সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সরকার পরিচালনায় নানা ধরনের অসহযোগিতার মুখে কাজ করতে না পারায় হতাশাবোধ থেকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করতে চান। তিনি আরেকটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিদায় নিতে চান।  

রাজনীতির পরিসরে কিছুদিন ধরে যে অস্থিরতা চলছিল, তাঁর এই কথিত পদত্যাগের সম্ভাবনায় তা আরও বহুগুণে ঘনীভূত হয়েছে। কিন্তু কোন পটভূমিতে এই পদত্যাগের গুঞ্জন? 

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনের সময় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ঘোষণার দাবি, মিয়ানমারে মানবিক সহায়তার জন্য কথিত করিডর প্রদানের প্রশ্ন, চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় বিদেশি কোম্পানিকে নিয়োগের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর অসন্তোষ নিয়ে যখন অস্বস্তি বাড়ছে, তখন এসব বিষয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামানের কথিত কিছু বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়। বুধবার ২১ মে সেনাপ্রধান ঢাকা সেনানিবাসে তাঁর অধীনস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে যে সভা করেন, সেখানে নির্বাচন, করিডর এবং চট্টগ্রাম বন্দর বিষয়ে তিনি যেসব মন্তব্য করেছেন বলে সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে, স্পষ্টতই তাতে সরকারের মতামতের প্রতিফলন ছিল না। 

সেনাপ্রধান ওই সভায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বিশেষ উদ্দেশ্যে সংঘবদ্ধ হওয়া বা মব সৃষ্টির বিরুদ্ধেও কথা বলেন। অথচ ২০ তারিখ রাতে তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার একটি বৈঠক হয়েছিল এবং তাতে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় বলে সরকারিভাবে জানানো হয়। সেনা সদরে অনুষ্ঠিত সভায় সেনাপ্রধানের বক্তব্য হিসেবে সংবাদমাধ্যমে যা প্রকাশিত হয়েছে, তা যথার্থ ছিল না—এমন কোনো দাবি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে করা হয়নি। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে বলেই সরকারের সূত্রগুলো জানিয়েছে। 

সেনানিবাসে সামরিক কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সেনাপ্রধানের বক্তব্য স্বাভাবিক সময়ে সংবাদপত্রের পাতায় বড় শিরোনাম হওয়ার কথা নয়। সেনাশাসনের সময়ে অবশ্য এটি নিয়মিতই ঘটত। কেননা, তখন সেনাশাসকের পক্ষে যে সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ আছে, সেটা প্রমাণ করা তাঁর জন্য জরুরি ছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার সাময়িক দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, সেই ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতেও সেনাপ্রধানের বক্তব্যের প্রতি সবার বাড়তি আগ্রহ থাকা অস্বাভাবিক নয়। তদুপরি বর্তমানে গুজবের যে সুনামি চলছে, তার পটভূমিতে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামানের বক্তব্যের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। 

২১ মে সেনাপ্রধান ঢাকা সেনানিবাসে তাঁর অধীনস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে যখন সভা করেন, সেই একই দিনে ফেসবুকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অন্তত ২৪টি ভুয়া তথ্য খণ্ডন করেছে। এগুলোর মধ্যে ছিল প্রধান উপদেষ্টাকে ক্ষমতাচ্যুত করা, সেনাপ্রধানকে অপসারণ ও গ্রেপ্তার করার মতো ভুয়া তথ্য। স্পষ্টতই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষকেরা নানাভাবে দেশে যে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে, এগুলো তারই অংশ। তবে দেশের ভেতরেও যে একাধিক গোষ্ঠী একই রকম চেষ্টায় জড়িয়ে পড়েছে, এমন সন্দেহও প্রবল। 

এ রকম স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জন এবং সেনাপ্রধানের বক্তব্যের নানা ধরনের ব্যাখ্যা তৈরি হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়। 

কিছুদিন ধরেই দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নিজেদের মধ্যে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কিছু বিষয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক ও টানাপোড়েন চলছে। স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের প্রধান প্রধান শক্তির মধ্যেই অবিশ্বাস ও রেষারেষি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপির কিছু নেতা দুজন ছাত্র উপদেষ্টা—মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার পদত্যাগ দাবি করেছেন। এর পাল্টা হিসেবে ছাত্রদের তৈরি নতুন দল এনসিপি অন্য তিনজন উপদেষ্টা—সালেহউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও অধ্যাপক আসিফ নজরুলকে বিএনপির প্রতিনিধি অভিহিত করে তাঁদের পদত্যাগ দাবি করেছেন। এ ধরনের বিরোধ যখন অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাভাবিক কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে, তখনই সেনাপ্রধানের এসব বক্তব্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক পক্ষগুলোর বিরোধে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। 

যে বিষয়টি এখন রাজনৈতিক অস্থিরতার সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হলো, সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্ন। নির্বাচনকে সংস্কারের শর্তসাপেক্ষ করার বিষয়টি গণ-অভ্যুত্থানের পর যতটা প্রবল ছিল, গত ৯ মাসে তা অনেকটাই মিইয়ে এসেছে। শাসনব্যবস্থার প্রায় সব জায়গায় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলেও তা সম্পন্ন করা যে সময়সাপেক্ষ, সে কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু ন্যূনতম সংস্কারের অগ্রগতি দৃশ্যমান না হওয়ায় ধৈর্যচ্যুতি ঘটাও তো স্বাভাবিক। একদিকে প্রতিশ্রুত সংস্কারের শ্লথগতি, অন্যদিকে শাসনকাজে দুর্বলতা বা ক্ষেত্রবিশেষে অক্ষমতাও প্রধান উপদেষ্টার হতাশার অন্যতম কারণ বলেই জানা যাচ্ছে। 

রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে সংগঠিত হওয়ার লক্ষ্যে মব সৃষ্টির কৌশলও অনুসৃত হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সরকারের নমনীয়তার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অরাজনৈতিক গোষ্ঠীর স্বার্থ আদায়ের বেপরোয়া চেষ্টা পরিস্থিতিকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। বিক্ষোভ-প্রতিবাদ নিয়ন্ত্রণে সরকারের নীতিতে দৃষ্টিকটু অসংগতিও সন্দেহ-সংশয়ের জন্ম দিয়েছে। ছাত্রদের সংগঠিত নতুন দল এনসিপির কর্মসূচিতে পুলিশের নমনীয়তা যতটা দেখা গেছে, অন্যদের বেলায় তা ঘটেনি। 

দেশের ভেতরে ও বিদেশে অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি সমর্থন ও আস্থার কোনো কমতি নেই। গভীর সংকটের সময়ে আন্দোলনের সব শরিকেরা নিঃসংশয়ে তাঁকে অভিভাবকের আসনে আসীন করেছে। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় দুই সপ্তাহ পর ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘বিপ্লবী ছাত্র-জনতা জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে আমাকে এক গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছে।’ সেই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘গণরোষের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকারপ্রধান দেশত্যাগ করার পর আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত। আমাদের লক্ষ্য একটিই—উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আমরা এক পরিবার। আমাদের এক লক্ষ্য। কোনো ভেদাভেদ যেন আমাদের স্বপ্নকে ব্যাহত করতে না পারে, সে জন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’ 

দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছাত্র-জনতার ঐক্যে ভাঙন ধরতে শুরু করলেও তা গুরুত্ব পায়নি। এখন তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, মনে হচ্ছে তা আর ঠিক হওয়ার নয়। কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়ার অর্থ হবে বিপর্যয়। পতিত স্বৈরাচারের সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষকেরা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে জঙ্গিদের উত্থান হিসেবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করে যে ব্যর্থ হয়েছেন, তাঁদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হবে। দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা যেমন গুরুতর রূপ নিতে পারে, তেমনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাও বিপজ্জনক ঝুঁকির মুখে পড়বে। 

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুত সংস্কারগুলো বাস্তবায়নে সমস্যা কোথায়, এমন প্রশ্নের মুখে কিছুদিন আগে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের মুখে শোনা গেছে, ‘ক্ষমতার ভরকেন্দ্র অনেকগুলো। ফলে কাজের দায় সরকারের, কিন্তু কাজ করে ক্ষমতার অন্যান্য ভরকেন্দ্র।’ পরে তিনি ফেসবুকে বিষয়টি আরও বিশদে তুলে ধরে বলেছেন, ‘জোড়াতালি দিয়ে গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্ভব না, সম্ভব নয় নূতন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। রাজনৈতিক দলগুলো ডিসেম্বরের পর সহযোগী ভূমিকায় নেই। কিন্তু, ঠিকই প্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশে তাঁরা স্টেইক নিয়ে বসে আছেন।’

প্রশাসন ও পুলিশে রাজনৈতিক দলগুলো স্টেক নিয়ে বসে থাকুক বা না থাকুক, রাষ্ট্রের এসব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের অপেক্ষায় আছে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। নির্বাচনে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে বলে তাদের বিশ্বাস, তারা ইতিমধ্যেই সেসব দলের আস্থা অর্জনে নেতা–নেত্রীদের তদবির রক্ষায় ব্যস্ত। সরকারের সংস্কার বাস্তবায়নে তাঁদের অধিকাংশেরই ন্যূনতম আন্তরিকতা নেই, আগ্রহও নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যেও গতি আসছে না। কারণ, বিনিয়োগকারীরা স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা চান। অন্য কথায়, তাঁরাও নির্বাচনের অপেক্ষায় আছেন। সেনাবাহিনীও নির্বাচনের বিষয়ে একই অবস্থান নিয়েছে। 

ক্ষমতার অনেকগুলো ভরকেন্দ্রকে আস্থায় রাখা নিঃসন্দেহে খুব বড় একটা চ্যালেঞ্জ। অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার কারণে তা যথাযথভাবে সামাল দিতে পারেনি। তবে কোনো চ্যালেঞ্জই অজেয় নয়। দীর্ঘ দেড় দশকের স্বৈরশাসনে সব রাজনৈতিক দলই অবদমনের শিকার হয়েছে। সুতরাং শৃঙ্খলমুক্তির পর তারা যে নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে অধৈর্য হয়ে পড়বে, সেটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। সে কারণেই রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় রাখার প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের বিশেষ মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন ছিল। গত ৯ মাসে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক হয়েছে সম্ভবত মাত্র চারটি। তাদের যৌক্তিক প্রত্যাশা ছিল, সব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তারা তাদের মতামত দিতে পারবে। এই যোগাযোগ আরও নিবিড় হলে বর্তমানের দৃশ্যমান অনৈক্য দেখতে হতো না। এটি কাটিয়ে ওঠার সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। কেননা, রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় গত সপ্তাহ পর্যন্ত এসব দল সক্রিয় অংশগ্রহণ চালিয়ে এসেছে এবং তা অব্যাহত রাখার কথা বলেছে। 

স্মরণ করা যেতে পারে যে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর প্রথম ভাষণেই বলেছিলেন, কখন নির্বাচন হবে, সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। অস্বীকার করার উপায় নেই, নির্বাচনের প্রশ্ন নিয়েই এখন সংকট ঘনীভূত হয়েছে। সুতরাং প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ব্যক্তিগত আবেগ ও হতাশার ঊর্ধ্বে উঠে সংকট নিরসনে উদ্যোগী হবেন এবং সব দলকে ডেকে আবারও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবেন বলেই দেশবাসী আশা করে। শান্তির জন্য বৈশ্বিক স্বীকৃতির মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে তাঁর সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। 

কামাল আহমেদ সাংবাদিক

* মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন র জন ত ক সরক র র স ছ ত র জনত পর স থ ত পদত য গ বল ছ ল আম দ র র জন য ক ষমত হওয় র র সময় ইউন স

এছাড়াও পড়ুন:

নোয়াখালীতে জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির আরও অবনতি, দুর্ভোগে বাসিন্দারা

নোয়াখালীতে জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। অতি ভারী বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় জেলা শহর মাইজদীতে প্রধান সড়ক ছাড়া অধিকাংশ সড়কেই ডুবে গেছে। পানি ঢুকে পড়েছে অনেক বাসাবাড়িতে। জলমগ্ন হয়ে রয়েছে শহরের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আজ বুধবার ও আগামীকাল বৃহস্পতিবারের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা ও শ্রেণি কার্যক্রম স্থগিত করেছে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ। জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় দুর্ভোগ বেড়েছে মানুষের।

জেলা আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষক ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আজ সকাল ৬টা পর্যন্ত এর আগের ২৪ ঘণ্টায় মাইজদীতে ২০৮ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাস অনুযায়ী আরও বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।

আজ সকালে সরেজমিনে মাইজদীর লক্ষ্মীনারায়ণপুর, নোয়াখালী সরকারি কলেজ সড়ক, হাকিম কোয়ার্টার সড়ক, সরকারি আবাসিক এলাকা সড়ক, মাইজদী হাউজিং এলাকা, মাইজদী নতুন হাউজিং, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সড়ক, জেলা জজ আদালত সড়ক ও টাউন হল মোড় এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এসব এলাকার বেশির ভাগ সড়ক কমপক্ষে এক থেকে দেড় ফুট পানিতে ডুবে রয়েছে। সড়কের পাশের নালা থেকে ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের এলাকায়।

সকালে শহরের মোহাম্মদ আবদুর রশিদ উচ্চবিদ্যালয়, লক্ষ্মীনারায়ণপুর পৌর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পুলিশ কেজি স্কুল অ্যান্ড কলেজের আঙিনা ও আশপাশের সড়কও জলমগ্ন হয়ে থাকতে দেখা গেছে। আবদুর রশিদ উচ্চবিদ্যালয়–সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা আবদুল জলিল প্রথম আলোকে বলেন, সড়কের পাশে যে ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে, এগুলো কোনোভাবেই বর্ষায় পানি নিষ্কাশনের উপযোগী নয়। অল্প বৃষ্টিতেই ড্রেনগুলো পানির চাপ নিতে পারে না। একটু ভারী বৃষ্টি হলে তো অবস্থা আরও খারাপ।

শহরের টাউন হল মোড় এলাকার ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন জানান, তাঁর দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়া সরকারি আবাসিক এলাকার সড়কটি অল্প বৃষ্টিতে ডুবে যায়। সড়কের পাশে কয়েক বছর আগে একটি ড্রেন নির্মাণ করা হলেও সেটি সড়ক থেকে অন্তত এক ফুট উঁচু। এ কারণে বৃষ্টির পানি সড়কে জমে থাকে। পানি জমে থাকার কারণে দুই দিন ধরে তিনি দোকান বন্ধ রেখেছেন। তিনি বলেন, সড়কটির আশপাশের ৩০ থেকে ৩৫ জন ব্যবসায়ী চলতি বর্ষার শুরু থেকে ঠিকভাবে ব্যবসা করতে পারছেন না। সড়কের পাশে একটি মসজিদ আছে, মসজিদটিতে মুসল্লিরা নামাজ পড়তেও যেতে পারেন না।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নুর উদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর প্রথম আলোকে বলেন, অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা পরিস্থিতিতে নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে যাওয়ায় জেলার সদর, সুবর্ণচর, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সেনবাগ উপজেলায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসাগুলোয় আজ ও আগামীকালের চলমান অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। নিজ নিজ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষার কর্মকর্তাদের তথ্যের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এদিকে জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর, রামপুর ও চর এলাহী ইউনিয়নের ছোট ফেনী নদী ও বামনী নদীর তীরবর্তী এলাকা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে। মুছাপুর এলাকার বাসিন্দা জসিম উদ্দিন আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে ওই এলাকার বেশির ভাগ সড়ক ডুবে গেছে। জলমগ্ন হয়ে পড়েছে অনেক বাড়িঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে লোকজন সীমাহীন ভোগান্তির মধ্যে পড়েছে।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভীর ফরহাদ শামীম আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, বৃষ্টি বন্ধ নেই। দুই দিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। এতে উপজেলার নিচু এলাকাগুলো প্লাবিত হয়েছে। অনেক রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। কিছু কিছু বাড়িঘর পানিতে প্লাবিত হয়েছে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত উপজেলার প্রায় ৮০টি পরিবারে শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে বলে জানান ইউএনও।

জেলা প্রশাসক খন্দকার ইশতিয়াক আহমেদ আজ সকাল ৯টায় প্রথম আলোকে বলেন, জেলার সার্বিক জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি নিয়ে আজ বেলা ১১টায় জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা আহ্বান করা হয়েছে। ওই সভায় সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে এবং পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। জেলা প্রশাসক জানান, জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির কারণে এরই মধ্যে কয়েকটি উপজেলায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা দুই দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আজ নেবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ