জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। রক্তক্ষয়ী সেই দিনগুলোর স্মৃতি এখনও তাজা। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসা সরকারেরও এক বছর হতে চলল। তার ‘পারফরম্যান্স’ও আলোচিত হচ্ছে গুরুত্বসহ। যেসব রাজনৈতিক দল ও পক্ষের সমর্থনে সরকারটি এসেছিল– বিগত সময়ে তাদের ভূমিকাও হচ্ছে আলোচিত। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুতরা মাঠে অনুপস্থিত। তাদের নেতৃস্থানীয় অংশটি অবস্থান করছে বিদেশে। অনেকের নামে শুরু হয়েছে বিচার। সংস্কারের আলোচনাও চলমান। তবে বেশি আলোচনায় নির্বাচন।

শেখ হাসিনার শাসনামলে নির্বাচন ঠিকমতো হয়নি। তিন-তিনটি ভুয়া নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকে যথেচ্ছাচার করে যাচ্ছিল সরকার। তাদের অপকর্ম নতুন করে বর্ণনার কিছু নেই। শেখ হাসিনার অন্ধ সমর্থক ছাড়া বিপুল অধিকাংশ জনগণ এ বিষয়ে একমত। জনগণের এ অংশটি ‘একটি দণ্ডে একাত্ম হয়ে’ সরকার পতনের আন্দোলনে শামিল হয়েছিল। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে সে ঐক্য অবশ্য নেই। কেননা, হাসিনা সরকারের পতন বাদে অন্যান্য প্রশ্নে তাদের মতপার্থক্য রয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যেও আছে মতপার্থক্য। বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন এই সময়ের প্রধান এজেন্ডা। এগুলো নিয়েও মতপার্থক্য কম নয়। সেটা গভীরতর হতেও দেখা যাচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব ছিল সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা ধরে রাখা। দলগুলো সর্বক্ষেত্রে ঐকমত্য পোষণ করবে, তা সম্ভব নয়। গণতন্ত্রে মতের ভিন্নতাকে ইতিবাচকভাবেও দেখা হয়ে থাকে। তবে ব্যতিক্রমী সময়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে আসা সরকারের কাছে দাবি করা হয় ‘রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা’।
গণতন্ত্রের ধ্বংসযজ্ঞ মাড়িয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত গণতন্ত্রে উত্তরণে সহায়তা জোগানো। জাতীয় নির্বাচন ছাড়া সেটি সম্ভব নয়। নির্বাচন যথাসম্ভব দ্রুত সম্পন্ন করা তাই প্রধান করণীয়। জাতি হিসেবে আমাদের যা কিছু প্রয়োজন, তা অর্জন করতে হবে গণতান্ত্রিকভাবেই। তবে গত প্রায় এক বছরে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি সামান্য বললে ভুল হবে না। কবে নাগাদ নির্বাচন– সেটা এখনও সুনির্দিষ্ট করতে পারেনি সরকার। নব্বইয়ে সামরিক শাসনের অবসানের পর তিন মাসের মধ্যেই কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছিল। সেই সরকার সংস্কারেও আগ্রহ দেখায়। কিন্তু সংস্কার তখন নির্বাচনের মুখোমুখি হয়ে সেটাকে বিলম্বিত করেনি।

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতি অবশ্য অনেক জটিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আসা সরকারটি অব্যাহতভাবে ক্ষমতায় থাকতে চেয়ে অনেক বেশি সর্বনাশ করে গেছে, সন্দেহ নেই। বিশেষত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিনষ্ট করে গেছে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে গেলেও এ ক্ষেত্রে কিছু সংস্কার প্রয়োজন। অন্যান্য ক্ষেত্রেও সংস্কারের আবশ্যকতা কেউ অস্বীকার করে না। সরকার আয়োজিত এ-সংক্রান্ত সংলাপে সব রাজনৈতিক দলই অংশ নিচ্ছে। হালে কিছু সাংবিধানিক সংস্কারেও তাদের দেখা গেল একমত হতে। এটাকে হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। আরও অগ্রগতি আনা গেলে অবশ্যই ভালো হতো। কিন্তু সংস্কারে কাউকে বাধ্য করার সুযোগ তো নেই। সে কারণেই বলা হচ্ছে, ঐকমত্যের জায়গাগুলো ধরে সংস্কারের বাস্তবায়ন শুরু করা উচিত ছিল। সরকারে তেমন আগ্রহ কিন্তু পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এতে সংস্কার আলোচনায় কালক্ষেপণের অভিযোগও উঠছে। তবে চলতি মাসেই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হওয়ার কথা। এর ভেতর দিয়ে নির্বাচনের সময় চূড়ান্ত হলেই গণতন্ত্রে উত্তরণে উন্মুখ জনগোষ্ঠী আশ্বস্ত হবে।
গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব পক্ষ অবশ্য দ্রুত নির্বাচনে আগ্রহী নয়। একাংশের ধারণা, বিদ্যমান বিধি ব্যবস্থায় ‘প্রত্যাশিত সংস্কার’ না করে নির্বাচনে গেলে আবারও স্বৈরতন্ত্রের উত্থান ঘটবে। তারা সংবিধানেও ব্যাপক সংস্কার চাইছে। বিচারে বড় অগ্রগতিও তাদের কাম্য। এসব প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোয় বিরাট মতানৈক্য রয়েছে, তা অবশ্য নয়। সেটা থাকলে বিশেষত সংবিধান সংস্কার আলোচনায় কোনো অগ্রগতিই হতো না। সংকট আসলে দেখা দিয়েছে বিচার ও সংস্কারকে নির্বাচনের পূর্বশর্ত করা নিয়ে। অন্তর্বর্তী সরকারকেও এখানে একটি পক্ষভুক্ত মনে হচ্ছে। আলোচিত লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের সময়ের ব্যাপারে অগ্রগতি হলেও সে ক্ষেত্রে রয়েছে বিচার ও সংস্কারে ‘পর্যাপ্ত অগ্রগতি’র শর্ত। এ কারণে নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না– ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। অনেক বাদানুবাদের পর এটুকু স্থির করা গেছে, এপ্রিলের মধ্যেই নির্বাচন। যদিও মনে করা হচ্ছে, প্রাকৃতিক ও আর্থসামাজিক দিক থেকে এপ্রিল নির্বাচনের উপযুক্ত সময় নয়!

কোনো কোনো পক্ষ আবার জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি তুলছে অব্যাহতভাবে। তারা এটাও বলছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই। গণঅভ্যুত্থানের পর মব ভায়োলেন্সসহ আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে চলেছে। প্রায় এক বছরেও এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি সরকার। রাজনৈতিক সহিংসতাও চলমান। মাঠে থাকা দলগুলো দেখাচ্ছে অসহিষ্ণুতা। গণঅভ্যুত্থানের কৃতিত্ব দাবি থেকে নিয়ে পরস্পরের ভূমিকা বিষয়ে উত্তেজক বক্তব্য প্রদানও অব্যাহত। এতে সাধারণ প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতেও রাজনৈতিক পরিবেশ হচ্ছে বিষাক্ত। এ অবস্থায় স্থানীয় নির্বাচন হলেও তা শান্তিপূর্ণভাবে হবে বলে মনে হয় না। সে কারণেও দ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানেই সর্বশক্তি নিয়োগ করা দরকার। তা ছাড়া জাতীয় নির্বাচন ঘিরেই তো সংকট দেখা দিয়েছে। আর গণঅভ্যুত্থানের পর যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে উত্তরণ ঘটতে পারে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমেই। এ লক্ষ্য অর্জনে সেনাবাহিনীর নজিরবিহীন সহায়তাও নিতে হবে এবার। কেননা, পুলিশকে এখনও সক্রিয় করা যায়নি।

গত দেড়-দুই দশকে বিশ্বে যেসব গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করেও পদক্ষেপ নিতে হবে। তিউনিসিয়ায় সৃষ্ট আরব বসন্তের পর সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কি সাধারণভাবে সুখকর? এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা অবশ্য ভিন্ন। এটাও ঠিক, দেশে দেশে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ভিন্নতা থাকে। তাই তুলনায় সতর্কতা প্রয়োজন। ‘বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণ’ও জরুরি। গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী আর এতে ক্ষমতা গ্রহণকারী সরকারকেও সেটা করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিরও নির্মোহ মূল্যায়ন প্রয়োজন। হালে স্বয়ং অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচনের সময়ের ব্যাপারে অগ্রগতি হওয়ায় উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থ ছাড়ে এগিয়ে এসেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বাংলাদেশে দ্রুত গণতন্ত্রে উত্তরণ দেখতে আগ্রহী। সংস্কারেও আগ্রহী তারা। আওয়ামী লীগের অপরাধী অংশের বিচারে ছাড় দেওয়ার কথাও কেউ বলছে না। তবে এসব করতে গিয়ে নির্বাচন বিলম্বিত হলে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা গ্রাস করবে জাতিকে। নানা দিক দিয়ে ‘দুর্বল’ বলে বিবেচিত অন্তর্বর্তী সরকার তা সামলাতে পারবে বলেও মনে হয় না। 
সরকার সবল হলে এবং মাঠে থাকা সব পক্ষের আস্থা অটুট রাখতে পারলেও নির্বাচনের জন্য কিছুটা বেশি সময় হয়তো নেওয়া যেত। অর্থনীতি বড় চ্যালেঞ্জে না থাকলেও হয়তো সম্ভবপর হতো সেটা। আর রাজনীতিতে অস্থিরতা ও ঝুঁকি কম থাকত। কিন্তু পরিস্থিতি তো জানা। চরম স্বেচ্ছাচারী একটি সরকারকে হটানোর পর এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়াটা অস্বাভাবিকও নয়। সে কারণেও প্রয়োজন যত দ্রুত সম্ভব স্বাভাবিক পরিবেশে উত্তরণ। নির্বাচন সেই পথ প্রশস্ত করবে বৈ কি। এর ভেতর দিয়ে বিচার ও সংস্কারের দাবি নিভে যাবে বলে মনে করারও কারণ নেই। নির্বাচিত সরকার তেমন মনোভাব দেখালে জনগণ নিশ্চয় তাদের মার্জনা করবে না।

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলাম লেখক

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত গণঅভ য ত থ ন র গ রহণক র গণতন ত র পর স থ ত র জন ত ক সরক র র ন র পর অবশ য দলগ ল ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

পিআর পদ্ধতি কি রাজনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হবে

প্রপোশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন বা পদ্ধতি বাংলাদেশে বর্তমানে আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ছোট-বড় প্রায় সব রাজনৈতিক দলের মধ্যেই পিআর পদ্ধতির পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান ও জনমত গঠনের প্রচেষ্টা চোখে পড়ার মতো।

বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে আলোচনা যত পুরোনো, ততই নতুন করে বারবার আলোচনার টেবিলে ফিরে আসে পিআর পদ্ধতির প্রস্তাব। তবে আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে এবারই সর্বোচ্চ আলোচনায় রয়েছে পিআর পদ্ধতি।

দেশের একশ্রেণির রাজনীতিবিদের দাবি, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন সংখ্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে ছোট দলগুলোকেও প্রতিনিধিত্বের সুযোগ তৈরি করে দেবে এবং নির্বাচনী রাজনীতিকে আরও যুগোপযোগী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলবে। তাঁদের দাবি, দলীয় স্বৈরতন্ত্রের লাগাম টেনে ধরে প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনকাঠামোর বিকল্প নেই।

আরও পড়ুনবাংলাদেশের জন্য পিআর পদ্ধতির নির্বাচন কতটা যৌক্তিক২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

অন্যদিকে আরেক শ্রেণির বিশ্লেষক এটিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, জোটের সংকট ও শাসন অদক্ষতার উৎস হিসেবে বিবেচনা করছেন। তাঁদের দাবি, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থায় একধরনের ‘নড়বড়ে’ সরকার গঠিত হবে, যা দিন শেষে রাজনৈতিক ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে শেষ হবে।

তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, গণপ্রতিনিধিত্বের এই গাণিতিক মডেল কি সত্যিই বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠবে, নাকি নতুন করে রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সূত্রপাত হবে?

এ প্রশ্নের উত্তর ব্যাপক ও বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। প্রথমেই পিআর পদ্ধতির মূল ধারণা ও এর প্রতি কেন বিশেষ কিছু রাজনৈতিক দলের এত আকর্ষণ, তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।

বস্তুত, এটি এমন একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা, যেখানে একটি দলের প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার অনুযায়ী সংসদে তাদের আসন বরাদ্দ হয়। অর্থাৎ একটি দল যদি জাতীয়ভাবে ২০ শতাংশ ভোট পায়, তবে সংসদে তারা ২০ শতাংশ আসন পাবে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই ভোটে একটি দল সংসদে ৩০০-এর মধ্যে ৬০টি আসন পাবে।

অর্থাৎ এটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে সম্পূর্ণ আধিপত্যের সুযোগ না দিয়ে সংখ্যালঘু দলগুলোকেও যথোপযুক্ত প্রতিনিধিত্বের সুযোগ করে দেয়। তাত্ত্বিকভাবে এটি গণতান্ত্রিক ন্যায়বিচারের নিখুঁত উদাহরণ, তাতে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

২.

আধুনিক বিশ্বে ১৮৯৯ সালে প্রথম বেলজিয়ামে পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ইউরোপের অনেক দেশ—বিশেষ করে জার্মানি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডসসহ নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন ও লাতিন আমেরিকার একাধিক দেশে এ ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে এই পদ্ধতিতে সাফল্যের সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা করে আসছে।

সেই উদাহরণ টেনেই বর্তমানে বাংলাদেশেও পিআর বাস্তবায়নের জোর আহ্বান জানিয়ে আসছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ বেশ কয়েকটি ছোট রাজনৈতিক দল। অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও তার সহযোগী দলগুলো বর্তমান প্রচলিত পদ্ধতি বহাল রাখার পক্ষে।

বাস্তবতা হলো, ইউরোপ বা লাতিন আমেরিকার উন্নত দেশগুলোর রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিপক্ব, তাদের দলীয় শৃঙ্খলা দৃঢ় এবং প্রশাসনিক কাঠামোও তুলনামূলকভাবে উন্নত ও নিরপেক্ষ। ফলে পিআর পদ্ধতি সেখানে গণতান্ত্রিক বৈচিত্র্য ও প্রতিনিধিত্বের ভারসাম্য বজায় রাখতে পেরেছে। এটি বাংলাদেশের জন্য কতটুকু উপযুক্ত—সেটিই প্রধান প্রশ্ন।

আরও পড়ুনআনুপাতিক সংসদীয় আসনব্যবস্থার জন্য আমরা কি প্রস্তুত২৮ অক্টোবর ২০২৪

বাংলাদেশে বর্তমানে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ পদ্ধতিতে একজন ভোটার শুধু তাঁর নির্বাচনী আসনের একজন প্রার্থীকেই ভোট দিতে পারেন।

প্রচলিত এই ব্যবস্থায় পুরো দেশকে মোট ৩০০টি পৃথক নির্বাচনী আসনে ভাগ করা হয়। প্রতিটি আসনে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত ব্যক্তিই নির্বাচিত বলে বিবেচিত হন।

একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। যেমন ঢাকা–১৯ আসনের কথাই বিবেচনা করা যাক। ধরা যাক, বর্তমান পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে এ আসনে তিনটি দল থেকে মনোনীত তিনজন ও একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলে মোট চারজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৮০ শতাংশ।

এর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ প্রার্থী যথাক্রমে ২৫, ১৫ ও ১০ শতাংশ করে ভোট পেয়েছেন। আর তৃতীয় প্রার্থী পেলেন ৩০ শতাংশ ভোট। বর্তমান পদ্ধতি অনুযায়ী তৃতীয় প্রার্থী এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। আর ওই তিনজন প্রার্থীর মোট ৫০ শতাংশ ভোট কোনো কাজেই আসবে না। কারণ, বিধি মোতাবেক শুধু একজনই নির্বাচিত হতে পারবেন।

৩.

বাংলাদেশে বহুদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রচলিত। এখানে অর্ধশতাধিক নিবন্ধিত দল রয়েছে। তবে বাস্তবতার নিরিখে দেখা যায়, হাতে গোনা চার-পাঁচটি রাজনৈতিক দল সক্রিয় এবং কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত তাদের ভোটব্যাংক রয়েছে। বাকি দলগুলোর এ ক্ষেত্রে নানা সংকট বিদ্যমান।

তাই বিচ্ছিন্নভাবে ৩০০টি আসনে কমবেশি ভোট পেলেও অধিকাংশ দলই সংসদের সীমিতসংখ্যক এমনকি কিছু ক্ষেত্রে কোনো আসনেও জিতে আসতে পারে না। এ জন্য বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি নিয়ে ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

ছোট দলগুলো জনগণের ভোট পেলেও সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকে না। এই বঞ্চনা পিআর পদ্ধতি দূর করতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। অর্থাৎ ৩০০ আসন মিলিয়ে প্রতি ১ শতাংশ ভোটের বিনিময়ে তিনটি করে আসন পাবে দলগুলো।

বিদ্যমান ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতিতে একটি দল তুলনামূলকভাবে কম ভোট পেয়েও সংসদে বিপুল আসন পেয়ে যায়। আবার কাছাকাছি সংখ্যক ভোট পেয়েও কিছু কিছু দল নগণ্যসংখ্যক আসন পেয়ে থাকে।

গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসা। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে ভোটাররা কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীকে নয়, বরং একটি রাজনৈতিক দল বা প্রতীককে ভোট দেন। এতে স্বভাবতই গণতান্ত্রিক জবাবদিহির সংকট তৈরি হয়। কারণ, এই কাঠামোয় জনগণের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিত্বের সম্পর্কটি পুরোপুরি ভেঙে যায়।

এমন পটভূমিতে পিআর পদ্ধতি বাংলাদেশের অনেক বিশ্লেষকের কাছে রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তির একটি বিকল্প উপায় বলে মনে হয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, বাংলাদেশের মতো সংকীর্ণ কিংবা অধীন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দলীয়করণে নিমজ্জিত রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোয় এই গাণিতিক মডেল বাস্তবে কতটুকু কাজ করবে?

বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো গণতান্ত্রিক সহনশীলতার পর্যায়ে পৌঁছায়নি। রাজনীতিতে সমঝোতার পরিবর্তে শত্রুতার মনোভাব প্রবল।

বিদ্যমান বাস্তবতায় পিআর পদ্ধতিতে কোনো দলেরই এককভাবে ক্ষমতায় যেতে না পারার সম্ভাবনাই বেশি। ফলে বাধ্য হয়েই জোট সরকার গঠন করতে হবে। তবে জোট সংস্কৃতি সহযোগিতার ভিত্তিতে না হলে রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক কালো অধ্যায়ের সূচনা হবে। বিশেষত বাংলাদেশের মতো সংঘাতমুখী রাজনীতিতে এটি স্থিতিশীলতার বদলে অবিরাম রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি করবে। তা ছাড়া পিআর ব্যবস্থায় দলীয় নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়।

কারণ, সংসদ সদস্যরা সাধারণ জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হয়ে দলীয় তালিকা থেকে মনোনীত হন। এতে দলীয় প্রধানের একনায়কত্ব আরও মজবুত হয়, যা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক।

অন্যদিকে প্রশাসনিক দুর্বলতা, দুর্নীতি এবং স্বচ্ছতার ঘাটতি—এ বাস্তবতায় পিআর ব্যবস্থা সহজেই রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সূত্রপাত করবে।

আরও পড়ুনআনুপাতিক উচ্চকক্ষই এখন সংস্কারের প্রধান চাওয়া এবং কেন?১২ জুন ২০২৫৪.

গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসা। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে ভোটাররা কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীকে নয়, বরং একটি রাজনৈতিক দল বা প্রতীককে ভোট দেন। এতে স্বভাবতই গণতান্ত্রিক জবাবদিহির সংকট তৈরি হয়। কারণ, এই কাঠামোয় জনগণের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিত্বের সম্পর্কটি পুরোপুরি ভেঙে যায়।

একজন সাধারণ ভোটার জানেন না, তাঁর দেওয়া ভোটে কে সংসদে যাচ্ছেন, বা সেই নির্বাচিত ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের পথ কী, সেটাও অজানা। ফলে সংসদ সদস্যের দায়বদ্ধতা জনগণের প্রতি নয়, বরং দলের প্রতি তৈরি হয়, যা গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতার মূল দর্শনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

বাংলাদেশে সংসদ সদস্যরা দায়বদ্ধতা থেকেই নিজের নির্বাচনী এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা স্থানীয় চাহিদা পূরণে যথেষ্ট সোচ্চার থাকেন। কেননা পরবর্তী নির্বাচনে ওই এলাকার জনগণের ভোটের ব্যাপার থেকে যায়।

কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে সেই তৃণমূল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। সংসদ সদস্যরা নির্বাচনী এলাকার মানুষকে নয়, বরং দলীয় হাইকমান্ডকে খুশি রাখতে ব্যস্ত থাকবেন। কেননা পুনরায় সংসদে যাওয়ার টিকিট তখন নির্ধারণ করবে সংশ্লিষ্ট দল, জনগণ নয়।

আবার পিআর বাস্তবায়নের আগে অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতাও বিবেচনায় রাখা আবশ্যক। পিআর ব্যবস্থায় সংসদে ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ নিয়ে বহু দল একত্রে বসবে। স্বার্থের ভিন্নতা ও দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা সংসদকে বিশৃঙ্খল করে তুলবে। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হবে এবং নীতি বাস্তবায়ন আরও জটিল হবে।

আরও পড়ুনএমপিদের ‘জমিদারি’ ঠেকানোর উপায় আনুপাতিক নির্বাচন২৩ ডিসেম্বর ২০২৪৫.

একটি অস্থিতিশীল ও নড়বড়ে সরকার গঠিত হবে, যা সহজেই জোট রাজনীতির জাঁতাকলে পড়ে যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে। বিশেষত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো বিশাল জনগোষ্ঠীর বহুমুখী এমন অস্থিতিশীলতার চাপ সহ্য করতে ব্যর্থ হবে, যা একটি ব্যর্থ সরকার এমনকি একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারে।

তাই বাংলাদেশের মতো দেশে স্থিতিশীল সরকার গঠন ও নীতির ধারাবাহিকতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যা পিআর পদ্ধতির অধীনে প্রায় অসম্ভব।

অবশ্য সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার স্পষ্টভাবে বলেছেন, তর্কবিতর্ক চললেও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন সংবিধানে নেই। ফলে কমিশন এর বাইরে যেতে পারবে না। তা ছাড়া বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি চালু হলে সংসদ হবে একটি খণ্ডিত রাজনৈতিক অঙ্গন, যেখানে একাধিক দল একে অপরের সঙ্গে দর-কষাকষিতে ব্যস্ত থাকবে।

আরও পড়ুনঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার নির্বাচন নাকি আনুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা, কোনটা?১৫ নভেম্বর ২০২৪

এতে সরকার গঠন যেমন কঠিন হবে, তেমনি দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন রাজনীতির বিলোপ ঘটবে। বিরোধী দলগুলোর জন্য এটি স্বল্প মেয়াদে কিছু প্রতিনিধিত্বের সুযোগ আনতে পারে, তা সত্য, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে গণতন্ত্রকে আরও অনিশ্চিত করে তুলবে, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

পিআর পদ্ধতি একটি গাণিতিক ধারণা। তবে তা হঠাৎ করেই আসন্ন সংসদ নির্বাচনে প্রচলন করার সুযোগ নেই। কারণ, গণতন্ত্র শুধু সংখ্যার খেলা নয়; এটি আমাদের দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি, নেতৃত্বের জবাবদিহি ও ন্যায্যতার অনুশীলন।

আমাদের দেশের গণতন্ত্রের বিদ্যমান সংকট পদ্ধতিগত নয় বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নিবদ্ধ। যত দিন পর্যন্ত নিরপেক্ষ প্রশাসন ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন নিশ্চিত না করা যাবে, আর রাজনীতির চর্চা সহনশীলতা ও সমঝোতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত না হবে, তত দিন কোনো নির্বাচনী মডেলই সফল হবে না।

সে জন্য এসব সংকট সমাধানে নজর দিতে হবে। পিআর পদ্ধতি হয়তো ভোটের ভারসাম্য আনবে, কিন্তু রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করবে। তাই আজকের বাংলাদেশে এটি কোনো সমাধান নয়, বরং এর মাধ্যমে নতুন এক রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সূত্রপাত হতে পারে।

ড. মো. শামছুল আলম অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ; ডিন (ভারপ্রাপ্ত) সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘নোট অব ডিসেন্টগুলো’ লিপিবদ্ধ হলে বিএনপি জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে: মির্জা ফখরুল
  • ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান দুদুর
  • কিশোরগঞ্জ-১ আসনে নির্বাচন করার ঘোষণা দিলেন জেলা বিএনপির সম্পাদক মাজহারুল
  • ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে মারা গেলেন কেনিয়ার বিরোধী নেতা
  • মিত্রদের প্রার্থী তালিকা নিয়ে হিসাব কষছে বিএনপি
  • গণতন্ত্র উত্তরণের পরীক্ষায় আমাদের উত্তীর্ণ হতে হবে: মির্জা ফখরুল
  • বিএনপি জনগণের শক্তির উপর আস্থাশীল: ডা. জাহিদ
  • পিআর পদ্ধতি কি রাজনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হবে
  • নির্বাচনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারিত হবে: ফখরুল