গণঅভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতা মিশ্র হলো কেন
Published: 8th, July 2025 GMT
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। রক্তক্ষয়ী সেই দিনগুলোর স্মৃতি এখনও তাজা। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসা সরকারেরও এক বছর হতে চলল। তার ‘পারফরম্যান্স’ও আলোচিত হচ্ছে গুরুত্বসহ। যেসব রাজনৈতিক দল ও পক্ষের সমর্থনে সরকারটি এসেছিল– বিগত সময়ে তাদের ভূমিকাও হচ্ছে আলোচিত। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুতরা মাঠে অনুপস্থিত। তাদের নেতৃস্থানীয় অংশটি অবস্থান করছে বিদেশে। অনেকের নামে শুরু হয়েছে বিচার। সংস্কারের আলোচনাও চলমান। তবে বেশি আলোচনায় নির্বাচন।
শেখ হাসিনার শাসনামলে নির্বাচন ঠিকমতো হয়নি। তিন-তিনটি ভুয়া নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকে যথেচ্ছাচার করে যাচ্ছিল সরকার। তাদের অপকর্ম নতুন করে বর্ণনার কিছু নেই। শেখ হাসিনার অন্ধ সমর্থক ছাড়া বিপুল অধিকাংশ জনগণ এ বিষয়ে একমত। জনগণের এ অংশটি ‘একটি দণ্ডে একাত্ম হয়ে’ সরকার পতনের আন্দোলনে শামিল হয়েছিল। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে সে ঐক্য অবশ্য নেই। কেননা, হাসিনা সরকারের পতন বাদে অন্যান্য প্রশ্নে তাদের মতপার্থক্য রয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যেও আছে মতপার্থক্য। বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন এই সময়ের প্রধান এজেন্ডা। এগুলো নিয়েও মতপার্থক্য কম নয়। সেটা গভীরতর হতেও দেখা যাচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব ছিল সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা ধরে রাখা। দলগুলো সর্বক্ষেত্রে ঐকমত্য পোষণ করবে, তা সম্ভব নয়। গণতন্ত্রে মতের ভিন্নতাকে ইতিবাচকভাবেও দেখা হয়ে থাকে। তবে ব্যতিক্রমী সময়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে আসা সরকারের কাছে দাবি করা হয় ‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা’।
গণতন্ত্রের ধ্বংসযজ্ঞ মাড়িয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত গণতন্ত্রে উত্তরণে সহায়তা জোগানো। জাতীয় নির্বাচন ছাড়া সেটি সম্ভব নয়। নির্বাচন যথাসম্ভব দ্রুত সম্পন্ন করা তাই প্রধান করণীয়। জাতি হিসেবে আমাদের যা কিছু প্রয়োজন, তা অর্জন করতে হবে গণতান্ত্রিকভাবেই। তবে গত প্রায় এক বছরে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি সামান্য বললে ভুল হবে না। কবে নাগাদ নির্বাচন– সেটা এখনও সুনির্দিষ্ট করতে পারেনি সরকার। নব্বইয়ে সামরিক শাসনের অবসানের পর তিন মাসের মধ্যেই কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছিল। সেই সরকার সংস্কারেও আগ্রহ দেখায়। কিন্তু সংস্কার তখন নির্বাচনের মুখোমুখি হয়ে সেটাকে বিলম্বিত করেনি।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতি অবশ্য অনেক জটিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আসা সরকারটি অব্যাহতভাবে ক্ষমতায় থাকতে চেয়ে অনেক বেশি সর্বনাশ করে গেছে, সন্দেহ নেই। বিশেষত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিনষ্ট করে গেছে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে গেলেও এ ক্ষেত্রে কিছু সংস্কার প্রয়োজন। অন্যান্য ক্ষেত্রেও সংস্কারের আবশ্যকতা কেউ অস্বীকার করে না। সরকার আয়োজিত এ-সংক্রান্ত সংলাপে সব রাজনৈতিক দলই অংশ নিচ্ছে। হালে কিছু সাংবিধানিক সংস্কারেও তাদের দেখা গেল একমত হতে। এটাকে হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। আরও অগ্রগতি আনা গেলে অবশ্যই ভালো হতো। কিন্তু সংস্কারে কাউকে বাধ্য করার সুযোগ তো নেই। সে কারণেই বলা হচ্ছে, ঐকমত্যের জায়গাগুলো ধরে সংস্কারের বাস্তবায়ন শুরু করা উচিত ছিল। সরকারে তেমন আগ্রহ কিন্তু পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এতে সংস্কার আলোচনায় কালক্ষেপণের অভিযোগও উঠছে। তবে চলতি মাসেই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হওয়ার কথা। এর ভেতর দিয়ে নির্বাচনের সময় চূড়ান্ত হলেই গণতন্ত্রে উত্তরণে উন্মুখ জনগোষ্ঠী আশ্বস্ত হবে।
গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব পক্ষ অবশ্য দ্রুত নির্বাচনে আগ্রহী নয়। একাংশের ধারণা, বিদ্যমান বিধি ব্যবস্থায় ‘প্রত্যাশিত সংস্কার’ না করে নির্বাচনে গেলে আবারও স্বৈরতন্ত্রের উত্থান ঘটবে। তারা সংবিধানেও ব্যাপক সংস্কার চাইছে। বিচারে বড় অগ্রগতিও তাদের কাম্য। এসব প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোয় বিরাট মতানৈক্য রয়েছে, তা অবশ্য নয়। সেটা থাকলে বিশেষত সংবিধান সংস্কার আলোচনায় কোনো অগ্রগতিই হতো না। সংকট আসলে দেখা দিয়েছে বিচার ও সংস্কারকে নির্বাচনের পূর্বশর্ত করা নিয়ে। অন্তর্বর্তী সরকারকেও এখানে একটি পক্ষভুক্ত মনে হচ্ছে। আলোচিত লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের সময়ের ব্যাপারে অগ্রগতি হলেও সে ক্ষেত্রে রয়েছে বিচার ও সংস্কারে ‘পর্যাপ্ত অগ্রগতি’র শর্ত। এ কারণে নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না– ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। অনেক বাদানুবাদের পর এটুকু স্থির করা গেছে, এপ্রিলের মধ্যেই নির্বাচন। যদিও মনে করা হচ্ছে, প্রাকৃতিক ও আর্থসামাজিক দিক থেকে এপ্রিল নির্বাচনের উপযুক্ত সময় নয়!
কোনো কোনো পক্ষ আবার জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি তুলছে অব্যাহতভাবে। তারা এটাও বলছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই। গণঅভ্যুত্থানের পর মব ভায়োলেন্সসহ আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে চলেছে। প্রায় এক বছরেও এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি সরকার। রাজনৈতিক সহিংসতাও চলমান। মাঠে থাকা দলগুলো দেখাচ্ছে অসহিষ্ণুতা। গণঅভ্যুত্থানের কৃতিত্ব দাবি থেকে নিয়ে পরস্পরের ভূমিকা বিষয়ে উত্তেজক বক্তব্য প্রদানও অব্যাহত। এতে সাধারণ প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতেও রাজনৈতিক পরিবেশ হচ্ছে বিষাক্ত। এ অবস্থায় স্থানীয় নির্বাচন হলেও তা শান্তিপূর্ণভাবে হবে বলে মনে হয় না। সে কারণেও দ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানেই সর্বশক্তি নিয়োগ করা দরকার। তা ছাড়া জাতীয় নির্বাচন ঘিরেই তো সংকট দেখা দিয়েছে। আর গণঅভ্যুত্থানের পর যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে উত্তরণ ঘটতে পারে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমেই। এ লক্ষ্য অর্জনে সেনাবাহিনীর নজিরবিহীন সহায়তাও নিতে হবে এবার। কেননা, পুলিশকে এখনও সক্রিয় করা যায়নি।
গত দেড়-দুই দশকে বিশ্বে যেসব গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করেও পদক্ষেপ নিতে হবে। তিউনিসিয়ায় সৃষ্ট আরব বসন্তের পর সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কি সাধারণভাবে সুখকর? এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা অবশ্য ভিন্ন। এটাও ঠিক, দেশে দেশে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ভিন্নতা থাকে। তাই তুলনায় সতর্কতা প্রয়োজন। ‘বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণ’ও জরুরি। গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী আর এতে ক্ষমতা গ্রহণকারী সরকারকেও সেটা করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিরও নির্মোহ মূল্যায়ন প্রয়োজন। হালে স্বয়ং অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচনের সময়ের ব্যাপারে অগ্রগতি হওয়ায় উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থ ছাড়ে এগিয়ে এসেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বাংলাদেশে দ্রুত গণতন্ত্রে উত্তরণ দেখতে আগ্রহী। সংস্কারেও আগ্রহী তারা। আওয়ামী লীগের অপরাধী অংশের বিচারে ছাড় দেওয়ার কথাও কেউ বলছে না। তবে এসব করতে গিয়ে নির্বাচন বিলম্বিত হলে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা গ্রাস করবে জাতিকে। নানা দিক দিয়ে ‘দুর্বল’ বলে বিবেচিত অন্তর্বর্তী সরকার তা সামলাতে পারবে বলেও মনে হয় না।
সরকার সবল হলে এবং মাঠে থাকা সব পক্ষের আস্থা অটুট রাখতে পারলেও নির্বাচনের জন্য কিছুটা বেশি সময় হয়তো নেওয়া যেত। অর্থনীতি বড় চ্যালেঞ্জে না থাকলেও হয়তো সম্ভবপর হতো সেটা। আর রাজনীতিতে অস্থিরতা ও ঝুঁকি কম থাকত। কিন্তু পরিস্থিতি তো জানা। চরম স্বেচ্ছাচারী একটি সরকারকে হটানোর পর এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়াটা অস্বাভাবিকও নয়। সে কারণেও প্রয়োজন যত দ্রুত সম্ভব স্বাভাবিক পরিবেশে উত্তরণ। নির্বাচন সেই পথ প্রশস্ত করবে বৈ কি। এর ভেতর দিয়ে বিচার ও সংস্কারের দাবি নিভে যাবে বলে মনে করারও কারণ নেই। নির্বাচিত সরকার তেমন মনোভাব দেখালে জনগণ নিশ্চয় তাদের মার্জনা করবে না।
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত গণঅভ য ত থ ন র গ রহণক র গণতন ত র পর স থ ত র জন ত ক সরক র র ন র পর অবশ য দলগ ল ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
খালেদা জিয়ার আরোগ্য কামনায় মসজিদ-মাদ্রাসায় মাসুদুজ্জামানের দোয়া
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর চেয়ারপারসন, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দ্রুত আরোগ্য, সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনায় নারায়ণগঞ্জে বিশেষ দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের বিএনপির মনোনীত প্রার্থী, বিশিষ্ট সমাজসেবী ও ক্রীড়া সংগঠক মাসুদুজ্জামানের উদ্যোগে রবিবার (৩০ নভেম্বর) জেলার বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, স্থানীয় ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানজুড়ে এ দোয়ার আয়োজন করা হয়।
মসজিদ, মাদ্রাসাতে অনুষ্ঠিত এই দোয়া মাহফিলগুলোতে অংশ নেন নানা বয়সের মুসল্লি, স্থানীয় আলেম-উলামা, মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। প্রতিটি স্থানে বেগম খালেদা জিয়ার দ্রুত আরোগ্য, দীর্ঘায়ু এবং দেশের কল্যাণ কামনায় বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করা হয়।
দোয়ায় অংশগ্রহণকারীরা বলেন, বেগম জিয়া দেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সংগ্রামের প্রতীক; তাঁর সুস্থতা কামনা করা সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
আয়োজক মাসুদুজ্জামান বলেন- “আমাদের প্রিয় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্য দেশের প্রতিটি মসজিদে দোয়া অব্যাহত রাখুন। আল্লাহ যেন তাঁকে পূর্ণ সুস্থতা, শক্তি ও দীর্ঘায়ু দান করেন- আমীন। আমরা সবাই জানি, দেশের মানুষের অধিকার, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।”
তিনি আরও বলেন - “এ দোয়া শুধু আজকের আয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আমরা চাই এটি ধারাবাহিকভাবে চলুক – গতকাল ২৯ নভেম্বরের মতো আজও যেন একইভাবে দোয়ার আয়োজন অব্যাহত থাকে, এ প্রত্যাশা জানিয়ে আমি সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি অনুরোধ করছি।
নারায়ণগঞ্জের প্রতিটি অঞ্চল, প্রতিটি মহল্লা, প্রতিটি মসজিদ-মাদ্রাসা এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়মিতভাবে দোয়া আয়োজনের ব্যবস্থা আমরা অব্যাহত রাখব, ইনশাআল্লাহ।
আমরা আশা করি- জনগণের আন্তরিক দোয়া ও প্রার্থনার মাধ্যমে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দ্রুত সুস্থ হয়ে আবারও দেশের মানুষের মাঝে ফিরে আসবেন।”
এই দোয়া মাহফিলে আগত মুসল্লিরা দেশনেত্রীর সুস্থতা ও দেশের কল্যাণ কামনা করে আন্তরিকভাবে দোয়া করেন।