বিজাতীয় সংস্কৃতিকে ছুড়ে ফেলে দিতে হবে: কাদের গনি চৌধুরী
Published: 23rd, May 2025 GMT
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, সংস্কৃতি একটি জাতির পরিচিতির মৌলিক উপাদান। এর মাধ্যমে কোনো জাতির জাতিসত্তা আলাদা রূপে পরিস্ফুটিত হয়। তাই সংস্কৃতিকে বলা হয় একটি সমাজের আয়না। কিন্তু সেই আয়নায় যদি সমাজের চিত্র না ফুটে, সমাজের বিপরীত কিছু ফুটে ওঠে, তবে সমাজের অসংগতি দেখা দেবে।
তিনি বলেন, অপসংস্কৃতি মানুষকে কলুষিত করে এবং জীবনের সৌন্দর্যের বিকাশকে স্তব্ধ করে দিয়ে শ্রীহীনতার দিকে ঠেলে দেয়। কোনো জাতির স্বকীয়তা, জাতীয়তা, সামাজিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ তার সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে। তেমনি সংস্কৃতিতে বিজাতীয় আগ্রাসন একটি জাতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। এ সংস্কৃতিকে ছুড়ে ফেলে দিতে হবে। জাতির উন্নয়নে শিক্ষা আমদানি করা যায় বটে কিন্তু সংস্কৃতি আমদানি করলে জাতিসত্তা হারিয়ে যায়।
শুক্রবার বিকেলে শিল্পকলা একাডেমিতে জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে জাতীয় শিশু কিশোর সংগঠন ‘আমরা কুঁড়ি’র ৩৪ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা সভা, পুরস্কার বিতরণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তিনি এসব বলেন।
এ এস এম কামাল উদ্দিনের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালাম, সৈয়দ আলমগীর, আইয়ুব ভূঁইয়া, নুরুল আজম পবন, এরফানুল হক নাহিদ, মাসুদুল হক, রাশেদা ওয়াহিদ মুক্তা, আমরা কুড়ির চেয়ারম্যান মুশতাক আহমদ ও মহাসচিব ফেরদৌস আরা বন্যা।
কাদের গনি চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যাদের সংস্কৃতির আছে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। যুগে যুগে এ দেশের সংস্কৃতি হয়েছে সমৃদ্ধ। অথচ গত কয়েক বছর ধরে এ দেশের সংস্কৃতিতে বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন চোখে পড়ার মতো। এ আগ্রাসন এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠছে যে, দেশীয় সংস্কৃতিকে ভুলে যাচ্ছে অনেকে। অনেকে বাংলা চলচ্চিত্রের অভিনেতাদের না জানলেও ভারতীয় অভিনেতা ও চলচ্চিত্রের নাম পরিচয় মুখস্ত। যেসব ছেলে রিয়াদ, মান্না, শাকিবদের নাম জানে না, তারা অনায়াসেই বলতে পারবে সালমান, শাহরুখ, আমির খানদের ইতিহাস। যেখানে দেশীয় চলচ্চিত্র নির্মাতারা লোকসান দিয়ে চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরে যেতে চাইছে, সেখানে বিদেশিরা এই দেশের হলগুলোতে তাদের চলচ্চিত্র নিয়ে ব্যবসা করতে চাইছে। কারণ, তারা জানে এই দেশের হলগুলোতে দেশীয় চলচ্চিত্রের দর্শক না থাকলেও, বিদেশি চলচ্চিত্রের দর্শকের অভাব হবে না।
তিনি বলেন, এ দেশের ছেলেরা বাংলা গান না শুনলেও, হিন্দি কিংবা ইংরেজি গায়কদের ইতিহাসও জানে। তবে বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসনটা সবচাইতে ভয়াবহ হচ্ছে নারীদের ক্ষেত্রে। এদের ওপর সবচাইতে বেশি আগ্রাসন চালাচ্ছে ভারতীয় টিভি চ্যানেল স্টার জলসা, স্টার গোল্ড, স্টার প্লাস, জি বাংলা, সনি আর্ট ইত্যাদি। এই চ্যানেলগুলোর সিরিয়ালের প্রতি এরা এতটাই আকৃষ্ট যে, এসব নারীদের সন্তান, স্বামী কিংবা অন্য যে কোনো আপনজনরা অসুস্থ হয়ে কাতরায়, তবু এরা স্টার জলসা, জি বাংলা সিরিয়াল ছেড়ে উঠে আসতে চায় না। আরেকটা বিষয়ে না বললেই নয়, সংগীতের বিশ্বায়নের নামে বাংলাদেশের অনেক মিডিয়ায় বিদেশি গানগুলো প্রচার করছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশীয় শিল্পীদের বাদ দিয়ে বিদেশি শিল্পীদের দেশে এনে অনুষ্ঠান করার সংস্কৃতি চালু হয়েছে।
বিএফইউজে মহাসচিব বলেন, আমার বলতে দ্বিধা নেই যে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রভাবে দেশীয় সংস্কৃতিতে আজ মহাবিপর্যয় নেমে এসেছে। আমাদের ঐতিহ্যবাহী সুরসম্ভার হারিয়ে গেছে ইংরেজি আর হিন্দি সংগীতের প্রভাবে। আজ বাংলাদেশের কোথাও বাংলা সংগীত শোনা যায় না সবখানে হিন্দি আর ইংরেজি দখল করে নিয়েছে। বিয়ে, উৎসব, পিকনিক থেকে শুরু করে যে কোনো আচার-অনুষ্ঠানে আজ শুধু হিন্দি সংগীতই শোনা যায়। এখানে বাংলা যেন নিষিদ্ধ। এখন আর আব্দুল আলীম, আব্বাস উদ্দিন কণ্ঠের সেই পল্লী জীবনের যে হৃদয়গ্রাহী চিত্র ফুটে উঠত তা শোনা যায় না। ব্যান্ড সংগীতের নামে আমাদের নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা যে চেঁচামেচির মহড়া দেয় তা মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করে না মোটেও। এরপরও একদল উঠতি যুবকের অবচেতন মনের দুর্বলতাকে পুঁজি করে এসবের বাজার দিন দিন সরগরম হচ্ছে।
সাংবাদিকদের এ নেতা বলেন, এক সময় পোশাক-পরিচ্ছদে আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ছিল। কিন্তু সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে তা আজ হারিয়ে গেছে। বিদেশি সাংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ও চর্চা আমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক-পরিচ্ছদে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। আমাদের তরুণ সমাজ আজ অপসংস্কৃতির স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। পশ্চিমা বিশ্বের জীবনাচরণকে মডেল বা আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করছে। ছেঁড়া প্যান্ট, চুলের অদ্ভুত কাটিং, অস্বাভাবিক অঙ্গভঙ্গিকে তথাকথিত আধুনিক হিসেবে জাহির করছে। আমাদের মেয়েদের অনেকেই স্বল্পবসনকে আধুনিক জীবনের নমুনা বলে মনে করে এর প্রতি চরম আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। এটাও সত্য যে, প্রযুক্তির এই অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে কোনো কিছুই বন্ধ করে রাখা সম্ভব নয়। তাই বলে ঘরে হাত গুটিয়ে বসে থাকাটাও সমীচীন হবে না।
তাই আমাদের বিজাতীয় সংস্কৃতিকে ছুড়ে ফেলে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা করতে হবে। এক্ষেত্রে বিষয়টি আমরা গ্রহণ করব। তবে সবার আগে নিজেদের সাংস্কৃতিক ভিত মজবুত ও উন্নত করতে হবে।
কাদের গনি আরও বলেন, শিক্ষার একটা সংস্কৃতি আছে। শিক্ষার সংস্কৃতির নিহিত চাহিদা হলো মুক্ত পরিবেশ, অংশগ্রহণের অবাধ সুযোগ, প্রকাশের স্বাধীনতা। শিশুদের মেধা ও মননের বিকাশে সংস্কৃতি চর্চার বিকল্প নেই। শিশুদের শুধু পাঠ্য বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবেন না। তাদের জন্য অবশ্যই খেলাধুলা, বিনোদন এবং সংস্কৃতি চর্চার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এতে শিশু সামাজিক হবে এবং সহনশীল হতে শিখবে। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে ছোটবেলা থেকেই, না হয় বড় হয়ে নিজেদেরই সন্তানদের জন্য বিপাকে পড়তে হবে।
‘আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তারাই আগামী দিনে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্ব দেবে। জ্ঞানচর্চা ও প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হয়ে গড়ে তুলবে সবার জন্য কল্যাণকর নতুন বিশ্ব। তাই শিশুদের প্রতি আমাদের বিশেষভাবে যত্ন নেওয়া উচিত। তারা যেন সৃজনশীল, মননশীল ও মুক্তমনের মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিশ্বের প্রতিটি মানুষের। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিশু সুরক্ষার জন্য কার কী দায়িত্ব, তা নির্ধারণ করে দিয়ে এই দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয় ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় পরিবার, স্কুল, মিডিয়া এবং সামাজিক সংগঠনগুলো শিশু সুরক্ষার জন্য প্রতিরোধমূলক কর্মকাণ্ড ও ইতিবাচক চর্চাগুলো নিশ্চিত করে।’
তিনি আরও বলেন, একদিকে আমাদের সন্তানরা আছে দুধে-ভাতে। ভালো কাপড় পরিধান করছে, ভালো খাচ্ছে, ভালো স্কুলে যাচ্ছে। অন্যদিকে অসংখ্য বাংলা মায়ের সন্তানকে দেখি পথশিশু বা টোকাই নামে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে। আমার সন্তান থাকবে দুধে-ভাতে আর অন্যের সন্তান থাকবে ফুটপাতে- এটা বন্ধ করতে হবে। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের জেগে উঠতে হবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: চলচ চ ত র র আম দ র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
স্বাধীন নিরপেক্ষ বিচারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে
একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং কার্যকর বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। বিচার বিভাগ পরিচালনার জন্য একটি স্বতন্ত্র ‘বিচার বিভাগীয় সচিবালয়’ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা পুনরায় জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হয়।
শুক্রবার বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে চট্টগ্রাম বিভাগের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ মো. হাসানুল ইসলাম। সভাপতিত্ব করেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ জজ মো: আমিরুল ইসলাম। চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার বিভিন্ন স্তরের বিচারকরা এ সভায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।
আলোচনায় বক্তারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরেন। বিচারকার্য পরিচালনায় অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দকে বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে বক্তারা জেলা আদালতের বিচারকদের প্রশাসনিক নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের আওতায় আনার ওপর জোর দেন।
সভায় ‘মাসদার হোসেন মামলার’ ৬ নম্বর নির্দেশনার আলোকে বিচারকদের জন্য একটি পৃথক ও স্বাধীন পে-কমিশন গঠনের দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়। বক্তারা বলেন, বিচারকগণ সংবিধান রক্ষার গুরু দায়িত্ব পালন করেন বিধায় তাদের আর্থিক সুবিধা ও সম্মানি সেই দায়িত্বের গুরুত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া উচিত। এই লক্ষ্যে বিদ্যমান বেতন কাঠামোর অতিরিক্ত ৩০% হারে বিচারিক ভাতা বকেয়াসহ প্রদানের এবং একটি নতুন পে-কমিশন গঠন করে শতভাগ বিচারিক ভাতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়।
উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জেলা আদালতের বিচারকদের প্রতি যে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়, তা নিরসনের প্রয়োজনে জ্যেষ্ঠতা, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে জেলা আদালতের বিচারকদের উচ্চ আদালতে ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানান।
বিচার বিভাগের আধুনিকায়ন ও স্বাধীনতা রক্ষায় অ্যাসোসিয়েশনকে একটি সক্রিয় ও কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গগে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে বক্তারা ‘ইয়ং জাজেস ফোরাম’-এর সাহসী ও গতিশীল ভূমিকাকে আন্তরিকভাবে স্বীকৃতি দেন। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
সভায় সর্বসম্মতিক্রমে প্রত্যাশা জানানো হয় যে, বর্তমান অর্ন্তবতীকালীন সরকার বিচার বিভাগের কাঠামোগত ও প্রশাসনিক সংস্কারে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। বক্তারা বলেন, বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ছাড়া রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। সে প্রেক্ষাপটে প্রধান বিচারপতির ঘোষিত বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ দ্রæত বাস্তবায়ন এবং একটি পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ কামনা করা হয়।