনেকটাই ভয়ের সম্পর্ক। নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে অনেক ছাত্রই যা করছে, তা বাস্তবে খবরদারি। সব তাদের দখল ও নিয়ন্ত্রণে থাকবে– এমন একটা ভাবসাব। দুর্ভাগ্যবশত, এখন পর্যন্ত কেউই বিশেষ করে সরকারের ওপর মহল ছাত্রদের লেখাপড়ায় ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেয়নি। কেন যেন সবাই চায়, ছাত্ররা রাস্তায় থাকুক। সরকারের পক্ষে ‘প্রেশার গ্রুপ’ হয়ে কাজ করুক। তা না হলে কেন শিক্ষা উপদেষ্টা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে এক দল ছাত্রের ধমকানো নিয়ে স্পষ্ট কোনো অবস্থান গ্রহণ করেননি? যদি ছাত্ররাই উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে থাকে, তাহলে উপদেষ্টারা কী করছেন? 

স্পষ্ট জানান দিতে চাই– এভাবে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালানো যায় না; যাবে না। এসব ছাত্রনামীয় পদমালিককে রোখা দরকার ছিল আগেই। কিন্তু তা করা যায়নি। জুলাই অভ্যুত্থানের অংশীদার এ দেশের সব শ্রেণির মানুষ। কিন্তু ক্ষমতা চর্চার মালিকানা কেন ছাত্র পরিচয়ধারী কয়েকজন মব সংগঠকের কাছে? তাদের এই কর্তৃত্ব করার অধিকার দিল কে? নিশ্চিতভাবেই এ দেশের জনগণ দেয়নি। কারণ কর্তৃত্ববাদিতার বিরুদ্ধেই তো জুলাই অভ্যুত্থান।
ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এখন যে পর্যায়ে আছে, তা কোনোভাবেই শিক্ষার প্রত্যাশিত পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস‍্যপূর্ণ নয়। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা, যাদের দ্বিধাহীন ও ব্যাপক অংশগ্রহণ গণঅভ্যুত্থানকে সম্ভব করে তুলেছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পথ এভাবেই রচিত হয়। সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে তাই এই সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতি বেশি দায়বদ্ধ থাকতে হবে। সরকারকে মনে রাখতে হবে– ভয়ের সংস্কৃতির জন‍্য যে কৌশলই ব‍্যবহৃত হোক না কেন, তা আদৌ ভালো ফল বয়ে আনে না। বেশি দূর যেতে হবে না; বিগত সরকারের পতনই তার প্রমাণ। তবে দুঃখজনক হলো, প্রতিকারের পদক্ষেপ না নিয়ে ঘটনা ঘটার পর সরকার এখনও বিবৃতিদানেই আটকে আছে– সেটি বুঝতে খুব বেশি মাথা ঘামাতে হয় না। 

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, 
নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ‍্যালয়
zobaidanasreen@gmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: উপ চ র য সরক র র উপদ ষ ট অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

কোন পথে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ

রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে পাল্টাপাল্টি হামলা বেড়েছে। নির্বাচিত হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার সংকল্প করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু তিনি তা পারেননি। বরং সামনের দিনগুলোতে আক্রমণ পাল্টা-আক্রমণ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

রাশিয়া তাদের গ্রীষ্মকালীন আক্রমণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে রাশিয়ার সেনাদের হাতে প্রতিদিনই ইউক্রেনের নতুন নতুন গ্রামের পতন ঘটছে। তারা ইউক্রেনের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ঘিরে ফেলা অথবা দখলে নেওয়ার দ্বারপ্রান্তে আছে। পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনও।

গত বৃহস্পতিবার ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে ফোনালাপ হয়। পরে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, আমার কথোপকথনে কোনো অগ্রগতি হয়নি। আমি খুবই হতাশ। পুতিন যুদ্ধ থামাতে চান বলে মনে হয় না।

পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বিবিসিকে বলেন, যুদ্ধের মূল কারণগুলো সমাধান না হওয়া পর্যন্ত রাশিয়া তাদের বিশেষ সামরিক অভিযান চালিয়ে যাবে। 

রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সোমবার জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় রুশ বাহিনী দিনিপ্রোপেট্রোভস্ক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম দাচনোয়ে এবং সুমি অঞ্চলের বেসসালোভকা গ্রাম দখল করেছে। দাচনোয়ে হলো দিনিপ্রোপেট্রোভস্ক অঞ্চলে রাশিয়ার দখল করা প্রথম জনপদ।

দোনেৎস্ক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শহর চাসিভ ইয়ার এবং এর আশপাশের সেটেলমেন্টগুলো সম্পূর্ণ দখলের নেওয়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে রাশিয়ার সেনারা। বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া যদি চাসিভ ইয়ার দখল করতে সক্ষম হয়, তাহলে তা সম্ভবত ক্রামাতোরস্ক ও স্লোভিয়ানস্ক শহরের দিকে আরও অগ্রসর হওয়ার সুযোগ করে দেবে। এগুলোই এখন রাশিয়ার দখলের বাইরে থাকা দোনেৎস্ক অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বসতি।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) জানিয়েছে, ইউক্রেনীয় বাহিনী সুমিতে কিছু এলাকা পুনর্দখল করেছে এবং ওই অঞ্চলে রুশ অগ্রগতি এখন ধীর হয়ে এসেছে।

বর্তমানে যুদ্ধ যেভাবে এগোচ্ছে তাতে রাশিয়ার দাবি করা বাকি অঞ্চলগুলো দখলে নিতে তাদের কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। দুই দেশের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকরে ট্রাম্প প্রশাসনের চেষ্টা এখনও সফলতার মুখ দেখেনি। 

অন্যদিকে, পশ্চিমাদের কঠোর নিষেধাজ্ঞার পরও রাশিয়ার অর্থনীতি এখন পর্যন্ত বেশ ভালোভাবেই সামলে চলেছেন পুতিন। এমন অবস্থায় ২০২৫ সালজুড়ে সংঘাত চলতে পারে এবং ২০২৬ সালেও গড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনকে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান হামলা থেকে আত্মরক্ষার সহায়তা করতে যুক্তরাষ্ট্র আরও অস্ত্র পাঠাবে। তবে এসব অস্ত্রের বেশির ভাগই হবে প্রতিরক্ষামূলক। সোমবার হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে নৈশভোজের শুরুতেই সাংবাদিকদের এ কথা বলেন ট্রাম্প। 

হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, আমরা আরও কিছু অস্ত্র পাঠাতে যাচ্ছি। আমাদের সেটা করতেই হবে। তাদের আত্মরক্ষার সক্ষমতা থাকতে হবে। তাদের এখন খুব কঠিনভাবে আঘাত করা হচ্ছে। আমাদের আরও অস্ত্র পাঠাতে হবে, প্রধানত প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র।


 

সম্পর্কিত নিবন্ধ