আমরা যতই চোখ বন্ধ করে থাকি, বাস্তবতা ততই তীব্রভাবে সামনে এসে দাঁড়ায়। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধকে কেউ কেউ ভাবতে পারেন মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি সংঘাত, যার সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। কিন্তু এই ধারণা চরম আত্মতুষ্টির। কারণ আজকের যুদ্ধগুলো শুধু গোলাগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; তা ছড়িয়ে পড়েছে সাইবার স্পেস, সংবাদমাধ্যম এবং নীতিনির্ধারণী স্তরে। এই যুদ্ধের ভেতর লুকিয়ে আছে এমন এক পাঠ, যেটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও কৌশলগত অবস্থান নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ইরানের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে– একটি দেশের পতন বাইরের বোমা দিয়ে নয়, ভেতরের ফাটল দিয়ে শুরু হতে পারে। এই যুদ্ধের শিক্ষার ভেতরে লুকিয়ে আছে একটি সুসংগঠিত জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালা তৈরির আহ্বান।
ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে ইরান তার ভেতরের বিশৃঙ্খলার কারণে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। ‘ট্রেচারাস অ্যালায়েন্স’ বইতে গবেষক ত্রিতা পার্সি বলেছেন, ‘ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের অভাব এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পরস্পর দ্বন্দ্বই বিদেশি আগ্রাসনের সবচেয়ে বড় সুযোগ তৈরি করেছে।’ এই বিশ্লেষণ বাংলাদেশের জন্য অমূল্য সতর্কতা। আমাদের দেশেও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, প্রশাসনিক ইউনিট, সামরিক ও বেসামরিক দপ্তর– সব একেকটি দ্বীপের মতো। কারও সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই। সমলয়ে কাজ করা দূরের কথা, অনেক সময় পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতাও স্পষ্ট হয়। এই সমন্বয়হীনতাই সবচেয়ে ভয়ংকর। আমরা প্রায়ই বলি, ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’ প্রশ্ন হচ্ছে, নিজেদের মধ্যকার অনৈক্য ও সমন্বয়হীনতাই কি এ ধরনের ষড়যন্ত্রকে যেচে আমন্ত্রণ জানায় না?
আগে যুদ্ধ মানেই ছিল ট্যাঙ্ক, কামান, বিমান। এখন যুদ্ধ হয় অতি আধুনিক অস্ত্র দিয়ে, যাকে আমরা বলি সফট পাওয়ার। এর বিশেষ মাধ্যম হচ্ছে ‘মানবাধিকার’, ‘গণতন্ত্র’, ‘বিনিয়োগ নিরাপত্তা’ বা ‘ডিজিটাল আইন’। উইলিয়াম ব্লাম তাঁর ‘কিলিং হোপ’ বইতে দেখিয়েছেন, কীভাবে স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে পশ্চিমা শক্তি ও তার মিত্ররা নির্দিষ্ট দেশের ভেতরে ঢুকে বিভাজন তৈরি করেছে, তথ্য নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং অর্থনৈতিক বাধার মাধ্যমে দেশগুলোর নীতিগত স্বাধিকার কেড়ে নিয়েছে। আজকের যুগে সেই কৌশল আরও ভয়ংকর। কারণ এখন আছে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স। বিদেশি রাষ্ট্র বা করপোরেট শক্তিগুলো বাংলাদেশ সম্পর্কে কোন বার্তাগুলো ভাইরাল হবে– তাও ঠিক করে দিতে পারে, যার সামনে আমরা প্রায়ই অসহায়।
বাংলাদেশ এখনই এই কৌশলের শিকার হতে শুরু করেছে। শ্রমিক অধিকার নিয়ে বিদেশি চাপ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনা কিংবা জলবায়ু অনুদানের বদলে রাজনৈতিক সংস্কার চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা– সবই সেই সফট যুদ্ধের অংশ।
দরকার সমন্বিত রাষ্ট্রীয় নীতিমালা
বাংলাদেশের জাতীয় নীতির ক্ষেত্রে যে অসংহতি রয়েছে, তা ইরানের চেয়েও গভীর। ইরান যতই সংকটে থাকুক না কেন, তাদের ন্যূনতম একটি কৌশলগত ভিত্তি রয়েছে, বিশেষত প্রতিরক্ষা ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণ মূলত বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার ফল। কখনও ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমে প্রযুক্তিনির্ভর রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখানো হয়, আবার কখনও ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর ব্যানারে ভবিষ্যৎমুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়। মাঝে একটি ‘জাতীয় নিরাপত্তানীতি’ও ঘোষিত হয়েছে, স্বীকার করতে হবে। কিন্তু এসব পরিকল্পনার মধ্যে নেই কোনো সুসংহত কাঠামো বা আন্তঃসংস্থাগত সমন্বয়। সবচেয়ে বড় বিষয়, রয়েছে সার্বিক সুশাসনের অভাব।
দেখা যাবে, বাংলাদেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, সাইবার নিরাপত্তা টিম, প্রশাসন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজেদের মতো চলে। সব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নীতি বা কৌশলগত সমন্বয়ের উদাহরণ নেই বললেই চলে। অনেক সময় দেখা যায়, একই ঘটনার ভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন সংস্থা থেকে, যা সংকট মোকাবিলায় নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। একটি পূর্ণাঙ্গ, বহুমাত্রিক ও বাস্তবভিত্তিক জাতীয় কৌশলপত্র দরকার, যেখানে রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা একই মানচিত্রে অবস্থান নির্ধারণ করতে পারে। নীতিমালার অভাব মানে শুধু অসংগঠিত অবস্থাই নয়; এটি একটি নিরাপত্তা ঝুঁকিও তৈরি করে, বিশেষ করে যখন প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র ও অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জ সামনে আসে। এখন সময় একীভূত কৌশলগত ভাবনার।
এই জায়গায় একটি সম্ভাব্য খসড়া প্রস্তাব হিসেবে ভাবা যেতে পারে ‘এনসিএসআইডি’ বা ন্যাশনাল কোহেশন অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক ইন্টেলিজেন্স ডকট্রিনের কথা, যার মূল স্তম্ভ হবে চারটি।
১.
২. সাইবার সার্বভৌমত্ব টাস্কফোর্স বা সাইবার সভরেন্টি টাস্কফোর্স (সিএসটি): এই ইউনিট কাজ করবে জাতীয় তথ্যভান্ডার, অর্থনৈতিক ও ডিজিটাল অবকাঠামো রক্ষায়। বিদেশি হ্যাকিং বা ডিজিটাল হামলার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ডেটা হচ্ছে নতুন জ্বালানি– এই উপলব্ধিকে কাজে লাগাবে।
৩. কৌশলগত যোগাযোগ ইউনিট বা স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন ইউনিট (এসসিইউ): এই ইউনিটের কাজ হবে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষা, বিদেশি বর্ণনার বিপরীতে নিজস্ব বয়ান বা ন্যারেটিভ তৈরি এবং নাগরিকদের মানসিক দৃঢ়তা গড়ে তোলা।
৪. অভ্যন্তরীণ ঐক্য পরিষদ বা ডমেস্টিক কোহেশন কাউন্সিল (ডিসিসি): রাজনৈতিক নেতা, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, একাডেমিক এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই পরিষদ অভ্যন্তরীণ বিভাজনের উৎস চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধ করবে। যেন সমস্যা সংঘর্ষে রূপ না নেয়। এই নীতিমালায় থাকবে বার্ষিক পুনর্মূল্যায়ন, আন্তঃসংস্থা মহড়া, বাস্তবমুখী নিরাপত্তা অনুশীলন ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সমন্বয় কাঠামো। এটি ‘সার্ভেইল্যান্স’ বা নজরদারিমূলক নয়; বরং প্রতিরোধমূলক নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
ঐক্য কেবল শব্দ নয়; পূর্বশর্ত।
উইলিয়াম ব্লাম দেখিয়েছেন, বাইরের শক্তিগুলো সবচেয়ে বেশি সফল হয় তখনই, যখন ভেতরের ঐক্য থাকে না। তারা নতুন ফাটল তৈরি করে না; শুধু বিদ্যমান ফাটলগুলোকে চওড়া করে। ত্রিতা পার্সিও একইভাবে বলেছেন, ইরানের গোয়েন্দা ব্যর্থতা আসলে অভ্যন্তরীণ অসংগঠনের ফল। তারা পরাজিত হয়নি; বরং তাদের দুর্বলতার সুযোগ কাজে লাগানো হয়েছে।
এই কথাগুলো আমাদের জন্য আয়নার মতো। বাংলাদেশ এখনও যুদ্ধক্ষেত্রে যায়নি। কিন্তু ভৌগোলিক দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা এমন অবস্থানে রয়েছি, যা ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, গোটা এশিয়ার বৃহৎ শক্তিগুলোর নজর রয়েছে এখানে; নতুন ও পুরোনো পরাশক্তিগুলোর স্বার্থও রয়েছে এ অঞ্চলে। বস্তুত গোটা বিশ্বব্যবস্থা আজ এমন নাজুক পরিস্থিতি অতিক্রম করছে, যে কোনো সময় যে কোনো অঞ্চলে বিদ্যমান নিরাপত্তা কাঠামো ভেঙে পড়তে পারে। আমাদের উচিত সব ধরনের পরিস্থিতির জন্য এখনই প্রস্তুতি নিয়ে রাখা। সে জন্য বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সমন্বয় জরুরি।
বাংলাদেশ একই সঙ্গে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে যেতে চায়– চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক, আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও অংশীদারিত্ব। ভারত, রাশিয়া, সৌদি আরব– সবদিকেই সমীকরণ। কিন্তু এই কূটনীতির ফসল ঘরে তুলতে চাইলে আগে ঘরের ভিত শক্ত করতে হবে। আমরা যদি নিজেদের সংস্থাগুলোকে ক্ষেত্রবিশেষে একটি কৌশলে না আনতে পারি; নিজেদের বিভক্তিকে নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারি, তাহলে অন্য কেউ আমাদের জন্য নীতি বানিয়ে দেবে। তখন আমরা স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলব।
আলাউদ্দীন মোহাম্মদ: যুগ্ম সদস্য সচিব, জাতীয় নাগরিক পার্টি
alauddin0112@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: অবস থ ন ব যবস থ ক শলগত র জন ত র ভ তর র জন য আম দ র সমন ব ইউন ট সবচ য়
এছাড়াও পড়ুন:
ইরান এবার বড় যুদ্ধের জন্য যেভাবে প্রস্তুত হচ্ছে
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যে অস্বস্তিকর যুদ্ধবিরতি হয়েছে, তাতে ১২ দিনের পাল্টাপাল্টি হামলার অবসান ঘটেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সংঘাতে নিজেদের বিজয় ঘোষণা করেছেন। একুশ শতকের স্বল্প স্থায়ী একটি যুদ্ধ হিসেবে এটি চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
ইরানও এই যুদ্ধে বিজয় দাবি করেছে। ১৯৮০-১৯৮৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ইরান-ইরাক যুদ্ধ শেষে যেমন করে ইরান বিজয় দাবি করেছিল, এবারের ঘটনাটি অনেকটাই তার সঙ্গে মিলে যায়। সেই যুদ্ধ ছিল বিশ শতকের অন্যতম দীর্ঘ প্রথাগত যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনও বিজয় দাবি করেছিলেন।
দুটি ক্ষেত্রেই ইরান আক্রান্ত হয়েছে। ইরানের শাসকেরা দুটি সংঘাতকেই ‘আরোপিত যুদ্ধ’ বলে চিত্রিত করেছেন এবং দাবি করেছেন এই যুদ্ধের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সবুজ সংকেত’ ছিল।
দুটি ক্ষেত্রেই ইরান তাদের বিজয় ঘোষণার ক্ষেত্রে কৌশলগত ধৈর্য (সব্র-ই রাহবর্দি) প্রদর্শনের নীতি নিয়েছে। অর্থাৎ সংযম প্রদর্শনের মাধ্যমে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারসাম্যকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে যাওয়ার নীতি অবলম্বন করেছে ইরান।
ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর, ইরান অপেক্ষা করে ছিল। সময় ও পরিস্থিতিকে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইরান নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রই ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় সাদ্দামের গণবিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংস করেছিল। এরপর ২০০৩ সালে তাঁকে সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল।
তেহরানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে আজকেও তারা সেই একই কৌশলগত ধৈর্যের নীতি প্রয়োগ করছে।
বর্তমান যুদ্ধবিরতিকে প্রকাশ্যে স্বাগত জানিয়েছে ইরান। কিন্তু দেশটির শাসকেরা বিশেষ করে রাজনৈতিক ও সামরিক মহল এটিকে একটি কৌশলগত যুদ্ধবিরতি হিসেবে দেখছেন। তাঁরা এটাকে টেকসই শান্তি হিসেবে দেখছেন না।
ইরানের জন্য ইসরায়েলের সঙ্গে এই যুদ্ধবিরতি একটি স্পষ্ট কৌশলগত উদ্দেশ্য বহন করছে।
এই কৌশলগত ঘাটতি পূরণে, ইরান এখন জরুরি ভিত্তিতে রাশিয়ার এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও সু-৩৫ যুদ্ধবিমান সংগ্রহের উদ্যোগ নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে চীনের কাছ থেকে যুদ্ধবিমান নেওয়ার বিষয়টিকেও ইরান এখন বিবেচনা করবে। কেননা, সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সময় চীনের যুদ্ধবিমান সক্ষমতা প্রমাণ করেছে।ইরানের এই কৌশলগত ধৈর্যের নীতিতে সময়কে একটি সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইরান এখন সময়কে পারমাণবিক কৌশল পুনর্মূল্যায়নের, আঞ্চলিক জোট সম্প্রসারণের এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজেদের দৃঢ়তার সীমা পরীক্ষার উপায় হিসেবে গ্রহণ করবে।
এই সময়ে ইরানের নীতিনির্ধারকেরা তাঁদের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাকে আবার পর্যালোচনা করবেন। বিশেষ করে নৌবাহিনীর সক্ষমতা এবং সাইবার অপারেশনের সক্ষমতার মতো বিষয়গুলো তাঁরা আবারও মূল্যায়ন করবেন। আর এসব কিছুর লক্ষ্য হচ্ছে, একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা তৈরি করা।
সময়, তেহরানের সামনে তিনটি জায়গায় নতুন করে চিন্তাভাবনা করার গুরুত্বপূর্ণ ফুরসত এনে দিয়েছে। প্রথমত, নেতৃত্ব পুনর্গঠন; দ্বিতীয়ত, অস্ত্রভান্ডার পূর্ণ করা এবং তৃতীয়ত, একটি আন্তর্জাতিক পরিসরে কূটনৈতিক আক্রমণ শানানোর পরিকল্পনা।
১৯৮১ সালের জুন মাসে ইসলামিক রিপাবলিকান পার্টির কার্যালয়ে বোমা হামলা করা হয়। এতে দলটির মহাসচিব মোহাম্মদ বেহেশতিসহ ৭৪ জন উচ্চপদস্থ কর্তা নিহত হন। ওই একই মাসে, ইরান ইরাক সীমান্তে এক লড়াইয়ে দেশটির অন্যতম প্রভাবশালী সামরিক কমান্ডার মোস্তাফা চামরান নিহত হন।
১৯৮১ সালের আগস্ট মাসে ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ-আলি রাজাই এবং প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ-জাভাদ বাহোনার তেহরানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি বোমা হামলায় নিহত হন।
এই হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল মুজাহিদিন-ই-খালক নামে সশস্ত্র গোষ্ঠী। বিরোধী এই গোষ্ঠী ইসলামিক রিপাবলিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এবং ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তুলেছিল।
বোমাটি স্থাপন করেছিল মাসউদ কেশমিরি। তিনি ছিলেন মুজাহিদিন-ই-খালকের সদস্য। নিরাপত্তা কর্মকর্তার ছদ্মবেশে তিনি সরকারে অনুপ্রবেশ করেছিল। বিস্ফোরণে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় পুলিশের প্রধান, জ্যেষ্ঠ সামরিক উপদেষ্টা এবং সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যসহ আটজন পদস্থ কর্তা নিহত হয়েছিলেন। যুদ্ধের শুরুর বছরে এটি ছিল ভয়ানক একটি নাশকতা।
এত বড় ক্ষয়ক্ষতির পরেও ইরান পাল্টা আক্রমণ চালাতে সক্ষম হয়েছিল। ইরানের ভূখণ্ড থেকে ইরাকের সমস্ত সেনাকে বিতাড়িত করেছিল।
গত ১৩ জুন ভোররাতে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েল তার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান শুরু করে।
এই হামলা শুধু পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না। ইরানের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার ও বিজ্ঞানীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল ইসরায়েল। নিহতদের মধ্যে ছিলেন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের কমান্ডার হোসেইন সালামি, এবং অ্যারোস্পেস প্রধান আমির আলী হাজিজাদেহ। বেশ কয়েকজন পারমাণুবিজ্ঞানী ও সামরিক কর্মকর্তাকেও হত্যা করেছিল ইসরায়েল।
এরপরও ইরান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিপুলসংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করতে সক্ষম হয়। ইসরায়েলের বহুল প্রশংসিত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে চরম চাপের মুখে ফেলে দেয়। এই যুদ্ধে ইরানের স্বল্প ও মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত কমেছে এবং ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
শান্তির এই নতুন পর্যায়ে, ইরান তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার পূর্ণ করা এবং আধুনিকায়নে অগ্রাধিকার দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর মধ্যে নতুন প্রজন্মের ক্ষেপণাস্ত্র ফাত্তাহ ও খাইবার শেকানের মতো হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত থাকবে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতের যেকোনো আকস্মিক হামলার আশঙ্কা মাথায় রেখে ইরান এখন আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও জোরদার করবে।
সদ্যসমাপ্ত যুদ্ধ থেকে ইরানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হতে পারে, একটি আধুনিক যুদ্ধে একটি সক্ষম ও উন্নত বিমানবাহিনী ছাড়া বিজয় অর্জন সম্ভব নয়।
যদিও ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনভিত্তিক প্রতিরোধব্যবস্থা কিছুটা কৌশলগত শক্তি দেখিয়েছে। কিন্তু এর বড় ধরনের দুর্বলতাও উন্মোচিত হয়েছে। আধুনিক বিমান ও বৈদ্যুতিন যুদ্ধের সক্ষমতা আছে, এমন শক্তির বিরুদ্ধে শুধু এই ব্যবস্থা সেভাবে কাজ করে না।
এই কৌশলগত ঘাটতি পূরণে, ইরান এখন জরুরি ভিত্তিতে রাশিয়ার এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও সু-৩৫ যুদ্ধবিমান সংগ্রহের উদ্যোগ নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে চীনের কাছ থেকে যুদ্ধবিমান নেওয়ার বিষয়টিকেও ইরান এখন বিবেচনা করবে। কেননা, সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সময় চীনের যুদ্ধবিমান সক্ষমতা প্রমাণ করেছে।
এ ছাড়া ইরানের সামরিকবিদেরা আরেকটি বড় ঘাটতিকে চিহ্নিত করেছেন। সেটা হলো, এয়ারবোর্ন ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম বা আকাশপথে কোনো আক্রমণ হলে আগেভাগেই সতর্ক করার প্রযুক্তি না থাকা।
সবচেয়ে উন্নত ভূমিভিত্তিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সক্ষমতাও মারাত্মকভাবে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় এয়ারবোর্ন ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম ছাড়া। এ কারণে তেহরান এখন চীন বা রাশিয়া থেকে এয়ারবোর্ন ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম সংগ্রহে অগ্রাধিকার দেবে।
এর বাইরেও ইরান এখন কূটনৈতিক ও আইনি পাল্টা আক্রমণ শাসানোর ভূমি প্রস্তুত করবে।
মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
মোহাম্মদ ইসলামি, পর্তুগালের মিনহো বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক
ইব্রাহিম আল-মারাশি, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি সান মারকোসের মধ্যপ্রাচ্য ইতিহাসের সহযোগী অধ্যাপক।