আমরা শুনেছি ধীরে রান্না, ধীরে ভ্রমণ, এমনকি ধীর জীবনযাপনের কথা। কিন্তু কখনো কি শুনেছেন ‘ধীর নামাজ’ বা ‘স্লো সালাত’র কথা? আজকের গতির জীবনে, যখন আমরা সন্তান, বয়স্ক পিতা–মাতা ও ক্যারিয়ারের চাপে জর্জরিত, ধীর নামাজ আমাদের জীবনকে একটি মানবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনতে পারে। এটি কেবল একটি কৌশল নয় বরং নামাজের প্রকৃত রুহানি অভিজ্ঞতায় ফিরে যাওয়ার পথ। আমাদের আধুনিক জীবনের গতি অমানবিকভাবে ত্বরান্বিত। ধীর নামাজ সেই তাড়াহুড়ার বিপরীতে আমাদের আল্লাহর সঙ্গে গভীর সংযোগ স্থাপনের সুযোগ দেয়। 

কেন ধীর নামাজ

আমরা অনেকেই বলি, ‘আমার এত কাজ, আমি কীভাবে ধীরে চলব? আমাকে তো গতি বাড়াতেই হবে!’ কিন্তু এই দ্রুতগতির জীবন আমাদের বার্নআউটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বার্নআউট শুধু ক্লান্তি নয়—এটি মানসিক নিঃশেষতা, উদাসীনতা ও উৎপাদনশীলতার হ্রাস। একজন স্প্রিন্টার দ্রুত দৌড়ায়, কিন্তু অল্প দূরত্বের জন্য। ম্যারাথন দৌড়বিদ দীর্ঘ পথ পাড়ি দেন, কারণ তাঁরা গতি নিয়ন্ত্রণ করেন। জীবনও একটি ম্যারাথন। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ-এর ‘টেকসই কর্মক্ষমতা’ ধারণা বলে, দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের জন্য ধীর কিন্তু টেকসই গতি প্রয়োজন। ধীর নামাজ আমাদের জীবনের এই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে।

আমরা মুসলিম হিসেবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সংযোগের সুযোগ পাই। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমরা প্রায়ই নামাজ দ্রত পড়ি, জীবনের অন্য কাজে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। যিনি আমাদের জীবনের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতে তাড়াহুড়া করে আমরা এমন কাজের দিকে ছুটি, যা আল্লাহ ছাড়া সম্পন্ন হওয়া সম্ভব নয়। নবীজি (সা.

) এই বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। এক ব্যক্তি জলদি করে নামাজ পড়ছিলেন। নবীজি (সা.) তাকে তিনবার বললেন, ‘ফিরে গিয়ে নামাজ পড়ো, কারণ তুমি নামাজ পড়োনি।’ অবশেষে তিনি বললেন, ‘নামাজে দাঁড়ানোর সময় অজু ভালোভাবে করো, কিবলার দিকে মুখ করো, তাকবির বলো, কোরআন থেকে যা পারো তিলাওয়াত করো, তারপর রুকুতে যাও যতক্ষণ না তুমি রুকুতে স্থির হও, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াও, তারপর সিজদায় যাও যতক্ষণ না তুমি সিজদায় স্থির হও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭৫৭)

আরও পড়ুন মসজিদে নববি ভ্রমণ করা যাবে ঘরে বসেই৩০ জানুয়ারি ২০২৩

ধীর নামাজ কীভাবে পড়বেন

১. নামাজের জন্য পর্যাপ্ত সময় রাখুন: নামাজের জন্য ১০-২০ মিনিট নয়, কমপক্ষে ৩০-৪৫ মিনিট সময় রাখুন। আপনার মনে হতে পারে এটি অতিরিক্ত, কিন্তু ভেবে দেখুন—আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কী আছে?

২. শান্তভাবে হেঁটে নামাজে যান: একজন কামার আজান শুনে হাতুড়ি ফেলে নামাজে ছুটতেন। আধুনিক জীবনে এটি প্রয়োগ করুন। আজান শুনলে হাতের কাজ গুছিয়ে নিন, ই–মেইল বন্ধ করুন, মিটিং থেকে বেরিয়ে আসুন। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আজান দেওয়ার সময় দৌড়ে নামাজে আসবে না, শান্তভাবে হেঁটে আসবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩৬)

৩. নির্বিঘ্ন নামাজের পরিবেশ: ঘড়ি ও ফোন দূরে রাখুন। গবেষণা বলে, ফোন দৃষ্টিসীমায় থাকলেও মনোযোগ কমে। যান্ত্রিক ঘড়ির চাপ আমাদের উদ্বেগ বাড়ায়। আল্লাহর সময়ে নিজেকে নিমজ্জিত করুন।

৪. যত্ন নিয়ে অজু করুন: ধীর নামাজ শুরু হয় অজু থেকে। একটি ছোট পানির বোতল দিয়ে অজু করুন। নবীজি (সা.) এক লিটারের কম পানি দিয়ে অজু করতেন। প্রতিটি অঙ্গ ধোয়ার সময় পাপ ধুয়ে যাওয়ার হাদিস স্মরণ করুন।

৫. নামাজের অঙ্গভঙ্গি নিখুঁত করুন: নবী (সা.) বলেছেন, ‘আমাকে যেভাবে নামাজ পড়তে দেখেছ, সেভাবে পড়ো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩১)

রুকুতে প্রতিটি জয়েন্ট স্থির না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন, সিজদায় কপাল, নাক ও হাতের তালু ভালোভাবে স্থাপন করুন, প্রতিবার অবস্থান পরিবর্তনের সময় শরীর সম্পূর্ণ স্থির না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। তিলাওয়াত শান্ত, ছন্দময় গতিতে করুন।

৬. তাড়াহুড়া এড়িয়ে যান: কখন তাড়াহুড়া করার ইচ্ছা হয়, তা চিহ্নিত করুন এবং উপেক্ষা করুন। এটি আপনার নফস ও শয়তানের প্ররোচনা। গভীর শ্বাস নিন এবং মনে করুন, এই মুহূর্তে আল্লাহর সঙ্গে সংযোগের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই।

৭. নামাজের পরও তাড়াহুড়া করবেন না: সালাম দেওয়ার পরই উঠে পড়বেন না। নবীজি (সা.) নামাজের পর জিকির করতেন। এই সময়টি আপনার আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাকে হৃদয়ে প্রোথিত করতে দেয়। জিকির, দোয়া ও কোরআন তিলাওয়াতের জন্য এই সময় ব্যবহার করুন।

শেষ কথা

হ্যাঁ, কখনো কখনো দ্রুত নামাজ পড়ার প্রয়োজন হয়। নবীজি (সা.) শিশুর কান্না শুনে নামাজ সংক্ষেপ করতেন, মায়ের প্রতি দয়া দেখিয়ে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭০৯)

কিন্তু লক্ষ করুন, তিনি সংক্ষেপ করলেও তাড়াহুড়া করেননি। তাড়াহুড়ার নামাজ ব্যতিক্রম হওয়া উচিত, নিয়মিত নয়।

প্রথমে চাইলে এক ওয়াক্ত নামাজ দিয়ে শুরু করতে পারেন—ফজর বা ইশা, যখন সময়ের চাপ কম থাকে। ধীরে ধীরে সব নামাজে এটি প্রয়োগ করুন। প্রশ্নটা এই নয় যে আমাদের ধীর নামাজের সময় আছে কি না, বরং তাড়াহুড়ার নামাজের আধ্যাত্মিক ক্ষতি আমরা সহ্য করতে পারি কি না। আমরা যেন জীবনের শেষে এসে আফসোস না করি, তাড়াহুড়া করে হারিয়ে যাওয়া মূল্যবান মুহূর্তগুলোর জন্য।

সূত্র: প্রোডাক্টিভ মুসলিম ডটকম 

আরও পড়ুনযে মসজিদে নামাজে থাকতে কিবলা পরিবর্তন হয়০১ মে ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সহ হ ব খ র র জ বন আম দ র জ বন র র জন য আল ল হ র সময

এছাড়াও পড়ুন:

বিলীন আরও ২০০ মিটার বাঁধ, হুমকির মুখে তিন গ্রাম

পদ্মা সেতু প্রকল্প রক্ষা বাঁধ ধসের এক দিন পর শরীয়তপুরের জাজিরায় মঙ্গলবার ভাঙন আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। পদ্মার প্রবল স্রোতে সেতুর কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড-সংলগ্ন রক্ষা বাঁধের আরও ২০০ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

স্থানীয়দের ভাষ্য, সোমবার বিকেলে শুরু হওয়া ভাঙনের স্রোত এতটাই তীব্র ছিল যে, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বিলীন হয়ে গেছে অন্তত ৯টি বসতবাড়ি ও ১০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। হুমকির মুখে রয়েছে মাঝিরঘাট বাজারসহ আশপাশের তিনটি গ্রাম। আতঙ্কে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিয়েছে অন্তত ২৫টি পরিবার। কেউ খোলা আকাশের নিচে, কেউ আবার আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন। অনেকেই তাদের শেষ সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন।

ভাঙনের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড মঙ্গলবার সকাল থেকেই জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলার (ডাম্পিং) কাজ শুরু করে। তবে প্রবল স্রোত ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে এই কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

এর আগে গত নভেম্বর ও চলতি বছরের জুনে ২ দফায় প্রায় ৩০০ মিটার বাঁধ ভেঙে যায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবহেলা এবং দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়ায় ভাঙনের এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

পাউবো, জাজিরা উপজেলা পরিষদ এবং স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত নভেম্বরে পদ্মা সেতু রক্ষা বাঁধের প্রায় ১০০ মিটার অংশ নদীতে বিলীন হয়। প্রায় চার মাস পর চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল থেকে ২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয়ে জিও ব্যাগ ও সিসি ব্লক ফেলে কাজ শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। 

এদিকে অবস্থার অবনতি ঠেকাতে সোমবারই পরিদর্শনে আসেন পানি উন্নয়ন বোর্ড ফরিদপুর অঞ্চলের প্রধান অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শাজাহান সিরাজ। তিনি বলেন, ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। জিও ব্যাগ ফেলা ও ব্লক বসানোর কাজ দ্রুত শুরু হবে।
আমরা দেখেছি, ভাঙনের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ। অতি দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

স্থানীয় বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘প্রতি বছরই আমরা নদী ভাঙনের মুখে পড়ি। কিন্তু এবার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। চোখের সামনে মাত্র এক
ঘণ্টায় ১০টি ঘর নদীতে চলে গেল। আতঙ্কে দিন কাটছে আমাদের। সরকারের কোনো প্রতিনিধি নজর রাখে না। বর্ষার শুরুতে কিছু জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছিল, কিন্তু সেগুলো কোনো কাজেই আসেনি। শুধু আশ্বাস আর আশ্বাস—বাস্তব ব্যবস্থা নেই। আমরা চাই দ্রুত স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হোক, না হলে পুরো এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।’

ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হারানো সুজন ফকির বলেন, ‘বাড়িতে দুপুরে খাবার খেতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ চিৎকার শুনি—পদ্মা সব ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে। এসে দেখি
নদীর ভেতরে আমার দোকানটি পড়ে আছে। সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম। সর্বনাশা নদী প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেওয়ার
সময়ও দিল না। এখন পরিবার নিয়ে কীভাবে চলব, বুঝতে পারছি না।’

বাড়ি হারানো খলিল মাদবর বলেন, ‘হঠাৎ করে পানিতে কিছু একটা ভেঙে পড়া শব্দ পাই। গিয়ে দেখি কয়েকটি দোকান ভেঙে নদীতে চলে গেছে।
এরপর ঘরের আসবাবপত্র সরিয়ে ফেলি। আধা ঘণ্টার মধ্যেই পদ্মা আমার বাড়ি কেড়ে নিল। নিঃস্ব হয়ে গেলাম। মাথা গোঁজার ঠাঁই রইলো না। গত বছর বাঁধ ভাঙার পর যদি দ্রুত মেরামত করা হতো, তাহলে হয়তো আজকের এই দুর্দিন দেখতে হতো না।’

স্থানীয় প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে শুকনো খাবার ও নগদ অর্থ বিতরণ শুরু হয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, সাময়িক সহায়তার পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে স্থায়ী বাঁধ পুনর্নির্মাণ ও পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে।

পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকায় ভাঙনের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তারেক হাসান বলেন, প্রায় ১২-১৩ বছর আগে সেতু বিভাগ পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা রক্ষার জন্য এই বাঁধ নির্মাণ করেছিল। বর্তমানে জাজিরার নাওডোবা জিরো পয়েন্ট এলাকায় প্রায় ১০০ মিটার অংশ ভেঙে পড়েছে। আমরা পাউবো এবং বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) যৌথভাবে সমীক্ষা চালিয়েছি। তাতে দেখা গেছে, প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকায় নদীর গভীরতা বেড়েছে এবং তলদেশ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। ফলে পুরো বাঁধ এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

তিনি আরও জানান, সোম ও মঙ্গলবার দুই দিনে উজান ও ভাটি মিলিয়ে আনুমানিক ২০০ মিটার বাঁধ ভেঙে গেছে। ভাঙন ঠেকাতে
জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হচ্ছে। বাঁধ মজবুতকরণের জন্য একটি ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে আগামী বর্ষার আগে পুরোপুরি বাঁধ মেরামত সম্ভব নয়।

গত বছরের নভেম্বরে জাজিরা উপজেলার পূর্ব নাওডোবা এলাকায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের তীর রক্ষা বাঁধে প্রায় ১০০ মিটার ভাঙন দেখা দেয়। পদ্মা সেতুর ১ হাজার ৭০০ মিটার পূর্বদিকে মঙ্গল মাঝির ঘাট এলাকায় সেই ভাঙন শুরু হয়।

পাউবো সূত্র জানায়, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে পদ্মার ভাঙনে শরীয়তপুরের নড়িয়া ও জাজিরা উপজেলার প্রায় ৩০টি গ্রাম নদীতে বিলীন হয়। গৃহহীন হয়ে পড়ে প্রায় ২০ হাজার পরিবার। শুধু ২০১৮ সালেই ৫ হাজার ৫০০ পরিবার ঘরবাড়ি হারায়, হারিয়ে যায় নড়িয়ার পাঁচটি বাজার। হাসপাতাল ভবনও রেহাই পায়নি। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ